বাংলাদেশের সংবিধানে মন্ত্রীর ক্রমবিন্যাসটা এরকম— উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী। ধাপে ধাপেই কাজের পরিধি, অভিজ্ঞতা, সুনাম বিবেচনা করে পদোন্নতি হয়। সাধারণের মধ্যে এরকম ধারণা প্রচলিত আছে যে উপমন্ত্রীর পরে প্রতিমন্ত্রী হবেন, প্রতিমন্ত্রীর পরে মন্ত্রী। কিন্তু চট্টগ্রাম কোতোয়ালী আসন থেকে নির্বাচিত মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উপমন্ত্রী থেকে পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষকে। নওফেলের নিজস্ব পরিচয়ের অধিকাংশ জুড়েই তার বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর খ্যাতি ও সুনাম রয়েছে।
উপমন্ত্রী থেকে এক লাফে মন্ত্রী হওয়ার পেছনে নওফেলের অবদান কতটুকু সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। এ নিয়ে কৌতূহলের কমতি নেই রাজনীতি সচেতনদের। তবে নওফেলের কথা, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার সততার মূল্যায়ন করেছে।’ জাতীয় সংসদে নওফেলের সিনিয়র ও আনোয়ারা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বললেন, ‘হি ইজ ক্যাপাবল, নওফেলের ক্যাপাসিটি আছে। সুন্দর ও স্মার্ট আছে। ভালো করে কথাও বলে।’
নওফেল মন্ত্রী হয়ে গেছে এটাই কেবল আলোচনার বিষয় নয়। তার এই প্রমোশন চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন বলয় ও মেরুকরণ তৈরি করবে। একদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, অন্যদিকে নওফেল। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনেক অনুসারীরাও। এ কারণে নওফেলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রভাব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়া বন্দর আসনের এমপি এম এ লতিফও।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। গত ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দলীয় যেসব প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন তাদের হয়ে অনেক জায়গায় সমাবেশ করেছেন আ জ ম নাছির। এতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের যে চাপ বিদেশি শক্তিগুলোর ছিল তাতে কিছুটা নতুন রূপ পায়। অর্থাৎ দলীয় নেতাকর্মী, অনুসারী ও সমর্থকদের নির্বাচনমুখী করার ক্ষেত্রে আ জ ম নাছিরের ভূমিকা ছিল বেশি। কিন্তু রাজনীতি এমনই এক ‘জটিল ইতিহাস’ যেখানে উদারতার পরিবর্তে নির্মম কাহিনীর জন্ম দেয়।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুবুর রহমান রুহেলের নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো বিদ্রোহী নেতা গিয়াসউদ্দিনকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করেছেন আ জ ম নাছির। লতিফের বিরুদ্ধে ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমনসহ অনেকের পক্ষেই অবস্থান ছিল নাছিরের। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে কেউ সমর্থন দিলে কখনও কখনও সেটি প্রতিহিংসার দিকে ঝুঁকতে থাকে। আ জ ম নাছির দলের সাধারণ সম্পাদক এবং মেয়র প্রার্থীর হওয়ার পেছনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের অবদানের কথা কমবেশি সকলেই জানেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ ও আ জ ম নাছিরের এই জটিল সমীকরণে নওফেলের রাজনীতি লাভবান হবে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।
চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, সিডিএ’র সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম ও সিডিএ’র বর্তমান চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ এদের সমর্থনও নওফেলের প্রতি। নওফেল নিজে অবশ্য এসব সমীকরণকে পাত্তাই দিতে চান না। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এসব ঝুট-ঝামেলার মধ্যে মনোযোগ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দায়িত্ব দিয়েছেন সেটি নিয়ে দেশব্যাপী কাজ করার মধ্যে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ব।’
বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর তিলে তিলে গড়া রাজনীতি থেকে কেন দূরে থাকবেন? তার উত্তর, ‘প্রত্যক্ষভাবে নয়, আমি পরোক্ষভাবে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করার কাজ করব ঠিকই। এবার চট্টগ্রামে আমাদের দলের নেতৃত্ব যাতে তারুণ্যনির্ভর হয় সেটিও মাথায় রাখতে হবে।’
২০০১ সালের একটি ঘটনা বেশ মনে পড়ছে। সে বছর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও আনোয়ারা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বেসরকারি ইউসিবিএল ব্যাংকের পরিচালক হুমায়ুন জহির হত্যা মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান। এরপরেই চট্টগ্রামের আওয়ামী রাজনীতিতে বাবু অনুসারীদের দাপট ও প্রভাব বাড়তে শুরু করে। এটি প্রায় সকলেই জানে চট্টগ্রাম প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ ও মহিউদ্দিন চৌধুরীর তিনটি ধারায় বিভক্ত ছিল। আজ প্রায় দুই দশক পরে এই তিন ধারার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর জায়গা নিচ্ছে তারই সুযোগ্য সন্তান নওফেল। প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরীর বড় ছেলে ও সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ অবশ্য এসব গ্রুপ বা বলয়কে বিশ্বাস করেন না। তবে বাবার অনুসারীদের প্রতি তার বরাবরের মতোই দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের উপস্থিতি এখন অনেক বেশি কার্যকর। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছেও তার সহজ যাতায়াত। রাজনীতিতে আবেগের জায়গা নেই। তারপরও মোশাররফের সকল আবেগ ছেলে রুহেলকে কেন্দ্র করে।
নওফেল মন্ত্রী হওয়ায় দলের রাজনীতিতে প্রভাবের বিষয় খুব বেশি গুরুত্ব দিতে চান না আ জ ম নাছির। তার মতে, ‘মন্ত্রী হলো রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের অধীন। এর সঙ্গে দলের রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। মহিউদ্দিন ভাই মন্ত্রী না হয়েও সারাদেশে আওয়ামী রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্ত করতে পেরেছেন তার বুদ্ধিমত্তা ও দলের প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে। দলের নেতাকর্মীদের প্রতি কতটা সংবেদনশীল থাকবেন সেটিও আওয়ামী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।’ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে নিজের অবস্থান দৃঢ় করতে সচেষ্ট ছিলেন আ জ ম নাছির। নিজের অনুসারীদের প্রতি তিনি বেশি আন্তরিক বলেও আলোচনা রয়েছে।
নওফেল নিয়ে রাজনীতির কথা তো হলো। পারিবারিক জীবনে তিনি অনেক মানসিক যন্ত্রণা সয়েছেন। অল্প বয়সে শিক্ষার জন্য ঘরের বাইরে থাকায় মায়ের আদর থেকে যেমন বঞ্চিত হয়েছেন তেমনি বাবার শাসন থেকেও। ক্যানসার আক্রান্ত বোন টুম্পাকেও হারিয়েছেন। বলতে গেলে এই পৃথিবীতে তিনিই তার আপনজন। ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন বলে তার রাজনীতির স্টাইলও একটু ভিন্ন। বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর মতো গণজনভিত্তিক নয়। শিক্ষা, আধুনিকতা আর বিনয় তার বড় অহংকার। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দরনগরী চট্টগ্রামের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে তিনি কতটা বাবার মতো জনপ্রিয় হতে পারবেন সেটি এখন তার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
এই বলে শেষ করতে চাই, মন্ত্রী না থাকলেও এমপি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের ক্ষমতার প্রভাব-বলয় অনেক বিস্তৃত। শোনা যায়, বিগত মন্ত্রিসভার অনেকেই জাবেদকে সমীহ করতেন। রুহেল এখনও বাবার ছায়ায়। শিক্ষা আর দলের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ তাকে বাড়তি সুবিধা পেতে সাহায্য করবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আর রাজনীতিতে মন্ত্রী নওফেল কিভাবে সমন্বয় ঘটাবেন, বাবা মহিউদ্দিন চৌধুরীর শুভাকাঙ্ক্ষী ও অনুসারীদের কিভাবে সন্তুষ্ট রাখবেন অথবা বাবার প্রতিপক্ষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আচরণের মাত্রা কোন লেভেলে সামলাবেন সেটি এখন চট্টগ্রামের মানুষের কাছে হাজার কোটি টাকার প্রশ্নের মতো!
মন্ত্রীত্ব তার জন্য অবারিত সুযোগ-সম্মান। এর বিপরীতের শব্দটি খুবই নির্মম আর বেদনাদায়ক। জনাব, নওফেল আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কী বলতে চেয়েছি!
লেখক: আবাসিক সম্পাদক, একুশে টিভি, চট্টগ্রাম।