পশ্চিমা বিশ্ব বেমালুম এটা ভুলে যায় যে ইহুদি গণহত্যার দায় ইউরোপের, অথচ ক্ষতিপূরণের জন্য মূল্য গুনতে হচ্ছে আরবদের, বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাসের হামলার মধ্য দিয়ে যুদ্ধের শুরু। ইসরায়েল ওই দিনই গাজায় পাল্টা হামলা করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কয়েক মাসের যুদ্ধে গাজায় ৩২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। তাদের বেশির ভাগ নারী ও শিশু। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখো ফিলিস্তিনি। অবরুদ্ধ গাজায় দেখা দিয়েছে চরম মানবিক সংকট। আকাশ থেকে গাজাবাসীকে লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র একাধারে দুটি জিনিস ফেলছে, যেমন: বোমা ও খাবারের ঝাঁকা। অন্যভাবে বলতে গেলে, একাধারে মৃত্যু ও জীবনদায়ী বস্তুর জোগান দিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভারসাম্যহীন মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে গোঁজামিল দিয়ে ভারসাম্য খুঁজছেন।
গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে এর আগে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাস হয়নি। তবে এবারের প্রস্তাবটি নজিরবিহীনভাবে চৌদ্দ-শূন্য ভোটে পাস হয়েছে। প্রস্তাবটিতে ভোট আর ভেটো কোনোটিই দেননি জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড। প্রস্তাবে গাজায় যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি অবিলম্বে ও নিঃশর্তভাবে হামাসের হাতে জিম্মি দশায় থাকা ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে গাজায় ত্রাণসহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
গাজায় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড শুরুর পাঁচ মাস পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অধিকৃত ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব পাস হলো। যুদ্ধ শুরুর পর বেশ কয়েকবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উঠলেও যুক্তরাষ্ট্র তাতে তিন দফা ভেটো দিয়েছে। সম্ভবত, ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তীব্র প্রতিক্রিয়া, নির্বাচনী বছরে ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাতকঠিন সমর্থনের কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ সমালোচনা ইত্যাদি কারণে ওয়াশিংটন ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে, কিংবা ভেটোও প্রয়োগ করেনি। রাষ্ট্রদূত জাতিসংঘকে বলেছেন, প্রস্তাবের সব বিষয়ে তারা একমত নন। তার এ বক্তব্যে প্রায় ৩২ হাজার বেসরকারি ফিলিস্তিনি নাগরিক হত্যা নিয়ে মার্কিন সরকারের যে নৈতিক অস্পষ্টতা, তা প্রকাশ্যে আসে। তারা হয়তো এখন ভাবছে গণহত্যার প্রতিটি ঘটনায় ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর চেয়ে এই অবস্থান শ্রেয়তর।
যদিও গাজার মানুষের ভোগান্তির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত নিয়ে উদ্যাপনের কিছু নেই। তারপরও এই সিদ্ধান্তের কিছু প্রভাব আছে। হয়তো অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নৈমিত্তিক যে হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসে সাময়িক বিরতি আসবে। প্রিয়জনের জন্য শোক করার সুযোগ পাবে গাজাবাসী, ক্ষত প্রশমনের দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক প্রক্রিয়াও শুরু হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব সম্প্রতি রাফা সীমান্তে গিয়ে গাজায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছানোয় যে প্রতিবন্ধকতা তা অপসারণের আহ্বান জানিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ইসরায়েল। আশা করা হচ্ছে, যুদ্ধবিরতিতে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসা সহায়তা গাজার বিপর্যস্ত হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছাবে।
দুর্ভিক্ষ যা ইসরায়েলের সৃষ্টি, তা এখন গাজায় হানা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গাজা উপত্যকায় শিশুরা মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। উপরন্তু হাজার হাজার শিশু এই যুদ্ধে অনাথ হয়েছে। চোখের সামনে গণহত্যা যারা ঘটতে দেখেছে, সেই শিশুদের জন্য বিশেষ চিকিৎসাসেবা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ মুহূর্ত থেকে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করতে হবে।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবারের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকায় এবারই প্রথম জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পর্ষদ নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান-সংবলিত প্রস্তাব পাস হলো। জো বাইডেন প্রশাসনের ভেটো না দেওয়ার এমন নীতি নজিরবিহীন। বিশ্লেষকদের মতে, এর মধ্য দিয়ে গাজা নিয়ে ইসরায়েলের নেতৃত্বের প্রতি ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান হতাশা মনোযোগ কেড়েছে। যদিও ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতীকী কিংবা বাগাড়ম্বরপূর্ণ প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে এসে ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের মৌলিক সমর্থনের বিষয়টি নতুন করে চিন্তাভাবনা করা দরকার।
বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে ইসরায়েল সরকারের প্রতি গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মানুষজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গাজায় আরও ত্রাণ বিতরণের সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি গাজা নিয়ে নীতি বদলে ফেলছে যুক্তরাষ্ট্র? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে। স্পষ্ট ভাষায় জবাব দিয়েছেন হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক মুখপাত্র জন করবি। তিনি বলেন, আমাদের ভেটো না দেওয়া কখনোই, আমি আবারও বলছি, কখনোই আমাদের নীতি পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে না। জন করবি আরও বলেন, আমাদের অবস্থান সুস্পষ্ট। আমরা জিম্মি মুক্তি চুক্তির অংশ হিসেবে যুদ্ধবিরতির পক্ষে বরাবর নিজেদের সমর্থন জানিয়ে এসেছি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থানকে ভিন্নভাবে দেখছেন নেতানিয়াহু। বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর দপ্তর জানিয়েছে, নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি পাস হওয়া ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা মার্কিন প্রশাসনের আগের অবস্থান থেকে স্পষ্টত সরে আসার উদাহরণ। নেতানিয়াহুর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো না দেওয়ার ঘটনা হামাসের বিরুদ্ধে চলমান ইসরায়েলি যুদ্ধচেষ্টার পাশাপাশি হামাসের হাতে থাকা ১৩০ জনের বেশি জিম্মিকে মুক্ত করার চেষ্টাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় নেতানিয়াহু তার দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের পূর্বনির্ধারিত ওয়াশিংটন সফর বাতিল করেছেন। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফায় সম্ভাব্য ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে দেশটির প্রতিনিধিদলের ওয়াশিংটন সফর করার কথা ছিল। নিরাপত্তা পরিষদের ভোটাভুটির আগেই ইসরায়েল জানিয়ে দিয়েছিল, যদি জো বাইডেন প্রশাসন ভেটো দেওয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে তারা তাদের প্রতিনিধিদলকে ওয়াশিংটনে পাঠাবে না। রাফায় পুরোদমে সামরিক অভিযান শুরু না করতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওয়াশিংটন।
মনে রাখতে হবে, এর আগেও নভেম্বরে সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে ইসরায়েল ও হামাস সম্মত হয়েছিল। কিন্তু দ্রুতই দীর্ঘ মেয়াদে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা ভেঙে যায়। যুদ্ধবিরতির নতুন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়া প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে, তেল আবিব কি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তকে মেনে নেবে, নাকি হিংস্র রাষ্ট্র হিসেবে যে পরিচিতি তারা পেয়েছে, সেই পরিচিতিই অক্ষুন্ন রাখবে? প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক, কারণ জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত- সাত দিনে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৩০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। তারা কি গাজায় এই নৃশংসতা চালিয়ে যাবে?
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক