সমাজ জুড়ে হিংস্রতারই উন্মোচন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | ২১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০
পাকিস্তানি হানাদারেরা যেসব জঘন্য অপরাধ করে গেছে সেগুলোর অনেক সাক্ষীর একটি হচ্ছে যুদ্ধশিশুরা। এদের অনেকেরই স্থান হয়েছে এতিমখানায়, কেউ প্রাণ হারিয়েছে পথেঘাটে পরিত্যক্ত অবস্থায়; যাদের কপাল ভালো তারা আশ্রয় পেয়েছে বিদেশে, পালক পিতামাতার গৃহে। পনেরজন এতিম গিয়েছিল কানাডাতে, তাদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন কানাডা অভিবাসী বাঙালি গবেষক ও সমাজকর্মী মোস্তাফা চৌধুরী। বইটির নাম দিয়েছেন, আনকনডিশনাল লাভ। এ স্টোরি অব এডপশন অব নাইনটিন সেভেনটিওয়ান ওয়ার বেবিজ। বইতে ওই পনেরজনের সবার কথাই আছে। এদের ভেতর পাঁচজন একবার বাংলাদেশে এসেছিল, নিজেদের মাতৃভূমির সন্ধানে।
পাঁচজন এতিম শিশুর একজন ছিল বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা ভেবে সে সর্বদাই দুঃখভারাক্রান্ত থাকত। গোপনে কাঁদত। মেয়েটি আবার কবিতাও লিখত। বাংলাদেশে এসে বিশেষভাবে সে নদী দেখেছে, বুড়িগঙ্গাতে নৌকায় বসে সে ভেবেছে এই দেশের কোথাও না কোথাও তার দুঃখী মা’টি লুকিয়ে আছে যে নাকি তাকে তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পরিত্যাগ করেছিল। অর্থাৎ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কানাডায় ফিরে গিয়ে মেয়েটি ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিল। নাম দিয়েছিল, ‘চাইল্ড অব দি রিভার্স’। বাংলাদেশকে সে নদীমাতৃক বলে জানে। সে-কথাটি আছে তার কবিতাতে। আছে তার নিজের মায়ের কথাও। বলেছে সে, মা তুমি আমাকে তোমার বুকে রাখতে পারোনি, ছেড়ে দিয়েছিলে, যখন আমি ছোট্টটি ছিলাম। তোমার কথা ভেবে আমি খুব কেঁদেছি, এবং আমার সে-বেদনা শেষ হবে না যতক্ষণ না আমি তোমাকে খুঁজে পাই, তোমাকে শক্ত করে অঁাঁকড়ে ধরি নিজের বুকের ভেতরে।
মেয়েটির বাংলা নাম রানী; পারিবারিক পদবি মোরাল। রানী মোরালের বিদেশি বাবা-মা অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। মোরালদের নিজেদের একটি সন্তান আছে, তবু তারা আগ্রহের সঙ্গে পালক নিয়েছেন বাংলাদেশের এতিম একটি শিশুকে এবং তাকে আপন সন্তানের মতোই মমতা ও যত্নে লালনপালন করেছেন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও রানীকে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত। সঙ্গ দেওয়ার জন্য রানীর সঙ্গে তারাও বাংলাদেশে এসেছিলেন। আশা করেছিলেন জন্মভূমি খুঁজে পেয়ে রানী তার বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু যা ঘটেছে তা ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশ দেখার পরে ছাব্বিশ বছর বয়স্কা রানীর যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সহ্য করতে পারেনি। অল্পদিন পরে সে নিজের হাতে নিজের জীবনের অবসান ঘটিয়েছে। অনুমান করি বাংলাদেশের অবস্থা দেখে তার শেষ ভরসাটুকু তার জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আঁকড়ে ধরবার মতো আর কোনো অবলম্বনই তার জন্য অবশিষ্ট ছিল না।
মাতৃহারা যে পাঁচজন মাতৃভূমির খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিল তাদের ভেতর রায়ান নামের ছেলেটি ছিল ভিন্ন ধরনের। টগবগ করত সে আশায়। এসেছিল সম্ভব হলে মায়ের দেশে থেকেই যাবে, এই রকমের একটা গোপন ইচ্ছা নিয়ে। এখানে ছিলও সে বছর খানেক। তার আসার খবরটা জানাজানি হয়ে যায়। মিডিয়া তাকে নিয়ে বেশ খানিকটা হৈ চৈ করে। যুদ্ধশিশুর প্রথম বাংলাদেশ আগমন! ব্যাপার সামান্য নয়। রায়ান দেখেছে, শুনেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। লোকের সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু অচিরেই তার ভেতর একটা হতাশা দানা বেঁধে ওঠে। হতাশা নিয়েই ফিরেছে সে কানাডাতে। তবে আত্মহত্যা করেনি।
বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতে কানাডার আপনজনদের সঙ্গে রায়ান নিয়মিত পত্রযোগাযোগ করত, ই-মেইলে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাত। ঢাকার রাস্তায় একদিন শোনে বোমার আওয়াজ, দেখতে পায় আতঙ্কগ্রস্ত একটি মেয়ে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। পরে শুনেছে সে যে নারী হয়রানি ও ধর্ষণ বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত আসে সে-সব খবর।
কানাডার বাবা-মা’কে সে একবার যা লিখেছিল বাংলায় অনুবাদ করলে সেটা এরকম দাঁড়ায়, “বাংলাদেশ মনে হয় একটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়েছে। সুড়ঙ্গটা অন্ধকার। এর শেষ মাথা দেখা যায় না। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ধরনটা পিরামিডের মতো। এর নিচের দিকে রয়েছে তরুণরা। এই তরুণরা অচিরেই বড় হবে; বড় হয়ে দেখবে যে তাদের স্থান সংকুলানের জন্য কোনো সামাজিক উদ্যোগ নেই। কাজ নেই, সুযোগ নেই, বাস্তবিক অর্থে কোনো অবকাশও নেই। বিশ্বায়িত এমন একটি বাংলাদেশে তারা বেড়ে উঠবে যেখানে কেব্ল টিভি ও আমদানি-করা অন্যান্য সামগ্রী খুবই ব্যস্ত থাকবে; শুধু ব্যস্ত নয়, থাকবে অত্যধিক পরিমাণে ব্যস্ত।”
রায়ান এটা লিখেছিল। আমরা ধারণা করি বাংলাদেশে সে আর ফিরে আসেনি। একদিন তার মা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন, অনতিক্রম্য এক বিপদে পড়ে। তা নিয়ে রায়ানের মনে দুঃখ ও গ্লানি থাকবার কথা। কিন্তু এটা খুবই সম্ভব যে বাংলাদেশে আসার পরে সে নিজেই তার মাতৃভূমি থেকে পলায়ন করেছে, প্রাণভয়ে। নইলে হয়তো তার অবস্থাও তার সমবয়স্ক ও ভগ্নিসম রানীর মতোই হতো। রায়ানের জন্য সুযোগ আছে। কানাডা আছে। সে পালাতে পারে। যাদের জন্য কোনো সুযোগ নেই তাদের অনেকেই চেষ্টায় থাকে পালাবার সুযোগ তৈরি করবার। সুযোগ তৈরি না-করতে পারলে ভীষণ হতাশ হয়। বিত্তবান পিতামাতা বৈদেশিক আশ্রয়ের এক রকমের ব্যবস্থা করেই রাখে। সন্তানদের জন্য, নিজেদের জন্যও।
হতাশ যুবক রায়ানের ১৯৯৮ সালের অভিজ্ঞতার পর একে একে আঠারোটি বছর কেটে গেছে। না, অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরঞ্চ অবনতিই ঘটেছে। আমাদের জন্য সমষ্টিগত সুড়ঙ্গ বাসের অবসান ঘটেনি। অন্ধকার এখন আরও গাঢ়, ভবিষ্যৎ এখন অধিকতর অনিশ্চিত। ইতিমধ্যে যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা হলো সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা।
ওদিকে মানুষের অর্থনৈতিক বিপদটা কমছে না, সেটা ক্রমবর্ধমান অবস্থানে রয়েছে। এদেশে উন্নতির যত বৃদ্ধি, তত বৃদ্ধি বৈষম্যের। জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, কর্মের সংস্থান হচ্ছে না। যুবক রায়ান যুবকদের সামনে যে দুর্দিন দেখতে পাচ্ছিল তা ক্রমশ বিকট থেকে বিকটতর হয়ে উঠছে। খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাইয়ের পেছনে অন্য কারণও আছে, একটা কারণ কিন্তু বেকারত্ব। কয়েক বছর আগে আলজেরিয়াতে একজন হতাশ যুবক নিজের দেহে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সে ঘটনা আলজেরিয়াতে তো বটেই সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই এক মহাবিক্ষোভের সূচনা করে। তার নাম দেওয়া হয়েছিল আরব বসন্ত। বাংলাদেশেও দেহে আগুন লাগিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। বেকার যুবক চলন্ত ট্রেনের নিচে নিজেকে নিক্ষেপ করেছে এমন খবরও পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব ঘটনা অনেক অঘটনের একটি হিসেবেই আসে, তেমন একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। বড় জোর পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা হয়। দৈনিক পত্রিকায় খবর আছে, গণমাধ্যমে খবর এসেছে রাজধানীতে ছয় ঘণ্টায় চারজন আত্মহত্যা করছে। এদের মধ্যে দুজন শিক্ষিত যুবক। এসেছিল চাকরির খোঁজে, চাকরি পায়নি, হতাশা বহন করতে অক্ষম হয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে। দেশের ভেতর কত মানুষ যে কোনোমতে টিকে আছে, মোটেই বেঁচে নেই, কে তার খবর রাখে। যুদ্ধসন্তান রায়ান যা আশঙ্কা করেছিল বাস্তবতা ইতিমধ্যেই তাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। নির্ভয়ে।
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে কৃষিজীবীরা। সেই কৃষক ভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছে, এবং বিকল্প কাজ পাচ্ছে না। রামপালে, বাঁশখালীতে তাদের ভূমি চলে যাবে বলে আশঙ্কা। প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃতি ভয়ংকরভাবে বিপন্ন। সুন্দরবনকে তো মনে হয় শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ তার ওপর মুনাফালোভীদের চোখ পড়েছে। প্রাকৃতিক ওই বনটি আত্মহত্যা করবে না, সে শক্তি তার নেই; কিন্তু রানীর হারানো মায়ের মতোই দুঃখ নিয়ে সে একদিন হারিয়ে যাবে। বুড়িগঙ্গা নদীকে দেখে রানী তার নিজের মায়ের কথা ভেবেছে, ভেবে কাতর হয়েছে। কেঁদেছে। রানী আজ বেঁচে নেই, যদি বেঁচে থাকত এবং বুড়িগঙ্গার খোঁজ করত তবে দেখতে পেত নদীটি আর নেই, মরে গেছে। একটা নয়, অনেক নদীই এখন মরা। বড় বড় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, উজানের ভারত পানি ছাড়ছে না বলে। মৃত্যুর আগে রানী দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেছে, নদীর মরণদৃশ্য তার যন্ত্রণা বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিত। সাভারে রানা প্লাজা ধ্বংস হওয়াতে একসঙ্গে এক হাজার একশ’ পঁয়ত্রিশজন শ্রমিক মারা গেছে, এবং তাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারখানার মালিকের কোনো দোষ দেখতে পাননি, ভবনটির পিলার ধরে অলৌকিক হস্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঝাঁকুনি দেওয়াকে শনাক্ত করেছেন। বিশ্বকাঁপানো ওই মাপের মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনার সংবাদ পেলে রানীর যন্ত্রণা কতটা বাড়ত আমরা অনুমান করতে পারব না। রানী যদি ভাবত যে নিহত শ্রমিকদের মধ্যে তার দুঃখিনী মা’ও আছেন তাহলে তাকে সান্ত¡না দিত কে? রানী সংবেদনশীল মানুষ, অন্যদের কষ্ট না দিয়ে নিজেই চলে গেছে, বক্ষভেদী দুঃখ বহন করে।
যুদ্ধশিশুরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনোপচনীয় গ্লানির ও দুঃসহ দুঃখের কারণ। বাংলাদেশ যে তার মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি সে-ব্যর্থতার ক্ষতিপূরণ কোথায়? আর অন্যসব শিশুরা? তাদের কী অবস্থা? কেমন আছে তারা? তাদের জন্য খেলার মাঠ কোথায়? চলাফেরার জায়গা কোনখানে? ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা জন্মের পরেই উৎপাটিত হয় পরিবেশ, প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে। এমনকি মাতৃভাষা থেকেও। গরিব ঘরের শিশুরা শিকার হয় অপুষ্টির, পাচার হয়ে যায় বিদেশে, বাধ্য হয় অমানবিক শ্রমে। শিশুহত্যা বাড়ছে। শিশুর ওপর যৌন হয়রানি ঘটছে। ভাড়াটের শিশুটি কাঁদছে দেখে বিরক্ত হয়ে বাড়িওয়ালার গিন্নি তাকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলছে; এমন ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ বলে ধরে নিলে ভুল হবে। এটি হলো ক্ষমতাবানদের অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতাহীনদের অসহায়ত্ব এবং সমগ্র সমাজ জুড়ে প্রবহমান হিংস্রতারই উন্মোচন।
লেখক
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী | ২১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০

পাকিস্তানি হানাদারেরা যেসব জঘন্য অপরাধ করে গেছে সেগুলোর অনেক সাক্ষীর একটি হচ্ছে যুদ্ধশিশুরা। এদের অনেকেরই স্থান হয়েছে এতিমখানায়, কেউ প্রাণ হারিয়েছে পথেঘাটে পরিত্যক্ত অবস্থায়; যাদের কপাল ভালো তারা আশ্রয় পেয়েছে বিদেশে, পালক পিতামাতার গৃহে। পনেরজন এতিম গিয়েছিল কানাডাতে, তাদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন কানাডা অভিবাসী বাঙালি গবেষক ও সমাজকর্মী মোস্তাফা চৌধুরী। বইটির নাম দিয়েছেন, আনকনডিশনাল লাভ। এ স্টোরি অব এডপশন অব নাইনটিন সেভেনটিওয়ান ওয়ার বেবিজ। বইতে ওই পনেরজনের সবার কথাই আছে। এদের ভেতর পাঁচজন একবার বাংলাদেশে এসেছিল, নিজেদের মাতৃভূমির সন্ধানে।
পাঁচজন এতিম শিশুর একজন ছিল বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। হারিয়ে যাওয়া মায়ের কথা ভেবে সে সর্বদাই দুঃখভারাক্রান্ত থাকত। গোপনে কাঁদত। মেয়েটি আবার কবিতাও লিখত। বাংলাদেশে এসে বিশেষভাবে সে নদী দেখেছে, বুড়িগঙ্গাতে নৌকায় বসে সে ভেবেছে এই দেশের কোথাও না কোথাও তার দুঃখী মা’টি লুকিয়ে আছে যে নাকি তাকে তার জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই পরিত্যাগ করেছিল। অর্থাৎ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। কানাডায় ফিরে গিয়ে মেয়েটি ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিল। নাম দিয়েছিল, ‘চাইল্ড অব দি রিভার্স’। বাংলাদেশকে সে নদীমাতৃক বলে জানে। সে-কথাটি আছে তার কবিতাতে। আছে তার নিজের মায়ের কথাও। বলেছে সে, মা তুমি আমাকে তোমার বুকে রাখতে পারোনি, ছেড়ে দিয়েছিলে, যখন আমি ছোট্টটি ছিলাম। তোমার কথা ভেবে আমি খুব কেঁদেছি, এবং আমার সে-বেদনা শেষ হবে না যতক্ষণ না আমি তোমাকে খুঁজে পাই, তোমাকে শক্ত করে অঁাঁকড়ে ধরি নিজের বুকের ভেতরে।
মেয়েটির বাংলা নাম রানী; পারিবারিক পদবি মোরাল। রানী মোরালের বিদেশি বাবা-মা অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। মোরালদের নিজেদের একটি সন্তান আছে, তবু তারা আগ্রহের সঙ্গে পালক নিয়েছেন বাংলাদেশের এতিম একটি শিশুকে এবং তাকে আপন সন্তানের মতোই মমতা ও যত্নে লালনপালন করেছেন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও রানীকে তারা বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না, শেষ পর্যন্ত। সঙ্গ দেওয়ার জন্য রানীর সঙ্গে তারাও বাংলাদেশে এসেছিলেন। আশা করেছিলেন জন্মভূমি খুঁজে পেয়ে রানী তার বিষণ্ণতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু যা ঘটেছে তা ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশ দেখার পরে ছাব্বিশ বছর বয়স্কা রানীর যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সহ্য করতে পারেনি। অল্পদিন পরে সে নিজের হাতে নিজের জীবনের অবসান ঘটিয়েছে। অনুমান করি বাংলাদেশের অবস্থা দেখে তার শেষ ভরসাটুকু তার জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আঁকড়ে ধরবার মতো আর কোনো অবলম্বনই তার জন্য অবশিষ্ট ছিল না।
মাতৃহারা যে পাঁচজন মাতৃভূমির খোঁজে বাংলাদেশে এসেছিল তাদের ভেতর রায়ান নামের ছেলেটি ছিল ভিন্ন ধরনের। টগবগ করত সে আশায়। এসেছিল সম্ভব হলে মায়ের দেশে থেকেই যাবে, এই রকমের একটা গোপন ইচ্ছা নিয়ে। এখানে ছিলও সে বছর খানেক। তার আসার খবরটা জানাজানি হয়ে যায়। মিডিয়া তাকে নিয়ে বেশ খানিকটা হৈ চৈ করে। যুদ্ধশিশুর প্রথম বাংলাদেশ আগমন! ব্যাপার সামান্য নয়। রায়ান দেখেছে, শুনেছে, ঘুরে বেড়িয়েছে। লোকের সঙ্গে মিশেছে। কিন্তু অচিরেই তার ভেতর একটা হতাশা দানা বেঁধে ওঠে। হতাশা নিয়েই ফিরেছে সে কানাডাতে। তবে আত্মহত্যা করেনি।
বাংলাদেশে থাকা অবস্থাতে কানাডার আপনজনদের সঙ্গে রায়ান নিয়মিত পত্রযোগাযোগ করত, ই-মেইলে। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাত। ঢাকার রাস্তায় একদিন শোনে বোমার আওয়াজ, দেখতে পায় আতঙ্কগ্রস্ত একটি মেয়ে প্রাণভয়ে দৌড়াচ্ছে। পরে শুনেছে সে যে নারী হয়রানি ও ধর্ষণ বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। খবরের কাগজে প্রতিনিয়ত আসে সে-সব খবর।
কানাডার বাবা-মা’কে সে একবার যা লিখেছিল বাংলায় অনুবাদ করলে সেটা এরকম দাঁড়ায়, “বাংলাদেশ মনে হয় একটা সুড়ঙ্গের ভেতর ঢুকে পড়েছে। সুড়ঙ্গটা অন্ধকার। এর শেষ মাথা দেখা যায় না। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ধরনটা পিরামিডের মতো। এর নিচের দিকে রয়েছে তরুণরা। এই তরুণরা অচিরেই বড় হবে; বড় হয়ে দেখবে যে তাদের স্থান সংকুলানের জন্য কোনো সামাজিক উদ্যোগ নেই। কাজ নেই, সুযোগ নেই, বাস্তবিক অর্থে কোনো অবকাশও নেই। বিশ্বায়িত এমন একটি বাংলাদেশে তারা বেড়ে উঠবে যেখানে কেব্ল টিভি ও আমদানি-করা অন্যান্য সামগ্রী খুবই ব্যস্ত থাকবে; শুধু ব্যস্ত নয়, থাকবে অত্যধিক পরিমাণে ব্যস্ত।”
রায়ান এটা লিখেছিল। আমরা ধারণা করি বাংলাদেশে সে আর ফিরে আসেনি। একদিন তার মা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন, অনতিক্রম্য এক বিপদে পড়ে। তা নিয়ে রায়ানের মনে দুঃখ ও গ্লানি থাকবার কথা। কিন্তু এটা খুবই সম্ভব যে বাংলাদেশে আসার পরে সে নিজেই তার মাতৃভূমি থেকে পলায়ন করেছে, প্রাণভয়ে। নইলে হয়তো তার অবস্থাও তার সমবয়স্ক ও ভগ্নিসম রানীর মতোই হতো। রায়ানের জন্য সুযোগ আছে। কানাডা আছে। সে পালাতে পারে। যাদের জন্য কোনো সুযোগ নেই তাদের অনেকেই চেষ্টায় থাকে পালাবার সুযোগ তৈরি করবার। সুযোগ তৈরি না-করতে পারলে ভীষণ হতাশ হয়। বিত্তবান পিতামাতা বৈদেশিক আশ্রয়ের এক রকমের ব্যবস্থা করেই রাখে। সন্তানদের জন্য, নিজেদের জন্যও।
হতাশ যুবক রায়ানের ১৯৯৮ সালের অভিজ্ঞতার পর একে একে আঠারোটি বছর কেটে গেছে। না, অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। বরঞ্চ অবনতিই ঘটেছে। আমাদের জন্য সমষ্টিগত সুড়ঙ্গ বাসের অবসান ঘটেনি। অন্ধকার এখন আরও গাঢ়, ভবিষ্যৎ এখন অধিকতর অনিশ্চিত। ইতিমধ্যে যা বৃদ্ধি পেয়েছে তা হলো সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা।
ওদিকে মানুষের অর্থনৈতিক বিপদটা কমছে না, সেটা ক্রমবর্ধমান অবস্থানে রয়েছে। এদেশে উন্নতির যত বৃদ্ধি, তত বৃদ্ধি বৈষম্যের। জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে, কর্মের সংস্থান হচ্ছে না। যুবক রায়ান যুবকদের সামনে যে দুর্দিন দেখতে পাচ্ছিল তা ক্রমশ বিকট থেকে বিকটতর হয়ে উঠছে। খুন, গুম, অপহরণ, ছিনতাইয়ের পেছনে অন্য কারণও আছে, একটা কারণ কিন্তু বেকারত্ব। কয়েক বছর আগে আলজেরিয়াতে একজন হতাশ যুবক নিজের দেহে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। সে ঘটনা আলজেরিয়াতে তো বটেই সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়েই এক মহাবিক্ষোভের সূচনা করে। তার নাম দেওয়া হয়েছিল আরব বসন্ত। বাংলাদেশেও দেহে আগুন লাগিয়ে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। বেকার যুবক চলন্ত ট্রেনের নিচে নিজেকে নিক্ষেপ করেছে এমন খবরও পাওয়া গেছে। কিন্তু এসব ঘটনা অনেক অঘটনের একটি হিসেবেই আসে, তেমন একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। বড় জোর পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা হয়। দৈনিক পত্রিকায় খবর আছে, গণমাধ্যমে খবর এসেছে রাজধানীতে ছয় ঘণ্টায় চারজন আত্মহত্যা করছে। এদের মধ্যে দুজন শিক্ষিত যুবক। এসেছিল চাকরির খোঁজে, চাকরি পায়নি, হতাশা বহন করতে অক্ষম হয়ে নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে। দেশের ভেতর কত মানুষ যে কোনোমতে টিকে আছে, মোটেই বেঁচে নেই, কে তার খবর রাখে। যুদ্ধসন্তান রায়ান যা আশঙ্কা করেছিল বাস্তবতা ইতিমধ্যেই তাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। নির্ভয়ে।
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে কৃষিজীবীরা। সেই কৃষক ভূমি থেকে উৎখাত হচ্ছে, এবং বিকল্প কাজ পাচ্ছে না। রামপালে, বাঁশখালীতে তাদের ভূমি চলে যাবে বলে আশঙ্কা। প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃতি ভয়ংকরভাবে বিপন্ন। সুন্দরবনকে তো মনে হয় শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হবে না। কারণ তার ওপর মুনাফালোভীদের চোখ পড়েছে। প্রাকৃতিক ওই বনটি আত্মহত্যা করবে না, সে শক্তি তার নেই; কিন্তু রানীর হারানো মায়ের মতোই দুঃখ নিয়ে সে একদিন হারিয়ে যাবে। বুড়িগঙ্গা নদীকে দেখে রানী তার নিজের মায়ের কথা ভেবেছে, ভেবে কাতর হয়েছে। কেঁদেছে। রানী আজ বেঁচে নেই, যদি বেঁচে থাকত এবং বুড়িগঙ্গার খোঁজ করত তবে দেখতে পেত নদীটি আর নেই, মরে গেছে। একটা নয়, অনেক নদীই এখন মরা। বড় বড় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, উজানের ভারত পানি ছাড়ছে না বলে। মৃত্যুর আগে রানী দুঃসহ যন্ত্রণা সহ্য করেছে, নদীর মরণদৃশ্য তার যন্ত্রণা বেশ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিত। সাভারে রানা প্লাজা ধ্বংস হওয়াতে একসঙ্গে এক হাজার একশ’ পঁয়ত্রিশজন শ্রমিক মারা গেছে, এবং তাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারখানার মালিকের কোনো দোষ দেখতে পাননি, ভবনটির পিলার ধরে অলৌকিক হস্তে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ঝাঁকুনি দেওয়াকে শনাক্ত করেছেন। বিশ্বকাঁপানো ওই মাপের মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনার সংবাদ পেলে রানীর যন্ত্রণা কতটা বাড়ত আমরা অনুমান করতে পারব না। রানী যদি ভাবত যে নিহত শ্রমিকদের মধ্যে তার দুঃখিনী মা’ও আছেন তাহলে তাকে সান্ত¡না দিত কে? রানী সংবেদনশীল মানুষ, অন্যদের কষ্ট না দিয়ে নিজেই চলে গেছে, বক্ষভেদী দুঃখ বহন করে।
যুদ্ধশিশুরা বাংলাদেশের মানুষের জন্য অনোপচনীয় গ্লানির ও দুঃসহ দুঃখের কারণ। বাংলাদেশ যে তার মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি সে-ব্যর্থতার ক্ষতিপূরণ কোথায়? আর অন্যসব শিশুরা? তাদের কী অবস্থা? কেমন আছে তারা? তাদের জন্য খেলার মাঠ কোথায়? চলাফেরার জায়গা কোনখানে? ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা জন্মের পরেই উৎপাটিত হয় পরিবেশ, প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে। এমনকি মাতৃভাষা থেকেও। গরিব ঘরের শিশুরা শিকার হয় অপুষ্টির, পাচার হয়ে যায় বিদেশে, বাধ্য হয় অমানবিক শ্রমে। শিশুহত্যা বাড়ছে। শিশুর ওপর যৌন হয়রানি ঘটছে। ভাড়াটের শিশুটি কাঁদছে দেখে বিরক্ত হয়ে বাড়িওয়ালার গিন্নি তাকে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলছে; এমন ঘটনাকে একটি বিচ্ছিন্ন অপরাধ বলে ধরে নিলে ভুল হবে। এটি হলো ক্ষমতাবানদের অসহিষ্ণুতা, ক্ষমতাহীনদের অসহায়ত্ব এবং সমগ্র সমাজ জুড়ে প্রবহমান হিংস্রতারই উন্মোচন।
লেখক
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়