
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নে বাসিন্দা সাহিনা আক্তার। রাজধানীর মগবাজার এলাকায় দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। সরকারি চাকরিজীবী স্বামী আবদুল ওয়াদুদ ২০২০ সালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। স্বামীর পেনশন থেকে প্রাপ্ত অর্থসহ সারা জীবন জমানো প্রায় ৩০ লাখ টাকা বেসরকারি খাতের তিনটি ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসেবে (এফডিআর) রেখেছিলেন। এফডিআরের লভ্যাংশ আর নিজের টিউশন পড়ানোর টাকায় সংসার চালাতেন তিনি। মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সম্প্রতি তিনটি টিউশনের একটি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে তাকে। এমন পরিস্থিতিতে বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়ায় খরচ আর সংসারের খরচ বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এফডিআরের ১০ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন। সেই টাকা দিয়েই ছোট ছেলের সেমিস্টার ফি আর অন্যান্য খরচ বহন করছেন তিনি।
শুধু সাহিনা আক্তারই নন, রাজধানীতে বসবাস করা আক্তার হোসেন, তারিকুল ইসলামসহ স্বল্প আয়ের অনেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়টাতে সংসার খরচের ব্যয় সামাল দিতে ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। এতে ব্যাংকের টাকা চলে যাচ্ছে মানুষের হাতে। আর ব্যাংকে দেখা দিচ্ছে তারল্যের সংকট। এক বছরের ব্যবধানে আমানতের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ৮ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমে এসেছে।
জানতে চাইলে সাহিনা আক্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যাংকের এফডিআরের লভ্যাংশ আর আমার টিউশন থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই আগে সংসার কোনোরকম চালানো সম্ভব ছিল। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আমার একটা টিউশন বন্ধ হয়ে যায়। আর সব পণ্যের এতটাই বেড়েছে যে, সংসার খরচ ও সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে ব্যাংকে রাখা স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ভাঙতে হয়েছে।’
ধারাবাহিক ঋণ কেলেঙ্কারি, ব্যাংক নিয়ে গুজবসহ নানা কারণে গেল বছরের শেষদিকে অনেকেই ব্যাংক খাত থেকে আমানত তুলে নিয়েছিলেন। এর বাইরে ব্যাংকে আমানতের সুদহার কমে যাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন কারণে গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা ব্যাংকের পরিবর্তে হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের মে মাসে ব্যাংক খাতের বাইরে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ২৫ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, যা চলতি বছরের মে শেষে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে টাকা চলে গেছে ৩০ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অবশ্য সরকারকে ঋণ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৮ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে। এটিও মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দিয়েছে।
তবে ঋণ কেলেঙ্কারি রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি ও হাতে টাকা রাখার ঝুঁকি বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে কিছু অর্থ ব্যাংকে ফিরেছে। তবে তা এখনো আগের বছরের তুলনায় কম।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের শেষদিকে ব্যাংক খাতের বেশ কয়েকটি কেলেঙ্কারির বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থার সংকট দেখা দেয়। বেশ কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। পাশাপাশি ব্যাংকে টাকা রাখলে পাওয়া যাবে না গুজব ও মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে মানুষ টাকা তুলে নেওয়া শুরু করে। তবে ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে অনেক গ্রাহকের মাঝে ধীরে ধীরে ব্যাংকের প্রতি আস্থা আবারও তৈরি হচ্ছে। তারপরও অনেক গ্রাহকের মনে ‘আস্থার ঘাটতি’ এখনো রয়েই গেছে। এমন পরিস্থিতিতে কেউ কেউ ব্যাংকে টাকা রাখা নিয়ে রীতিমতো দোটানায় পড়েছেন। কোনো কোনো গ্রাহক এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর করছেন। বিশেষ করে শরিয়াহ আইনে পরিচালিত ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা তুলে সরকারি কিংবা বিদেশি ব্যাংকে রাখছেন। আর নেহাত যাদের ব্যাংকের ওপর আস্থা কম, তারা টাকা তুলে হাতে রাখছেন। এ কারণেই ব্যাংকের বাইরে টাকা বেড়ে গেছে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জয়তুন বিজনেস সলিউশনসের চেয়ারম্যান মো. আরফান আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যাংকের বাইরে টাকা চলে যাওয়া ভালো নয়। এটা ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি করতে পারে। এটি হয় দুই কারণে; প্রথমত দেশে যদি দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। তখন মানুষ সংসার চালাতে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে হাতে রাখার চেষ্টা করেন। আর দ্বিতীয়ত, যদি ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ মনে না করেন তাহলে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ ছাড়া আমানতে সুদের হার কম থাকলেও মানুষ টাকা ব্যাংকে না রেখে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করেন।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছর এপ্রিল শেষে মানুষের হাতে থাকা অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। আর মে মাসে এ অর্থ কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে রাখা অর্থের পরিমাণ কমেছে ৭ হাজার ৫৪৩ কোটি বা ২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত বছর জুনে ব্যাংকিং সিস্টেমের বাইরে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৮ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন আরও বলছে, ২০২১ সালের জুন মাসে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ বেড়েছিল ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনে হাতে টাকা রাখার প্রবণতা আরও বেড়েছে। এ সময় হাতে টাকা রাখার পরিমাণ বেড়েছে ১২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) থেকে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এই তহবিল থেকে অর্থায়নের সুবিধা পেতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব করেছে। এতদিন সেটা তেমন আমলে না নিলেও এবার যুক্তরাষ্ট্র ডিএফসি সুবিধা দিতে এগিয়ে এসেছে। আর এ সহায়তা পেতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে পরিবেশ, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আজ মঙ্গলবার ঢাকা সফরে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্রবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া ও সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। এ সফরে তারা আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টরে শর্তযুক্ত বিনিয়োগ করার প্রস্তাব করতে পারেন। আর এর মধ্য দিয়ে আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে পেতে চায় বিশ্ব মোড়ল এ দেশটি; যা সরকারকে নতুন করে চাপে ফেলতে পারে।
চার দিনের সফরে মার্কিন এই প্রতিনিধিদলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ সময় তারা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা, গণতন্ত্র সুসংহত করা, মানবাধিকার উন্নয়ন এবং শ্রম অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে পারেন বলে জানা গেছে।
সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও বিদেশি সম্পর্কোন্নয়ন নিয়ে কাজ করা আওয়ামী লীগের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন কৌশল নিয়েছে। সেটা হলো, তারা বেসরকারি সেক্টরে শর্তযুক্ত বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসবে। বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে দেশের প্রতিষ্ঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে পেতে চায় তারা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডিএফসি তহবিল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেসরকারি খাতে শর্তযুক্ত ঋণ দিয়ে থাকে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারবিষয়ক ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে বেসরকারি সেক্টরের বড় ব্যবসায়ীদের পেতে মূলত শর্তযুক্ত ডিএফসি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই তহবিল জ¦ালানি, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কম সুদে, দীর্ঘমেয়াদি ও ক্ষেত্রবিশেষে সুদবিহীন বড় অঙ্কের অর্থায়ন করে থাকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বেসরকারি বাণিজ্যিক সেক্টরে। তবে এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পরিবেশ, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, পরিবেশ ও শ্রম অধিকারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার পরিস্থিতি রুগ্্ণ থাকা কোনো দেশে ডিএফসি তহবিল দেয় না। ডিএফসির মূল লক্ষ্যই হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সরকারপ্রধানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এখানে আমার কোনো কিছু জানা-বোঝার কথা নয়।’
জানা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের যে চ্যালেঞ্জ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল সে সম্পর্কেও আলোচনা করবে। টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, তার একটি রূপরেখাও ওই প্রতিনিধিদলের হাতে তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা গ্রহণ ও দেশের মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পারে সরকার তেমন একটি পরামর্শও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে আসতে পারে। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির পরস্পরবিরোধী অবস্থান দূর করতে আবারও সংলাপের প্রস্তাব আসবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র ও সরকারের দুই মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও শ্রম অধিকার বিষয়ে এবং আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে মূলত সফরকারী যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধিদল সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করবে।
সূত্রগুলো জানায়, সরকারও মানবাধিকার, গণতন্ত্র উন্নয়ন ও শ্রম অধিকার আইন নিয়ে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের পথে, সেগুলো বিস্তর আকারে প্রতিনিধিদলের কাছে তুলে ধরবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল সফরে আসুক, আলোচনা করুক, তারপর কথা বলব।’ তিনি বলেন, সব ঠিক আছে।
কূটনীতিক কৌশল নিয়ে কাজ করেন সরকারি দলের এমন একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে বলেন, শ্রমিকদের মানোন্নয়ন, অধিকার সুরক্ষায় ইতিমধ্যে শ্রম আইন সংশোধন করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র নিশ্চিতে সরকার কী কী করেছে, তা উদাহরণসহ তুলে ধরা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলকে সন্তুষ্ট করতে ইতিমধ্যে বিস্তারিত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সরকার মানবাধিকারের ক্ষেত্রে যে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে, সেগুলোও সফররত প্রতিনিধিদলকে অবহিত করা হবে।
ডিএফসির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ডিএফসির বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রকে বৈশ্বিক উন্নয়নের মঞ্চে একটি শক্তিশালী এবং আরও প্রতিযোগিতামূলক নেতা করে তোলে। রূপান্তরমূলক প্রকল্পগুলোতে মিত্রদের সঙ্গে অংশীদারত্ব করার এবং রাষ্ট্র-নির্দেশিত উদ্যোগ; যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আরও খারাপ করে দিতে পারে, সেগুলোতে আর্থিকভাবে উপযুক্ত বিকল্প প্রদান করে আন্তর্জাতিক এ তহবিল।
ডিএফসির বিনিয়োগ প্রভাবশালী বৈশ্বিক উন্নয়ন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির অগ্রগতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের জন্য রিটার্ন তৈরিতে ফোকাস করে। ডিএফসির বিনিয়োগ সীমা ৬০ বিলিয়ন ডলার। ডিএফসি উন্নয়নশীল বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সমাধানে অর্থায়নের জন্য বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারত্ব করে। সংস্থাটি শক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে। ডিএফসি উদীয়মান বাজারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য ছোট ব্যবসা এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়ন করে। ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি সংস্থা ডিএফসি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চমান মেনে চলে এবং পরিবেশ, মানবাধিকার এবং কর্মীদের অধিকারকে সম্মান করে।
ডিএফসি যে বিনিয়োগগুলো সংহত করে তা বিশ্বের কিছু দরিদ্র দেশ এবং সংঘাত দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে কাজ করে। এসব বাজারে বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসাকে বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল বাজারগুলোতে পা রাখতে সাহায্য করে।
দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার না করতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘আপনারা এমন কোনো সংবাদ প্রকাশ করবেন না যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে এবং এর চলমান অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে। ক্ষমতায় থাকার কারণে গত ১৪ বছরে গণমাধ্যমকে যতটা স্বাধীনতা আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে, তা আগে কখনো কেউ ভোগ করেনি।’
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের করবী হলে অসুস্থ, অসচ্ছল সাংবাদিক এবং নিহত সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের আর্থিক চেক প্রদান অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। খবর বাসস।
সাংবাদিকদের ‘দেশের ভালোর জন্য’ সামলোচনা করার আহ্বান রেখে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমালোচনা যেন আমাদের দেশের কল্যাণে হয়, দেশের ক্ষতির জন্য না হয়। সমালোচনা থেকে যদি কোনো কিছু সংশোধন করা লাগে আমরা (সরকার) সেটা করে নেব এবং আমরা সেটা করে থাকি। সেখানে আপনাদেরও কিছুটা দায়িত্ব আছে। স্বাধীনতা ভোগ করবেন, সঙ্গে দায়িত্ববোধও থাকতে হবে। দেশ ও জাতির জন্য কর্তব্যবোধ থাকতে হবে।’
সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইতিমধ্যে আমরা একটা ওয়েজবোর্ড কার্যকর করেছি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের আওতায় আনা হবে, খুব দ্রুত এটা বাস্তবায়ন করা হবে। গণমাধ্যমকর্মী চাকরি শর্তাবলী আইন, সেটাও আমরা করে দেব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি সেই সমালোচনাটা গঠনমূলক হওয়া উচিত। শুধু বলার জন্য বলা না। বিরোধী দল তো বলবেই, তারা সারা দিন কথা বলে, টক শো করে, টক শোতে ইচ্ছেমতো বলে যাচ্ছে, যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে, কথা বলার পরে বলবে, কথা বলার স্বাধীনতা দেয়নি। স্বাধীনতা ছিল কখন? আইয়ুুব খানের আমলে ছিল? জিয়াউর রহমানের আমলে ছিল? এরশাদের আমলে ছিল?’
বিএনপির শানসামলের উদাহরণ টেনে সরকারপ্রধান বলেন, ‘২০০১ সালের কথা একবার চিন্তা করেন, খালেদা জিয়া যখন প্রথম সরকারে এলেন, দক্ষিণাঞ্চলে কি কোনো সাংবাদিক যেতে পেরেছিল? কোনো সাংবাদিক যেতে পারেনি। সেখানে এত অত্যাচার করেছিল। সাংবাদিক নিষিদ্ধ ছিল। তাদের অপকর্ম কোনো পত্রিকা লিখতেই পারত না। যে লিখত তাকে খেসারত দিতে হতো। তখন স্বাধীনতাটা ছিল কোথায়?’
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে সংবাদপত্রের ‘ব্যাপক বিকাশ’ ঘটেছে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা সরকার গঠন করার সময় সংবাদপত্র ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। তখন অবাধে সংবাদ যাতে প্রকাশিত হতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছি।’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একসময় সাংবাদিকতা করেছেন জানিয়ে তার মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেদিক থেকে তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিবারের একজন বলে মনে করেন।
ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এবং বিপদ-আপদে আকস্মিক সহযোগিতার জন্য ভুক্তভোগী সাংবাদিক পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর ভাবনা থেকে কল্যাণ ট্রাস্ট আইন গঠন করে দেওয়ার কথাও জানান শেখ হাসিনা।
সাংবাদিকদের আবাসনের বিশেষ প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অনেককে প্লট দেওয়া হয়েছে, আবার অনেকে বিক্রিও করে দিয়েছে। সরকারিভাবে আমরা ফ্ল্যাট তৈরি করেছি, কিছু টাকা জমা দিয়ে, কোনোটা ১৬ বছর, কোনোটা ২৬ বছর ধীরে ধীরে টাকা জমা দিয়ে ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যায়। সেভাবে আমরা অনেক ফ্ল্যাট তৈরি করেছি। সাংবাদিকরা চাইলে আমরা সেটা ব্যবস্থা করতে পারি। আমি সাংবাদিকদের বলব, তারা যদি ফ্ল্যাট কিনতে চান, সরকারি প্লট যেগুলো আমরা করেছি, আমরা বিক্রি করব।’
চাকরির অবসরে বেসরকারি চাকরিজীবীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা তুলে ধরে সরকারপ্রধান রাজনীতিবিদের সঙ্গে সাংবাদিকের জীবনের সাদৃশ্যও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক তাদের চাকরির কোনো স্থায়িত্ব থাকে না, বয়স্ক বা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের কোনো সুযোগই থাকে না। সরকারি চাকরিতে অবসর ভাতা পাওয়া যায়। আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য কিছু থাকে না, আবার সাংবাদিকদের জন্য কিছু থাকে না, এটা বাস্তব।’
তিনি বলেন, ‘এখন গণভবনে আছি ভালো কথা, তারপর কোথায় উঠব? আমি নিজের জন্য চিন্তা করি না, সবার জন্যই ভাবি।’
সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাদের (সাংবাদিক) বলব, আপনারা যদি কেউ ফ্ল্যাট কিনতে চান তাহলে কিস্তিতে দেব, সেভাবে আমরা ফ্ল্যাট তৈরি করে দিচ্ছি। যদি নিজেরাই ঘর করতে চান তাহলে একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেব।’
তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদসহ সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
গ্রামীণ অঞ্চলে থেকে চিকিৎসা দেওয়ার পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর : দেশের চিকিৎসাসেবার আরও উন্নতির জন্য চিকিৎসকদের গবেষণার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সঙ্গে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চিকিৎসকদের জেলা, উপজেলা পর্যায়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
গতকাল সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ডা. মিলন অডিটরিয়ামে ৭৮তম ডিএমসি ডে উদযাপন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা মেডিকেল নিয়ে আমাদের নতুন পরিকল্পনা রয়েছে। এটি আরও সুন্দর ও আধুনিক হাসপাতাল হিসেবে গড়ে উঠবে। এর কাজ খুব তাড়াতাড়িই শুরু করতে পারব।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রায় ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এদের মধ্যে বিদেশিরাও রয়েছে। প্রতিদিন পাঁচ হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। ২ হাজার ৬০০ বেডের হাসপাতালে ভর্তি থাকে চার হাজার রোগী। এজন্য আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ ও ঘাটতি রয়েছে। আমরা তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছি। সব হাসপাতাল আধুনিকায়ন করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া, ঢামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শফিকুল আলম চৌধুরী, হাসপাতালটির পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকসহ আরও অনেকে। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন ঢামেক অ্যালামনাই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. জুলফিকার রহমান খান।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীনে থাকা ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’-এর যে ওয়েবসাইট থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে, সেটি ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ফলে এসকিউএল ইনজেকশনের মাধ্যমে ওই সব তথ্য ফাঁস হয়েছে। এ ছাড়া ওয়েবসাইটটির নিরাপত্তায় নিয়মিতভাবে ভিএপিটি (দুর্বলতা মূল্যায়ন এবং অনুপ্রবেশ পরীক্ষা) করেনি কর্র্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় থেকে তাদের চিঠি দেওয়া হলেও তারা গুরুত্ব দেয়নি। এদিকে ফাঁস হওয়া তথ্য ডার্ক ওয়েবে বিক্রির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে যাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে, তারা দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ও পুলিশের সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা প্রকৃত ঘটনা তদন্তে কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান বিটক্র্যাক সাইবার সিকিউরিটির গবেষক ভিক্টর মারকোপাওলোস বাংলাদেশের লাখ লাখ নাগরিকের তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি সামনে আনেন। তার তথ্য অনুযায়ী ব্যক্তির নাম, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), মোবাইল ফোন নম্বর, পেশা ও ঠিকানা ফাঁস হয়। এর পরই নড়েচড়ে বসেন সরকারের দায়িত্বশীলরা। আইসিটি বিভাগ একটি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করে। সেই বিশেষজ্ঞ দল গত রবিবার সকালে ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ ওয়েবসাইট থেকে এনআইডির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। তবে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যদের ধারণা, ওয়েবসাইটটি থেকে এনআইডির তথ্যভান্ডারে ঢুকে তথ্য সংরক্ষণ করেছে অনেকে। কেননা ওই ওয়েবসাইটে ঢুকে পাবলিক সার্চ টুল ব্যবহার করলে সরাসরি এনআইডির তথ্যভান্ডার থেকে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সামনে চলে আসত।
ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ ওয়েবসাইটটিতে বর্তমানে অনলাইন জন্ম নিবন্ধন সংখ্যা ১৬ কোটি ৮০ লাখ (১০০%) এবং মৃত্যু নিবন্ধনের সংখ্যা ৯২ লাখ ৫৪ হাজার। অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্ম নিবন্ধন ১ কোটি ৩৯ লাখ এবং হার ৮৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর তথ্য থাকা এ ওয়েবসাইটটির তথ্য ফাঁস হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে আইসিটি মন্ত্রণালয়ের গঠন করা বিশেষজ্ঞ দলে থাকা তথ্যপ্রযুক্তিবিদ তানভীর হাসান জোহা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন’ ওয়েবসাইটে দুর্বলতা ছিল, দীর্ঘদিন ধরে এখানে অবহেলা হয়েছে। এখানে একটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, সেই সচেতনতাই তাদের নেই। তারা (কর্র্তৃপক্ষ) কখনো এটা আমলেই নেয়নি যে এর ফলাফল কী হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডেটাবেইসে এসকিউ ইনজেকশন করা যাচ্ছিল। এটা একটি ওয়েবসাইটের দুর্বলতা। সব ওয়েবসাইটের নিরাপত্তায় ভিএপিটি (দুর্বলতা মূল্যায়ন এবং অনুপ্রবেশ পরীক্ষা) করতে হয়, আইটি অডিট করাতে হয়। এগুলো যদি করা হতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। তারা একটি ওয়েবসাইট করেছে, অথচ সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) চেক করেনি।’
তিনি বলেন, ‘ওয়েবসাইটটির দুর্বল পোর্টগুলোকে ঠিক করা হয়েছে, কিন্তু যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। নিরাপত্তার বিষয়ে অতীতে মন্ত্রণালয় থেকে জানতে চেয়ে তাদের অনেকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্র্তৃপক্ষ সেই চিঠি ফেলে রেখেছে। তারা কোনো অভিযোগ দেয়নি। তাহলে সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?’
ডার্ক ওয়েবে তথ্য বিক্রির আশঙ্কা : ফাঁস হওয়া এসব তথ্য একাধিক ডার্ক ওয়েব বা চোরাগোপ্তা সাইটে বিক্রি করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা সংশ্লিষ্টরা। এতে ভুক্তভোগী ব্যক্তির নাম-পরিচয় ব্যবহার করে তার আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘিœ করার চেষ্টাও চালানো হতে পারে।
ফাঁস হওয়া তথ্যে ঝুঁকি বাড়বে : তথ্য ফাঁসের ফলে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়েই নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়েছে। সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের যেসব ব্যক্তির তথ্য ফাঁস হয়েছে, তাদের সহজেই চিহ্নিত করে খুব সহজেই যেকোনো ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব। যেমন পেশাভিত্তিক মানুষকে বা টার্গেট গ্রুপকে সিলেক্ট (নির্বাচন) করে তাদের বিভিন্ন ধরনের মেসেজ অথবা তথ্য পাঠিয়ে বিভিন্ন কাজে প্রলুব্ধ করা সম্ভব। ই-মেইল অ্যাড্রেস পাওয়ার ফলে ই-মেইলের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং লিংক পাঠিয়ে তাদের ব্যাংকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট খুব সহজেই হ্যাক করা যায়। এ ছাড়া ফাঁস হওয়া তথ্য ব্যবহার করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও গুগলে কোটি কোটি ফেইক আইডি তৈরি করা সম্ভব, যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। যেমন ফাঁস হওয়া তথ্য ব্যবহার করে কাউকে সহজেই জিম্মি করা যাবে। কোনো ব্যক্তির এসব তথ্য জানার পর তার রেফারেন্স ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট বা তার আশপাশের যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে খুব সহজেই প্রতারণা করা সম্ভব।
পুলিশের ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তথ্য ফাঁস হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে যারা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করেন, তাদের ঝুঁকি বেশি বাড়বে। কেননা হ্যাকাররা পাসওয়ার্ড চুরি করে ওই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট (হিসাব) থেকে অর্থ চুরি করতে পারে। এ ছাড়া যারা নিয়মিত অনলাইনে কেনাকাটা করেন এবং পণ্যের দাম এমএফএসের মাধ্যমে (মোবাইল ব্যাংকিং) পরিশোধ করেন, তারাও ঝুঁকিতে পড়বেন। কোনো ব্যক্তির ফাঁস হওয়া তথ্য দিয়ে তার নামে ক্রেডিট কার্ড তুলে নিতে পারে হ্যাকাররা। ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করে টাকাও পাচার করে নিতে পারে তারা।
এই পরিস্থিতিতে করণীয় জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মনিরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখন প্রধান কাজ হচ্ছে সার্ভার থেকে কাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে, তা চিহ্নিত করা। যাদের তথ্য ফাঁস হয়েছে সেই ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা অবগত করা। তাদের জানাতে হবে আপনার এসব তথ্য ফাঁস হয়েছে, এসব তথ্য দিয়ে এ ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম হতে পারে আপনি সতর্ক থাকেন।
তথ্য ফাঁস হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তথ্য ফাঁস হওয়া নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। এর সঙ্গে কেউ জড়িত আছে কি না, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার ইউনিট ও সিটিটিসির (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) সাইবার উইনিট ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।’
ভূমি মন্ত্রণালয়ের গণবিজ্ঞপ্তি : নাগরিক তথ্য ফাঁস প্রসঙ্গে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এখন পর্যন্ত ভূমিসেবাসংক্রান্ত সিস্টেম থেকে নাগরিক তথ্য ফাঁসসংক্রান্ত কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশন অথবা আইসিটি বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি বলে দাবি করা হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে। গতকাল সোমবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আব্দুল্লাহ আল নাহিয়ান স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নাগরিক তথ্য বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ অবস্থায়, ভূমিসেবা গ্রহণে জাতীয় পরিচয়পত্র সিস্টেমের কারিগরি বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে গতকাল বৈঠক করে। এখন পর্যন্ত ভূমিসেবাসংক্রান্ত সিস্টেম থেকে নাগরিকদের তথ্য ফাঁসসংক্রান্ত কোনো তথ্য নির্বাচন কমিশন অথবা আইসিটি বিভাগ থেকে পাওয়া যায়নি।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ভূমি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করছে যে ভূমিসেবা ডিজিটাইজেশন কার্যক্রমে ডেটা নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা হয় এবং এর পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা শুরু থেকেই বিদ্যমান।
হু হু করে জনসংখ্যা বাড়ছিল সত্তর ও আশির দশকে। নব্বইতে এসেও তা বহাল ছিল। রাষ্ট্রীয় নীতি বদলাচ্ছিল একের পর এক। ছোট দেশ, মানুষ বেশি হয়ে গেলে মুশকিল! তাই পলিসি মেকাররা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকেই মোক্ষম অস্ত্র মনে করেছিলেন। সেভাবেই দিয়েছিলেন দাওয়াই।
তারই ফলাফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় হার পড়তির দিকে। স্থীতিশীল থেকে বৃদ্ধিরেখার এ বাঁকবদলে ভারসাম্যহীনতাও তৈরি হচ্ছে।
বরাবরের মতো উচ্চবিত্তের জনসংখ্যা বাড়ার হার ঋণাত্মক না হলেও সমান সমান। বড় পরিবর্তন এসেছে মধ্যবিত্তে। এককভাবে না হলেও নিম্নবিত্তের সঙ্গে এ শ্রেণিও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে মধ্যবিত্তের অবস্থান বদল হয়েছে। এ শ্রেণির জনসংখ্যা বাড়ার হারও ঋণাত্মক না হলেও সমান সমান অবস্থানে রয়েছে। তবে আগের মতো নিম্নবিত্ত এখনো জনসংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। আর নিম্নবিত্তের এ বৃদ্ধিই সমাজে নতুন করে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা ডেকে আনছে। বৃদ্ধির হার বজায় রেখে তারা সামাজিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জগতেও নেতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।
পপুলেশন সায়েন্টিস্ট এবং ইকোনমিস্টরা মনে করেন, একটা সময় নীতিনির্ধারকরা জনশক্তিকে হুমকি হিসেবে দেখেছিলেন। সে সময় অনেক অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। বারবার নীতিবদল করে বিষয়টি কার্যকর রাখা হয়েছে। একটি সময় সেøাগান ছিল ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তান যথেষ্ট’। পরে আরও কঠোর নীতি নিতে হয়েছিল সরকারকে। এর পরের সেøাগান ছিল ‘একটি হলে দুটি নয়’। এসব কার্যক্রমেরই ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ। যাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য এত চেষ্টা, সেই জনগণ এখন দেশের জন্য বড় শক্তি। কিন্তু তাদের কাজে লাগানো যায়নি। জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করা যায়নি।
দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে কিন্তু শতকরা বৃদ্ধির হার কমেছে। অর্থাৎ ১৯৮১ সালে যে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ছিল, ২০২২ সালের সবশেষ শুমারিতে তা কমে অর্ধেকের নিচে নেমেছে। ১৯৭৪ সালের প্রথম আদমশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখের বেশি। ১৯৮১ সালের শুমারিতে বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ১৯৯১ সালে তা আরও কমে হয়েছে ২ দশমিক ০১। ২০০১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫৮ এবং ২০১১ সালে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০২২ সালের জনশুমারিতে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ২২ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেমোগ্রাফিক প্যারামিটারে বিবেচনা করলে দেখা যায়, নিম্নবিত্তদের মধ্যে শিক্ষার হার কম। স্বাস্থ্য, মৃত্যু এবং শিক্ষা এ জায়গাগুলোতে নিম্নবিত্তদের মাঝে বেশি। ধনিকশ্রেণির মধ্যে মৃত্যুহার কম, তাদের মধ্যে শিক্ষার হার বেশি। এখন দেখার বিষয় শিক্ষার সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক, পেশার সম্পর্ক বা উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। জনসংখ্যার উপাদানগত অবস্থান থেকে দেখা যায়, ধনিকশ্রেণি ভালো অবস্থানে আছে। যারা দরিদ্র শ্রেণি তারা খারাপ অবস্থানে আছে। খারাপ অবস্থানে থেকেও মানুষ ভালো করছে, যেমন কৃষিকাজ। কৃষকের মধ্যে চাষ করার প্রাকৃতিক জ্ঞান রয়ে গেছে। কৃষিকাজে তিনি উপার্জন করে অনেকের চেয়ে বেশি আয় করেন। অনেক আছে শিক্ষা নেই কিন্তু আয় কয়েক লাখ টাকা। সাংস্কৃতিক জায়গা থেকে নিম্নবিত্তদের উত্থানে অনেক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে। দেখতে হবে সামাজিকীকরণটা কোথায় হচ্ছে। তবে ডেমোগ্রাফিক জায়গা থেকে দেখতে গেল, সম্পদের বিবেচনায় নিম্নশ্রেণির মানুষদের মধ্যে জন্মহার বেশি। যারা নিম্নবিত্ত আছেন, তাদের জন্মহার যাতে না বাড়ে, সে বিষয়ে কৌশল নিতে হবে।
জনসংখ্যা বাড়ার বিষয়টি নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর। জন্মহার, মৃত্যুহার এবং স্থানান্তর। এ তিন কারণে যেকোনো দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ভর করে। দেখা গেল একটি দেশে অনেক মানুষ জন্ম নিল, কিন্তু কোনো বিপর্যয় বা যুদ্ধে মারাও গেল অনেক মানুষ, তাহলে জনসংখ্যা বাড়বে না। জন্মহার বেশি, মৃত্যুহার কম হলে জনসংখ্যা বাড়ে। এখানে স্থানান্তর হলেও প্রভাব পড়ে। অনেক মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেল অথবা অনেক মানুষ অন্য দেশ ছেড়ে এ দেশে চলে এলো, এটাও জনসংখ্যা বাড়া বা কমার ওপর প্রভাব ফেলে।
মধ্যবিত্ত সবসময়ই উচ্চবিত্তকে অনুসরণ করেছে। এ শ্রেণি উচ্চবিত্তকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিম্নবিত্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আর এ বিচ্ছিন্নতার সুযোগে নিম্নবিত্তের আলাদা সাংস্কৃতিক বলয় জোরালো হয়েছে। রুচির দুর্ভিক্ষ বলে দূরে ঠেলার চেষ্টা করলেও ওই সাংস্কৃতিক বলয় বিস্তৃত হচ্ছে। সাংস্কৃতিক বলয় ছেড়ে তারা রাজনীতিতেও অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের নয়নপুর গ্রামের ইরফান আলী ১০ বছর ধরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দুই সন্তানের জনক ইরফান যে বেতন পান, তাতে সংসার চললেও সঞ্চয় নেই। তার প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কাশি হলেও চলে যান সিঙ্গাপুরে। সেখানেই শপিং করেন। তিনি এক সন্তানের জনক।
ইরফানেরই চাচাতো ভাই শফিকুল ইসলাম গ্রামের দিনমজুর। চার সন্তানের জনক। যেদিন শ্রম দিতে পারেন না, সেদিন খাবার জোটানো মুশকিল হয়ে পড়ে।
ইরফানের সঙ্গে শফিকুলের পৈতৃক জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে। সেগুলো নিয়ে স্বাভাবিক কথাবার্তায়ও শফিক তার সন্তানদের অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করায়। ইরফানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। ইরফানও তার দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ জায়গা থেকে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা স্পষ্ট হচ্ছে। দেশের মানুষের সংস্কৃতি ও রুচিরও পরিবর্তন হয়েছে। সমাজে মধ্যবিত্তদের প্রভাব কমে যাচ্ছে, নিম্নবিত্তরা সমাজে আলাদাভাবে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করছেন। রাজনীতিতেও তাদের দেখা যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের অনীহায় সুযোগ পেয়েছেন তারা। মধ্যবিত্তরা বেশিরভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকেন নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে। আর উচ্চবিত্তরা রাজনীতিতে এলেও সেটি নিজেদের আখের গোছানোর জন্য। বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে তাদের মাধ্যমেই। যেসব উচ্চবিত্ত রাজনীতিতে জড়িয়েছেন, তাদের অনেকেই জনকল্যাণের চেয়ে জনহুমকির উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।
ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমছে। দেশগুলোতে এখন আয়ের বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে। এদিক থেকে বাংলাদেশ এখনো স্বর্ণযুগে অবস্থান করছে। কেননা বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে কমলেও গত এক যুগে বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়েছে সোয়া দুই কোটি। এমন সুযোগ যেকোনো জাতির ভাগ্যে একবারই আসে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কর্মক্ষমতার ইতিমধ্যে ১০ বছর চলে গেছে, সেটিকে বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারেনি।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ কাজে লাগাতে পারিনি। আগের ১০ বছর চলে গেছে। আগামী ১০ বছরেও কতটুকু কাজে লাগাতে পারব সেটি দেখার বিষয়।’ তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মানসম্মত শিক্ষা। এটাকে পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ এবং যে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে নিতে হবে। যারা যুবসমাজকে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারাই শক্তিশালী হয়েছে। এ জনমিতিক লভ্যাংশ পেতে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতার ওপর জোর দিতে হবে। দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে শিক্ষার মানের দুর্বলতা বেশি। এর ফলে ডিভিডেন্ড আসা তো দূরের কথা, বরং উল্টো বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।’
দেশে উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্য বাড়ার বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা যে বক্তব্য দিয়ে আসছেন, তার প্রমাণ মেলে পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের জরিপেই। শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের আয় ও ব্যয়, সবই কম। তবে শহরে আয় বৈষম্য বেশি, গ্রামের পরিস্থিতি তুলনামূলক কিছুটা হলেও ভালো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত গত ১২ বছরে তিনটি খানা জরিপের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য বেড়েই চলছে। বাংলাদেশ এখন চরম আয় বৈষম্যের দিকে যাচ্ছে।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেশে একদিকে চরম দারিদ্র্যের হার কমেছে, অন্যদিকে আয় বৈষম্যও বেড়েছে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে মজুরি বাড়ানোর যে সক্ষমতা, সেটি আমরা বাড়াতে পারিনি। আয় বৈষম্য কমানোর দিক হতে পারে, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মাধ্যমে। সারা বিশে^ আয় বৈষম্য কমানোর একটি বড় উপায় হলো এই ট্যাক্সেশন বিশেষত প্রত্যক্ষ কর। আমাদের দেশে কর আদায় কম, ঋণখেলাপি, টাকা বাইরে নিয়ে যাওয়া এগুলো আয় বৈষম্য, ভোগ বৈষম্য এবং সম্পদ বৈষম্য বাড়াচ্ছে।’
বাংলাদেশে গত ১২ বছর ধরে মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট-টিএফআর) স্থিতাবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে এ হার ২ দশমিক ৩। অর্থাৎ এ সময় ধরে একজন ১৫-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারী তার জীবদ্দশায় গড়ে দুটি করে সন্তান প্রসব করছেন।
অন্যদিকে প্রজনন হার স্থির থাকলে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ মানুষ মোট জনসংখ্যায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ আদমশুমারি-২০২২ তথ্য অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যার আকার বেড়ে এখন ১৭ কোটির মতো হয়ে গেছে। এরপর আরও এক বছর গেছে। এখন ২০২৩ সালে এসে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৩০ লাখের মতো। যদি চলমান প্রজনন হার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এভাবে চলমান থাকে, তাহলে এ জনসংখ্যা ২০৩০ সালে হয়ে যাবে ১৮ কোটি ৪০ লাখের মতো। আর ২০৫০ সালে হয়ে যাবে ২০ কোটি ৪০ লাখের মতো।
মোট প্রজনন হারের এ স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে ও বর্তমান অনুপাতে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে একসময় দেশে শিশু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমবে ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে জনসংখ্যার স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য ২০৬৫-৬৬ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এরপর জনসংখ্যা কমতে থাকবে। তখন মোট প্রজনন হার কমে ১-এর নিচে চলে আসবে। সেটা হলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও কমে যাবে। বয়স্ক বা বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
দেশের জনসংখ্যার এ চিত্রকে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার ‘গোলমেলে অবস্থা’ বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এএসএম আতীকুর রহমান। তিনি গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যার সমস্যা হলো এটার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। জনসংখ্যাকে ধরতে হবে আন্তর্জাতিক জনসংখ্যা হিসেবে। কিন্তু এখানে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা গোলমেলে। বর্তমানে পররাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতি অর্থনৈতিককেন্দ্রিক। সেই ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনসংখ্যা উৎপাদনশীল সম্পদে পরিণত করতে হবে।
দেশের জনসংখ্যাকে গুণগত আকারে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে কোনোভাবেই হোক টিএফআর ২ দশমিক ১-এ ধরে রাখতে হবে। টিএফআর যেভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে, এ অবস্থায় থাকলে জনসংখ্যার আকার আরও বাড়বে। গত এক দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৩ শতাংশ (জনস্বাস্থ্য জরিপ অনুযায়ী) হয়েছে। সেখানে টিএফআরও বেড়ে গেছে। এখন যদি পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার না বাড়ে, বাল্যবিয়ে ও কিশোরী মাতৃত্ব না কমে, তাহলে এই টিএফআর হার একই জায়গায় থাকবে বা বেড়ে যাবে। বেড়ে গেলে জনসংখ্যার আকার আরও বেড়ে যাবে।
স্থির হয়ে আছে টিএফআর : বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, টিএফআর সমগ্র প্রজনন হার। এর অর্থ ১৫-৪৯ বছর বয়স পর্যন্ত একজন বিবাহিত নারী তার জীবদ্দশায় গড়ে কয়টা করে সন্তান প্রসব করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে এ হার ২ দশমিক ৩। ১৯৭৪-৭৫ সালে টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৪। এখন ২ দশমিক ৩-এ এসে পৌঁছেছে। ২০১১ সাল থেকে টিএফআর একই জায়গায় স্থিতাবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ টিএফআর কমছে না। ২০২২ সাল পর্যন্ত স্থির হয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে দেশের পপুলেশন গ্রোথ রেট বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। যেটা আগে একসময় ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ ছিল। এর মাধ্যমে জানা যায়, প্রতি বছর প্রতি ১০০ জনে কতজন মানুষ নতুন করে যুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর এটা ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ ছিল। সেটা এখন কমতে কমতে ১ দশমিক ২২ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০১১ সালে ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। তার মানে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ মানুষ নতুন করে যুক্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা দেশের জনসংখ্যা কমাতে টিএফআর কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান হার কমাতে হলে প্রথমত টিএফআর কমাতে হবে। এখন যেটা ২ দশমিক ৩ আছে, সেটা ২ দশমিক ১-এ নিয়ে আসতে হবে। এটাই হবে প্রতিস্থাপনযোগ্য জনসংখ্যার প্রজনন হার। একটা প্রজন্মকে আরেকটা প্রজন্মে আদর্শগতভাবে প্রতিস্থাপন করতে হলে, এই টিএফআর লাগবে। অর্থাৎ একটা পরিবারে দুটি করে সন্তান থাকতে হয়।
এ বিশেষজ্ঞ বলেন, টিএফআরের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে বড় সমস্যা বাল্যবিয়ে ও কিশোরী মাতৃত্ব। বাল্যবিয়ে থাকার কারণে দ্রুত সন্তান হয়ে যাচ্ছে। ১৫-১৯ বছরের মধ্যে মেয়েরা মা হয়ে যাচ্ছে। মোট প্রজনন হারের প্রায় ২৫ শতাংশই ঘটছে এ কিশোরী মাতৃত্ব থেকে। কিন্তু টিএফআর যদি ২ দশমিক ১-এর নিচে নেমে যায়, তাহলে জাপান ও চীনের মতো বাংলাদেশেও বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে।
বয়স্ক মানুষ নিয়ে উদ্বেগ : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, এখন দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এদের বয়স ১৫-৬৪ বছর। ২০৩৬-৩৭ সাল পর্যন্ত এ কর্মক্ষম শ্রেণির জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতার হার অনুকূলে থাকবে। এরপর বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তখন এ গোষ্ঠীর থেকে সুবিধা নিতে হলে এ জনসংখ্যাকে কাজে লাগাতে হবে, কর্ম দিতে হবে। এজন্য পরিবার পরিকল্পনার সুবিধা দিতে হবে, যাতে কিশোরী মাতৃত্ব ও বাল্যবিয়ে না হয়। এটা করা গেলে একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী শ্রমবাজারে যাবে। অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। মাতৃমৃত্যু কমে আসবে।
এ বিশেষজ্ঞ জানান, দেশের শ্রম বাজারের প্রায় ৩৩ শতাংশ মানুষ ৬৫ বছরের ঊর্ধ্ব। তাদের কর্মক্ষম ও সুস্বাস্থ্য রাখতে হবে। এখন থেকেই গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। শ্রমবাজারও পরিবর্তন হবে। তাদের টেকনোলজির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
প্রবীণ জনগোষ্ঠী নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান। তিনি বলেন, দেশে অতি প্রবীণদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের জন্য লং টার্ম কেয়ার, প্যালিয়েটিভ কেয়ারসহ অন্য কোনো সুবিধা নেই। প্রবীণ জনগোষ্ঠী পরিবারেই থাকবে। কিন্তু এখানে তাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম করা হয়েছে। অথচ দরকার ওলড হোম।
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২১-২০৩০ সালকে বলছে ‘ডিকেড অব হেলথি এজিং’ বা ‘শক্তিময় বার্ধক্যের দশক’। বুড়ো মানুষকে শারীরিক দিক থেকে কর্মক্ষম রাখা যায় আর যদি বাইরের পরিবেশ প্রবীণদের অনুকূলে রাখা যায়, সেটা শক্তিময় বার্ধক্য। এটার জন্য বাংলাদেশে কোনো প্রস্তুতি নেই। প্রবীণ জনসংখ্যার জন্য যা কিছু পাওয়া গেছে, সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান। যেমন বয়স্ক ভাতার কর্মসূচি, প্রবীণদের জন্য নীতিমালা ও আইন ও সার্বজনীন সামাজিক পেনশন।
উদ্যোগে ঘাটতি : জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনসংখ্যার সঠিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের তেমন ভাবনা-চিন্তা নেই। জাতীয় জনসংখ্যা নীতি-২০১২ বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু গত ১২ বছরে এর কোনো সভা হয়নি। জনসংখ্যা নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা কী, সেটা স্পষ্ট না। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পপুলেশন কাউন্সিলের বছরে দুটি করে সভা করার কথা। একটা সভাও হয়নি। অর্থাৎ জনসংখ্যাকে ‘গুণগত মানুষ’ হিসেবে তৈরি করার কোনো কর্মপরিকল্পনা নেই। প্রতি বছর দুই-তিন মিলিয়ন মানুষ শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। তাদের কীভাবে স্থানীয় শ্রমবাজারে যুক্ত করতে হবে, সেটার পরিকল্পনা নেই। প্রচুর শিক্ষিত বেকার পড়ে আছে। হিউম্যান ক্যাপিটাল সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যমমানে, দশমিক ৫। চীন সর্বোচ্চ স্থানে দশমিক ৭-এ। শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের চেয়ে ওপরে। ফিলিপাইনের জনসংখ্যা বাংলাদেশের চেয়ে কম। কিন্তু তাদের রেমিট্যান্স এখানকার চেয়ে বেশি। কারণ তারা দক্ষ মাইগ্রেন্ট তৈরি করেছে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা না থাকলে জনসংখ্যাকে কাজে লাগানো যাবে না। জীবনের গুণগত জায়গায় যেতে হবে। জেন্ডার সমতা আনতে হবে। কর্মকৌশল নিতে হবে।
আদমশুমারির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন : সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারিতে উঠে আসা বিভিন্ন তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব বিশেষজ্ঞ বলেন, এবারের আদমশুমারির পুরো প্রতিবেদনের তথ্য খুবই আশ্চর্যজনক। গ্লোবাল হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ছিল। এবার হয়তো প্রবীণ জনগোষ্ঠী ১ কোটি ৫০ লাখের মতো। কিন্তু আদমশুমারিতে দেখা গেল সেটা প্রায় দুই কোটি হয়ে গেছে। আমরা মনে করেছিলাম বার্ধক্য জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ ৬০ বছর-উর্ধ্ব জনসংখ্যা ৮ শতাংশের মতো হবে, কিন্তু সেটা দেখানো হচ্ছে ১২ শতাংশ। এসব তথ্যে তারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
তামিম ইকবাল দলে না থাকাতে যেন অনেকেরই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে! আবার বিশ্বকাপের দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অন্তর্ভুক্তিতেও অনেকের চোখ কপালে! দল ঘোষণার পর যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা এলেন সংবাদ সম্মেলনে, তখন আলোচনায় শুধু ছিলেন এই দুজনেই। তাদের এই বিরহ বেদনায় চাপা পড়ে যায় অনেক প্রশ্ন। লিটন দাসকে বাদ দিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত কেন সহ-অধিনায়ক! বাড়তি কোনো ওপেনার ছাড়া কিংবা পাঁচ পেসারকে নিয়ে কেন দল গড়া?
প্রায় মিনিট পনেরোর সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে এসেছে একই প্রশ্ন। প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নুও ঘুরেফিরে বন্দী ছিলেন একই কথার বৃত্তে। প্রশ্নোত্তর শেষে বেরিয়ে যান তিন নির্বাচক। যেতে যেতে কথা হয় তাদেরই একজন হাবিবুল বাশারের সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল চাপা পড়া সেইসব প্রশ্নের উত্তর।
শুরুতেই জানতে চাওয়া হয় লিটনকে বাদ দিয়ে শান্তকে কেন সহ-অধিনায়ক করা হয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যৎ একটা কারণ। আর লিটনের অনাগ্রহও তাকে নেতৃত্ব থেকে সরানোর একটি কারণ। লিটন নিজেও চায় না নেতৃত্বের চাপ নিতে। সে একটু ব্যাটিংয়ে বেশি মনোযোগ দিতে চায়।’
বিশ্বকাপ দলে বিকল্প ওপেনার না থাকার কারণও জানা গেল এই নির্বাচকের কথায়। তিনি জানালেন, ‘আমরা ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে মিরাজকে ভাবছি।’
বিকল্প ওপেনার হিসেবে বিশেষজ্ঞ কাউকে না নেওয়ায় একজন বাড়তি বোলার দলে রাখার সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলে শেখ মেহেদি হাসান সুযোগ পেয়েছেন সে কারণে। পাশাপাশি জায়গা হয়েছে পাঁচ পেসারেরও। এর পেছনে বাশার ভারতের কন্ডিশনের কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ভারতে এখন আর্লি সিজন। উইকেট সতেজ থাকবে। স্বাভাবিকভাবেই পাঁচজন পেসার দরকার হবে।’
যেতে যেতে আরও বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক মুখোমুখি হলেন, এই দলটা বিশ্বকাপে কেমন করবে? এই প্রশ্নটা শুনেই ঘুরে দাঁড়ালেন হাবিবুল। উত্তরে মজা করে বললেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হবে এই দল।’ এরপর একটু গাম্ভীর্য ফিরিয়ে এনে যোগ করলেন, ‘আমি এদের অনেক দিন ধরে দেখছি। ওরা কয়টা ম্যাচ জিতবে জানি না। তবে বিশ্বকাপে প্রতিটি দলকে ভোগাবে, এটা জানি।’
পুলিশের পদোন্নতির তালিকায় থাকা পদ কাটছাঁট করায় অসন্তোষ কমছে না। এ নিয়ে পুলিশ কর্তারা একাধিক বৈঠক করছেন। প্রধানমন্ত্রী দেশে এলে পদোন্নতি নিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। পুলিশের অসন্তোষ ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ উদ্যোগও নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিকেলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে পদোন্নতির পদ আরও বাড়াতে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। চিঠি পেয়ে জনপ্রশাসনও কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, পদোন্নতির সংখ্যাটি প্রধানমন্ত্রী ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কাটছাঁট করে পুলিশকে বিব্রত করেছে। অন্য ক্যাডাররা একের পর এক পদোন্নতি পেলেও পুলিশ পিছিয়ে আছে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিব আশ্বাস দিয়েছেন, বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।
এদিকে ক্যাডারদের পাশাপাশি নন-ক্যাডারদেরও পদোন্নতির বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। ইতিমধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরদের পদোন্নতির উদ্যোগ নিতে পুলিশ সদর দপ্তর বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পদোন্নতির তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তিন দিন আগে পদোন্নতি পেতে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ওই সময় রাজধানীর ৫০ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতির বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পুলিশের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা কাজ করছি। যাদের পদোন্নতি পাওয়ার যোগ্যতা আছে তারা অবশ্যই পদোন্নতি পাবেন। বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির পদ বাড়াতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করি শিগগির বিষয়টি সুরাহা হবে। নন-ক্যাডারদের কর্তারাও কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাদের বিষয়টিও সমাধান হবে বলে আশা করছি।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার পুলিশের জন্য যা করেছে, অতীতের কোনো সরকারই তা করেনি। পুলিশের কারণে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুুলিশের পদোন্নতির তালিকা কাটছাঁটের বিষয়ে গত মঙ্গলবার আইজিপিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রের সিনিয়র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওইদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পুলিশের পদোন্নতির বিষয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নুর-এ- মাহবুবা জয়া।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষাবাহিনী প্রধানতম বাহিনী, যা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত। নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, পেশাদায়িত্ব ও শৃঙ্খলা রক্ষায় তদারকি ও ব্যবস্থাপনা এ বাহিনীর নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুলিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানে পুলিশ সুপার থেকে তদূর্ধ্ব পদে পর্যাপ্তসংখ্যক পদ এবং দক্ষ জনবল থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক (গ্রেড-৩) ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (গ্রেড-২) তুলনামূলক কম। বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামোর আলোকে (বিদ্যমান পদে অতিরিক্ত) অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে উপপুলিশ মহাপরিদর্শক এবং উপপুলিশ মহাপরিদর্শক হতে অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদোন্নতি দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হবে। প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি প্রদানের জন্য পদ সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিদ্যমান পদের অতিরিক্ত সুপারনিউমারারি পদ রাজস্ব খাতে অস্থায়ীভাবে সৃজনের প্রস্তাবে পদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) থেকে পুলিশ সুপার (এসপি) পর্যন্ত ৭২০ কর্মকর্তার পদোন্নতি পেতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। তালিকাটি সংশোধন করতে ফেরত পাঠায় মন্ত্রণালয়। পরে পুলিশ সদর দপ্তর ৫২৯টি পদ চূড়ান্ত করে আরেকটি তালিকা পাঠায়। সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দিতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ১ আগস্ট এ প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় তালিকা কাটছাঁট করেছে। অতিরিক্ত আইজিপি পদে দুজন, ডিআইজি পদে ৫০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে ১৪০ ও পুলিশ সুপার পদে ১৫০ জনকে পদোন্নতি দিতে ১৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন। পুলিশের তালিকায় ছিল অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-১) ১৫, অতিরিক্ত আইজিপি (গ্রেড-২) ৩৪, ডিআইজি ১৪০, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৫০ ও এসপি ১৯০ পদে পদোন্নতি দিতে। এ তালিকা কাটছাঁট হওয়ায় পুলিশে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এ অসন্তোষ এখনো অব্যাহত আছে। অসন্তোষ ঠেকাতে আবার জনপ্রশাসনকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি দ্রুত সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশে সংখ্যাতিরিক্ত (সুপারনিউমারারি) পদোন্নতিতে অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি ও এসপি পদে পদোন্নতির নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৫২৯টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করতে গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। পদোন্নতির বিষয়ে সিগন্যাল আসার পর ২০ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে এ-সংক্রান্ত একটি সভা হয়েছিল। সভায় অতিরিক্ত সচিবসহ (পুলিশ ও এনটিএমসি) পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
তিনি বলেন, পুলিশে বর্তমানে একজন অতিরিক্ত আইজিপির পদ খালি রয়েছে। সুপারনিউমারারি পদে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। ১৮, ২০, ২১, ২২ ও ২৪তম ব্যাচের প্রায় সবাই ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি ২৭, ২৮ ও ২৯তম ব্যাচের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের এসপি হিসেবে পদোন্নতির বিষয়টি আমলে নেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নন-ক্যাডাররা পদোন্নতি পাবেন। সাব-ইন্সপেক্টর থেকে ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টর থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি দেওয়া হবে। আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সুপারনিউমারারি পদে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতোই নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা হবে। ইন্সপেক্টর থেকে এএসপি পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কারা পাবেন তার তালিকা তৈরি হতে পারে।
বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ছিল পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) ১০ বছর পূর্তিতে ষষ্ঠ গ্রেড দেওয়া। ১০ বছর পূর্তিতে ব্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রেড পরিবর্তন করা। ১০ বছরের মধ্যে পদোন্নতি না হলে সুপারনিউমারারি পদে পদোন্নতি দেওয়া। সাব-ইন্সপেক্টরদের (এসআই) ক্ষেত্রেও একই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে এসআই/সার্জেন্ট পদটি দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাদের র্যাংক ব্যাজের নীল বা লাল ফিতা তুলে নেওয়া। কনস্টেবলদের বিভাগীয় পরীক্ষায় একবার পাস করলে সেখান থেকে প্রমোশন লিস্ট করে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে মন্ত্রীর কাছে।’
গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত অভিযোগে দেশের কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টা বক্তব্য দিতেও শুরু করেছে। এতে বিরোধীপক্ষেরই ঝুঁকি দেখছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই সবপক্ষই চাপে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থান নিয়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা হলেও মূলত নির্বাচনী রাজনীতিতে এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। একপক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলেও সেই পথ থেকে তাদেরও সরতে হবে। আবার সরকারপক্ষ যেনতেন নির্বাচন করে ক্ষমতায় বসে যাবে সেই সুযোগও থাকছে না। যে যাই বলুক নির্বাচনী রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে এ পরিবর্তন আসতেই হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সবপক্ষের জন্য। তাদের অবস্থানে বিএনপি উৎফুল্ল হয়ে যাবে, আর আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয়ে যাবে ব্যাপারটা এমন নয়। বরং এতে এক ধরনের সমাধানের পথ খুলে যেতে পারে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ না দিলেও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হবে এমন আভাস দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আসছে। তাদের একাধিক প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করে সরকার ও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে সমর্থনের কথা জানিয়ে গত ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। যার প্রয়োগের কথা জানানো হলো গত শুক্রবার।
এর আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা ও র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তার অনড় অবস্থানের বিষয়টি আবার জানাল। দেশটির এ অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দেখছে দুভাবে। একটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখা। দ্বিতীয়টি হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। এর বাইরে অন্য কোনো বিরূপ প্রভাব দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, সরকার এত দিন যেটা চেয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র সেটাই আশা করছে।
তবে বিএনপি ভিসানীতির জন্য সরকারকে দায়ী করেছে এবং সেটা তাদের নেতাকর্মীদের এক দফা আন্দোলনে আরও উজ্জীবিত করবে, এমন দাবি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কারণে আগামী নির্বাচন যেনতেনভাবে হয়ে যাবে সেটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রস্তুতি সবাইকে নিতে হবে। এর বাইরে কোনো রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তা যেই হোক শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা বা একপেশে করার চিন্তা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে চাইলে, পড়তে হবে ভিসানীতির আওতায়। যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান এখন পর্যন্ত সেটাই ইঙ্গিত করে।’
সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে এক দফা দিয়ে আন্দোলনে আছে বিএনপি। অন্যদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জন্য এক দফা ঘোষণা করেছে। তারাও শান্তি-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার সরকারও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। সেটা নিশ্চিত করতে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ এটাও বলে আসছে, তাদের সরকারের চাওয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া একই।
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অনড় অবস্থানকে আওয়ামী লীগ দুভাবে দেখলেও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নানা রকম কানাঘুষা রয়েছে। ভেতরে-ভেতরে ‘ভেঙে পড়লেও’ ওপরে শক্ত মনোভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তারা বেশ বিরক্তি প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সরকার ও আওয়ামী লীগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নতুন কিছু নয়। দুপক্ষের অবস্থান একই বলেও দাবি করেন ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা।
সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যে অবস্থান তাতে বিএনপিরই ক্ষতি, কারণ তারা ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি বলেন, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা ও আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় সরকার। সেখানে সব দল নির্বাচনে আসুক সেই আহ্বানও জানানো হয়েছে।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত এবং সহযোগিতা করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই ব্যক্তিদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছেন। শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জোরালোভাবে দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র তো বিএনপির দাবি সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান সেখানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এসব বলা হয়নি। ফলে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের প্রক্রিয়া শুরু করায় আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন বেকায়দায় পড়বে? আমরা মনে করি, বিএনপিই তো বেকায়দায় রয়েছে। কারণ, তাদের দাবি অসাংবিধানিক। আর অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করছে। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই অনড় অবস্থান বিএনপির বিরুদ্ধে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খানের দাবি, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে শঙ্কিত বিএনপি। তারা তো বিএনপির একটা দাবির কথাও বলে নাই।’ সরকার বা আওয়ামী লীগ ভীত ও শঙ্কিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনাদের উচিত বিএনপির প্রতিক্রিয়া জানা।’
আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘আমরা যেমন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই, আমেরিকারও একই রকম চাওয়া।’
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কিছু করবে এটা প্রত্যাশিতই ছিল। এটা সিম্পল ব্যাপার আমাদের জন্য।’
ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় বিরোধী দল আছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যে বক্তব্য এসেছে সে সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিবৃতিতে কোন বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। তাই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তবে আজকে দেশে গণতন্ত্রের যে সংকট তার জন্য সরকার এককভাবে দায়ী। তা ছাড়া এর আগে বাইডেন প্রশাসন তাদের দেশে যে গণতন্ত্রের সম্মেলন করেছে তাতে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি।’
ভিসানীতি প্রয়োগের জন্য সরকারকে দায়ী করে তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগ বিগত দুটি বিতর্কিত সংসদ নির্বাচন করার পর আবারও আগামী নির্বাচন একতরফা করতে যে পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। আজকে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার দেশ রূপান্তরকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ আগের ঘোষণার ধারাবাহিকতা। প্রথমদিকে নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের ভেতর যে বড় ধাক্কা মনে হয়েছিল, ঘোষণা আসার পর সেটা মনে হয়নি। তবে কোনো একটা সমীকরণ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর প্রভাব কত দূর যাবে সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনে কী বার্তা যাবে সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা তাদের বৈশি^ক চর্চারই অংশ। মূল কথা হলো, এটা সবার জন্যই চাপ।’
বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে জানিয়েছেন ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর আজ শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী ব্যক্তিদের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপের পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করার ঘোষণা পর তিনি এ তথ্য জানান। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা তিনি জানাননি ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমাদের আজকের পদক্ষেপগুলি শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য এবং বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায় তাদের সমর্থন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।’
মে মাসে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে ভিসানীতির ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন ওই ঘোষণা দেন।
সামনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী নভেম্বরে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনে রদবদলের সুযোগ নেই সরকারের। তাই এর আগেই নির্বাচনী প্রশাসনে ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রশাসনে চলছে পদোন্নতি ও রদবদল। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রশাসন সাজাতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বদলি-পদায়ন হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে বড় পদোন্নতি হয়েছে। নির্বাচনের আগে অবসরে যাওয়া কয়েকজন সচিবেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের ২৬ জন, ২৫তম ব্যাচের ২০ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ১৮ জন ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিসিএসের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৫ সালে, ২৫তম ব্যাচ ২০০৬ সালে এবং ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন ২০০৮ সালে।
জানা যায়, নির্বাচনের সময় ডিসিরা জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন। তাদের যে কোনো কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ থেকে শুরু করে বাতিলের ক্ষমতাও থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও থাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা তথা ডিসির অধীনে। নির্বাচনের সময় সমন্বয়কারীর ভূমিকায়ও থাকেন ডিসিরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন তাদের দুটি ব্যাচের কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছিলেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে। আর সে সময় বিসিএস নিয়ে বেশ বিতর্ক ছিল। বিসিএসে ছিল নানা ধরনের তদবির। ২৪ ও ২৫তম ব্যাচ দুটি বিএনপির সময়ে নিয়োগ পেলেও ২৭তম ব্যাচ নিয়োগ পেয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কারণ বিএনপির শেষ সময়ে ২৭তম ব্যাচের নিয়োগে বড় ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকায় তা বাতিল হয়। পরে ফের পরীক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে এ ব্যাচের নিয়োগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল ২৪তম ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২৪তম ব্যাচের কয়েকজন কর্মকর্তাকে ডিসির পদ থেকে তুলে আনা হতে পারে। নির্বাচনের সময় যারা ডিসির দায়িত্বে থাকবেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের সবার ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে পরিবার ও নিকট আত্মীয়স্বজনদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো যাচাই করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ছাত্রজীবনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে আর ডিসির পদে রাখা হবে না।
এ ছাড়া নির্বাচনে অন্যতম ভূমিকা পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। বর্তমানে ৩৩, ৩৪ ও ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন ইউএনও পদে, যারা আসন্ন নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। এখন ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইউএনওর দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে; এ ব্যাচে প্রশাসন ক্যাডারের ২৯১ জন কর্মকর্তা রয়েছেন।
জানতে চাইলে সরকারি কর্ম কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ইকরাম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষা হয় যোগ্যতা, মেধা ও দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে ছাত্রজীবনে কে কোন পার্টি করেছিলেন, কোন দল ক্ষমতায় আছে তা বিবেচনা করা হয় না। বিসিএস কর্মকর্তাদের যে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং হয়, তাতে তাকে একজন অফিসার হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। এরপর এসিআর, সুপিরিয়রের মতামত, সুনাম, দক্ষতা, যোগ্যতার ভিত্তিতেই একজন কর্মকর্তাকে উচ্চতর পদে দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তবে সরকার যে দল পরিচালনা করে তাদের কিছু নীতিমালা ও উদ্দেশ্য থাকে। কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সরকারের নেওয়া বৈধ ও জনকল্যাণে গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা। তিনি প্রলুব্ধ হবেন না, নিরপেক্ষ থেকে তার দায়িত্ব পালন করবেন। যদি কোনো নির্বাচনী দায়িত্বও দেওয়া হয়, সেটাও নিরপেক্ষভাবে তিনি পালন করবেন।’
গত মে মাসে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জনের পদোন্নতি হয়। জুলাই মাসে পাঁচ বিভাগে নতুন বিভাগীয় কমিশনার দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসেই বদলি ও নতুন মিলিয়ে ৩০টি জেলায় ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উপসচিব পদমর্যাদার এই ডিসি পদে এবারও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আটজন পিএসকে পদায়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ৪ সেপ্টেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন ২২১ কর্মকর্তা। এ পদোন্নতিতে মূল বিবেচনায় এসেছে ২২তম ব্যাচ। বর্তমানে যুগ্ম সচিবের স্থায়ী পদ ৫০২টি। এর বিপরীতে পদোন্নতি পাওয়ার পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা হলো ৯৪৬ জন। এর আগে সর্বশেষ গত বছর ২ নভেম্বর ১৭৫ জন কর্মকর্তাকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। আর গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২৭০ জন সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
জানা যায়, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগেই অন্তত ১০ জন সচিবের স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার কথা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন আগামী ১৩ অক্টোবর অবসরে যেতে পারেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান ১৪ সেপ্টেম্বর, সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আবদুস সালামের ২৬ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। তবে আবদুস সালামের চাকরি এক বছর বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩০ অক্টোবর, ইআরডি সচিব শরিফা খান ২৪ নভেম্বর, শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এহসানে এলাহী ২৫ নভেম্বর এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগের সিনিয়র সচিব কামাল হোসেন ২৯ নভেম্বর অবসরে যাবেন। ৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম এবং ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মো. ফয়জুল ইসলাম। এ ১০ জনের মধ্যে কয়েকজন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
গত কয়েক বছরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং মুখ্য সচিব পদে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই স্বাভাবিক অবসরের মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। সর্বশেষ সাবেক চার মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মধ্যে একমাত্র কবির বিন আনোয়ার ছাড়া বাকি তিনজনই স্বাভাবিক মেয়াদ শেষে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন। তারা হলেন মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম ও খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনেরও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে।
তার নাম শেখ মোহাম্মদ আসলাম। একসময় সুইডেন ছিলেন বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন স্ইুডেন আসলাম নামে। তেজগাঁও এলাকার এই শীর্ষ সন্ত্রাসী একসময় ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড বা অপরাধ জগৎ কাঁপাতেন। ২৭ বছর ধরে আছেন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে। হত্যাসহ ১৭ মামলার একটি ছাড়া বাকিগুলোতে জামিন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু বহু দিনের পুরনো প্রতিপক্ষের হাতে প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জামিনের জন্য আবেদন করছেন না তিনি।
মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালও জামিনের আবেদন করছেন না। প্রায় ২০ বছর ধরে কারাগারে থাকা হেলালের বিরুদ্ধে আছে অন্তত এক ডজন মামলা। বেশিরভাগ মামলায় জামিন হয়ে গেছে। এই দুজনের মতোই কারা হাজতে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছেন না। এ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষ্যও দিতে আসেন না আদালতে। তারা বছরের পর বছর ধরে কারাগারে থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না। অনেকেই অসুস্থ না হয়েও বছরের পর বছর হাসপাতালে আরামে
থাকছেন। বাইরে থাকা তাদের সহযোগীদের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকছে। এই সহযোগীরাই তাদের হয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন।
পুলিশের তালিকায় ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম আছে যাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। অবশ্য এই তালিকায় সুইডেন আসলাম নেই। তালিকা করা হয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। এদের মধ্যে ১৩ জন বিদেশে আত্মগোপন করে আছেন। কারাগারে আছেন ৬ জন, মারা গেছেন ৩ জন। একজনের কোনো হদিস নেই।
এই শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আটজনকে ১ লাখ টাকা এবং ১৫ জনকে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মধ্যে পিচ্চি হান্নান র্যাবের ক্রসফায়ার, গণপিটুনিতে আলাউদ্দিন ও কামাল পাশা ওরফে পাশা কারাগারে মারা গেছেন। কালা জাহাঙ্গীর বেঁচে আছেন নাকি আত্মগোপনে, কেউ বলতে পারছেন না। পিচ্চি হেলাল, টিটন, ফ্রিডম সোহেল ও কিলার আব্বাস কারাগারে আছেন। খোরশেদ আলম ওরফে রাশু কিছুদিন আগে ছাড়া পেলেও কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আবার আটক করেছে। মশিউর রহমান কচি, সুব্রত বাইন, আমিন রসুল সাগর. ইমাম হোসেন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, মোল্লা মাসুদ, শামীম আহমেদ, হারিস আহমেদ, তানভিরুল ইসলাম জয়, জাব্বার মুন্না, জাফর আহমেদ, কামরুল হাসান হান্নান ওরফে ছোট হান্নান দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তাদের ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি আন্ডারওয়ার্ল্ডে একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা চলছে। সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে গাড়ি থামিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ এক পথচারী সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন জড়িত বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও। দেশের বাইরে থাকা সন্ত্রাসীরা নিজেদের সহযোগীদের মাধ্যমে নতুন করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি কারাগারে থাকা সন্ত্রাসীরাও সহযোগীদের নানা বিষয়ে বার্তা দিচ্ছে। এর মধ্যে কেউ কেউ রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত হতে চাইছে। যে কারণে সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর সব কটি ইউনিট, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার এসপিদের বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে আত্মগোপনে থাকা সন্ত্রাসীদের বিষয়ে নতুন করে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষকেও হাজতি ও বন্দি সন্ত্রাসীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, যেসব সন্ত্রাসী দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটক আছে, তাদের একটি তালিকা করেছে একটি সংস্থা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও তারা জামিন নেওয়ার চেষ্টা করছে না। তারা কারাগারকেই নিরাপদ মনে করছে।
কারা সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম একটি মামলায় জামিন না নেওয়ায় কারাগারে আছেন। বাকি সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। ২৭ বছরের কারাজীবনে তার দুইবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বেশিরভাগ সময় কেটে যাচ্ছে হাসপাতালে থেকেই। হুইলচেয়ারে করে চলাফেরা করেন সব সময়। মোবাইল ফোনে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ করেন সহযোগীদের সঙ্গে। তার স্ত্রী আয়েশা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
সুইডেন আসলামের বিষয়ে তার এক আত্মীয় দেশ রূপান্তরকে বলেন, এলাকায় তার যখন একক আধিপত্য ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। সুইডেন আসলাম বের হয়ে এলে প্রতিপক্ষরাই তাকে মেরে ফেলবে, এমন শঙ্কা আছে। এসব দিক বিবেচনা করেই তিনি বের হতে চাইছেন না। কারাগারেই তিনি ভালো আছেন।
জানা গেছে, সুইডেন আসলামের বিরুদ্ধে মামলাগুলোতে কোনো সাক্ষীও পাওয়া যায় না। ১৯৮৬ সালে তিনি অপরাধ জগতে যুক্ত হন। ওই বছর পূর্ব রাজাবাজারে স্কুলের সামনে কিশোর শাকিলকে গুলি করার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তারপর থেকে তার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যাকা-সহ নানা অপরাধের তথ্য বের হয়ে আসে। এরই মধ্যে নিজেকে রক্ষা করতে সুইডেন চলে যান। বছর পাঁচেক ওই দেশে থেকে আবার ফিরে আসেন দেশে। তারপর সুইডেন শব্দটি নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯৭ সালের ২৩ মার্চ গালিব খুন হন। এ ঘটনায় আসলামসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ এপ্রিল অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২৪ সাক্ষীর মধ্যে পুলিশ চারজনকে আদালতে হাজির করতে পেরেছে। বাকিরা আর আসেননি এবং এই মামলায় তিনি জামিনও নেননি।
দীর্ঘদিন কারাগারে থাকলেও আসলাম মোবাইল ফোনে সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। স্ত্রী আয়েশা আকতার নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। বলা চলে রাজার হালেই আছেন তিনি।
মিরপুর ও কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস ২২ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। তার বিরুদ্ধে থাকা ১১টি মামলার জামিন হয়েছে। একটি মামলার জামিন হতে বাকি আছে। তা ছাড়া কমিশনার নিউটন হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ হলেও উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন তিনি। আরেকটি মামলার শুনানি চলছে উচ্চ আদালতে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিলার আব্বাসের এক সহযোগী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে দেখা করে আসি। দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি কারাগার থেকে বের হতে চাচ্ছেন না। জামিন চাইলে তিনি জামিন পেয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই তা করবেন না। কারণ প্রতিপক্ষ সক্রিয় আছে। তার প্রাণ শঙ্কা আছে। আমরা ইচ্ছা করলে যেকোনো সময় জামিন নিয়ে ভাইকে বের করে আনতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আরেক সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালেরও প্রায় সব মামলার জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলার জামিন বাকি আছে। তিনি যখন কারাগারে, তখন বিএনপি তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল। অথচ হেলাল বিএনপির রাজনীতি করেন। জেলে বসেই মোহাম্মদপুর, আদাবর ও ধানম-ি, মিরপুর এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন। মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড দখল ও চাঁদাবাজি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের ভালো যোগাযোগ। মোবাইল ফোনে নিয়মিত কথা বলেন তারা। তার আরেক সহযোগী হাবিবুর রহমান তাজ ১৩ বছর ধরে কারাগারে আটক আছেন। মামলার সাক্ষীদের হাজির করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। ইচ্ছে করে জামিনও নিচ্ছেন না তাজ। গ্রেপ্তারের আগে দীর্ঘদিন ভারত পালিয়ে ছিলেন। ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস পর তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজধানীর কাফরুলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ইসমাইল হোসেনকে হত্যা করার অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তা ছাড়া কলেজছাত্র কামরুল ইসলাম ওরফে মোমিন হত্যার সঙ্গেও জড়িত তাজ। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি এ কে এম রফিকুল ইসলামের আশ্রয়-প্রশয়ে থাকতেন তিনি। কয়েক বছর আগে ওসি রফিক মারা যান।’
মতিঝিলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করে আলোচনায় আসে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ঈদুল। প্রায় ১৫ বছর ধরে কাশিমপুর কারাগারে আটক আছেন তিনি। একবার পঙ্গু হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে আটক করে ফেলে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা থাকলেও দুটি মামলা বাদে সব কটিতে জামিন পেয়েছেন। বাকি মামলাগুলোতে ইচ্ছা করে জামিন নিচ্ছেন না বলে তার এক স্বজন জানিয়েছেন।
সেভেন স্টার গ্রুপের একসময়ের সদস্য ফ্রিডম সোহেল ধানম-ি ৩২ নম্বরে গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন সাজার আসামি। সাজা কমিয়ে কারাগারেই থাকার চেষ্টা করছেন সোহেল। তার বিরুদ্ধে ১১টি মামলা আছে। ৯টি মামলায় জামিন পেয়েছেন। একটি মামলায় সাজা হয়েছে। আরেকটি মামলায় জামিন নিচ্ছেন না।
তার সহযোগী পুরস্কারঘোষিত সন্ত্রাসী রাশু কিছুদিন আগে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে আটক করে। তার এক স্বজন দেশ রূপান্তরকে জানান, মাস দুয়েক আগে সর্বশেষ মামলায় জামিন হয় রাশুর। তার কোনো ইচ্ছা ছিল না কারাগার থেকে বের হওয়ার। আর এ কারণে ইচ্ছা করেই একটি সংস্থাকে কারাগার থেকে বের হওয়ার তথ্য দিয়ে আবার গ্রেপ্তার হন। কারণ তিনি বের হলে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মেরে ফেলবে এমন আশঙ্কা ছিল। আরেক সন্ত্রাসী লম্বু সেলিম একটি মামলা বাদে সব মামলায় জামিনে আছেন। ভারতের কলকাতা থেকে তাকে পুশব্যাক করা হয়েছিল। প্রায় আট বছর ধরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। বেশিরভাগ সময় হাসপাতালে থাকেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে জেল থেকে বের হচ্ছেন না তিনি।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, সন্ত্রাসীদের কর্মকা- রোধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা কৌশলে কাজ করছে। তারা সরগরম হলেও কাজ হবে না। যারা দেশের বাইরে আছে, তাদের চিহ্নিত করে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরার চেষ্টা চলছে। যারা দেশে আছে, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে পুলিশ-র্যাব কাজ করছে। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ বিশ্ঙ্খৃলা তৈরি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ‘কোনো সন্ত্রাসী জামিন না নিলে এটা আমাদের করার কিছু নেই। তবে তাদের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো যাতে দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, সেদিকে নজর দেওয়া হচ্ছে।’
পুলিশ সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চোরাকারবারিসহ ভিন্ন ধরনের অপরাধীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশে অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। তাদের নির্দেশে হত্যাকান্ডের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন তারা। মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকান্ডের পেছনে বিদেশ কানেকশন।
২০০৩ সালে মালিবাগের সানরাইজ হোটেলে ডিবি পুলিশের দুই সদস্যকে হত্যার পর পালিয়ে যাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দুবাইয়ে আত্মগোপন করে আছেন। টিপু হত্যাকান্ডের পর তিনি আলোচনায় এসেছিলেন। দুবাইয়ে থাকলেও ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে সবচেয়ে বেশি প্রভাব তার। জিসানের সহযোগী জাফর আহমেদ মানিক ওরফে ফ্রিডম মানিক ভারতে পালিয়ে আছেন। কিন্তু দেশে তার দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য ও চাঁদাবাজিতে নিয়ন্ত্রণ এখনো আছে। মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইন ভারতে থেকে সক্রিয় আছেন। তানভীর ইসলাম জয়ও সক্রিয় আছেন। কলকাতা, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ঘুরে তার অবস্থান এখন থাইল্যান্ডে। সেখানে বসেই তিনি কলকাঠি নাড়ছেন।