মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে ভিড় বাড়ছে তেঁতুলিয়ায়

আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২০, ০২:৩১ পিএম

নেপাল এবং সিকিম সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার উচ্চতার কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্লভ মায়াবী দৃশ্য পঞ্চগড় থেকে দেখা যাচ্ছে।

সম্প্রতি বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ মেঘমুক্ত থাকা এবং বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়ায় এবার আগেভাগেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হয়েছে।

অন্যান্য বছর ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত এবং বিকেল থেকে সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত দৃশ্যমান হতো কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা একটানা দৃশ্যমান হচ্ছে।

ইতিপূর্বে তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও এবার শুধু তেঁতুলিয়া নয়, পঞ্চগড় জেলাসহ পাশের ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর জেলার কিছু কিছু স্থান থেকেও দেখা যাচ্ছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য দেখার খবর পেয়ে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দলে দলে পর্যটকেরা ভিড় করছেন পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ায়।

গত ২৯ অক্টোবর থেকে এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যমান হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে আসতে শুরু করেছেন পর্যটকেরা।

সূর্য উদয়ের পর কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াটি প্রথমে কালচে-লালচে দৃশ্যমান হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ সৌন্দর্য পরিবর্তন হতে থাকে।

সোনালী, রূপোলির পর তুষার শুভ্র বরফে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যটকদের সামনে দৃশ্যমান হয়। বিকেলে সূর্যকিরণে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াটি অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ধরা দেয় পর্যটকদের সামনে।

 চোখের কাছে ভেসে থাকা হিমালয় পর্বত ও কাঞ্চনজঙ্ঘার দুর্লভ মায়াবী দৃশ্য যে কারোরই মন কেড়ে নেয়। হাত বাড়ালেই যেন শ্বেত-শুভ্র হিমালয়! আর একটু এগুলোই হয়তো ছুঁয়ে ফেলা যাবে, চোখ জুড়ানো মনভোলানো বরফ ঢাকা পর্বতটাকে।

তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানায়, নেপাল ও ভারত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। নেপাল, ভুটান, ভারত ও চীন তেঁতুলিয়ার কাছাকাছি হওয়ায় দেশের এ এলাকা থেকেই কেবল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়।

আবহাওয়া অনুকূল থাকলে মেঘমুক্ত আকাশে ডিসেম্বর পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়।

image

লকডাউনের কারণে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ কমে যাওয়া, বৃষ্টি ও আকাশে মেঘ না থাকায় পঞ্চগড়সহ আশপাশের জেলাগুলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট ও দীর্ঘক্ষণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বলে জানালেন তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

পঞ্চগড়ের শৌখিন ফটোগ্রাফার আব্দুল্লাহ আল মারুফ জানান, অন্যান্য বছর ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত দেখা যেত। এরপর অস্পষ্ট হয়ে যেত। আবার তেঁতুলিয়া ছাড়া অন্য কোথা থেকে দেখা যেত না কিন্তু এবার কাঞ্চনজঙ্ঘা  ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি দেখা যাচ্ছে।

ঠাকুরগাঁও থেকে আসা মুশফিরা রহমান নামে এক ছাত্রী জানান, কাঞ্চনজঙ্ঘার সুন্দর একটা ভিউ এখান থেকে দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘার এত সুন্দর ভিউ বাংলাদেশের আর অন্য কোন জায়গা থেকে ক্লিয়ার দেখা যায় না। এবার কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্যটা আরও বেশি সুন্দর লাগছে। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানেই আমার এখানে আসা।

কাঞ্চনজঙ্ঘার অপরূপ দৃশ্য অবলোকন করার জন্য সপরিবারে দিনাজপুর থেকে তেঁতুলিয়ায় এসেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আশিকা আকবর তৃষা।

সূর্যোদয়ের সময় বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছেন। পরে একাধিক স্পটে গিয়ে আবারও কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখেছেন ভিন্ন রূপে। জানালেন অসাধারণ তুলনাহীন।

‘কাঞ্চনজঙ্ঘা সিকিম ও দার্জিলিং থেকে দেখেছি তবে বাংলাদেশ থেকে দেখাটা ব্যতিক্রম’ বললেন ঢাকা থেকে আসা রাহী সরকার ও আয়শা সিদ্দিকা দম্পতি।

তাদের মতে, একটা নদী বয়ে যাচ্ছে তার উপরে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা, গ্রামীণ অবয়বের পাশাপাশি চতুরদিকে ধানক্ষেত লোকজন সেখানে কাজ করছে তার উপরে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা। একেক জায়গায় কাঞ্চনজঙ্ঘার একেক রূপ। তবে বাংলাদেশের এই ভিউটা বা রূপটা আমাদের ভালো লাগে। পাঁচ বছর ধরে আমরা এখানে এই ভিউটা দেখতে আসি।

তাদের মতো জেলার বাইরে থেকে অনেক দম্পতিই এসেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

ঢাকা থেকে বন্ধুদের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে এসেছেন সানজিদ নামে অপর এক পর্যটক।

তিনি জানালেন, সকালের অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা সত্যিই অসাধারণ। এখানকার সবকিছুই ভালো, তবে ভালো মানের আবাসিক হোটেল নেই। বাবা-মা বা পরিবার নিয়ে এসে এখানে থাকার সুযোগ নেই।

image

পাখি বিশেষজ্ঞ, পর্যটক ও ফটোগ্রাফার ফিরোজ আল সাবাহ জানান, আগন্তুক পর্যটকদের রাতযাপনের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জেলা পরিষদের দুটি ডাকবাংলো, বেরং কমপ্লেক্সসহ সরকারি বেসরকারি দু-একটি আবাসিক হোটেলে স্বল্প সংখ্যক পর্যটকের ব্যবস্থা হলেও এ মৌসুমে অধিকাংশ পর্যটকেরই রাত্রিযাপনের সুযোগ থাকে না।

আবাসন সংকট ও ভালো মানের খাবার হোটেল না থাকায় অনেককেই ফিরে যেতে হয় জেলা শহর পঞ্চগড়ে।

পর্যটন মোটেলসহ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে এখানে পর্যটকদের সংখ্যা বাড়বে। পর্যটক বাড়লে সরকার যেমন রাজস্ব পাবে, তেমনি সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থানের।

টুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোনের ইনচার্জ আমিনুল ইসলাম জানান, তেঁতুলিয়া শান্তিপূর্ণ উপজেলা তবুও পর্যটকদের বাড়তি নিরাপত্তায় পর্যটকেরা যেন নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরা করতে পারেন এ জন্য এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করছে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মাসুদুল হক আবাসন সংকটের কথা স্বীকার করে জানান, সরকারিভাবে তেঁতুলিয়ায় ১৪টি কক্ষ রয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে দু-একটি হোটেল রয়েছে। তারপরও বর্তমানে চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তবে পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে এখানে বহুতল ভবনের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।

পর্যটকদের কথা চিন্তা করে তেঁতুলিয়ার সাবেক ইউএনও সানিউল ফেরদৌস তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো ও পিকনিক কর্নারকে নতুন রূপে দৃষ্টিনন্দন করে সাজিয়েছেন।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, পর্যটকদের সুবিধার্থে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পর্যটন বান্ধব স্থাপনা নির্মাণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যটন এলাকায় উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলছে।

জেলা পরিষদের দুটি ডাকবাংলো, তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নারে স্থান সংকুলান হয় না। প্রায় সময় এখানে ভিআইপি অতিথিরা আসেন।

এ জন্য পিকনিক কর্নারের পাশে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ নতুন করে 'বেরং কমপ্লেক্স' নামে আরেকটি ডাকবাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও এখানে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। সব মিলিয়ে এখানে পরিবেশটা বরাবরের মতো ভ্রমণ উপযোগী। এখানে যে কেউ এসে মানসিক তৃপ্তি নিয়ে ঘুরে যেতে পারেন।

image

কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে পঞ্চগড় কিংবা তেঁতুলিয়া অথবা বাংলাবান্ধায় সরাসরি দূরপাল্লার কোচ (দিবারাত্রি) যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, নাবিল পরিবহন, এনা পরিবহন ও শ্যামলীর এসি/ননএসি বাস চলাচল করছে।

ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, একতা বা দ্রুতযান এক্সপ্রেসে করে চলে আসতে পারেন পঞ্চগড়।

অন্যদিকে রাজশাহী থেকেও বাংলাবান্ধা এক্সপ্রেসে করে আসতে পারেন পঞ্চগড়। এ ছাড়া ঢাকা থেকে বিমানে সৈয়দপুর পর্যন্ত আসতে পারেন। পঞ্চগড় থেকে বাস, মাইক্রোবাস, কার বা যে কোন যানবাহনে তেঁতুলিয়া উপজেলায় যেতে পারবেন। তেঁতুলিয়ায় আবাসনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ডাকবাংলো বুক করতে পারবেন।

এ ছাড়া যে কোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন অ্যাপল টুরিজমের মাহাবুবুল আলম মন্টুর (০১৫৯৫৫৩৩৮৮৮) সঙ্গে। তিনি যাওয়া আসা থাকা খাওয়াসহ সব বিষয়ে আপনাকে সহযোগিতা করতে পারবেন।

কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও অপূর্ব সুন্দরের রাজ্য পঞ্চগড়ে সবুজের নৈসর্গ সমতল ভূমির চা বাগান। সীমান্ত নদী মহানন্দার পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দর্শন, মোঘল আমলের স্থাপত্য মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বার আউলিয়ার মাজার, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বদেশ^রী মন্দির (সীতার ৫১ পীঠের এক পীঠ), গোলকধাম মন্দির, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, দেশের একমাত্র পাথর সমৃদ্ধ পাথরের জাদুঘর রকস ‘রকস্ মিউজিয়াম’, জেমকন গ্রুপের  কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের আনন্দ ধারা, শিশুপার্ক, দেশের অন্যতম বৃহৎ প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন ভিতরগড় দুর্গনগরী ও ১৫০০ বছরের পুরাতন সুবিশাল মহারাজার দীঘি, ভূগর্ভস্থ ও নদী থেকে পাথর উত্তোলন দেখলে পর্যটকদের চোখ জুড়িয়ে যাবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত