বাঘ, ভাটিশ্বর, মনসা ও পাঁচ পীরের সুন্দরবন
সৌমিত্র দস্তিদার, কলকাতা থেকে | ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০
কখনো কোনোদিন বাঘের জন্য কষ্ট হবে তা ভাবিনি। তা নিয়ে আবার লিখব তা কল্পনাও করিনি। কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে বাঘ আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। সিংহকে যতই ঢাকঢোল বাজিয়ে পশুরাজ বলা হোক না কেন যারা সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে একটু আধটুও জানেন তারা সবাই নিশ্চিত আমার সঙ্গে একমত হয়ে বলবেন যে পশুরাজ বলতে বাঘ ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। কী তার আভিজাত্য, চলন-বলন, মেজাজ-মর্জি, রাজকীয় হিংস্র আচরণ, ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে। সম্ভ্রমে মাথা আপনা থেকেই নিচু হয়ে আসে।
সুন্দরবনের গাঁ-গঞ্জে তাকে নিয়ে গল্পগাথার শেষ নেই। তিন বন্ধু মাছ ধরতে গেছে খাঁড়িতে। রাত হয়ে যাওয়ায় নদীর ধারে নোঙর করল। তিনজনের একজন খুব ভীতু। বারেবারে সে বলছে, ভাই এসব জায়গা বাঘের রাজত্বি। এখানে থাকা ঠিক নয়। ক্লান্ত বন্ধুরা তাকে আশ্বস্ত করল, তুই ভেতরে শো। আমরা বাইরে আছি। কিচ্ছু হবে না। রাত গভীর তখন। আচমকা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বন্ধুদের। অবাক বিস্ময়ে আতঙ্কিত হয়ে তারা দেখল ছৈ-এর ভেতরে ঢুকে বাঘ সবচেয়ে নিরীহ বন্ধুটির ঘাড় মটকে নিয়ে যাচ্ছে। যখন তাদের হুঁশ ফিরল, হৈ হৈ করে চেঁচিয়ে উঠল ততক্ষণে বাঘ জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রায় মাঝনদীতে পৌঁছে গেছে। এই চতুর প্রাণীটিকে সুন্দরবনের মানুষজন নাম দিয়েছ ‘দক্ষিণ রায়’। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ধপধপি গ্রামে বাঘ বাহাদুরের মন্দির আছে। ধুমধাম করে পুজো হয় বাবা ‘দক্ষিণ রায়’-এর। পুরনো আখ্যানে কিন্তু এই দক্ষিণ রায় ছিলেন মস্ত এক বীর। যশোরের রাজা ছিলেন মুকুট রায়। দক্ষিণ রায় ছিলেন তার সেনাপতি। শাসন করার সুবিধে হবে বলে মুকুট রায় নিজের রাজ্যকে দুভাগে ভাগ করে ছিলেন। উত্তর দিকে শাসন করতেন স্বয়ং মুকুট রায়। দক্ষিণে, ভাটির দিকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সেনাধ্যক্ষ দক্ষিণ রায়। শিবভক্ত দক্ষিণ রায়ের আর এক নাম তাই ‘ভাটিশ্বর’। এরকমভাবে শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে গল্প কাহিনীতে দক্ষিণ রায় অমর হয়ে থেকে গেছেন। দুঃখ এটাই যে বাঘ নিয়ে সুন্দরবনের আমজনতার এমন আবেগ, এত বীরত্বগাথা সেই বাঘের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে মানুষের। এ লেখা লিখতাম না যদি কয়েকদিন ধরে সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে বাঘ ঢুকেপড়া নিয়ে হেডলাইন না হতো। কখনো নিমপীঠে বাঘ হানা দিচ্ছে। কখনো গোসাবা, ঝড়খালির লোকালয়ে বাঘ গরু-ছাগল মেরে তা-ব চালাচ্ছে।
বাঘের লোকালয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে যে জঙ্গল তথাকথিত উন্নয়নের দাপটে যতই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ততই বাধ্য হয়ে বাঘ খাবারের খোঁজে গ্রামে ঢুকে পড়ছে। আর একটা ব্যাখ্যাও আছে। সুন্দরবনের নোনা জলে বাঘের লিভার খারাপ হয়ে যায়। সে তখন মিষ্টি জলের খোঁজে গ্রামে ঢোকে। আবার এও শোনা যাচ্ছে যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়লেও বাঘিনী ক্রমে কমছে। ফলে পুরুষ বাঘ সঙ্গিনীর অভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। ব্যাখ্যা যাই হোক বাঘ বনাম মানুষের সংঘাত এখন অরণ্য ও পশুপ্রেমীদের কাছে যথেষ্ট চিন্তার। ১৯২৭ সালে সারা দেশে বাঘের সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজারেরও বেশি। এখন তা কমতে কমতে তিন, সাড়ে তিন হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। বনেদি পরিবারে একসময় বাঘ মারা ছিল ফ্যাশন। রাজরাজড়া বাঘ শিকার না করলে তাদের ইজ্জত থাকত না। বস্তুত তাদের ‘পাপে’ বাঘ ক্রমেই লুপ্ত প্রজাতির প্রাণী হতে চলেছে। একদিন আসবে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নামটাই হয়তো মুছে যাবে।
আমাদের দেশভাগ নিয়ে কত কথা হয়, অথচ দেশভাগের ফলে অরণ্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যেও যে বিপুল প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা হয়েছে বলে শুনিনি। বেঙ্গল টাইগার ও তার চারণভূমি সুন্দরবনের বড় অঞ্চল আজ ওপারে। এপারের সুন্দরবন অংশে দ্বীপের সংখ্যা ১০২টি। তারমধ্যে মানুষের বসবাস আছে ৫৪টিতে। সুন্দরবনের ইতিহাস ও ভূগোল নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই সম্ভবত সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর খুলনার ইতিহাস। সুন্দরবনের খ্যাতি মনসা মঙ্গলের জন্য। লোক বিশ্বাস, চাঁদ সওদাগরের ওপর ক্ষিপ্ত মনসা চাঁদের ছেলে লখিন্দরকে বাসর ঘরে সাপ ঢুকিয়ে মেরে ফেলেছিল। লখিন্দরজায়া বেহুলা সুন্দরবনের এসব জলপথ দিয়েই একদিন স্বামীর প্রাণভিক্ষে করতে স্বর্গে পৌঁছেছিলেন। শেষ অবধি প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন লখিন্দর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাঁদ সওদাগর বাঁ হাতে হলেও বাধ্য হয়েছিলেন মনসা পুজো করতে। সেই বিশ্বাসে আজও সাপে কাটা দেহ সাপের দেবী মনসার আশীর্বাদে যদি ফের বেঁচে ওঠে সেই ভরসায় প্রিয়জনের দেহ জলে ভাসিয়ে দেয় বাড়ির লোক। কথায় আছে না, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। নদীর পাড়ে কারা যেন মৃতদেহ মাটিতে রেখে চলে যাচ্ছে। গরিব মানুষ, সৎকারের পয়সা নেই। তাই জলের ধারে রেখে দিচ্ছে আপনজনের দেহ। জোয়ার এসে তা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। গোমর বা মাতলা নদীতে ভেসে যেতে যেতে দেখতে পাবেন কলাপাতার ভেলায় মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।
সুন্দরবনে সাধারণত লোকে যায় শীতকালে। আমি বলব জঙ্গলের রোমাঞ্চ অনুভব করতে গেলে অবশ্যই আপনাকে যেতে হবে প্রবল গরমে কিংবা দারুণ বর্ষায়। গরমের রাতে নৌকার গলুইয়ে শুয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকুন। অত তারা নিশ্চিত কখনো দেখেননি। রাতের ঘন ঘোর তা-বের পর আকাশ এখন ধীরে ধীরে ফর্সা হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর। আজান ও শাঁখের আওয়াজ এখানে মিলেমিশে নতুন এক সুরের জন্ম দেয়। বর্ষার সুন্দরবন ভয়ংকর সুন্দর। প্রবল বর্ষায় একবার সারা রাত কেটেছিল রায়মঙ্গল নদীতে। সেই ভয়াবহ রাত কোনোদিনই ভোলার নয়। ছোট ছোট জেলে নৌকা ভিড় করছে। কোনো এক নৌকার মাঝিরা গান ধরেছে। ‘আমরা আজ পোলাপান, গাজী আছে নিখাবান, শিরে গঙ্গা দরিয়া, পাঁচ পীর বদর বদর’। কজন আর আমরা মনে রেখেছি পাঁচ পীরের নাম। আমার লঞ্চের সারেং পরীক্ষিত দা হাসতে হাসতে আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, পাঁচ পীর হলেন, গিয়াসউদ্দিন, সামসুদ্দিন, সেকেন্দার, গাজী ও কালু।
এই বাংলাকে চিনতে হলে আপনাকে মানুষের কাছে যেতে হবে। এ বঙ্গের হদিস কোনো অ্যাকাডেমিক টেক্সটে পাবেন না। রাঙ্গাবেলিয়া, মৌসুমি, পাথর প্রতিমা বা রামগঙ্গার কোনো জেলে আপনাকে ঠিক বলে দেবে কোন দিকে হাওয়া দিলে ইলিশ ধরা দেবে জালে। বৃষ্টির পরে ঝকঝকে আকাশে মস্ত চাঁদ যেন মাতিসের ছবি। চাঁদনি রাতে সাহস থাকলে কলস দ্বীপের কাছে নদীর খাঁড়িতে ডিঙ্গি নৌকা নোঙর করুন। কান পেতে জলের শব্দ শুনুন। শব্দ ভুল বললাম। আসলে নদীর শব্দ এখানে নিয়ত জন্ম দিচ্ছে ধ্রুপদী সংগীতের। রাত গভীর হচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কর্কশ গলায় অচেনা পাখি ডাকতে ডাকতে চলে গেল। চুপ, কোনো শব্দ নয়। ঠিক ধরেছেন, ওই তো সতর্ক ভঙ্গিতে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রাজকীয় স্টাইলে তিনি আসছেন। দ্য গ্রেট রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। হলদে ডোরাকাটা এক অপূর্ব ভাস্কর্য। ভয় পাবেন না। দেখতে থাকুন। পৃথিবীর এমন চলমান সুন্দর আর হয়তো কখনোই আপনার দেখা হবে না। তিনি আপনার নৌকা দেখেছেন। পাত্তা দিলেন না। জানেন যে এটা তার রাজত্ব। এখানে মানুষ তার প্রজা মাত্র। তাই ধীরে গুছিয়ে জল খেয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন। এই বাঘকে ভালো না বেসে থাকা যায়!!
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক
শেয়ার করুন
সৌমিত্র দস্তিদার, কলকাতা থেকে | ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০

কখনো কোনোদিন বাঘের জন্য কষ্ট হবে তা ভাবিনি। তা নিয়ে আবার লিখব তা কল্পনাও করিনি। কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে বাঘ আমাকে খুবই ভাবাচ্ছে। সিংহকে যতই ঢাকঢোল বাজিয়ে পশুরাজ বলা হোক না কেন যারা সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সম্পর্কে একটু আধটুও জানেন তারা সবাই নিশ্চিত আমার সঙ্গে একমত হয়ে বলবেন যে পশুরাজ বলতে বাঘ ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না। কী তার আভিজাত্য, চলন-বলন, মেজাজ-মর্জি, রাজকীয় হিংস্র আচরণ, ভাবলেই বুক কেঁপে ওঠে। সম্ভ্রমে মাথা আপনা থেকেই নিচু হয়ে আসে।
সুন্দরবনের গাঁ-গঞ্জে তাকে নিয়ে গল্পগাথার শেষ নেই। তিন বন্ধু মাছ ধরতে গেছে খাঁড়িতে। রাত হয়ে যাওয়ায় নদীর ধারে নোঙর করল। তিনজনের একজন খুব ভীতু। বারেবারে সে বলছে, ভাই এসব জায়গা বাঘের রাজত্বি। এখানে থাকা ঠিক নয়। ক্লান্ত বন্ধুরা তাকে আশ্বস্ত করল, তুই ভেতরে শো। আমরা বাইরে আছি। কিচ্ছু হবে না। রাত গভীর তখন। আচমকা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল বন্ধুদের। অবাক বিস্ময়ে আতঙ্কিত হয়ে তারা দেখল ছৈ-এর ভেতরে ঢুকে বাঘ সবচেয়ে নিরীহ বন্ধুটির ঘাড় মটকে নিয়ে যাচ্ছে। যখন তাদের হুঁশ ফিরল, হৈ হৈ করে চেঁচিয়ে উঠল ততক্ষণে বাঘ জলে ঝাঁপ দিয়ে প্রায় মাঝনদীতে পৌঁছে গেছে। এই চতুর প্রাণীটিকে সুন্দরবনের মানুষজন নাম দিয়েছ ‘দক্ষিণ রায়’। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ধপধপি গ্রামে বাঘ বাহাদুরের মন্দির আছে। ধুমধাম করে পুজো হয় বাবা ‘দক্ষিণ রায়’-এর। পুরনো আখ্যানে কিন্তু এই দক্ষিণ রায় ছিলেন মস্ত এক বীর। যশোরের রাজা ছিলেন মুকুট রায়। দক্ষিণ রায় ছিলেন তার সেনাপতি। শাসন করার সুবিধে হবে বলে মুকুট রায় নিজের রাজ্যকে দুভাগে ভাগ করে ছিলেন। উত্তর দিকে শাসন করতেন স্বয়ং মুকুট রায়। দক্ষিণে, ভাটির দিকে দায়িত্ব পেয়েছিলেন সেনাধ্যক্ষ দক্ষিণ রায়। শিবভক্ত দক্ষিণ রায়ের আর এক নাম তাই ‘ভাটিশ্বর’। এরকমভাবে শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে গল্প কাহিনীতে দক্ষিণ রায় অমর হয়ে থেকে গেছেন। দুঃখ এটাই যে বাঘ নিয়ে সুন্দরবনের আমজনতার এমন আবেগ, এত বীরত্বগাথা সেই বাঘের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে মানুষের। এ লেখা লিখতাম না যদি কয়েকদিন ধরে সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে বাঘ ঢুকেপড়া নিয়ে হেডলাইন না হতো। কখনো নিমপীঠে বাঘ হানা দিচ্ছে। কখনো গোসাবা, ঝড়খালির লোকালয়ে বাঘ গরু-ছাগল মেরে তা-ব চালাচ্ছে।
বাঘের লোকালয়ে যাওয়ার পেছনে অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে যে জঙ্গল তথাকথিত উন্নয়নের দাপটে যতই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ততই বাধ্য হয়ে বাঘ খাবারের খোঁজে গ্রামে ঢুকে পড়ছে। আর একটা ব্যাখ্যাও আছে। সুন্দরবনের নোনা জলে বাঘের লিভার খারাপ হয়ে যায়। সে তখন মিষ্টি জলের খোঁজে গ্রামে ঢোকে। আবার এও শোনা যাচ্ছে যে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বাড়লেও বাঘিনী ক্রমে কমছে। ফলে পুরুষ বাঘ সঙ্গিনীর অভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। ব্যাখ্যা যাই হোক বাঘ বনাম মানুষের সংঘাত এখন অরণ্য ও পশুপ্রেমীদের কাছে যথেষ্ট চিন্তার। ১৯২৭ সালে সারা দেশে বাঘের সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজারেরও বেশি। এখন তা কমতে কমতে তিন, সাড়ে তিন হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। বনেদি পরিবারে একসময় বাঘ মারা ছিল ফ্যাশন। রাজরাজড়া বাঘ শিকার না করলে তাদের ইজ্জত থাকত না। বস্তুত তাদের ‘পাপে’ বাঘ ক্রমেই লুপ্ত প্রজাতির প্রাণী হতে চলেছে। একদিন আসবে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নামটাই হয়তো মুছে যাবে।
আমাদের দেশভাগ নিয়ে কত কথা হয়, অথচ দেশভাগের ফলে অরণ্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যেও যে বিপুল প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা হয়েছে বলে শুনিনি। বেঙ্গল টাইগার ও তার চারণভূমি সুন্দরবনের বড় অঞ্চল আজ ওপারে। এপারের সুন্দরবন অংশে দ্বীপের সংখ্যা ১০২টি। তারমধ্যে মানুষের বসবাস আছে ৫৪টিতে। সুন্দরবনের ইতিহাস ও ভূগোল নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই সম্ভবত সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোর খুলনার ইতিহাস। সুন্দরবনের খ্যাতি মনসা মঙ্গলের জন্য। লোক বিশ্বাস, চাঁদ সওদাগরের ওপর ক্ষিপ্ত মনসা চাঁদের ছেলে লখিন্দরকে বাসর ঘরে সাপ ঢুকিয়ে মেরে ফেলেছিল। লখিন্দরজায়া বেহুলা সুন্দরবনের এসব জলপথ দিয়েই একদিন স্বামীর প্রাণভিক্ষে করতে স্বর্গে পৌঁছেছিলেন। শেষ অবধি প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন লখিন্দর। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাঁদ সওদাগর বাঁ হাতে হলেও বাধ্য হয়েছিলেন মনসা পুজো করতে। সেই বিশ্বাসে আজও সাপে কাটা দেহ সাপের দেবী মনসার আশীর্বাদে যদি ফের বেঁচে ওঠে সেই ভরসায় প্রিয়জনের দেহ জলে ভাসিয়ে দেয় বাড়ির লোক। কথায় আছে না, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। নদীর পাড়ে কারা যেন মৃতদেহ মাটিতে রেখে চলে যাচ্ছে। গরিব মানুষ, সৎকারের পয়সা নেই। তাই জলের ধারে রেখে দিচ্ছে আপনজনের দেহ। জোয়ার এসে তা ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চিরদিনের মতো। গোমর বা মাতলা নদীতে ভেসে যেতে যেতে দেখতে পাবেন কলাপাতার ভেলায় মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে।
সুন্দরবনে সাধারণত লোকে যায় শীতকালে। আমি বলব জঙ্গলের রোমাঞ্চ অনুভব করতে গেলে অবশ্যই আপনাকে যেতে হবে প্রবল গরমে কিংবা দারুণ বর্ষায়। গরমের রাতে নৌকার গলুইয়ে শুয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকুন। অত তারা নিশ্চিত কখনো দেখেননি। রাতের ঘন ঘোর তা-বের পর আকাশ এখন ধীরে ধীরে ফর্সা হচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের সুর। আজান ও শাঁখের আওয়াজ এখানে মিলেমিশে নতুন এক সুরের জন্ম দেয়। বর্ষার সুন্দরবন ভয়ংকর সুন্দর। প্রবল বর্ষায় একবার সারা রাত কেটেছিল রায়মঙ্গল নদীতে। সেই ভয়াবহ রাত কোনোদিনই ভোলার নয়। ছোট ছোট জেলে নৌকা ভিড় করছে। কোনো এক নৌকার মাঝিরা গান ধরেছে। ‘আমরা আজ পোলাপান, গাজী আছে নিখাবান, শিরে গঙ্গা দরিয়া, পাঁচ পীর বদর বদর’। কজন আর আমরা মনে রেখেছি পাঁচ পীরের নাম। আমার লঞ্চের সারেং পরীক্ষিত দা হাসতে হাসতে আমাকে মনে করিয়ে দিলেন, পাঁচ পীর হলেন, গিয়াসউদ্দিন, সামসুদ্দিন, সেকেন্দার, গাজী ও কালু।
এই বাংলাকে চিনতে হলে আপনাকে মানুষের কাছে যেতে হবে। এ বঙ্গের হদিস কোনো অ্যাকাডেমিক টেক্সটে পাবেন না। রাঙ্গাবেলিয়া, মৌসুমি, পাথর প্রতিমা বা রামগঙ্গার কোনো জেলে আপনাকে ঠিক বলে দেবে কোন দিকে হাওয়া দিলে ইলিশ ধরা দেবে জালে। বৃষ্টির পরে ঝকঝকে আকাশে মস্ত চাঁদ যেন মাতিসের ছবি। চাঁদনি রাতে সাহস থাকলে কলস দ্বীপের কাছে নদীর খাঁড়িতে ডিঙ্গি নৌকা নোঙর করুন। কান পেতে জলের শব্দ শুনুন। শব্দ ভুল বললাম। আসলে নদীর শব্দ এখানে নিয়ত জন্ম দিচ্ছে ধ্রুপদী সংগীতের। রাত গভীর হচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কর্কশ গলায় অচেনা পাখি ডাকতে ডাকতে চলে গেল। চুপ, কোনো শব্দ নয়। ঠিক ধরেছেন, ওই তো সতর্ক ভঙ্গিতে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রাজকীয় স্টাইলে তিনি আসছেন। দ্য গ্রেট রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। হলদে ডোরাকাটা এক অপূর্ব ভাস্কর্য। ভয় পাবেন না। দেখতে থাকুন। পৃথিবীর এমন চলমান সুন্দর আর হয়তো কখনোই আপনার দেখা হবে না। তিনি আপনার নৌকা দেখেছেন। পাত্তা দিলেন না। জানেন যে এটা তার রাজত্ব। এখানে মানুষ তার প্রজা মাত্র। তাই ধীরে গুছিয়ে জল খেয়ে তিনি চলে যাচ্ছেন। এই বাঘকে ভালো না বেসে থাকা যায়!!
লেখক : ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক