
সত্তরের নির্বাচনের পর একাত্তরে যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে যে চেতনাটি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল সেটি ওই ভাগ্য-পরিবর্তনেরই। নির্দিষ্ট অর্থে সেটা মুক্তির। মুক্তির জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা তো অবশ্যই দরকার ছিল; কিন্তু কেবল ওই প্রাপ্তিতেই যে কাজ হবে সে বিশ্বাস মানুষের ছিল না। সাতচল্লিশের ব্যর্থ স্বাধীনতা একেবারে ঘাড়ে ধরে প্রমাণ করে দিয়েছিল যে মুক্তির জন্য সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয়। কয়েকজন রাজা হয়ে থাকবে বাদবাকিরা গোলামি করবে, এ ব্যবস্থা মানুষের মুক্তি আনবে না। প্রত্যাশাটা ছিল সবার জন্যই থাকবে সমান অধিকার ও সমান সুযোগ। তেমনটা ঘটেনি। মুক্তি আসেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস মূলত বৈষম্য বৃদ্ধিরই ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে ছিল একটি সমাজবিপ্লবের চেতনা। কিন্তু হায়, সে-বিপ্লব ঘটল না। উন্নতি হয়েছে, রীতিমতো হুলুস্থুল করে; কিন্তু সে-উন্নতি পুঁজিবাদী, যার চালিকাশক্তি মুনাফালিপ্সা, এবং যার অনিবার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে নানা রকমের বৃদ্ধি; যেমন লুণ্ঠনের, ভোগবাদিতার, বিচ্ছিন্নতার, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারের, প্রকৃতির ওপর নির্দয় আচরণের। মনুষ্যত্ববিনাশী এসব তৎপরতা আমরা দেখছি, এবং বাধ্য হচ্ছি মেনে নিতে।
এই সার্বিক দুর্দশার ভেতরে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে কয়েকটি সত্য আরও পরিষ্কার হচ্ছে। একটি হলো টাকার ভূমিকা। টাকা মনে হয় উড়ছে; কিন্তু এই উড়ন্ত পাখিরা মনিবের পোষ-মানা, তারা অন্য পাখিদের ভাগিয়ে নিয়ে আসবে।যারা টাকা খাটিয়েছে নির্বাচিত হলে সে-টাকা তারা বহু গুণে তুলে নেবে। ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী হলফনামায় সম্পদ বৃদ্ধির পুরো ছবিটা কখনোই পাওয়া যায় না, কিন্তু যা পাওয়া যায় তাতেই লোকের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বোঝা গেছে ক্ষমতার কী শক্তি!
আরও বড় ঘটনা হলো বুর্জোয়া রাজনীতির মতাদর্শিক দীনতার উন্মোচন। বুর্জোয়াদের দুটি জোট আগেও ছিল। ছোট দলগুলো বড় দুই জোটে শামিল হবে; তাতে ছোটদের লাভ, বড়দের লাভটাও কম নয়। কিন্তু মতাদর্শিক বিবেচনায় দুই জোটের ভেতর পার্থক্যটা কোথায়? কতটুকু? বস্তুগত একটা পার্থক্য অবশ্যই আছে। সেটি হলো বিগত পনেরো বছর ধরে একটি জোট ক্ষমতায় আছে, ফলে তাদের সুযোগ-সুবিধা ও যোগাযোগ অনেক বেশি, আর অন্য জোটটি রয়েছে ক্ষমতার বাইরে, তাই তাদের অসুবিধা অধিক। কিন্তু এর বাইরে? মতাদর্শের ব্যাপারে? যেমন ধরা যাক জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটা। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল; কিন্তু তাদের জোটে তো হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পার্টিকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। ওই পার্টি কেবল যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী তাই নয়, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মেরও সংস্থাপক।
সংবিধান রচনায় কামাল হোসেনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং আদি সংবিধানে জাতীয়তাবাদ বলতে বাঙালি জাতীয়তাবাদকেই বোঝানো হয়েছে, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আগমন বিএনপির হাত ধরে; অথচ তার অবস্থান এখন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গেই। কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর বাইরে কাউকে নেতা মানেন না, কিন্তু তিনি এখন আর নৌকাতে নেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের কথা তুলেও আর লাভ নেই; মুক্তিযোদ্ধারা দুই জোটেই আছেন। আর এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে সরাসরি লড়াই করেছেন বলে অভিহিত একজন তো আওয়ামী জোটের মনোনয়নই পেয়ে বসেছিলেন। তাহলে? বলা হয় রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। এমন নিরেট ও নিষ্ঠুর কথা তারাই বলতে পারে যাদের কাছে মতলব হাসিলটাই মুখ্য, মতাদর্শ তুচ্ছ।
আর ইসলামপন্থি দল? তারা তো উভয় জোটেই দৃশ্যমান। ওদিকে আদি সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি উল্লেখ ছিল, তাদের কথা তো এখন তেমন আর শোনাই যায় না। সংশোধিত হতে হতে মূলনীতি চারটির দশা শুকনো গাছের মতো, পাতা যা ছিল এরই মধ্যে ঝরে গেছে, গাছটিও ক্রমাগত শুকাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রত্যয় প্রগতিশীলরাও এখন আর ব্যক্ত করেন না, মৃদুকণ্ঠে বলেন অসাম্প্রদায়িকতা চাই।
বাংলা বর্ণমালার ‘ব’ এবং ‘র’-এর ব্যবধান সামান্য একটি বিন্দুর, কিন্তু তবু তারা একেবারেই আলাদা, যেন দুই স্বতন্ত্র জগতে তাদের বসবাস; মতাদর্শের ক্ষেত্রে আমাদের দুই রাজনৈতিক জোটের দৃশ্যমান ব্যবধান ওই বিন্দুর মতোই ছোট, কিন্তু তাই বলে তাদের ভেতরকার দূরত্ব যে বর্ণমালার দুটি অক্ষরের মতো দুই ভিন্ন জগতের তা কিন্তু মোটেই নয়। মতাদর্শের ক্ষেত্রে তারা ঘনিষ্ঠজন, ভাই-ভাই বলা যায়; লড়াইটা চলছে অনার্জিত সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়ে।
আমেরিকায় যেমন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা আছে, নির্বাচনে লড়াই চলে হাতি ও গাধাতে, কিন্তু উভয় দলই অবিচল থাকে পুঁজিবাদী অবস্থানে, আগামীতে আমরাও হয়তো দুই জোটকে ওই রকমের বড় দুই দল হিসেবেই পাব, লড়াই চলবে নৌকায় আর ধানের শীষে। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হবে এই সত্যও যে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল যতই থাকুক না কেন, রাজনীতির ধারা কিন্তু দুটোইÑএকটি দক্ষিণপন্থি অপরটি বামপন্থি।
বুর্জোয়ারা যেখানেই এবং যে পোশাকেই থাকুক, তারা সবাই পুঁজিবাদে ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় বিশ্বাসী। সে-কারণে সবাই তারা নির্ভুলরূপে দক্ষিণপন্থি। দক্ষিণপন্থার সীমাটা খুবই বড়, সেটা পরিষ্কার উদারপন্থা থেকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মৌলবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত।
দক্ষিণপন্থি এই ধারার ঠিক বিপরীতে অবস্থান বামপন্থিদের, যারা পুঁজিবাদবিরোধী এবং ব্যক্তি মালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ। নির্বাচন সামনে রেখে বামপন্থিরাও একটা জোটে মিলিত হবেন নিশ্চয়। কিন্তু তারা মূলধারার কাছে তো নয়ই, অত্যন্ত দুর্বল অবস্থাতেই রয়ে যাবেন। বামপন্থিরা মেহনতিদের পক্ষের দল; পুঁজিবাদী উন্নতির নিষ্পেষণে পড়ে ওই মেহনতিরা হয় নিঃস্ব হয়ে গেছে, নয়তো নিঃস্ব হওয়ার পথে রয়েছে। সমাজে মেহনতিরা আজ যতটা অসহায়, তাদের পক্ষের জোটও ততটাই দুর্বল। অথচ মেহনতিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সংখ্যায় তারা বিপুল, এবং তাদের মেহনতের ওপর ভর করেই উন্নতির সৌধটা লকলক করে ওপরে বাড়ছে। অর্থনীতিতে বুর্জোয়াদের যে আধিপত্য তাদের ক্ষতিকর রাজনীতিও আজ ততটাই প্রধান ও প্রবল হয়ে উঠেছে।
জাতীয় নির্বাচন সবচেয়ে বড় যে সত্যটা দেখিয়ে দেবে তা হলো বর্তমান সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের আবশ্যকতা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় মানুষের অভাব, নিরাপত্তাহীনতা ও বেকারত্ব বাড়ছে, মাদকাসক্তি মানুষকে পঙ্গু করে দিচ্ছে, ধর্ষণ ও নারী-নির্যাতন ঘটছে যত্রতত্র, সড়কে রীতিমতো নরহত্যা চলছে, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, জবাবদিহি এখন লজ্জায় মুখ দেখায় না, বিপর্যস্ত প্রকৃতি ও পরিবেশের নীরব ক্রন্দন কেউ শুনছে না। সর্বোপরি, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থা উৎপাদনের শক্তিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে, যেজন্য দারিদ্র্য দূর হওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বুর্জোয়ারাই তো ক্ষমতায় আসবে, কিন্তু তারা এ অবস্থা সামাল দিতে পারবে এমন ভরসা অন্যদের তো নেই-ই, তাদের নিজেদেরও নেই। ভরসা আসলে সমাজ-পরিবর্তনের রাজনীতিই। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বামপন্থিরা যদি বুর্জোয়াদের রাজনীতির চেহারার উন্মোচন এবং নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে সামনে নিয়ে আসতে পারেন তবে সেটা হবে একটা জরুরি অর্জন। তাদের নিজেদের জন্য তো অবশ্যই, দেশের মানুষের জন্যও বটে।
আমেরিকার নির্বাচনে হাতি ও গাধার লড়াইতে সে-দেশের মানুষের মুক্তি যে আসবে না সেটা যেমন স্পষ্ট, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নৌকা ও ধানের শীষের লড়াই যে মানুষকে মুক্তি দেবে না তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। বার্নি স্যান্ডার্স নামে একজন সাহসী ও ঘোষিতরূপেই সমাজতন্ত্রী ব্যক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়েছিলেন, কিন্তু নিজের দলের অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থনও শেষ পর্যন্ত পাননি। বোঝা গেছে সমাজতন্ত্রীদের স্বতন্ত্র দল চাই। এই বোধটা এখন সব দেশেই শক্তিশালী হচ্ছে। বাস্তবতাই বুদ্ধি জোগাচ্ছে।
তা আমাদের এই সর্বজনীন নির্বাচনী উৎসব তো আসবে, যাবে; কিন্তু বাস্তবতাটা রয়েই যাবে। তার উন্মোচনও নতুন নতুন ভাবে ঘটবে, ঘটতেই থাকবে। তবে আমাদের প্রত্যেককেই ঠিক করতে হবে, দক্ষিণ ও বামের চরম যুদ্ধে আমরা কে কোন পক্ষে। নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। কোনোকালেই ছিল না, এখন যখন মেরুকরণ ব্যাপক ও গভীর হয়েছে তখন তো নিরপেক্ষতার কোনো সুযোগই নেই; নিরপেক্ষতা অর্থ হচ্ছে পক্ষপাতিত্বকে লুকিয়ে রাখা। নিজের সঙ্গে প্রতারণা করাটা কি বাঞ্ছনীয়?
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
চমক দিয়ে শুরু হয়েছে এবারের ছেলেদের বিশ্বকাপ ফুটবল। টুর্নামেন্টের একেবারে শুরুর দিকে অপেক্ষাকৃত খর্বশক্তির দল সৌদি আরব হারিয়ে দিয়েছে বৃহৎ শক্তি এবং এবারের অন্যতম ফেবারিট আর্জেন্টিনা ফুটবল দলকে। এশিয়ার দেশ জাপান হারিয়েছে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ান জার্মানিকে। তারপর থেকে অঘটন ঘটেই চলেছে। প্রথম রাউন্ডের শেষের দিকে তো ব্রাজিলকে হারিয়ে দিয়েছে আফ্রিকার দল ক্যামেরুন। এই প্রথম আফ্রিকার কোনো দল বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে হারাল। উত্তেজনাপূর্ণ প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে গেছে বড় শক্তির দল জার্মানি। এশিয়ার দল জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া চমক দেখিয়ে উঠে গেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। এবারের বিশ্বকাপ সাম্প্রতিক সময়ের দুই মহাতারকা মেসি ও রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ। আমাদের সময়ের এই দুজন ফুটবল লিজেন্ডকে সামনের বিশ্বকাপে আর দেখা যাবে না, এটা বলাই যায়। ফলে এই দুজনও এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম আকর্ষণ। নানা হিসেব-নিকেশ, উত্তেজনা, অঘটন, চমক মিলিয়ে এই বিশ্বকাপ দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
প্রথম থেকেই এবারের বিশ্বকাপের ভেন্যু নির্বাচন নিয়ে ছিল নানা বিতর্ক। ইউরোপের অনেক মানুষ কাতার বিশ্বকাপ বর্জন করার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে খুব উৎসবমুখর একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে এই টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে। কাতার তার দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো কিছুর অনুমতি না দিয়েই উপভোগ্য একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পেরেছে। দুটো দলের মধ্যে যে দল বেশি গোল করে, সেই দলটি জেতেÑ এই সরল হিসাবটি মাথায় রেখে যে কেউ ফুটবলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ফুটবলের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হতে পারে এটি সহজেই বোঝা যায়। মোট কথা ফুটবল উপভোগের জন্য সাধারণ দর্শকদের জটিল সব নিয়মকানুন মাথায় রাখতে হয় না, বোদ্ধা হতে হয় না। আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণে প্রায় রণক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো এই খেলাটি। যুদ্ধের মতো, কিন্তু যুদ্ধ নয় বরং অনেক বেশি শিল্পই মনে হয় এই খেলাটিকে।
বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সমর্থকরা দুই দলে বিভক্ত। লাতিন আমেরিকার দেশ অর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল দলের সমর্থকই মূলত বাংলাদেশে বেশি। এর বাইরে অল্প কিছু জার্মান, ফ্রান্স, ক্রোয়েশিয়াসহ অন্যান্য দলের সমর্থক আছে। বাংলাদেশ কখনোই বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলেও বিশ্বকাপ এলেই দারুণ উত্তেজনা শুরু হয় বাংলাদেশের দর্শকদের মধ্যে। এই উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে এই মৌসুমে যেদিকে তাকাবেন, আর্জেন্টিনা এবং ব্রাজিলের পতাকা চোখে পড়বেই। ছেলেমেয়েদের গায়ে দেখা যাবে প্রিয় দলের জার্সি। দল জিতলে শেষ রাতে মিছিলের শব্দে ঘুম ভেঙে যাবে। এবারের বিশ্বকাপ অন্যবারের চেয়ে বেশি উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। নানা জায়গায় বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানো হচ্ছে। প্রচুল লোকসমাগম হচ্ছে সেসব খোলা জায়গায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, টিএসসিতে দেখানো হচ্ছে খেলা। প্রচুর মানুষ প্রিয় দলের খেলা দেখতে সমবেত হচ্ছে সেখানে। এর আগের বিশ্বকাপগুলোতে বাংলাদেশে এত বড় পরিসরে বৃহৎ স্ক্রিনে এভাবে খেলা দেখানো হয়নি। এর একটা কারণ হতে পারে প্রযুক্তির প্রসার। এখন যেমন বড় স্ক্রিন সহজলভ্য, চার বছর আগে তেমন ছিল না। তখন অবশ্য চায়ের দোকানের ছোট ছোট টিভিতে লোকে সমবেতভাবে খেলা দেখত। পৃথিবীর অনেক দেশে কিন্তু আগে থেকেই এভাবে বড় জমায়েতে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখার প্রচলন ছিল এবং আছে। রেস্তোরাঁ, বার, পাবগুলোতে বিশ্বকাপ খেলা তো দেখানো হয়ই, ইউরোপিয়ান ফুটবল ক্লাবগুলোর খেলাও সেখানে নিয়মিত দেখানো হয়। এ ছাড়া, অনেক দেশেই বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানোর জন্য নির্দিষ্ট খোলা জায়গা আছে। খেয়াল করে দেখবেন ইউরোপের দেশগুলোতে বড় ক্লাবগুলোর খেলা থাকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন শনিবার রাতে। যাতে বেশিরভাগ মানুষ খেলাটা উপভোগ করতে পারে। সেখানকার লোক খেলা দেখে উচ্ছন্নে গেছে এমন দাবি কোথাও শুনিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বড় স্ক্রিনে ফুটবল খেলা দেখানো নিয়ে চোখে পড়ল কয়েকটি সমালোচনাপূর্ণ লেখা। আদতে এখানে সমালোচনার কী আছে সেটা বুঝতে অনেক সময় লাগল। প্রচুর মাথা ঘামিয়ে দুটো প্রধান আপত্তি বুঝতে পেরেছি সাকুল্যে। একদল বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় হলো লেখাপড়ার জায়গা, এখানে এভাবে খেলা দেখানোর কী আছে? আরেক দল বলছেন, দেশ রসাতলে যাচ্ছে, দ্রব্যমূল্য হু হু করে বাড়ছে আর এর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বকাপে মজে আছে, কী নিদারুণ অবক্ষয় মানবজাতির! প্রথম পক্ষের কাছে আমি জানতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা বলে সারা দিন মাথা নিচু করে বইয়ে মুখ গুঁজে রাখতে হবে এমন দিব্যি কে দিয়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ক্যারম, হকি ইত্যাদি খেলার দল আছে বলেই জানি, এসব ছাত্ররাই খেলে, আমরা কি এখন এগুলোও বন্ধ করে দেব? এসব বন্ধ করে দিলে পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠবে তো? যে বছরগুলোতে বিশ্বকাপ হয় না, সেই বছরগুলোতে কি আমরা ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে একেবারে ওপরের দিকে থাকি?
দ্বিতীয় পক্ষের কাছে জানতে চাই, দেশ কি বিশ্বকাপ শুরুর পর থেকে রসাতলে যাচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম কি বিশ্বকাপের পর থেকে বাড়তে শুরু করেছে? এই যে প্রতিবাদহীন জাতি তৈরি হয়েছে বিশ্বকাপের জন্য, এমন দাবি আপনারা করছেন, এই জাতি বিশ্বকাপের আগে প্রতিবাদ করে কী কী অর্জন করেছিল? খেলাধুলার সংস্কৃতি খারাপ কিছু নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানো নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। এতগুলো মানুষ একসঙ্গে বসে আনন্দমুখর পরিবেশে খেলা দেখছে এটা কোনো অর্থে খারাপ বলা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ খেলা দেখে মূলত দুই দলের। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। খেলার সময় দুই ঘণ্টাও যদি ধরি, ফাইনাল পর্যন্ত যদি দুটো দলই যায়, তাহলেও প্রায় একেকটি দল সর্বোচ্চ সাতটি খেলা পাবে। তাতে নষ্ট (!) হবে সাকুল্যে চৌদ্দ ঘণ্টা। চার বছরে একজন ছাত্র ফুটবল বিশ্বকাপের পেছনে এই চৌদ্দ ঘণ্টা ব্যয় না করলে সে বিদ্যাসাগর হয়ে যাবে এমন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। খেলাধুলা বরং মাদকাসক্তি ও অন্যান্য খারাপ কাজ থেকে একজন মানুষকে দূরে রাখতে পারে। বিনোদন তো মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে পড়ে। চরম বৈরী পরিবেশেও কি মানুষ ভালোবাসে না? যে দেশে যুদ্ধ হয়, সেখানে কি চিত্তের আনন্দ হয় এমন কাজ ছেড়ে দেয় সব মানুষ? সেখানে ফুল ফোটে না? পাখি গায় না? মানব-মানবী প্রেমময় চোখে একে অপরের দিকে তাকায় না? তো, মানুষ যদি বিনোদনের জন্য একসঙ্গে সমবেত হয়, খেলা দেখে তাতে আপত্তি কেন? বাংলাদেশের জমায়েতের এই দর্শকদের ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। খোদ ফিফা তার টুইটার হ্যান্ডেলে সেই ছবি দিয়েছে। আর্জেন্টিনার অফিশিয়াল ফুটবল পেজ থেকে বাংলাদেশকে নিয়ে প্রশংসাসূচক কথাবার্তা লেখা হয়েছে। বিশ্বকাপে এমন উৎসবমুখর পরিবেশ হবে এটাই তো স্বাভাবিক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা না করার সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। আমরা ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলের দর্শক নই, আমাদের দেশ বিশ্বকাপে খেলে না, আমাদের দেশে নিয়মিত ফুটবল খেলা হয় না আগের মতো। আমরা শুধু বিশ্বকাপের দর্শক। ফলে বিশ্বকাপকে ঘিরে আমাদের উত্তেজনা চরমে উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বড় জমায়েতে মেয়েদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম, এটা চোখে লেগেছে। উন্নত বিশ্বে এই জমায়েতগুলোতে একই সারিতে নারী-পুরুষ খেলা উপভোগ করে। আমাদের নারীরা যে এসব জমায়েতে কম থাকেন বা যান না তার অন্যতম কারণ নিরাপত্তাহীনতা। আমরা নারীদের জন্য তেমন পরিবেশ এখনো তৈরি করতে পারিনি।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
কালের আবর্তে ছাড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহনকারী অনেক লোকজ শিল্প। অনিবার্য আধুনিকতার ছোঁয়া, মানুষের সুখ ও সুবিধাবিলাসী মানসিকতা এবং সংরক্ষণ বিমুখতার কারণে তলিয়ে যাচ্ছে একদা উজ্জ্বল একদল খেটে খাওয়া মানুষের নিষ্ঠা, শ্রম ও ঘামের আঙিনায় জাদুস্পর্শী নিপুণ হাতের শিল্পিত কারুকাজ। হারিয়ে যাওয়া এমনি এক লোকজ শিল্পের নাম রংপুরের পোড়ামাটির ‘কুয়ার পাট’ বা ‘চুয়ার পাট’।
ঐতিহাসিক যুগে প্রাগজ্যোতিষপুর, কামরূপ, কামতাপুর বা কুচবিহার রাজ্যের শাসনাধীন থাকলেও ভৌগোলিকভাবে রংপুর ছিল পুন্ড্রবর্ধন তথা বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত। ১৯১৪ সালে ‘রংপুর জাদুঘর’-এর দ্বারোদ্ঘাটন উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতায় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন, ‘রংপুর বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত। বরেন্দ্রভূমি এককালে ভাস্কর কার্যের জন্য সমস্ত ভারতবর্ষে বিখ্যাত হইয়াছিল’ (‘সুরেন্দ্রচন্দ্র রায় চৌধুরী’, সুশান্ত চন্দ্র খাঁ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ:২৪)। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই বক্তব্য নিঃসন্দেহে রংপুরের শিল্প ঐতিহ্যের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত নির্দেশ করে।
মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারিক প্রয়োজনের তাগিদে উৎপাদিত বস্তুর মধ্য দিয়ে যে শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে তাকেই আমরা বলতে পারি লোকজ শিল্প। বাংলাদেশে এই লোকজ শিল্প সৃষ্টির অন্যতম প্রধান উপাদান হলো মাটি। আর এই মাটি দিয়ে তৈরি মূর্তি, পুতুল ও বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্রই বাংলায় এ যাবৎ আবিষ্কৃত শিল্প ঐতিহ্যের প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে আদৃত। বাংলার মাটির বিশেষ গুণাবলির কারণে এদেশে গড়ে উঠেছে পোড়ামাটি বা টেরাকোটার শিল্প। মাটিকে রোদে শুকিয়ে অল্প তাপে পোড়ানোর পর যে শিল্পবস্তু প্রস্তুত হয় তাই আমাদের মৃৎশিল্প। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত প্রাচীন ও মধ্যযুগে ব্যবহৃত পোড়ামাটির মৃৎপাত্র এবং বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য সেই সময় থেকে এই অঞ্চলে পোড়ামাটির শিল্পচর্চার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই সময় ব্যবহৃত এসব তৈজসপত্র, খেলনা পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি ও ভাস্কর্যই ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ।
এরপর ক্রমাগত পৃথিবীর পরিবেশ প্রতিবেশের পরিবর্তন, আধুনিক সভ্যতার নতুন ও অভিনব সুযোগ-সুবিধার উদারতা, মানুষের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এবং যথাযথ পোষকতার অভাবে অনেক লোকজ শিল্পই আজ প্রায় অবলুপ্তির পথে। রংপুরের পাত কুয়ার পাট বা চুয়ার পাট তাদের অন্যতম। বিগত শতাব্দীর সত্তর দশক পর্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলে এর ব্যবহার ছিল প্রায় একচেটিয়া।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর আশির দশক থেকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক বিভিন্ন গ্রাম পর্যায়ে বাস্তবায়িত স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং জেলা পরিষদ, থানা/উপজেলা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও সেসব কর্মসূচির আওতায় সব ইউনিয়নের ওয়ার্ড পর্যায়ে টিউবওয়েল বিতরণ ও স্থাপনের ফলে মাটির পাতকুয়া বা পাটকুয়ার প্রয়োজন ও ব্যবহার ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসে। পরে এ ধরনের পাটকুয়ার ব্যবহার কিছুটা পরিলক্ষিত হয় উত্তরাঞ্চলের উঁচু এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে উৎপাদিত তামাক, আলু, বিভিন্ন প্রকারের রবিশস্য ও শাক-সবজি উৎপাদন ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে। অবশ্য ইদানীং বৈদ্যুতিক সেচ ব্যবস্থা প্রায় সর্বত্র বিস্তৃতি লাভ করায় পাতকুয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে; ফলে দায় হয়ে পড়েছে এই শিল্পের বেঁচে থাকাটাই।
উত্তরাঞ্চলের গ্রামবাংলায় শুধু নয়, বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই সেই প্রাচীনকাল থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত মানুষের পানীয় জল এবং গৃহস্থালির ব্যবহার্য জলের প্রধান উৎস ছিল নদী, পুকুর বা প্রাকৃতিক জলাধার। (এখনো দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ও সুন্দরবন এলাকাবাসী মানুষের কাছে এ ধারা অনেকটাই অব্যাহত আছে)। পাশাপাশি জ্ঞানবিজ্ঞানের বিচিত্র আবিষ্কারে মানুষের সুখ-সুবিধার প্রসার ও প্রচারে স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্রমোন্নতিতে সাধারণ মানুষও এক সময় প্রাকৃতিক জলাধারের চেয়ে ব্যক্তিগত জলাধারের উৎস সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে একসময় ব্যক্তিগতভাবে খনন করা কূপের প্রচলন শুরু হয়।
প্রথমে মাটি খুঁড়ে বাঁশ ও খড়ের বেড় তৈরি করে তা নিচে স্থাপন করে কুয়া বা চুয়া তৈরি করা হতো। কিন্তু তা হতো খুবই ক্ষণস্থায়ী। এক বর্ষা গেলেই এসব কুয়া টিকত না। এরপরেই চালু হয় পোড়ামাটির পাট তৈরি করে কুয়া বানানো। মাটির কাজের কারিগর কুমাররা তাদের কারখানায় এইসব গোলাকার পাট তৈরি করে প্রথমে রোদে শুকিয়ে পরে সহনীয় তাপে পুড়িয়ে নেন। এই পোড়ামাটির পাট ভাড়ে করে গ্রামের লোকজন তাদের প্রয়োজনে নিয়ে এসে গ্রামের কিছু অভিজ্ঞ কারিগর দ্বারা কুয়া তৈরি করেন। কারিগররা একটি পাটের ওপর আর একটি পাট স্থাপন করে তা সামান্য পানি ঢেলে ঘষে ঘষে জোড়া লাগান। এইভাবে সুবিধামতো কয়েকটি পাট একত্রে জোড়া লাগিয়ে কয়েকজন মিলে রশি দিয়ে আগে খননকৃত মাটির কুয়া বা কূপের তলদেশে নামিয়ে স্থাপন করেন। তারপর লম্বা বাঁশ দিয়ে দুই/তিনজন লোক কূপে নেমে স্থাপিত পাটের ওপর দাঁড়িয়ে চাপ দিতে থাকলে জলাবদ্ধ কূপের মধ্যে পাটগুলো ধীরে ধীরে নিচের দিকে কিছুটা ডুবে যেতে থাকে। এইভাবে আরও কিছু পাটের রিং-এর ওপর স্থাপন করে সমতলে উঠে আসেন তারা। এভাবেই পাটের কূয়া বা চুয়া তৈরি করতে দেখেছি শৈশবে ও কৈশোরে।
অন্যদিকে একসময় চুন, বালি ও পাথর দিয়ে এবং পরে পাথর ও বালির সঙ্গে সিমেন্ট ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে পাকা বাড়িঘর নির্মাণের পাশাপাশি বিত্তবান মানুষ কুয়ার বদলে ইঁদারা বা ইন্দিরা নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। একটি পাট কুয়া ৫ বা ১০ বছর স্থায়ী হলে একটি ইঁদারা অবস্থা ভেদে দীর্ঘদিন টিকে থাকে বা কার্যকর থাকে। এছাড়া মাটির পাট কুয়ায়, এর গভীরতা ও আয়তনের কারণে এতে সিঞ্চিত জলের যে পরিমাণ তা একটি ছোট পরিবারের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু অধিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে তা উপযোগী নয়। সেইক্ষেত্রে একটি বড় ইঁদারা অনেক মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম।
এই পোড়ামাটির পাট তৈরির জন্য রংপুর জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, মিঠাপুকুর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং বদরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের লালমাটি (স্থানীয় ভাষায় বলে ‘খিয়ার’ মাটি) অত্যন্ত উপযোগী বলে মনে করা হতো। এক্ষেত্রে মিঠাপুকুর উপজেলার খোরাগাছ ও ময়েনপুর ইউনিয়নে উৎপাদিত চুয়ার পাট ছিল খুবই বিখ্যাত। বিশেষত ময়েনপুরের চুয়ার পাটের চাহিদা ও সুনাম একসময় ছিল কিংবদন্তিতুল্য। এই দুই ইউনিয়নের কুমারপাড়ার শিল্পীদের সেই পোড়ামাটির শিল্পের ঐতিহ্য আজ অবলুপ্ত প্রায়। পেটের চাহিদা মেটাতে তারা এখন বিকল্প কাজ, বিকল্প পেশায় নিয়োজিত।
প্রাচীনকালে ঠিক কখন থেকে এই পাতকুয়ার প্রচলন শুরু হয় তার সঠিক খবর পাওয়া দুষ্কর। সম্রাট অশোকের সময় প্রজাদের পানীয় জলের কষ্ট নিবারণের জন্য পাতকুয়ার খনন ও তার ব্যবহার হয়েছিল বলে ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়। তবে সেই সময়ের কুয়া কীসের তৈরি বা কেমন ছিল তা আর এখন জানা সম্ভব নয়। হয়তো সেই সময় পোড়ামাটির পাট বা পাথর বালির তৈরি পাটে নির্মিত কুয়ার ব্যবহার শুরুই হয়নি। আর হলেও তার ব্যবহার শুধুমাত্র রাজকীয় সামর্থের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ।
পরে মুঘল আমলে বা সুলতান শেরশাহর আমলে মুসাফির, তীর্থযাত্রী বা পথিকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বসতি এলাকায় এবং ঘনবসতিপূর্ণ পাড়ায় অধিক সংখ্যক মানুষের ব্যবহারের জন্য পোড়ামাটির বেষ্টনী দেওয়া কূপ বা কুয়া নির্মাণের ইতিহাস জানা যায়। সেই সময় থেকে গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত এই পাতকুয়া বা পাটের চুয়ার অবিরাম চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এর উৎপাদন ও ব্যবহার এই পোড়ামাটির শিল্পকে রংপুরের এক সমৃদ্ধিশালী ঐতিহ্যে পরিণত করেছে। এইসব হারিয়ে যাওয়া লোকজশিল্প প্রবীণদের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি, আর নবীনদের কাছে গবেষণার উপাদান।
লেখক: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও গবেষক
১৯৯২ সালে ৩ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস’ ঘোষণা করে জাতিসংঘ। প্রায় দুই দশক পর বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী জনগণের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে পাস হয় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’। আইনটি পাসের ফলে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী অধিকার সনদে বর্ণিত প্রায় সব অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় দেশে। কিন্তু, আইনে অনেক কিছু থাকলেও বাস্তবায়নের সাফল্য খুবই কম। অন্যদিকে পরিবার ও সামাজিক পরিসরেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনেক ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকেন। দেখা গেছে সামান্য মানবিক আচরণ ও সুবিধা পেলে তারা স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী হয়ে সমাজে অবদান রাখতে পারেন। উল্লেখ্য, আইনে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে। অটিজম, শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, বাক, বুদ্ধি, শ্রবণ, দৃষ্টি, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম ও বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা। অনেকে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আংশিক বা পুরোপুরি পঙ্গুত্বের ভার বহন করছেন। শারীরিক পঙ্গুত্ব বা বিকলঙ্গতা দিয়ে চিহ্নিত করার মতো আচরণের কারণে অনেক সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। পাশাপাশি অনেকে মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার। আমাদের সমাজে মানসিক রোগীকে ‘পাগল’ আখ্যায়িত করে অপাঙ্ক্তেয় করে রাখার চল রয়েছে, যা ভুল ও অমানবিক। দেখা যায়, এসব কারণে যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকার পরও সমাজ-রাষ্ট্রের অবহেলা ও অমানবিক আচরণ এ ধরনের ব্যক্তিদের জীবনকে আরও কঠিন এবং নিরাময়হীনতার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। অথচ এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে, যা প্রমাণ করে শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও তারা সমাজে অংশ নিতে পারেন এবং সফলতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।
রবিবার দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘প্রতিবন্ধীদের তৈরি পণ্য যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ফ্রান্সসহ ১২ দেশে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কয়েকজনের কথা উঠে এসেছে। ময়না আক্তার ২০০৮ সালে ট্রেন দুর্ঘটনায় বাম পা হারান, শেফালি আক্তারের দুই বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার অভাবে দুই পা অবশ হয়ে যায়, একই রোগে আক্রান্ত হয়ে শৈশবে দুই পা অচল হয়ে যায় নোপালি চাম্বুগংয়ের। কিন্তু প্রতিবন্ধী পরিচয় তাদের দমাতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতা জয় করে তারা সামনে এগিয়ে চলছেন। তাদের এই সফলতার পেছনে রয়েছে ‘ময়মনসিংহ প্রতিবন্ধী আত্মউন্নয়ন সংস্থা।’ ময়না, শেফালি ও নোপালির মতো আরও অনেকেই কাজ করছেন সংস্থার কার্পেট কারখানায়। সেখানে তাদের হাতে তৈরি দৃষ্টিনন্দন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। নোপালি চাম্বুগং বলেন, ‘প্রতিবন্ধিতা ও অভাব-অনটনের কারণে শৈশবে স্কুলে যাওয়া হয়নি।’ সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯১ জন। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২৩ লাখ ৬১ হাজার ৬০৪ জনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে। বিবিএসের তথ্যে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রতিবন্ধীরা আশঙ্কাজনক হারে পিছিয়ে আছে। জাতীয় পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ শিশুই স্কুলে গেলেও প্রতিবন্ধী শিশুদের মাত্র ৪০.৫৫ শতাংশ স্কুলে যেতে পারছে। কিন্তু শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার পরও প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার মুখে পড়তে হয়। দেশের সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল আইনে। যদিও সেই ব্যবস্থা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাধারণ স্কুলগুলোতে ভর্তিই নেওয়া হয় না। সরকারিভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তা খুবই সীমিত। দেশে সব ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সমাজকল্যাণ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি।
ফ্রান্স সরকারের আমন্ত্রণে বিশ্ব প্রতিবন্ধী ফোরামে অংশ নেওয়া ময়মনসিংহ প্রতিবন্ধী আত্মউন্নয়ন সংস্থার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, যিনি নিজেই শারীরিক প্রতিবন্ধিতার শিকার, শেফালি আক্তার বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা সরকারিভাবে ভাতা পেলেও কর্মসংস্থানের সুযোগ তেমন নেই।’ প্রসঙ্গত, বাজেট প্রস্তাবনায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে শুধু প্রতিবন্ধীদের ভাতা ১০০ টাকা বৃদ্ধি করে ৮৫০ টাকা করা হলেও, বলা বাহুল্য যে, টাকার পরিমাণ খুবই নগণ্য। অন্যদিকে, দুর্ঘটনা বা হঠাৎ অসুস্থতার কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়া ব্যক্তিদের জন্যও নেই কোনো পদক্ষেপ। সুচিকিৎসা, মানসিক পরিষেবা দিয়ে এই মানুষগুলোকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করা হলে, তারা যে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাক লাগিয়ে দিতে পারেন সে প্রমাণ তো দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতেই রয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না, এবারের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনমুখী পদক্ষেপ : প্রবেশগম্য ও সমতাভিত্তিক বিশ্ব বিনির্মাণে উদ্ভাবনের ভূমিকা’। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের প্রস্তুত করতে হবে। যারা কাজ করতে একেবারে অক্ষম তাদের সরকারের ভাতার আওতায় আনতে হবে।
চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট। বাবার নাম গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি নিজ চেষ্টায় ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা-সাহিত্য এবং সংগীতে দক্ষতা অর্জন করেন। তার হাতেই ভারতীয় শিল্পকলা নতুন প্রাণ পায়। ‘নির্বাসিত যক্ষ’,‘ভারতমাতা’ ও ‘সাজাহানের মৃত্যু’ তার অমর শিল্পকীর্তি। ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্ট তারই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। লন্ডন, প্যারিস ও জাপানে তার চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। ১৮৯৮ সালে তিনি কলকাতার আর্ট কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘বাগেশ্রী অধ্যাপক’ নিযুক্ত হন এবং ১৯৪২ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্যচর্চায়ও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষত শিল্পকলা সম্পর্কে তার সমালোচনা ছিল অতি উন্নতমানের। তার উল্লেখযোগ্য রচনা শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী ও ভারতশিল্প, বাগেশ্বরী শিল্প, জোড়াসাঁকোর ধারে, আপনকথা, আলোর ফুলকি, ভারতশিল্পে মূর্তি, বাদশাহী গল্প ইত্যাদি। ১৯৫১ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সরকারি হিসাবে চলতি বছরে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা হবে প্রায় দ্বিগুণ। পরের দুই বছরে কিছু পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও অতিরিক্ত সক্ষমতা হবে প্রায় দেড়গুণ। অথচ আদর্শ মান অনুযায়ী অতিরিক্ত সক্ষমতা সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ হওয়া উচিত। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ আমদানি ও নতুন কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি সংকট ও সঞ্চালন-বিতরণ লাইনের সীমাবদ্ধতার কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। ফলে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।
তাদের মতে, সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যত মনোযোগ দিয়েছে তার তুলনায় বিতরণ ও সঞ্চালন লাইন বাড়ানো হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানির সংস্থানও টেকসই করা হয়নি। অথচ কেন্দ্র ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি সরকারের বিনিয়োগ অলস পড়ে থাকার মাত্রা বাড়ছে। এ অবস্থা চললে ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোকসান কমানো কঠিন হয়ে পড়বে। এতে বিদ্যুৎ খাতের অস্থিরতা বাড়বে।
পিডিবির সূত্রমতে, দেশে গ্রিড বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ২৩ হাজার ৪৮২ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ বিভাগ এটিকেই উৎপাদন ক্ষমতা বলে প্রচার করছে। প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। সাধারণত গড়ে ১১-১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। বর্তমানে ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির করা হচ্ছে। ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে আরও দেড় হাজার মেগাওয়াট আমদানি করা হবে আগামী মার্চে।
বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৪০ সালের মধ্যে ভারত, নেপাল ও ভুটান থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ২০৩০ সাল নাগাদ নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াট আমদানির লক্ষ্যে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
পিডিবির পরিচালক মোহাম্মদ শামীম হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রতি বছর বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। সে হিসাবে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা ও চাহিদার মধ্যে ফারাক বেশি মনে হলেও সক্ষমতা থাকার পরও জ্বালানি স্বল্পতার কারণে চাহিদার পুরো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় না। অনেক কেন্দ্র কারিগরি ত্রুটি ও মেইনটেনেন্সের কারণে বন্ধ রাখতে হয়। এসব বিবেচনায় নিলে সক্ষমতা বেশি নয়।’
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাই যথেষ্ট। এর বেশি সক্ষমতা মানে বিপুল আর্থিক বোঝা। কাগজে-কলমে যে সক্ষমতা এখন আছে সেটা অনেক বেশি। আরও বেশি হলে কীভাবে এফোর্ড করব। এর ফলে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাড়বে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেমন বিদ্যুৎ নিতে না পারলেও ৫ হাজার কোটি টাকা “ক্যাপাসিটি পেমেন্ট” দিতে হয়েছে। ভারতের আদানিকেও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘২০২৭ সাল নাগাদ প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। এসবের জ্বালানির পুরোটাই আমদানিনির্ভর। প্রশ্ন হলো, এ আমদানি ব্যয় কি বহন করা সম্ভব? যদি না পারি তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও এসব কেন্দ্রের জন্য ভাড়া গুনতে হবে। এ টাকা কে দেবে? গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই কি তা সম্ভব? কার্যত নানাভাবে ভোক্তার পকেট থেকে এ টাকা যাবে।’
পিডিবির তথ্যমতে, সরকারি-বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে ১৭টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, যার মোট উৎপাদন ক্ষমতা ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট। ১০ হাজার ৮৬৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৫ সালের মধ্যে উৎপাদনে আসবে। ১৭টি কেন্দ্রের ১৩টি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাবে। এসবের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬৫০ মেগাওয়াট। আরও ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্রের আওতায় রয়েছে। পরিকল্পনাধীন কেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু করার কথা রয়েছে ২০২৫ সালের মধ্যে। এ ছাড়া ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে চলতি বছর ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। অন্যদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু হবে ২০২৫ সাল নাগাদ। সব মিলে দুই বছর পর দেশের মোট উৎপাদন সক্ষমতা অন্তত ৩৯ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটে দাঁড়াবে। অথচ তখন বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৯ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট।
আগামী দুই-তিন বছরে ৭-৮ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার কিছু পুরনো ও তেলবিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা হলেও ২০২৫ সালে উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে প্রায় ৩৩ হাজার মেগাওয়াটে। বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ক্ষতি ও কেন্দ্রের নিজের ব্যবহার্য বিদ্যুৎ বিবেচনায় নিলেও চাহিদার তুলনায় তখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি হবে। যদিও চাহিদা এর চেয়ে কম হবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। কারণ এর আগের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমেছে।
প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমলেও উৎপাদন কিন্তু বেড়েই চলেছে। যেমন চলতি বছর পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৩০৮ মেগাওয়াট ধরা হলেও পিডিবির হিসাবে তা দাঁড়াবে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট। প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চাহিদা কমে যাওয়া ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ার ফলে প্রায় অর্ধেক কেন্দ্র অলস বসে থাকবে।
ড. তামিম বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছরে শিল্পকারখানার সম্প্রসারণ আশানুরূপ হয়নি। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শিল্পে গ্রিডভিত্তিক বিদ্যুতের চাহিদা তেমন বাড়েনি। এ কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম। সরকার বিদ্যুতের যে সক্ষমতার কথা বলছে তা আসলে কতটুকু সত্য আমরা জানি না। প্রকৃত চিত্র আমাদের দেখানো হয় না।’ তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে বিদ্যুৎ নিয়ে যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল সে অনুযায়ী চাহিদা বাড়েনি। অথবা চাহিদা বেড়েছে কিন্তু সে অনুযায়ী সরবরাহ করতে না পারায় চাহিদা কম দেখানো হচ্ছে। ক্লিয়ার পিকচার আমরা পাচ্ছি না। পরিকল্পনা আরও সতর্কভাবে করা দরকার।’
নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার দরকার নেই এমন মন্তব্য করে ড. তামিম বলেন, ‘আমার জানামতে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেগুলো ঠিকমতো গ্যাস পেলেও উৎপাদন করতে পারবে না। এগুলো বন্ধ করে তেলবিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা কমানো দরকার। এতে বিদ্যুতের চাহিদাও মিটবে, উৎপাদন ব্যয়ও কম হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সত্যিকারের চাহিদার প্রক্ষেপণ করা। জাইকা পুরনো “জিডিপি গ্রোথ” ধরে একটা প্রক্ষেপণ করছে। আমি এটার বিরোধী। বাস্তবের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আমরা যে “ইকোনমিক গ্রোথ”-এর কথা বলছি সেটা কিন্তু পলিটিক্যাল গ্রোথ। বাস্তব নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে ৮-৯ শতাংশ সাসটেইনেবল গ্রোথ হয়েছে এমন নজির নেই। গত ছয়-সাত বছরে আমাদের যে সর্বোচ্চ ইকোনমিক গ্রোথ হয়েছে তা কি এনার্জি ইনটেনসিভ ইকোনমিক গ্রোথ? নাকি অন্য ফ্যাক্টর আছে এখানে? বিবেচনায় নিতে হবে। ২০১৭ সাল থেকে আমরা যে শিল্পপ্রবৃদ্ধি হিসাব করছি তা কিন্তু হয়নি। গত কয়েক বছরে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে আবাসিক খাতে। শিল্পে বেড়েছে খুবই কম।’
বিদ্যুতের চাহিদার প্রক্ষেপণ কঠিন নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক তামিম বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে কী পরিমাণ শিল্পকারখানা হবে, কত বিদ্যুৎ লাগবে তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকেই জানা সম্ভব। অন্যান্য খাতের তথ্যও জানা সম্ভব। ছড়িয়ে থাকা তথ্যগুলো একত্রিত করলেই আসল হিসাবটা পাওয়া সম্ভব। একটু সময় দিলে নিখুঁত চিত্র পাওয়া যাবে।’
বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়া বা কমার প্রভাব পড়ে দেশের বিদ্যুৎ খাতে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে না এলে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সমস্যা থেকেই যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অপরিকল্পনা, অদক্ষতা আর কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। সরকারের দাবি অনুযায়ী চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তাহলে আমদানি কেন? বিদ্যুৎ আমদানি ও অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা দরকার। নইলে বিদ্যুতের দাম বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চমূল্যে জ্বালানি আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে দাম বাড়তেই থাকবে। অথচ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে অনেক কম দামে টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সরকারের কমদামি বিদ্যুতের চেয়ে বেশি দামের বিদ্যুতে আগ্রহ বেশি। কারণ গোষ্ঠী স্বার্থ।’
ইউক্রেনের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা গণমাধ্যম বলছে খুব শিগগিরই বড় আকারে হামলা চালাতে যাচ্ছে রাশিয়া। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জানিয়েছে, চলতি মাসেই আরও সৈন্য ও সরঞ্জাম নিয়ে নতুন অভিযান শুরু হতে পারে। এদিকে আরও দ্রুত অস্ত্র সরবরাহের অনুরোধ নিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দপ্তর ব্রাসেলস যেতে পারেন।
ইউক্রেনের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করতে রাশিয়া পূর্বের অধিকৃত এলাকায় আরও সৈন্য ও সরঞ্জাম জমা করছে বলে নানা সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রুশ সেনাবাহিনী আরও বড় আকারের হামলা চালাতে পারে, এমন আশঙ্কা বাড়ছে। লুহানস্ক অঞ্চলের ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকার গভর্নর সেরহি হাইদাই বলেন, রাশিয়া থেকে রিজার্ভ বাহিনীর আরও সদস্য এবং সরঞ্জাম আসছে। নতুন ধরনের গোলাবারুদও আসতে দেখা যাচ্ছে। দিনরাত গোলাবারুদ নিক্ষেপ বন্ধ করে রুশ বাহিনী কোনো বড় অভিযানের জন্য সেগুলো প্রস্তুত রাখছে বলে হাইদাই মনে করেন। তার মতে, ১৫ ফেব্রুয়ারির পর যেকোনো সময়ে রাশিয়া আরও জোরালো হামলা শুরু করতে পারে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনীও বসন্তকালে রাশিয়া অধিকৃত আরও এলাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে, এমন ধারণা জোরালো হচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব থেকে ব্যাটেল ট্যাংকসহ আরও অস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ ঠিক সময়ে হাতে না পেলে এমন অভিযান কতটা কার্যকর হবে, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। ২০২২ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ইউক্রেন এলাকা পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যে সাফল্য পেয়েছিল, তা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে থমকে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জেলেনস্কি চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ সম্মেলনে সশরীরে যোগ দিতে পারেন বলে জল্পনা-কল্পনা চলছে। ইইউ জানিয়েছে, জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি সত্যি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ব্রাসেলস গেলে সেটা হবে যুদ্ধ শুরুর পর দেশের বাইরে তার দ্বিতীয় সফর। গত বছর ওয়াশিংটনে গিয়ে জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনা করেন এবং দেশটির কংগ্রেসে ভাষণ দিয়ে আরও অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। ইউরোপের কাছ থেকেও তেমন সাড়া পেতে তিনি ঝুঁকি নিয়ে ব্রাসেলস যেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চামেলী হলে শিক্ষামন্ত্রী ও সব বোর্ডের চেয়ারম্যানরা নিজ নিজ বোর্ডের ফলাফল প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন।
ফলাফল হস্তান্তরের সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে নিজ নিজ শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে ফলাফল আপলোড করা হবে। এ সময় থেকে যে কেউ রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে ওয়েবসাইট ও মোবাইলে এসএমএস করে ফল দেখতে পারবেন।
আজ দুপুর সাড়ে ১২টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত ফল প্রকাশ করবে। পরীক্ষাকেন্দ্রগুলোয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে একযোগে ফল প্রকাশ করা হবে বেলা একটায়।
করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় গত ৬ নভেম্বর সারা দেশে অনেকটা স্বাভাবিক পরিবেশে শুরু হয়েছিল এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীন মোট পরীক্ষার্থী ছিলেন ১২ লাখ ৩ হাজার ৪০৭ জন।
ঢাকা ডমিনেটরসের ক্রিকেটাররা ৭৫ ভাগ পারিশ্রমিক বুঝে পেয়েছেন, বাকিটা টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি।
আজ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন দলটির অধিনায়ক নাসির হোসেন। এবারের বিপিএলে নিজেদের শেষ ম্যাচটি খেলেছে ঢাকা। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ১৫ রানের হার দিয়ে শেষ হয়েছে নাসিরের দলের এবারের বিপিএল মিশন।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে নাসির জানালেন, পারিশ্রমিক নিয়ে সংকট দূর হয়েছে। ‘আমার মনে হয়ে অনেক খেলোয়াড় ৭৫% পারিশ্রমিক পেয়েছে। আমিও পেয়েছি। ২৫% বাকি। চুক্তি অনুযায়ী টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যে বাকিটা পেয়ে যাওয়ার কথা। প্রথম পেমেন্টটা পেতে একটু দেরি হয়েছে। কিন্তু তারা সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।’
আসরের মাঝপথে ঢাকার খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক সংক্রান্ত জটিলতার কথা জানা গেলেও নাসির আশ^স্ত করেছেন নিয়ম মেনেই এখন তিন-চতুর্থাংশ পারিশ্রমিক পরিশোধ করেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি কর্র্তৃপক্ষ। তবে দল গঠন ও পরিচালনার ব্যপারে ফ্র্যাঞ্চাইজিকে ‘অনভিজ্ঞ’ বলে দাবি করেছেন নাসির।
তার সুপারিশ করা বেশ কয়েকজন বিদেশি ক্রিকেটারকে আনতে না পারার কথাও বলেছেন, ‘আমার কাছে মনে হয় বিদেশি খেলোয়াড়রা একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমরা ভালো বিদেশি খেলোয়াড় আনতে পারিনি। তাছাড়া আমাদের টপ অর্ডার ভালো করেনি। ওরা ভালো করলে অন্যরকম হতো। আর মোমেন্টাম না পাওয়ায় আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। টিমটা শেষ মুহূর্তে হওয়ায় এরকম হতে পারে। আমার বিশ্বাস পরের বছরে এই দল থাকলে ভালো একটা দল হবে। বিদেশি লিগ চলায় খেলোয়াড় পাওয়া যায়নি। যাদের পেয়েছে তাদেরই তারা নিয়ে এসেছে। আরও কিছু বিদেশি খেলোয়াড় পেলে আমরা ভালো করতাম।’
গ্যারি ব্যালান্সের জন্মটা জিম্বাবুয়েতে। তবে স্কুলজীবনে স্বদেশ ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে। তবে মাতৃভূমির বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপে খেলেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তার অভিষেক ইংলিশদের জার্সি গায়ে। যদিও সেখানেও অনেকদিন ধরে ব্রাত্য। তাই ক্রিকেটের টানে ঘরে ফিরেছেন তিনি। যা রাঙিয়েছেন অসাধারণ এক শতক হাঁকিয়ে।
বুলাওয়ের কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব সাক্ষী হলো বিরল এই কীর্তির। ঘরে ফেরা গ্যারি ব্যালান্সকে কেপলার ওয়েসেলসের কীর্তি ছুঁতে দেখল কুইন্স স্পোর্টস ক্লাব। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক ওয়েসেলসের পর দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে যে টেস্ট ক্রিকেটে দুটি দেশের হয়ে সেঞ্চুরি পেলেন ব্যালান্স।
বর্ণবাদী নীতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ থাকার সময় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলেছেন ওয়েসলস। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৪ টেস্টে চারটি সেঞ্চুরি করা ওয়েসেলস পরে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১৬ টেস্টে করেন দুটি সেঞ্চুরি। ইংল্যান্ডের হয়ে চারটি টেস্ট সেঞ্চুরির মালিক ব্যালান্স জিম্বাবুয়ের হয়ে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই পেয়ে গেলেন সেঞ্চুরি।
স্কুলে পড়ার সময় জিম্বাবুয়ে ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমিয়েছিলেন গ্যারি ব্যালান্স। তবে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক টিকে ছিল আরও অনেক দিন। ২০০৬ সালে তো ১৬ বছর বয়সী ব্যালান্স জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবুয়ে। যে ম্যাচে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রান করেছিলেন দলের পক্ষে।
২০১৩ সালে ওয়ানডে দিয়ে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অভিষেক ব্যালান্সের। পরের বছর ইংল্যান্ডের দুর্দশার অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্ট অভিষেক। সিডনির সেই টেস্টে ১৮ ও ৭ রান করা ব্যালান্স ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই পেয়ে যান প্রথম সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ টেস্টের ১৭ ইনিংসেই চার সেঞ্চুরিতে ১ হাজার রান করে ফেলা ব্যালান্স খারাপ সময়টা দেখে ফেলেন তাড়াতাড়ি। পরের ১৩ টেস্টে মাত্র দুটি ফিফটি পাওয়া বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ২০১৭ সালের পর আর সুযোগ পাননি ইংল্যান্ড দলে।
ইংল্যান্ড দলে ফেরার স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া সেই ব্যালান্স জন্মভূমি জিম্বাবুয়ের হয়ে খেলার সিদ্ধান্ত নিলেন গত বছর। এ বছরই জিম্বাবুয়ের হয়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলার পর চলমান বুলাওয়ে টেস্টেই লাল বলের ক্রিকেটে জন্মভূমির হয়ে প্রথম খেলছেন ব্যালান্স। আর প্রথমবার ব্যাট করতে নেমেই সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে জানিয়ে দিলেন তাঁকে ফিরিয়ে ভুল করেনি জিম্বাবুয়ে।
ব্যালান্স যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন জিম্বাবুয়ের রান ৩ উইকেটে ১১৪। ঘণ্টাখানেক পরই আরও ৩ উইকেট হারিয়ে ১৪৭ রান জিম্বাবুয়ের। ফলোঅনের শঙ্কায় পড়া দলের লেজে ব্যাটসম্যানদের নিয়ে এরপর কী লড়াইটাই না করলেন ব্যালান্স। সেই লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়ে ইনিংস ঘোষণার মতো বিলাসিতা করে নিলেন জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক ক্রেগ আরভিন।
৯ উইকেটে ৩৭৯ রান তুলে জিম্বাবুয়ে যখন ইনিংস ছাড়ে ব্যালান্স অপরাজিত ১৩৭ রানে। ব্রেন্ডন মাভুতাকে নিয়ে অষ্টম উইকেটে ১৩৫ রান যোগ করা ব্যালান্স খেলেছেন ২৩১ বল, মেরেছেন ১২টি চার ও ২টি ছক্কা। ৯ চারে ৫৬ রান করেছেন নয়ে নামা মাভুতা। জিম্বাবুয়ের অবশ্য লিড নিতে পারেনি। ৬৮ রানে পিছিয়ে ছিল ইনিংস শেষে। চতুর্থ দিন শেষে সেই ব্যবধানটাকে ৮৯ রানে নিয়ে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে বিনা উইকেটে ২১ রান তুলেছে ক্যারিবীয়রা।
শ্রম পরিদর্শক পদে যোগ দেওয়ার ৩৪ বছর পর পদোন্নতি পেলেন মাহমুদুল হক। স্বপ্ন দেখতেন পদোন্নতির সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে যাবেন। সেই স্বপ্ন আট বছরেই লুটিয়ে পড়ল জ্যেষ্ঠতার তালিকায়।
১৯৮৮ সালে যোগ দেওয়ায় ’৯৫ সালেই পদোন্নতি পাওয়ার কথা ছিল মাহমুদুল হকের। কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অদূরদর্শিতা সে স্বপ্ন শুরুতেই বাধা পেল। এন্ট্রি পোস্টে যোগ দেওয়ার পর তার মতো অন্য কর্মচারীরা যখন পদোন্নতির স্বপ্নে বিভোর, তখন তাতে গা-ই করলেন না সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানপ্রধান।
মাহমুদুল অপেক্ষায় রইলেন পরিবর্তিত পরিস্থিতির জন্য। সেই পরিবর্তন আসতে আসতে চাকরিতে কেটে গেল আঠারো বছর। আঠারোতে মানুষ প্রাপ্তবয়স্ক হয়। তিনিও ভাবলেন আঠারোতে তিনি না হয় ‘জব ম্যাচিউরিটি’তে পৌঁছালেন। চাকরির আঠারো বছরে পদোন্নতি পেলেও মন্দ হয় না।
কিন্তু অবাক ব্যাপার, কর্তৃপক্ষ পদোন্নতি দিল, তবে মাহমুদুলকে ছাড়া। পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনে কোথাও তার নাম নেই। হতাশায় মুষড়ে পড়লেন তিনি। জুনিয়র কর্মকর্তারদের নাম আছে, অথচ তার নাম নেই। প্রতিষ্ঠানের নীতি-নির্ধারকদের দরজায় দরজায় ঘুরলেন ন্যায়বিচারের আশায়। কিন্তু তারা পাত্তাই দিলেন না বিষয়টি।
তারা আমলে না নিলেও মাহমুদুলের স্বপ্ন তো সেখানেই থেমে যাওয়ার নয়। সেই স্বপ্ন পুঁজি করে তিনি গেলেন আদালতে। সেই ভিন্ন জগৎটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দিল। মাহমুদুল আনন্দে আত্মহারা হলেন। কিন্তু সেই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। সরকার আপিল করল প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালে। মামলার ফল উল্টে গেল। হতাশায় ভেঙে না পড়ে তিনি গেলেন উচ্চ আদালতে। আপিল বিভাগে সিভিল আপিল মামলা করলে প্রশাসনিক আপিল আদালতের রায় বাতিল হয়। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল থাকে।
জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করার মতো মাহমুদুল হকও যেন সরকারের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন করল সরকারপক্ষ। একপর্যায়ে সরকার বুঝতে পারল কোনোভাবেই তারা এ মামলায় জিততে পারবে না। সরকারপক্ষে রিভিউ পিটিশন প্রত্যাহার করা হলো। আদালত সরকারের পদোন্নতির প্রজ্ঞাপনকে আইনের কর্তৃত্ববহির্ভূত বলে ঘোষণা করল। জুনিয়র কর্মকর্তাকে যেদিন থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে এবং যতবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, একইভাবে মাহমুদুল হককে পদোন্নতি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব পাওনা কড়ায়-গ-ায় পরিশোধের নির্দেশনা আসে।
আদালতের এই নির্দেশনা দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর আদেশ বাস্তবায়ন করতে সরকারের লেগে যায় প্রায় চার বছর। ২০২২ সালের ১১ মে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ৩৪ বছর পর পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন মাহমুদুল হক। আবারও তাকে ঠকিয়েছে সরকার। জুনিয়র কর্মকর্তা যুগ্ম মহাপরিদর্শক হলেও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয় তার দুই ধাপ নিচের সহকারী মহাপরিদর্শক পদে। উপমহাপরিদর্শক ও যুগ্ম মহাপরিদর্শক আরও ওপরের পদ। আদালতের নির্দেশনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কখনোই প্রজ্ঞাপন মাহমুদুল হকের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনেনি। পুরো চাকরিজীবন আদালতের বারান্দায় ঘুরে তিনি পৌঁছেছেন অবসরের প্রান্তসীমায়। আর তিন মাস পরে তিনি অবসরে যাবেন। যৌবন ও মধ্য বয়সের দিনগুলোতে আদালতে ঘুরে বেড়ানোর শক্তি ও সাহস থাকলেও মাহমুদুল হক এখন সেই সাহস দেখাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করছেন। পারবেন তো শেষ সময়ে এসে সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে?
মাহমুদুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, তিনি আদালতের কাছেই জানতে চাইবেন, আদালতের বিচার না মানার শাস্তি কী।
পুরো ঘটনা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা শুনিয়ে জানতে চাইলেন, কতজনের পক্ষে মাহমুদুল হকের মতো লড়াকু মনোভাব দেখানো সম্ভব?
সীমাহীন আনন্দ নিয়ে মানুষ সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়। এরপরই তার মধ্যে যে স্বপ্নটি দানা বাঁধে তা হচ্ছে পদোন্নতি। কার কীভাবে পদোন্নতি হবে তা আইনকানুন, নিয়ম-নীতি দিয়ে পোক্ত করা। পুরো বিষয়টি কাচের মতো স্বচ্ছ। এরপরও পদোন্নতি হয় না। দিন, মাস, বছর পার হয়ে যায়, কাক্সিক্ষত পদোন্নতির দেখা মেলে না।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডারে নিয়মিত পদোন্নতি হয়। বাকি ক্যাডারে হতাশা। তার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি নন-ক্যাডারে। ক্যাডার কর্মকর্তারা নিজের পদোন্নতির ষোলো আনা বুঝে নিয়ে ঠেকিয়ে দেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি। সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নন-ক্যাডাররা একজন আরেকজনকে নানা ইস্যুতে আটকাতে গিয়ে পুরো প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করেন। সরকারের মোট কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কর্মচারী। সেই হিসেবে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের পদোন্নতি হয় না। পে-কমিশন হলেই কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য করুণা উথলে ওঠে। এমনকি ব্লকপোস্টে যারা আছেন, তাদের জন্যও পদোন্নতির বিকল্প সুবিধা বাতলে দেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কর্মচারীদের পদোন্নতি উপেক্ষিতই থাকে।
যখন সময়মতো পদোন্নতি হয় না, তখন নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে থাকে। এসব সমস্যা সংশ্লিষ্ট দপ্তর-অধিদপ্তরের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমজনতাকেও প্রভাবিত করে। নন-ক্যাডার কর্মকর্তা আর সঙ্গে কর্মচারীরা যখন বুঝতে পারেন পদোন্নতির আশা তাদের নেই, তখন তারা দুহাতে টাকা কামানোর ধান্দায় মেতে ওঠেন। এতে করে ঘুষের সংস্কৃতি সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। অকার্যকর পথে হাঁটে রাষ্ট্র। সাধারণ মানুষ টাকা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কোনো সেবা পায় না, ব্যবসায়ীরা নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে ব্যবসায় আসেন না, ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি না থাকায় মুখ ফিরিয়ে নেন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। প্রধানমন্ত্রীর বারবার আহ্বানেও বিনিয়োগকারীরা সাড়া দেন না। সাধারণ মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে সেবা দেওয়ার বাণীতেও উদ্বুদ্ধ হন না সংশ্লিষ্টরা।
এই পরিস্থিতিতে অনিয়ম আটকে রাখার সব কৌশলই ব্যর্থ হচ্ছে। যথাযথ তদারকি না থাকায় বিভাগীয় ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে গেছে। ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৩৫০টি অডিট আপত্তি ঝুলে থাকায় অডিট প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ হারিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে পড়ছে অনিয়মে। দন্তহীন বাঘে পরিণত হওয়ার তথ্য সাংবাদিকদের জানান দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান নিজেই।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদোন্নতির বড় একটা অংশ আটকে রাখে মন্ত্রণালয়গুলো। এই আটকে রাখার কারণ হচ্ছে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের স্বার্থ। বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিলে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতিপ্রাপ্তদের ওপরের পদে বসাতে হবে। এতে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের এককালীন লাভ; অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে একবার পদোন্নতি দেওয়া যাবে। কিন্তু পদোন্নতি না দিয়ে সংশ্লিষ্টদের চলতি দায়িত্ব দিলে বছরজুড়ে টাকা আয় করতে পারেন নীতিনির্ধারকরা। দপ্তর, অধিদপ্তরে বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। চলতি দায়িত্বপ্রাপ্তদের আয় অনুসারে নীতিনির্ধারকদের মাসোহারা দিতে হয়। নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া হলে মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের নিয়মিত আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে আইন বা বিধি-বিধানের ফাঁকফোকর গলিয়ে নন-ক্যাডার এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়।
সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সচিবালয় এবং সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পদোন্নতির মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। নন-ক্যাডারের কিছু বিষয় ছাড়া সচিবালয়ের কর্মচারীরা সময়মতো পদোন্নতি পায়। কিন্তু সচিবালয়ের বাইরে পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। সচিবালয়ে মাত্র ১০ হাজার কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ের বাইরে আছেন ১০ লাখের বেশি। এসব কর্মচারীর পদোন্নতি নিয়ে বহু বছর ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনো ফল পাইনি। সর্বশেষ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ সমস্যা নিয়ে কাজ করার জন্য একটি কমিটি করে দিয়েছে। কমিটি কিছু সুপারিশ করেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। এরপর এর কোনো অগ্রগতি নেই। যেখানে সরকারপ্রধান বলেন, চাকরিজীবনে সবাই যেন কমপক্ষে একটি পদোন্নতি পায়। সেখানে বহু কর্মচারী কোনো পদোন্নতি ছাড়াই অবসরে যাচ্ছেন। সরকারপ্রধানের নির্দেশনা উপেক্ষা করেন আমলারা। তাদের আগ্রহ কেনা-কাটায়, বিদেশ ভ্রমণে, নতুন জনবল নিয়োগে। এসব করলে তাদের লাভ। কর্মচারী পদোন্নতি দিতে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। এর নিশ্চয়ই একটা শেষ আছে। বৈষম্যের পরিণতি কী হয়, তা অনেক দাম দিয়ে বিডিআর বিদ্রোহে আমরা দেখেছি।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি ঝুলছে বছরের পর বছর। এই অধিদপ্তরের কয়েক শ কর্মকর্তা পাঁচ বছর আগেই পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। নানা কায়দা-কানুন করে তাদের পদোন্নতি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সংশ্লিষ্টদের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করে তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নতুন করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার নামে সময়ক্ষেপণ করছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকা করার পর এখন তাদের পারিবারিক সদস্যদের তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই সংস্থা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদেরও তথ্য তালাশ করছে। তাদের আত্মীয়দের মধ্যে কে কোন দলের সমর্থক তার তথ্য নিচ্ছেন সংস্থার কর্মকর্তারা।
গত মাসে শেষ হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনে দায়িত্ব পালন করছিলেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সুরম্য ভবনে দায়িত্ব পালন করলেও ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মনের অবস্থাটা মনোহর ছিল না। কেমন আছেন জানতে চাইলে ওই নন-ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো নেই। চাকরি করছি, পদোন্নতি নেই। ২০১৫ সালের আগে পদোন্নতি না পেলেও টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড ছিল। তাও তুলে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল সময়মতো পদোন্নতি হবে, ব্লকপোস্টধারীদের দেওয়া হবে বিশেষ আর্থিক সুবিধা। এসবের কোনোটাই হয়নি।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে একটি প্রশাসনিক আদেশ খুবই পরিচিত। সেই প্রশাসনিক আদেশ ১৬/২০১৮ অনুযায়ী ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগ হবে। আর ৩০ ভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ৭০ ভাগ কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগের ফলে বিমানে বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় কর্মকর্তা বেশি। নীতিনির্ধারকদের নতুন জনবল নিয়োগে আগ্রহ বেশি। পুরনোদের পদোন্নতি দিয়ে ওপরের পদ পূরণের চেয়ে তারা নতুন নিয়োগে যান। ফলে কারও চাকরিজীবনে একবারও পদোন্নতি হয় না। নামমাত্র যে পদোন্নতি হয় তা অনিয়মে ভরপুর।
নন-ক্যাডার ছাড়াও ১৩তম গ্রেড থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতি হয় না বললেই চলে। প্রতিটি দপ্তরে এসব গ্রেডের পদোন্নতি আটকে আছে। অথচ এসব গ্রেডেই বেশি লোক চাকরি করছেন। সরকারের মোট জনবল প্রায় ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ২৩ শতাংশ পদের মধ্যেও নন-ক্যাডার রয়েছেন। এ ছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৭৭ শতাংশ পদই ১৩তম থেকে তার পরের গ্রেডের। এতে করে সহজেই বোঝা যায় সরকারের জনবলের বড় অংশই পদোন্নতির চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। সরকারের জনবলের এই বিশাল অংশ যখন পদোন্নতি নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তখন তারা নানা অনিয়মে ঝুঁকে পড়েন।
বেশির ভাগ দপ্তর, অধিদপ্তর পরিচালনা করেন বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা তাদের প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দপ্তর, অধিদপ্তরে পাঠান। প্রেষণে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা শুধু রুটিন কাজটুকুই করতে চান। শূন্যপদে জনবল নিয়োগ বা পদোন্নতি রুটিন কাজ না হওয়ায় তা উপেক্ষিত থাকে। তা ছাড়া পদোন্নতি দিতে গিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়; বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রী বা সচিব তাদের পছন্দের লোককে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য সংস্থার প্রধানকে চাপ দেন। এই চাপ উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ না থাকায় অযোগ্য লোককে পদোন্নতি দিতে হয় সংস্থার প্রধানকে। এই জটিলতা থেকে দূরে থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের পদোন্নতি দেওয়া থেকেও দূরে থাকেন সংস্থার প্রধানরা।
নন-ক্যাডার কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের পদোন্নতি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের ১৪ গ্রেডের একজন কর্মচারী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাইরের লোকের ইচ্ছাটাই জাগে না আমাদের পদোন্নতি দিতে। আমাদের দপ্তরপ্রধান মহাপরিচালক প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। অতিরিক্ত মহাপরিচালকও অনেক সময় প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসেন। তাদের কেন ইচ্ছা জাগবে আমাদের পদোন্নতি নিয়ে। যদি এসব পদে ফুড ক্যাডারের কর্মকর্তা থাকতেন, তাহলে তারা খাদ্য বিভাগের সমস্যা বুঝতেন। তা ছাড়া নিয়োগ বিধি সংশোধনের নামে আমরা দীর্ঘদিন একই পদে আটকে আছি।’
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে এক আবেদনে জানান, ‘বর্তমানে সচিবালয়ে প্রায় দুই হাজারের বেশি প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্মরত। এর বিপরীতে ক্যাডারবহির্ভূত সংরক্ষিত পদের সংখ্যা ২৬৭টি, যা খুবই নগণ্য। ফলে একই পদে ২০-২২ বছরের বেশি সময় কর্মরত থাকার পরও অনেকে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। পদোন্নতি না পাওয়ায় সৃষ্ট হতাশার ফলে কর্মস্পৃহা নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার এ সমস্যা থেকে কীভাবে বের হতে পারে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সরকার সব সময়ই কাজ করে। কিন্তু এ চেষ্টা জটিলতার তুলনায় কম। এ বিষয়ে আরও এফোর্ট দিতে হবে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা খরচের হিসাব ধরে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে সরকার। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৭২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে খরচের বেশিরভাগ অর্থ জোগাড়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়ানো হবে। আসছে জুনের প্রথমভাগে জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী বাজেট হবে জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট। তাই এখানে নেওয়া কোনো পদক্ষেপে যেন আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচনার মুখে না পড়ে এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্টদের থাকছে বিশেষ নজর। এ ছাড়া রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। তাই সংকট ও নির্বাচন দুটোই মাথায় রাখতে হচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদের।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে মোটাদাগে একটি রূপরেখা পাঠানো হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার পাশাপাশি গত তিন মেয়াদে সরকার কী কী উন্নয়ন করেছে আগামী বাজেট প্রস্তাবে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি নীতিনির্ধারকদের উপস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে’ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো আগামী বাজেটের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আর গত সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) চিঠি পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, যে হিসাব ধরে অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছে তা কয়েক দফা খতিয়ে দেখা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে। তিনি প্রয়োজনীয় সংশোধন, যোগ-বিয়োগ করে আবারও অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। বাজেট প্রস্তাব চূড়ান্ত হওয়ার আগেও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
ডলার সংকটে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় পণ্যের দাম বাড়ছে। কাঁচামাল সংকটে বিপাকে শিল্প খাত। ব্যাংক খাতে অস্থিরতা। নতুন চাকরির সুসংবাদ নেই বললেই চলে। দফায় দফায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি। খুব শিগগিরই এসব সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে ঋণদাতা সংস্থার কঠিন শর্তের বেড়াজালে আছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বৈশি^ক অস্থিরতা মোকাবিলায় সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা আগামী বাজেটে স্পষ্ট করা হবে। দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথাও বলা হবে। তবে শত সংকটের মধ্যেও আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী যতটা সুবিধা দেওয়া সম্ভব তা দিতে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে বাজেট প্রস্তুত কমিটির কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে কাঁচামাল আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দিতে হিসাব কষা হচ্ছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডলার সংকটে আমদানি রপ্তানি প্রায় বন্ধ। ব্যবসা-বাণিজ্যে সংকটকাল চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমাদের দাবি অনুযায়ী নগদ সহায়তা দিতে হবে। রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। কর অবকাশ ও কর অব্যাহতি বাড়াতে দিতে হবে।’
ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া সংস্কারের শর্ত মানার অঙ্গীকার করে সরকার ঋণ পেয়েছে। শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে ঋণের যেকোনো কিস্তি আটকে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি। পর্যায়ক্রমে প্রতি অর্থবছরের বাজেটে এসব সংস্কার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা হবে। আসছে বাজেটে শর্ত মানার চেষ্টা থাকবে। বিশেষভাবে অতীতের মতো ঢালাওভাবে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না। আর্থিক খাতের সংস্কারের কিছু ঘোষণা থাকবে। বিশেষভাবে ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দেওয়া হবে। আইএমএফের সুপারিশে এরই মধ্যে ভ্যাট আইন চূড়ান্ত হয়েছে। আয়কর আইন মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হয়েছে। শুল্ক আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ে আছে। এ তিন আইন অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আসছে বাজেটে টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার কথা বলা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু উদ্যোগের কথা শোনানো হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঋণদাতা সংস্থার শর্ত মানার কথা বলা হলেও সব আগামী বাজেটে একবারে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে। না হলে অর্থনীতির গতি কমে যাবে।’
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত খাত এবং এনবিআর খাতের জন্য মোট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ১৯ শতাংশ বাড়িয়ে ধরা হতে পারে। এতে লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে। এনবিআর এ লক্ষ্যমাত্রা কমানোর জোরালো আবেদন করেছে। কিন্তু তা আমলে আনেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। নতুন অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে প্রায় ৩৫ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হিসেবে, ৩৪ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা আয়কর হিসেবে এবং ৩১ শতাংশ বা বাকি ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা শুল্ক হিসেবে সংগ্রহ করার কথা বলা হতে পারে বলে জানা গেছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রার কথা শুধু বললেই হবে না। কীভাবে অর্জিত হবে, সেটি নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে প্রতিবারের মতো ঘাটতি থাকবে। রাজস্ব ঘাটতি হলে অর্থনীতিতে আয় ব্যয়ের ভারসাম্য নষ্ট হয়। তাই এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত হওয়া উচিত।’
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এনবিআর উৎসে করের আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। সম্পদশালীদের ওপর নজর বাড়ানো হবে। শুধু বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর গুনতে হবে। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। সুপারট্যাক্স গ্রুপকে উচ্চহারে গুনতে হবে কর। আগামী অর্থবছরেও অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা থাকবে। অর্থ পাচারোধে আইনের শাসন কঠোর করা হবে। অর্থ পাচার আটকাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হবে। করপোরেট কর কমানোর দাবি থাকলেও তা মানা হবে না। অন্যদিকে নির্বাচনের আগের বাজেট হওয়ায় করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে খোদ অর্থমন্ত্রী বললেও রাজস্ব আদায় কমে যাবে এমন যুক্তি দেখিয়ে এনবিআর রাজি নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে। কমানো হবে শিল্পের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি শুল্ক। ডলারের ওপর চাপ কমাতে বেশি ব্যবহৃত পণ্য আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হবে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি কমাতে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের সব সুবিধা বহাল রাখা হবে। শিল্পের অন্যান্য খাতেও কতটা সুবিধা বাড়ানো যায় তা নিয়ে এনবিআর হিসাব করছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া বাজেট প্রস্তুতিবিষয়ক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং ঘাটতি ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হতে পারে। আগামী অর্থবছরে জিডিপির ৬ শতাংশ ঘাটতি ধরে ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হতে পারে বলে জানা যায়। ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে ভর্তুকি কমানোর চাপ থাকলেও আগামীবার এ খাতে বেশি ব্যয় ধরা হতে পারে। এ খাতে ১ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি ব্যয় আছে ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, গত সোমবার রাতে আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ অনুমোদন করে। ঋণদাতা সংস্থাটির কাছ থেকে বাংলাদেশ ছয় কিস্তিতে তিন বছরে ৪৭০ কোটি ডলার পাচ্ছে। ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের দিন আইএমএফ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে পূর্বাভাস দেয়। সংস্থাটি বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা হতে পারে ৭ দশমিক ১ শতাংশ।
এতে রিজার্ভ সম্পর্কে বলা হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার কোটি ডলার। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়বে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে প্রথমবারের মতো রিজার্ভ ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় চলতি বোরো মৌসুমে সেচে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সরকার নানারকম প্রস্তুতি নিয়েছে বলে দাবি করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের যে পরিস্থিতি তাতে গ্রীষ্মে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বেশি দাম দিয়েও কৃষক ঠিকমতো বিদ্যুৎ না পেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়তে পারে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল, সার ও বীজের দাম বেড়েছে। এখন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। তার মানে চারদিক থেকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকের ‘সিগনিফিকেন্ট লস’ হবে। এভাবে দাম বাড়িয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বোরো উপকরণনির্ভর ফসল। কিন্তু উপকরণের দাম এভাবে বাড়তে থাকলে, কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেললে; সে ঠিকমতো উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না। এতে উৎপাদন ব্যাহত হবে। উৎপাদন খারাপ হলে চালের ঘাটতি হবে। এমনিতেই এখন প্রায় ৭০ লাখ টন গম ও ভুট্টা আমদানি করতে হচ্ছে। এরমধ্যে যদি চাল আমদানি করতে হয়; তাহলে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
ড. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সারাবিশ্ব নানারকম সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় আমাদের অন্তত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ রয়েছে। সেজন্য যে পরিমাণ দাম বেড়েছে সে পরিমাণ নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে কৃষককে। ২০০৯-১০ সালের দিকে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক কোটির বেশি কৃষককে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা সরাসরি নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। এজন্য তারা ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলেছিলেন। তাদের সেই অ্যাকাউন্ট এখনো আছে, কিন্তু সহায়তা দেওয়া হয় না। এখন যদি সেই সহায়তা দেওয়া হয় তাহলে কৃষক আবার উৎসাহ পাবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, প্রতি বছর সেচ মৌসুমে (ফেব্রুয়ারি থেকে মে) বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যায়। গত মৌসুমে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। চলতি বছর সম্ভাব্য চাহিদা ধরা হয়েছে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় এ বছর সেচ সংযোগের সংখ্যা ১ হাজার ৯১টি বেড়ে মোট ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫৯টি হয়েছে। এজন্য বিদ্যুৎ লাগবে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
সেচ মৌসুমে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উৎপাদনও বাড়ানো হচ্ছে। সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গ্যাস, ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল সরবরাহ বৃদ্ধি করা, গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি ভালো হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে প্রতিদিন ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস, ৭৭ হাজার ৪০০ টন ফার্নেস অয়েল এবং ৬৬ হাজার ১০০ টন ডিজেলের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। সূত্রমতে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা বাস্তবে খুব কঠিন ব্যাপার। গত বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পিডিবির দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ১৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট ছিল। বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ বছর জ¦ালানির ঘাটতি আরও বেশি। তবে সরকার খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী কতটা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে তা নিয়ে কর্মকর্তাদের অনেকেই সন্দিহান।
পিডিবির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে ১০ হাজার থেকে ১০ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। গ্যাস ও কয়লা সংকটের কারণে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার মেগাওয়াট কম বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের কারণেও কিছু কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে।
দেশে নির্মাণাধীন ও আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আগামী মার্চের শেষ দিকে ভারতের আদানি থেকে অতি উচ্চ দামে ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ছাড়া মে মাসের দিকে চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে ৬১২ মেগাওয়াট এবং অন্যান্য কিছু ছোট বা মাঝারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে পারে। এপ্রিল-মে মাসের দিকে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি হবে। তখন এসব কেন্দ্র সময়মতো উৎপাদনে এলেও ১৩ হাজার মেগাওয়াটের জোগান দেওয়া সম্ভব হবে। এর বাইরে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে কিছু কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে পারে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মনে করেন, চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করার সক্ষমতা সরকারের নেই। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ করতে সরকারের ডলার খরচের যে সক্ষমতা দরকার তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘জ্বালানি খাতে সরকারের ভুলনীতি আর অন্যায্য ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের কারণে দাম বেড়েই চলেছে। সেই ব্যয় মেটাতে এখন বিদ্যুৎ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে ভর্তুকি সমন্বয় করতে চাইছে। এই পরিস্থিতিতে উচ্চ দামে বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করে চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব ব্যাপার।’
এদিকে ডলার সংকট এবং ঋণপত্র (এলসি) খোলার বিলম্বের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মোটা অঙ্কের বিল পাওনা থাকলেও তারা ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি করতে পারছেন না। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নির্মাণকাজ এবং জ্বালানি আমদানির যে অগ্রগতি তাতে চাহিদার তুলনায় আগামী গ্রীষ্মে বিদ্যুতের ঘাটতি হবে আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। তবে সাশ্রয় নীতি অবলম্বনের মাধ্যমে ১ হাজার মেগাওয়াট এবং উচ্চ মূল্যের জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণ করতে পারে সরকার। এরপরও অন্তত ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকবে।
এদিকে দাম সমন্বয়ের নামে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে জানুয়ারি মাসে ১৮ দিনে চার দফা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করেছে সরকার। এর মধ্যে দু’দফায় অন্তত ১০ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে সেচে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২৯ টাকা দাম বাড়ানো হয়। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে।
কুমিল্লার নাঙলকোট উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম মজুমদার বলছিলেন, গত বছর এক বিঘা বা ৩৩ শতক জমিতে ধান চাষ করতে সেচের জন্য ২৭৫০ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বোরো মৌসুমে এ ব্যয় বেড়ে অন্তত ৪ হাজার টাকা হবে। এর বাইরে অন্যান্য খরচও আনুপাতিক হারে অনেক বেড়েছে। ফলে এখন ধান চাষ করলে প্রতি বিঘা জমিতে অন্তত দেড় থেকে দুই হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে।
ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের শিয়ালা গ্রামের কৃষক নাঈম। শনিবার রাতে টেলিফোনে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতিবিঘা জমিতে এ বছর সেচের ব্যয় বেড়েছে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা। সার, বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বেড়েছে।
এর আগে মূল্যবৃদ্ধির গণশুনানির সময় বিইআরসি কৃষক ও প্রান্তিক মানুষের কথা বিবেচনা করলেও নির্বাহী আদেশের সময় এসব কিছুই বিবেচনা করা হয় না।
অতীতে সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে প্রতিমাসে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বিদ্যুতের দাম তুলনামূলক কম বাড়াত কমিশন। দেশে এ ধরনের গ্রাহক রয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ, যাদের অধিকাংশই কৃষক। কিন্তু সর্বশেষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আদেশে এ সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
লাইফ লাইন শ্রেণির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বিল ছিল ৩.৭৫ টাকা। গত ডিসেম্বরে তা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা করেছিল মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে এবার আরেক দফা বাড়িয়ে ৪.১৪ টাকা করা হয়েছে। ফলে গত দুই মাসের ব্যবধানে দরিদ্র মানুষকে এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের জন্য ৩৯ পয়সা বাড়তি ব্যয় করতে হবে।
কৃষকের কথা বিবেচনা করে আগে সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম সবসময়েই তুলনামূলক সাশ্রয়ী রাখার চেষ্টা করা হতো। কিন্তু এখন কৃষকেরাও রেহাই পাচ্ছে না। গত ১২ ডিসেম্বর কৃষিতে ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা করা হয়। সেখান থেকে এবার আরও ২২ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৫৯ টাকা করা হয়েছে।
রংপুরের একজন কৃষক আনোয়ার আলী খানিকটা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দফায় দফায় যেভাবে সবকিছুর দাম বাড়ছে তাতে চাষি তো আর বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘ধান চাষ করে এখন লাভ তো দূরের কথা খরচই ওঠে না। তাই আগের চেয়ে ধান চাষ কমিয়ে দিয়েছি। এখন সারা বছর খাওয়ার জন্য যতটুকু ধান দরকার ততটুকুই চাষ করি। তাতে লোকসান হলেও কী করব? ডাল-ভাত তো খাওয়া লাগবে।’
তাকে বলা হয় নাটকের রাণী। দীর্ঘ এক যুগের ক্যারিয়ারে অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন। নানামাত্রিক চরিত্রে হাজির হয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন, দু’হাতে কুড়িয়েছেন দর্শকদের ভালোবাসা। বলছিলাম, সুপারস্টার, দেশের সর্বাধিক দর্শকের তারকা মেহজাবীন চৌধুরীর কথা। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তার ওয়েব সিরিজ ‘দ্য সাইলেন্স’। সিরিজ, নাটক, সিনেমা এবং সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তাকে নিয়ে লিখেছেন ইমরুল নূর।
সদ্য মুক্তি পাওয়া ‘দ্য সাইলেন্স’ সিরিজটি থেকে দর্শকদের কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছি। শুধু যে আমি-ই পাচ্ছি, এমনটা নয়। প্রত্যেকটা সেক্টরের প্রশংসা হচ্ছে যেমন- নির্মাণ, আর্ট, সিনেমাটোগ্রাফি এবং যারা অভিনয় করেছেন এখানে সবার অভিনয়ের বিষয়ে অনেক পজেটিভ মন্তব্য দেখছি, শুনছি, পড়ছি। সব মিলিয়ে পুরো টিম প্রশংসা পাচ্ছে। অনেক ভালো লাগছে।
এমন একটা চরিত্র হয়ে উঠা কতটা চ্যালেঞ্জের? তার জন্য প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছিলেন?গল্পটা এত বেশি ইন্টারেস্টিং ছিলো যে শোনার পরই কাজটি করতে রাজি হয়ে যাই। আমার চরিত্রটাও ইন্টারেস্টিং যেখানে অভিনয়ের অনেক সুযোগ ছিল। আমার কাছে মনে হয়েছে, যদি চরিত্রটা সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি তাহলে দর্শকদের মায়াও লাগবে আবার রাগও হবে। তখন তাদের মনে প্রশ্ন জাগবে, এরকম কেন চরিত্রটা? তাই এমন একটা চরিত্র পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি। পরিচালক ভিকি জাহেদ গল্পের রুবি চরিত্রটি কীভাবে দেখতে চায়, সেসব নিয়ে তার কাছ থেকে শুনি এরপর আমার মত করে চরিত্রটিকে গুছিয়ে নেই।
লুকের দিক থেকে হালকা একটু পরিবর্তন আনা হয়েছে। যারা আমাকে চেনেন তারা সেটা দেখলেই বুঝতে পারবেন।
চরিত্রটির জন্য আপনাকে আলাদা দাঁত ব্যবহার করতে হয়েছিলো। জানা মতে, মুখে অতিরিক্ত জিনিস ব্যবহার করে অভিনয় করা কিংবা এক্সপ্রেশন প্রকাশ করা খুবই কঠিন। সেটা কীভাবে সামলেছেন?
হ্যাঁ, একদমই তাই। আমি আমার মতই কিন্তু একটু আলাদা, অন্যরকম দেখানোর জন্যই এরকমটা করা হয়েছে। ফেসিয়াল স্ট্রাকচারের মধ্যে পরিবর্তন আনতে আলাদা দাঁত ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা আসলেই অনেক কঠিন ছিল আমার জন্য। দাঁতের ওপর দাঁত ব্যবহার করে কথা বলা, এক্সপ্রেশন দেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না। আমি একটু কঠিন কিছু করতেই পছন্দ করি সবসময়। তাই চেয়েছিলাম কথা বলা, এক্সপ্রেশন থেকে ভঙ্গি কিছুটা আলাদা-ই হোক। সহজ ছিলো না, কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় জড়িয়ে যেত তারপরও যতটুকু সম্ভব ওভারকাম করার চেষ্টা করেছি।
আর এই সিরিজটিতে নিজেকে সুন্দর কিংবা পরিপাটি দেখানোর কোন ইচ্ছেই ছিলো না। চাচ্ছিলাম আমাকে যেন আমার মত না লাগে।
যতটুকু প্রত্যাশা নিয়ে কাজটি করেছিলেন, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে ?
টিমের একজন সদস্য হিসেবে কাজটি নিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে ভয় ছিল বেশি। কারণ, এরকম একটা কনসেপ্ট নিয়ে কাজ- সেটা দর্শকরা গ্রহণ করবে কিনা, যেটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে সেটা বুঝবে কিনা! কি হলো, কেন হলো, কিভাবে হলো, মূল ম্যাসেজটা সবাই ধরতে পারবে কিনা এই ভয়টা ছিল।
সবার এত মন্তব্য, রিভিউ পড়ে মনে হলো যে আমরা সাকসেসফুল। দর্শকদেরকে ম্যাসেজটা বুঝাতে পেরেছি। সেই জায়গা থেকে পুরো টিম প্রশংসা পাচ্ছে। আমার মনে হয়েছিলো, কাজটা হয়তো খুব বেশি দর্শক দেখবে না কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত এত মন্তব্য দেখছি যেটা আসলে ভালো লাগা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ আবার এমন মন্তব্যও করেছেন যে, কিছুক্ষণ দেখার পর ভয়ে নাকি বন্ধ করে দিয়েছেন (হাহাহা)। আসলে ভয়ে বন্ধ করে দিলেই তো হবে না। আমরা চাই একদম শেষ পর্যন্ত দর্শকরা কাজটি দেখুক। এই গল্পের শেষ দেখাটা খুব জরুরি।
যার মাসের ত্রিশ দিনই সময় কাটতো শুটিং ফ্লোরে, এখন তার ব্যস্ততা কি নিয়ে?
আগে তো নাটকে নিয়মিত ছিলাম কিন্তু এখন অন্যান্য কাজের কারণে নাটকে সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নাটকের স্ক্রিপ্টের মধ্যে নতুনত্ব, আলাদা কিছু খুঁজছি। সবসময়ই যে আলাদা গল্প পাবো, এমনটাও তো সম্ভব না। তবে স্ক্রিপ্টে যেন সৌন্দর্যতা থাকে, গল্পটা সুন্দর হয় কিংবা দর্শকদের সাথে কানেক্ট হবে; এরকম স্ক্রিপ্টেই কাজ করার ইচ্ছে আছে। নয়তো বা আমার অনেক ভালো লাগতে হবে এমন গল্প হলে আবারও নাটকে দেখা যাবে।
আপনার দর্শকদের জন্য সামনে নতুন কি চমক থাকছ?
আগে থেকে বলে ফেললে সেটা তো আর চমক থাকে না। তাই আপাতত কিছু না-ই বলি।
লাক্স সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে বের হওয়ার পর আপনার একটি সিনেমা করার কথা ছিলো কিন্ত সেটি আর হয় নি। এটা আসলে কেন? সিনেমা দিয়েই যার অভিষেক ঘটার কথা তার ব্যস্ততা বাড়লো নাটকে..
হ্যাঁ। লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার থেকে বের হওয়ার পরপই ‘ওয়ারিশ’ নামে একটা সিনেমার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম। এটাতে আমার সঙ্গে ছিলেন আরিফিন শুভ ভাইয়া। আমরা রিহার্সেলও করেছিলাম এটার কিন্তু এরপর নানা কারণে সে কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে ঐ সিনেমাটি-ই আর হয়নি।
যেহেতু সিনেমা দিয়ে অভিষেক হয়নি তাই আমি চেয়েছিলাম নাটকেই কাজ শুরু করি কারণ, এতে করে অভিনয়ের অনেক কিছু শিখতে পারবো। এরপর প্রস্তুত হয়ে নাহয় সিনেমা করবো। পরে নাটকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এরপর তো ওয়েব সিনেমা, সিরিজ করছি। যদি মেইনস্ট্রিম সিনেমা বা বড় পর্দায় কাজ এখন পর্যন্ত না করার সবচেয়ে বড় কারণ হলো, সঠিক গল্প, ভালো স্ক্রিন-প্লে এবং একটা ভালো টিম না পাওয়া। এক কথায় যদি বলি, মনের মত করে পাইনি এখনও। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি কোনো কাজ করতে চাচ্ছি না। নাটক আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার পরিচিতি, দর্শকের ভালোবাসা- সবকিছুই নাটকের মাধ্যমে। নাটক দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে আজকে আমি এই জায়গায়। আমি এই বিষয়টা অনেক বেশি উপভোগ করি। আমি শুধু ভালো কাজ করতে চাই। এটা দর্শক কোন মাধ্যমে দেখছে তার চেয়ে আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ- আমি তাদের কতটা ভালো কাজ দিতে পারছি, ভালো অভিনয় দিতে পারছি কিনা! দর্শক আমাকে ভালোবাসলে তারা নিজের মত করে দেখে নেবে। সেটা নাটকে, ওটিটিতে অনলাইন মাধ্যমে নাহয় টিকিট কেটে সিনেমাহলে দেখবে; আমার দর্শকদের প্রতি এটুক বিশ্বাস আছে।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় টেলিভিশনের প্রায় সব শিল্পীই এখন ওটিটিতে ঝুঁকছে। এতে করে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে শিল্পী সংকট তৈরি হয়েছে বলে অনেক পরিচালকের অভিমত। তাদের ভাষ্য, সুযোগ থাকলেও প্রথম সারির শিল্পীদের এখন পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?
দেখুন, এই মুহূর্তটাতে আমি নাটকে কাজ কমিয়েছি আমার নিজের জন্য। এটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত। নাটক ছেড়ে দিয়েছি, বিষয়টা কিন্তু তেমন না। আমি জানিয়েছি, ভালো স্ক্রিপ্ট হলে আমি অবশ্যই করবো। সে জায়গা থেকে আমার নিজের কাজ, নিজেকে আরও অনেক উপরে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য ঠিক সেরকম গল্পও তো লাগবে নাকি! তা নাহলে তো সেই একইরকমের কাজ করার পর দর্শকরাই বিরক্ত হবে আর বলবে, মেহজাবীন একইরকম কাজ করছে!
আমি নিজেকে আলাদা করার জন্য এবং দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য নিজের মত করে কাজ করার চেষ্টা করছি। দর্শকরা তো এটাই চাইতো, কাজ কম হোক কিন্তু সেটা যেন ভালো হয়। আমি এখন সেটাই করছি। আর একজন শিল্পী হিসেবে আমিও তো চাইবো, আমার প্রত্যেকটা কাজ খুবই এক্সক্লুসিভ হোক, আলাদা হোক। আগের করা কোন চরিত্রের সাথে মিলে না যাক। দর্শকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করার চেষ্টাতেই এই সময়ে এসে কাজ কমিয়ে দেওয়া।
আর শিল্পীদের ওটিটিতে আগ্রহী হওয়ার অনেক কারণ আছে। এখানে শিল্পীরা নিজেদেরকে ফুটিয়ে তুলতে সব ধরণের স্বাধীনতা পাচ্ছে যেটা টেলিভিশনে সম্ভব হয় না। এটা একটা ক্রিয়েটিভ জায়গা। যেকোন ক্রিয়েটিভ কাজ ভালো করতে হলে সময়ের দরকার। ওটিটিতে শিল্পীরা ভালো গল্প পাচ্ছে, চরিত্র নিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে, সময় নিয়ে কাজ করতে পারছে। এটাই তো চায় সবাই।
তাছাড়া এখন আমাদের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক বড়। এখানে অনেক শিল্পী রয়েছেন তাছাড়া যারা নতুন আছেন তারাও অনেক ট্যালেন্টেড। তাদের এখন সুযোগ দরকার ভালো পরিচালকদের সঙ্গে, ভালো গল্পে কাজ করার। এখন তাদেরকে সেই সুযোগটা দেওয়া হোক এবং তারা নিজেদের মত করে এগিয়ে যাক। একটা ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু গুটিকয়েক জনের উপর নির্ভর করে চলবে না এবং উচিতও না। এখানে প্রত্যেকটা মানুষের সেই সুযোগটা পাওয়া উচিত। আবার যখন কারও মনে হবে যে আমি এখান থেকে অন্য জায়গায় যাবো, সে স্বাধীনতাও তার থাকা উচিত। কারণ, আমরা যারা শিল্পী তারা কিন্তু অভিনয়টা বেছেই নিয়েছি ভালো সুযোগ, ভালো কাজ, ভালো চরিত্রের জন্য। যেখানে সে সুযোগটা পাবে, সেটা বেছে নেওয়ার অধিকার একজন শিল্পীর আছে। এতদিন আমি নাটকে অভিনয় করেছি, এখন একটু কম করছি; এটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত। সেই স্বাধীনতা তো একজন শিল্পীর অবশ্যই থাকা উচিত।
যারা এখন নতুন কাজ করছে, তাদের জন্য আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক শুভকামনা। তারা যে চেষ্টা করছে এটা খুব ভালো লাগছে। দর্শকদের উচিত তাদেরকে সাপোর্ট করা। কারণ, একটা সময় সেই সাপোর্টটুকু আমরাও পেয়েছিলাম যখন একেবারেই নতুন ছিলাম। আমাদেরকে যেই ভালোবাসাটা দিয়েছিলেন সেই ভালোবাসাটুকু এখন নতুনদেরকে দিন, এটাই আমি চাইবো।