রোববার, ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৯ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সেতু প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করতেন মন্ত্রী-সচিব

আপডেট : ২৪ জুন ২০২৫, ০৭:২৫ এএম

সরকারি বিলাসবহুল গাড়ি বরাদ্দ থাকার পরও সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের কাজের জন্য ক্রয়কৃত আটটি জেলার ১২টি বিলাসবহুল গাড়ি জোর করেই ব্যবহার করতেন সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, স্থায়ী কমিটির সভাপতি তৎকালীন সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও সচিব মো. শাহ কামালসহ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এসব গাড়ির বেশিরভাগই পারিবারিক কাজে ব্যবহার করা হলেও প্রকল্প থেকে গাড়ির জ্বালানি খরচ হিসেবে ৩০ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৩ টাকা বিল নিয়েছেন। এর মধ্যে বিল ছাড়াই কয়েক লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। সরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন বরিশাল, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও কক্সবাজার জেলার আওতাধীন প্রকল্পের ১২টি গাড়ি প্রকল্পের কাজে ব্যবস্থা করতে না দিয়ে জোর করেই সেগুলো ব্যবহারের জন্য নিয়েছেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা।

তথ্য বলছে, ওই সময়ে ত্রাণমন্ত্রী ছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সচিব মো. শাহ কামালসহ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই গাড়িগুলো ব্যবহার করেছেন এবং গাড়ির জ্বালানি খরচ হিসেবে ৩০ লাখ ৪১ হাজার ৩৭৩ টাকা প্রকল্প থেকে নিয়েছেন। অভিযোগ গাড়ি মন্ত্রী-সচিব ব্যবহার করতে নিলেও গাড়িগুলো তাদের পরিবারের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ত্রাণমন্ত্রী ৭৫৯১ নম্বর গাড়ি ব্যবহার করতেন। তিনি এজন্য ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ছয়টি বিলের মাধ্যমে জ্বালানির খরচবাবদ ২ লাখ ৩১ হাজার ৫৭০ টাকা নিয়েছেন। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ৭৫৮৭ নম্বর গাড়িটি ব্যবহার করতেন। তিনি একই সময়ে ছয়টি বিলের মাধ্যমে জ্বালানি খরচ হিসেবে ১ লাখ ৩৭ হাজার ১২০ টাকা নিয়েছেন। তৎকালীন সচিব শাহ কামাল ব্যবহার করতেন ৭৫৯৯ নম্বর গাড়ি। তিনি এ গাড়ির জন্য ২০১৮ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয়টি বিলের মাধ্যমে জ্বালানি খরচবাবদ বিল নিয়েছেন ১ লাখ ৭৩ হাজার ৮৫০ টাকা। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিব ৭৫৮৫ ও ৭৫৮৩ নম্বর গাড়ি দুটি ব্যবহার করতেন। তারা একই সময়ে ছয়টি করে বিলের মাধ্যমে জ্বালানি হিসেবে হিসেবে যথাক্রমে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৯০ ও ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা নিয়েছেন। অর্থাৎ এ পাচঁজন কর্মকর্তা এক মাসের কম সময়ে পাঁচটি গাড়ির জ্বালানি খরচের জন্য মোট ৮ লাখ ২১ হাজার ৯৩০ টাকা নিয়েছেন।

তথ্য বলছে, এ পাঁচটি ছাড়া মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা আরও সাতটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। তার মধ্যে ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ২০১৮ সালের ১২ জুন পর্যন্ত ১০ মাসে ঢাকা মেট্রো-ঘ-৪৫৭৬, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৮৪৫৫, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-০৯৩৩, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৭৯৪৬, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৭৩৯৩ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৩৬৫৪ নম্বরসহ ছয়টি গাড়ির জন্য জ্বালানি খরচ হিসেবে ২২ লাখ ১৯ হাজার ৪৪৩ টাকা নেওয়া হয়েছে। আর অন্য একটি গাড়ির জ্বালানি খরচের হিসাব পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মন্ত্রণালয় থেকে গাড়িগুলো প্রকল্পের কাছে ফেরত পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের গাড়িগুলো প্রকল্পের কাজের জন্য নির্ধারিত। যে উদ্দেশ্যে গাড়িগুলো ক্রয় করা হয়েছিল তার বাইরে এসব গাড়ি ব্যবহার করা যাবে না। তারপরও মন্ত্রী, স্থায়ী কমিটির সভাপতি, সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নিয়মনীতি অমান্য করে এসব গাড়ি ব্যবহার করেন। এসব গাড়ির জন্য জ্বালানি তেলের বিল নেওয়া হয় প্রকল্প থেকে। বিষয়টি গোপন রাখা হলেও একসময় ধরা পড়ে যায়।

এদিকে, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে গাড়ি ব্যবহার ও জ্বালানি খরচের নামে বিল নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, সাবেক সচিব শাহ কামালের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান-তদন্ত চলছে।

দুদকের তথ্যমতে, সাবেক ত্রাণমন্ত্রী ও চাঁদপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া এবং তার স্ত্রী পারভীন চৌধুরীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। অনুসন্ধান চলমান থাকায় দুদকের উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার মায়া চৌধুরী ও তার স্ত্রীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন গ্রহণ, দলীয় পদ ও মনোনয়নবাণিজ্য, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে টিআর কাবিখাসহ বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প হতে অর্থ আত্মসাৎপূর্বক বিদেশে অর্থ পাচারসহ নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মায়া চৌধুরী এবং তার স্ত্রী পারভীন চৌধুরী দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেলে গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডপত্র বিনষ্টসহ অনুসন্ধান কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমন রহিত করা আবশ্যক। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ জাকির হোসেন গালিবের আদালত মায়া ও তার স্ত্রী পারভীন চৌধুরীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন।

সাবেক সিনিয়র সচিব শাহ কামালের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান : ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন শাহ কামাল। তিনি ২০২০ সালের ২৯ জুন অবসরে যান। গেল বছরের ১৬ আগস্ট শাহ কামালের মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযানে ৩ কোটি ১ লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার হয়। এরপর ১৭ আগস্ট রাতে তাকে মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ত্রাণের অর্থ আত্মসাৎ, বদলি ও জনবল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। দুদক থেকে শাহ কামাল ও তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দের আবেদন করা হয় আদালতে। দুদক লিখিতভাবে আদালতকে জানায়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামালের ১২টি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৫ কোটি ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার ৭২১ টাকা। অন্যদিকে তার স্ত্রীর সাতটি ব্যাংক হিসাবে জমা হয় ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪১৪ টাকা। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর ১ সেপ্টেম্বর শাহ কামাল ও তার স্ত্রীর ১৯টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেয় আদালত। ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন।

ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার স্ত্রী মাধবী বিরুদ্ধে মামলা : বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও তার স্ত্রী মাধবী দেবনাথের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২৯ জানুয়ারি আলাদা দুটি মামলা করেছে দুদক। এ ছাড়া একই অভিযোগে শম্ভুর ছেলে ও পুত্রবধূ সুনাম দেবনাথ ও কাপসিয়া তালুকদার এবং দুই মেয়ে শুল্কা দেবনাথ, মনীষা মুনমুনের সম্পদের তথ্য দাখিলেরও নোটিস দিয়েছে দুদক।

দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম জানান, আসামি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্বশীল পদে থেকে ৫ কোটি ৪১ লাখ ২০ হাজার ১২৫ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করার অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে। তার নামে ১৬টি ব্যাংক হিসাব থেকে মোট ৪১ কোটি ৯৩ লাখ ২৫ হাজার ৭০২ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া স্বামীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার স্ত্রী মাধবীর বিরুদ্ধে ২ কোটি ২ লাখ ৪১ হাজার ৪০৪ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা করা হয়েছে।

জেলার বিভিন্ন কাজে অনিয়ম দুর্নীতি করে শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী লীগের এই নেতার বিরুদ্ধে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথ ও তার স্ত্রী কাপসিয়া তালুকদারের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে।

সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া পলাতক এবং সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শাহ কামাল কারাগারে থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত