logo
আপডেট : ৩ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০
চার দলে সক্রিয় ৪০ মামলাবাজ
আলাউদ্দিন আরিফ

চার দলে সক্রিয় ৪০ মামলাবাজ

রাজধানীর ‘রাজারবাগ দরবার শরিফের’ পীর দিল্লুর রহমানের আস্তানা ঘিরে গড়ে ওঠা মামলাবাজ সিন্ডিকেটে সক্রিয়া অন্তত ৪০ জন। তারা চারটি দলে বিভক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘টার্গেট করা’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করে থাকেন। মামলা দেওয়াই তাদের ‘অ্যাসাইনমেন্ট’। কোন মামলায় কে বাদী হবেন, কে সাক্ষী হবেনÑ তা নির্ধারণ হয় রাজারবাগের পাশাপাশি আশুলিয়ায় পীরের শ^শুরবাড়ির আস্তানা থেকে। চারটি দলের প্রধানরা ঠিক করে দেন কার বিরুদ্ধে কত মামলা হবে। জামিন পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আবার কীভাবে নতুন মামলা দেওয়া হবে এসবও নির্ধারণ হয় দুই আস্তানা থেকে।

দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এক মামলার বাদী অন্য মামলায় সাক্ষী। এমন বাদীও পাওয়া গেছে যে, একই অভিযোগ এনে ভিন্ন ভিন্ন জেলায় একই ব্যক্তির নামে মামলা করেছেন চারটি।

এদিকে গতকাল দেশ রূপান্তরে ‘মামলাবাজ পীর সিন্ডিকেট’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর রাজারবাগের পীরের মুরিদদের অনেকেই আস্তানা ছেড়ে চলে গেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল শনিবার সকাল থেকে বহু মুরিদ পীরের আস্তানা ছেড়ে চলে যান। তারা কোথায় গেছেন সে বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা কিছু জানাতে পারেননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজারবাগের পীরের সংগঠন উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকাভুক্ত সংগঠন। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর মতিঝিলে বলাকা ভাস্কর্যটি ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ সংগঠনটির ৮ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় তারা নিজেদের রাজারবাগ দরবারের বড় হুজুর সাইয়্যেদ দিল্লুর রহমানের অনুসারী বলে জানান। উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সংগঠনটি রাজারবাগ থেকেই পরিচালিত। দিল্লুর রহমানের নির্দেশে তারা বলাকা ভাস্কর্য ভাঙচুর করেন। ২০১৭ সালে হাইকোর্ট চত্বরে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে গড়া ‘ন্যায়বিচারের প্রতীক’ ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যে উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাত সেটি সরিয়ে ফেলতে উড়োচিঠিতে হুমকি দেয়। এরপর পুলিশের বিশেষ শাখা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতসহ ৮টি সংগঠনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনের পর আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতসহ ৮টি সংগঠন কালো তালিকাভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কালো তালিকাভুক্ত হলেও সংগঠনটি নির্বিঘেœ তাদের কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘তাদের কার্যক্রম আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি।’

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিভিন্ন জেলায় মামলাবাজ এই পীর সিন্ডিকেট যাদের আসামি করে মামলা করেছে তারা খালাস পেয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে আসামিদের বিরুদ্ধে নয়, বাদীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় দেখা যায়, যে ঘটনার উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে সে রকম কোনো অপরাধই হয়নি, বা যে এলাকায় অপরাধ সংঘটনের কথা বলা হয়, সেখান কখনোই যাননি আসামিরা। কিছু ক্ষেত্রে কল্পিত কাহিনী দিয়ে গায়েবি মামলা করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে রাজারবাগী পীরের বেশ কিছু অনুসারী। আদালতে হলফনামা দিয়ে তারা বলেছে মামলা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না বাদী। ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে মামলা দিয়েছেন চক্রের সদস্যরা। এই সিন্ডিকেট গত ১৫ বছরে কত মানুষের নামে মামলায় জড়িয়ে তাদের নিঃস্ব করেছে তার হিসাব কারও কাছেই নেই।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার গোলাম কবিরের ছেলে শাকেরুল কবির রাজারবাগ পীরের মুরিদ। তার প্রধান কাজ সাজানো বাদী দিয়ে নিরীহ মানুষের নামে মামলা দেওয়া। আর সেই মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন শাকেরুল। এই শাকেরুল কবিরদের মামলার জালে বন্দি তার আপন ফুফাতো ভাই রাজধানীর শেওড়াপাড়ার আকরামুল আহসান কাঞ্চন। তার বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৪৬টি। অথচ পুলিশের ‘ক্রিমিনাল রেকর্ড’-এ কাঞ্চনের নাম নেই।

শাকেরুল কবিরের বড়ভাই শাহেদুল কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার ছোটভাই শাকেরুলের কাজই হলো পীর সাহেবের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং সেগুলো পরিচালনা করা।’ তিনি জানান, তার আপন ফুফাতো ভাই কাঞ্চনের বিরুদ্ধে করা বাদী হয়ে কোথায় কোন মামলা দিচ্ছে তার সবই জানে শাকেরুল। তিনি বলেন, ‘কাঞ্চনের আপন ভাই আকতারুল কামাল খোকন রাজারবাগী পীরের মুরিদ। তিনি তাদের পৈতৃক বাড়ি পীরের দরবারে লিখে দিতে কাঞ্চনসহ পরিবারের সবাইকে চাপ দেন। কাঞ্চন বাড়ি লিখে দিতে রাজি না হওয়ায় খোকন নিজেই পরামর্শ দিয়ে শাকেরুলকে দিয়ে দেশের বিভিন্ন থানায় এসব মামলা দিচ্ছে। যাতে কাঞ্চন বাড়িসহ সহায় সম্বল লিখে দিতে বাধ্য হন।’ এসব মামলার কারণে কাঞ্চন ও তার পরিবার এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন শাহেদুল। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাজানো মামলা দিতে গিয়ে শাকেরুল কবির ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ সাতক্ষীরার কলারোয়া থানায় গ্রেপ্তার হন। সেখানে নাহিদা বেগম, সুমী বেগম ও আরজু আক্তারকে দিয়ে খাগড়াছড়ির দিঘীনালার নুরুল আলম ও খলিল হাওলাদার এবং কক্সবাজারের রামুর তৈয়ব উল্লাহর বিরুদ্ধে মানবপাচার মামলা করানোর চেষ্টা করেন শাকেরুল। পুলিশের সন্দেহ হলে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করার এক পর্যায়ে তিনি সাজানো মামলার বিষয়টি স্বীকার করেন। পরে ওই তিন নারীকে বাদী করে শাকেরুল কবির ও রাজারবাগ পীরের মুরিদ আক্তারী কামালের ছেলে হাবিবুল্লাহ সৌমিকসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। গ্রেপ্তার করে শাকেরুল ও সৌমিকসহ পাঁচ প্রতারককে, যারা সবাই রাজারবাগী পীরের মুরিদ।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, রাজধানীর অদূরে আশুলিয়া চারাবাগ এলাকায় রাজারবাগ পীর দিল্লুর রহমানের  শ্বশুরবাড়ি সাজানো মামলার বাদীদের অন্যতম আস্তানা। হামিদা বেগম, তার স্বামী আহম্মদ আলী ও তাদের মেয়ে সোনিয়া আক্তার পীরের শ^শুরবাড়িতে আশ্রিত থেকে নিরীহ মানুষকে মামলার জালে ফাঁসায়। একমাত্র মেয়ে সোনিয়াকে ‘ভিকটিম সাজিয়ে’ তার মা হামিদা বেগম তিনটি এবং আহম্মদ আলী আরেকটি মামলা করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সোহেল চৌধুরী ও তুহিনের বিরুদ্ধে। সোনিয়াকে মানবপাচার মামলার ‘ভিকটিম সাজিয়ে’ নারায়গঞ্জের ফতুল্লা থানায় মামলা করা হয় রাজধানীর বাসাবোর আব্দুল কাদের ও কাশেম মিয়াসহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে। পারিবারিক এই সিন্ডিকেট নিজেদের মেয়ে সোনিয়াকে চার বার বিদেশে পাচারের মিথ্যা অভিযোগে চারটি থানায় মামলা করেন। পরে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে সাজানো আসামিদের বিরুদ্ধে নয় বরং এই চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজারবাগী পীরের মামলাবাজ সিন্ডিকেটে আইনজীবী নামধারী কিছু ব্যক্তিও রয়েছেন। তারা বিভিন্ন লোকের বিরুদ্ধে রাজারবাগী সিন্ডিকেটের হয়ে মামলা সাজিয়ে দেন। তারা একেক স্থানে একেক নাম ব্যবহার করেন। এই সিন্ডিকেট রাজারবাগের পীরের দরবারের গেটে অবস্থিত পার্টি হাউজ নামে কমিউনিটি সেন্টার ভবনের মালিকানা নিয়ে পীরের পক্ষ হয়ে তার আপন তিন ভাই জিল্লুর রহমান, হাফিজুর রহমান ও আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করান।

টিকাটুলীর বাসিন্দা এম সাইফুল্লাহর বিরুদ্ধে যে ৬০টি মামলা করা হয়েছে তার সবই করেছেন রাজারবাগী পীরের অনুসারীরা। এসব মামলায় বাদী আর সাক্ষী ঘুরেফিরে একই গ্রুপের লোকজন। সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে লাকী আক্তারকে দিয়ে মামলা সাজানো হয়েছিল সেই লাকী আক্তার আদালতে হলফনামা দিয়ে বলেছে, মামলা সাজিয়ে দিয়েছে রাজারবাগ পীর দিল্লুর রহমান, তার ছেলে মুয়াজ ও জনৈক আইনজীবী। এই মামলায় বাদী চেনেন না আসামিকে, আসামি চেনেন না বাদীকে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজারের বহুল আলোচিত মানবপাচার মামলার আসামি শিশু আলাউদ্দিনের (১২) বিরুদ্ধে দায়ের মামলার সাজানো বাদী নুরুল ইসলাম বদু। জেরার মুখে বদু স্বীকার করেছেন, তিনি আসামি মীর আহমেদ মিলন ও শিশু আলাউদ্দিনসহ অপরাপর আসামিদের চিনতেন না। মামলার আগে তাদের তিনি দেখেনওনি। রাজারবাগ দরবার শরিফ থেকে তাকে মামলা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি পীরের নির্দেশ পালন করেন। ওই মামলা করে তিনি এক লাখ বিশ হাজার টাকা পেয়েছেন। বদু আরও জানান, তার পাশের গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনকে মিথ্যা মামলার বাদী বানাতে রাজারবাগ দরবার শরিফে নিয়ে গিয়েছিলেন।

কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম এলাকায় মামলার জালে ফেলেন মামলাবাজ এই সিন্ডিকেটের অন্যতম রাজারবাগ পীরের প্রতিনিধি আনিসুর রহমান ওরফে লাদেন মৌলভী। ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সহায়সম্পদ হাতিয়ে নিতে মামলার জালে জড়ানোই তার কাজ। চট্টগ্রামের চকরিয়া শপিং কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় তাদের আস্তানা থেকে এসব মামলা পরিচালনা করা হয়। এসব মামলার মাধ্যমে তারা পাহাড়ি এলাকায় হাজার হাজার একর জমিয়ে নিয়েছেন উলামা আঞ্জুমানে আল বাইয়্যিনাতের নামে, যা ওই এলাকায় সাইয়্যিদুল আইয়্যাদ শরিফ নামে পরিচিত। রাজারবাগী পীরের মামলাবাজ সিন্ডিকেটে আরও আছেন মফিজুল ইসলাম, আহমাদুল্লাহ মাসুম, মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাজারবাগ দরবার শরিফের মুখপাত্র আল্লামা মুহাম্মদ মাহবুব আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এর সবই সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভুয়া। রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর সাহেবের বিদ্বেষী লোকজন দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলার এসব ঘটনা সাজিয়ে পীর সাহেবকে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করছেন। আমরা এসবের বিরুদ্ধে আইনগতভাবে মোকাবিলা করছি।’