মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

দুই দিনে সিলেট ভ্রমণ

আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৭ পিএম

পাহাড়, ঝরনা আর সবুজের প্রাচুর্যে ভরা সিলেটে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব পর্যটনকেন্দ্র। সবুজে মোড়া পাহাড়ের কোলঘেঁষা পাথুরে নদী, বন, ঝরনা, চা-বাগান কী নেই এখানে! সিলেটের বৈচিত্র্যে ভরা সৌন্দর্য দেখতে ছুটে আসেন পর্যটক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। আমরা তিন বন্ধুও ঠিক করলাম দুটি পাতার একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট ভ্রমণে যাব। তিনজনের একজন শফিকুল ইসলাম জসিম থাকে মানিকগঞ্জ। আরেকজন সাইফুল ইসলাম সাভারে। আর আমি ঢাকায়। তিন রাত ও দুই দিনের প্ল্যান। ঠিক হলো এক রাতে যাব, এক রাত থাকব, আরেক রাতে ফেরত আসব আর দুই দিনে সিলেটের অধিকাংশ স্পট ঘুরে দেখব।

কোন কোন স্পট দেখব?
প্রথমেই দেখব লালাখালের নীল পানি। এরপর প্রকৃতিকন্যা নামে পরিচিত জাফলং। এরপর দেখব দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন রাতারগুল, জল-পাথরের নদী খ্যাত বিছানাকান্দি আর মেঘ-পাথর-জল-পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাদা পাথর। এ ছাড়া দেখব চা বাগান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হজরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরানের (রহ.) মাজার।

থাকব কোথায়?
কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই নয় বরং নানান বিলাসবহুল ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রিসোর্ট আর হোটেলের জন্যও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সিলেট। এ জন্যই কর্মক্লান্ত শহরের বাসিন্দারা কোলাহলমুক্ত এই চায়ের রাজ্যে ছুটে আসেন। দেশের অন্যতম বিলাসবহুল রিসোর্টগুলোর সিংহভাগ সিলেটে অবস্থিত। এর মধ্যে পাঁচ তারকা রোজ ভিউ হোটেল, এটি সিলেট সদরের একটি জনপ্রিয় ও বিলাসবহুল হোটেল। এ ছাড়া আছে আধুনিক ও উন্নত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন হোটেল গার্ডেন ইন, হোটেল নুরজাহান গ্র্যান্ড, লা ভিস্তা হোটেল, হোটেল স্টার প্যাসিফিক, হোটেল মিরা গার্ডেনসহ আরো অনেক হোটেল। আমরা ঠিক করলাম, থাকব লা ভিস্তা হোটেলে। এটি সিলেট শহরের লামাবাজারে অবস্থিত। আগেই হোটেলের ওয়েবসাইট থেকে নম্বর নিয়ে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম।

সিলেটে কীভাবে যাবেন
রাজধানী ঢাকা থেকে সিলেটে তিন ভাবে যাওয়া যায়। সড়ক, রেল এবং আকাশ পথ। আকাশ পথে প্রতিদিন কয়েকটি ফ্লাইট চলাচল করে। সড়ক পথে হানিফ, শ্যামলী, গ্রিনলাইন পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি পরিবহন ঢাকা থেকে সিলেটে যায়। ভাড়া নন এসি ৫৭০ টাকা, এসি ১৩০০ টাকা থেকে ১৫০০। প্রতিদিন কয়েকটি ট্রেনও যায়। এর মধ্যে উপবন এক্সপ্রেস, পারাবাত এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা ও কালনি এক্সপ্রেস অন্যতম। ভাড়া এসি চেয়ার স্নিগ্ধা ৬৩০ টাকা। এসি কেবিন ১১৪৯ টাকা। চেয়ার ৩২০ টাকা। আমরা ঠিক করলাম উপবন এক্সপ্রেসে যাব। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ঠিক ৯টায় ছেড়ে যায় ট্রেনটি। সিলেট গিয়ে পৌঁছে ভোর ৫টায়।

কোথায় খাবেন?
সিলেটে জিন্দাবাজার এলাকায় খাবারের জন্য বেশ কয়েকটি ভালো মানের হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ ভাই হোটেল ও পানসি হোটেল অন্যতম। তবে পাঁচ ভাই হোটেলে খাবারের মান খুবই ভালো এবং তুলনামূলকভাবে কম দাম। হরেক রকম ভর্তা, মাংস, মাছ, খিচুড়ি খুবই মজার। এদের পাঁচ মিশালি আইটেম দারুণ। আমরা গিয়ে পাঁচ ভাই ও পানসিতে খেয়েছি। সিএনজি অটোরিকশা চালককে বলে স্পট থেকে সোজা হোটেলে গিয়েছি।

সিলেট টুর প্ল্যান
সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে তিন থেকে চার দিন সময় প্রয়োজন। একটা স্পট থেকে আরেকটা বেশ দূরের। আমরা তিন বন্ধু প্ল্যান করলাম দুই দিনে উল্লেখযোগ্য দশটি দর্শনীয় স্থান কাভার করার।

প্রথম দিন: জাফলং, লালাখাল, রাতারগুল, চা বাগান, শাহপরানের (রহ.) মাজার ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আমাদের উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন ভোর পাঁচটার আগেই সিলেটে পৌঁছে দেয়। স্টেশন থেকেই একটি অটোরিকশা নিয়ে হোটেলে চলে যাই। চেকইন করে ফ্রেশ হয়ে অল্প সময় রেস্ট নিয়ে চলে যাই শহরের আম্বর খানায়। নাশতা করে একটি অটোরিকশা ১৫০০ টাকায় ভাড়া করে ফেলি। অটোরিকশা চালককে কোন কোন স্পটে যাবেন সেগুলো বলে ভাড়া করে নিতে হবে। আমরা প্রথমে যাই হজরত শাহপরান (রহ.) মাজারে। এরপর যাই লালাখাল। সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠে আকাশি নীল পানিতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করি। এরপর সিএনজিতে উঠে সোজা চলে যাই জাফলং। তখন ঘড়ির কাটা সকাল ১০টা। আমরা এক ঘণ্টা জাফলংয়ে থাকি। সেখানে আমরা ডাব কিনে খাই। এরপর সোজা রওনা দিই রাতারগুলের উদ্দেশে। রাতারগুলে পৌঁছতে ২টা বেজে যায়। রাতারগুলে গিয়ে ৯৩০ টাকা দিয়ে টিকিট ও নৌকা ভাড়া করতে হয়। রাতারগুলেও আমরা এক ঘণ্টা থাকি। এখানেও আমরা ডাব কিনে খাই। এরপর সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিই। আসার সময় চা-বাগানে একটু দাঁড়াই। শহরে এসে চলে যাই পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টে। সেখানে গিয়ে দুপুরের খাবার খাই এবং হোটেলে ফিরে যাই। হোটেলে গোসল করে কিছুক্ষণ রেস্ট নিই। এরপর বিকেল ৫টায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে যাই। রাতে হোটেলে ফিরে আসি। হোটেলেই রাতের খাবার খাই।

দ্বিতীয় দিন: বিছানাকান্দি, সাদা পাথর, শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক ও হজরত শাহজালাল (রহ.)

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে হোটেলেই নাশতা করে নিই। হোটেল ভাড়ার সঙ্গে নাশতাটা ফ্রি ছিল। এরপর আগের দিনের সিএনজি অটোরিকশা চালক চলে আসেন আমাদের নিতে। আজকের দিনের জন্যও আমরা ভাড়া দিই ১৫০০ টাকা। আমরা সোজা চলে যাই বিছানাকান্দিতে। হাদারপাড়র বাজারে গিয়ে সিএনজি রেখে আমরা নৌকায় উঠি। তখন ঘড়ির কাটায় সকাল ১০টা। নৌকা ভাড়া করি ৬০০ টাকায়। বিছানাকান্দিতে গিয়ে এক ঘণ্টা থাকি। এরপর রওনা হই ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরের উদ্দেশে। ভোলাগঞ্জে পৌঁছে নৌকা ভাড়া করি ৮০০ টাকা দিয়ে। সাদা পাথর এলাকায় গিয়ে ডাব খাই। তখন বিকেল ৩টা। ঘণ্টাখানেক থেকে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দিই। কিছু দূর এসে হাতের বাম পাশে পড়বে শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক। আমরা নেমে ছবি তুলি। এরপর সিলেট শহরের পানসি রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে যাই। যাওয়ার সময় চেক আউট করে বের হয়েছিলাম। সন্ধ্যা ৬টায় বের হয়ে যাই হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে। সেখান থেকে বের হয়ে কয়েকটি মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরে যাই। ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকেই রাতের খাবার খেয়ে কদমতলী বাসস্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিই। পূর্বেই ঠিক করা ছিল বাস। রাত ১০টায় বাস ছেড়ে দেয় ঢাকার উদ্দেশে।

একনজরে স্পটগুলো

জাফলং: জাফলং সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। সিলেট শহর থেকে এর দূরত্ব ৬২ কিলোমিটার। এখানে ভারতের ডাউকি বন্দরের ঝুলন্ত সেতুও আকর্ষণ করে অনেককে। পর্যটনের সঙ্গে জাফলং পাথরের জন্যও বিখ্যাত। শ্রমজীবী মানুষেরা পাথরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে সেই বহু বছর যাবৎ।

লালাখাল: লালাখাল সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার একটি পর্যটন এলাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান। লালাখালের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে গোয়াইন নদী। সেই নদীতে অসংখ্য বাঁক রয়েছে। নদীটির কূলে পাহাড়ি বন, চা-বাগান এবং নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজি রয়েছে। লালাখালের পানি নীল। জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে আসা প্রবহমান পানির সঙ্গে মিশে থাকা খনিজ এবং কাদার পরিবর্তে নদীর বালুময় তলদেশের কারণেই এই নদীর পানির রং এ রকম দেখায়।

রাতারগুল: রাতারগুল জলাবন বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। বনের আয়তন ৩,৩২৫.৬১ একর, আর এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি জলাবনের মধ্যে অন্যতম একটি। এটি বন বিভাগের অধীনে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখানে সবচেয়ে বেশি জন্মায় করচ গাছ। বর্ষাকালে এই বন ২০–৩০ ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। বাকি সারা বছর, পানির উচ্চতা ১০ ফুটের মতো থাকে।

বিছানাকান্দি: বিছানাকান্দি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এটি মূলত একটি পাথর কোয়েরি; যেখানে নদী থেকে পাথর সংগ্রহ করা হয়। এই জায়গায় মেঘালয় পর্বতের বিভিন্ন স্তর এসে একবিন্দুতে মিলিত হয়েছে। মেঘালয় পর্বত থেকে নেমে আসা একটি ঝরনা এখানে একটি হ্রদের সৃষ্টি করেছে যা পিয়াইন নদীর সঙ্গে গিয়ে সংযুক্ত হয়েছে। এখানকার শিলা-পাথর গুলো একদম প্রাকৃতিক এবং এগুলো পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে পানির মাধ্যমে নেমে আসে। যেখানে ছোট-বড় পাথরের শয্যা পাতা! এর ওপর দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছ পানি। দেহমন প্রশান্ত করতে পর্যটকেরা শরীর এলিয়ে দেন সেই শয্যায় কিংবা মেতে ওঠেন জলখেলায়। একবার শরীর এলিয়ে দিলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না।

সাদা পাথর: ধলাই নদ পাড় হয়ে বালু পথ মাড়িয়ে সামনে এগোতেই চোখে পড়ে নিরেট পাথর রাজ্য। পাথর ছুঁয়ে ধেয়ে নামছে পাহাড়ের স্বচ্ছ জল। বিশাল এলাকাজুড়ে দুদিকে নিরেট পাথর রাজি আর মধ্যে স্বচ্ছ জল। মেঘালয় পাহাড়ের ওপর মেঘের আলিঙ্গন। এ যেন প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য সাদা পাথর। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের ক্যানভাস। এটি সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থিত।

দুই দিনের সিলেট ভ্রমণ নিয়ে শেষ কথা
সময় বাঁচানোর জন্য আমরা দুপুরের খাবার খেয়েছি শহরে এসে বিকেলে। এ ছাড়া এত কম সময়ে সিলেটের অধিকাংশ স্পট দেখা সম্ভব নয়। শহরের আম্বরখানা এলাকা থেকে স্পটগুলো বলে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করবেন। জাফলং বা সাদা পাথরে বাস যায়। বাসে গিয়ে দুই দিনে এতগুলো স্পট দেখা সম্ভব হবে না। আপনার ভ্রমণ সুন্দর হোক।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত