সামীউর রহমান ‘লালমোহন বাবু, জিলিপি বস্তুটা কী বলুন তো’, চারমিনারে ধোঁয়ার রিং ছুড়ে প্রশ্নটাও ছুড়ে দিল ফেলুদা। আমরা বসে আছি ঢাকার গুলশানে এক ধনী ব্যবসায়ীর বাড়িতে। ভদ্রলোক ফেলুদার শাঁসাল মক্কেল দীননাথ লাহিড়ীর বন্ধু। কলকাতায় তার ব্যবসাপত্তর দীননাথ বাবুই সামলান। খুব তড়িঘড়ি করে দীননাথ বাবু যেভাবে আমাদের বাংলাদেশে নিয়ে এলেন, আর বাড়ির যে বহর দেখছি তাতে বুঝতে পারছি ভদ্রলোক টাকার কুমীর নন, তিমি মাছ গোত্রের। নাম আলম খান। দামি সোফা আর বাহারি ঝাড়বাতির নিচে বসে থেকে পনির দেওয়া ঢাকাই বাকরখানি আর মালাই চা সাবাড় করেও আমরা এখনো ভদ্রলোকের দেখা পাইনি।
‘তা যা বলেছেন মশাই, জিলিপি হচ্ছে গিয়ে অমৃত। যদি গরম-গরম খাওয়া যায়। আমাদের গড়পাড়ের সুখেনের দোকানের জিলিপি যাকে বলে ওয়ার্ল্ড ফেমাস...’ এসব বলতে বলতে লালমোহন বাবু কথা থামিয়ে দিলেন কারণ, দীননাথ বাবু একজন সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে বসার ঘরে ফেরত এসেছেন। ভদ্রমহিলার বয়স ৪০ থেকে ৪৫-এর ঘরে হবে, দেখে বোঝা যায় বয়সকালে সুন্দরী ছিলেন। গুছিয়ে শাড়ি পরেছেন, হালকা তবে দামি গয়না শরীরে। ফেলুদা উঠে দাঁড়ালে আমরাও দাঁড়াচ্ছিলাম, তিনি বললেন ‘বসুন। আমি রীনা খান। আলম খান আমার স্বামী। দীননাথ বাবুকে আমিই বলেছি আপনাদের যে করেই হোক ঢাকায় নিয়ে আসতে।’ বসতে বসতে ফেলুদা বলল, ‘আলম সাহেবকে খুঁজে বের করতে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব। সেই সঙ্গে যারা তাকে অপহরণ করেছে, তাদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসব, আপনি একদমই চিন্তা করবেন না।’ বিস্ময়ে রীনা খান জানতে চাইলেন, ‘আপনি কীভাবে জানলেন যে আলমকে অপহরণ করা হয়েছে? ফেলুদা একটা বাকরখানি তুলে নিয়ে বলল, ‘কলকাতা থেকে গোয়েন্দা প্রদোষ চন্দ্র মিত্তিরকে উড়িয়ে আনা হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই হারানো বেড়াল খুঁজে বের করার জন্য নয়। অন্য কোনো কাজ থাকলে সেটা আলম সাহেব সরাসরিই যোগাযোগ করতেন। দীনুবাবুকে ধরতে হতো না। এখন বলুন শেষবার তার সঙ্গে যখন আলাপ হয়, তখন তিনি কোথায় ছিলেন?’
‘আসলে উনার সঙ্গে আমার সবশেষ কথা হয় পরশু বিকেলে। ছেলেমেয়েরা বায়না ধরেছিল জিলিপি খাবে। সেই জিলিপি কিনতেই উনি বের হয়েছিলেন, এরপর আর বাসায় ফেরেননি’, জানালেন আলম সাহেবের স্ত্রী। তাহলে এজন্যই কি ফেলুদা লালমোহন বাবুকে জিলিপি নিয়ে প্রশ্ন করছিল? কিন্তু কেন? এসব যখন ভাবছি তখনই পাশের নিউজপেপার র্যাক থেকে একটা কাগজ তুলে নিল ফেলুদা, ‘এই জিলিপি? দ্য গোল্ডেন কয়েন, বাংলায় যাকে বলা যায় স্বর্ণকুন্ডল’। আমি তাকিয়ে আছি পত্রিকার দিকে, পুরো পেছনের পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন। সোনায় মোড়ানো জিলিপি বিক্রি হচ্ছে ঢাকার এক পাঁচতারা হোটেলে। ১ কেজি জিলিপির দাম ১ কোটি টাকা! রীনা বললেন, ‘হ্যাঁ, গরিব মানুষের রক্ত চুষে খেতে খেতে আমাদের মুখটা পানসে হয়ে গেছে। ব্যাংকও গোটা চারেক খাওয়া হয়েছে। স্বাদবদলের জন্য ছেলে, মেয়ে, মেয়ের জামাই সবাইকে নিয়ে ভাবছিলাম এই সোনার জিলিপি খাব। সোনার জিলিপি খাবার জন্য রুপোর প্লেটও নামিয়েছিলাম, কিন্তু ও তো জিলিপি নিয়ে এলো না। ফোনও ধরছে না। তাই আপনাদের খবর দিলাম। যত টাকা লাগে লাগুক, আপনি আলমকে খুঁজে এনে দিন।’
ফেলুদা জিলিপির বিজ্ঞাপনটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সেখানে লেখা, ‘শতভাগ খাঁটি ২৪ ক্যারেট সোনার তৈরি জিলিপি। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সুগার ফ্রি জিলিপির বন্দোবস্তও আছে। কমপক্ষে ১ কেজির নিচে বিক্রি হয় না। ৫ কেজির বেশি কিনতে হলে অগ্রিম অর্ডার আবশ্যক। নগদ মূল্যে বিক্রি। কোনো রকম কার্ড বা ডিজিটাল মুদ্রা গ্রহণযোগ্য নয়’। সেই জিলিপির প্রমাণ সাইজ ছবি দেখে মনে হচ্ছে সোনার সাপ কুন্ডুলি পাকিয়ে আছে, আর গা থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে একটা অশুভ আলো। বিজ্ঞাপনে দেওয়া কিউ আর কোডটা ফেলুদা তার আইফোন ১৫ প্রো ম্যাক্স দিয়ে স্ক্যান করে নিতেই (কী! ফেলুদার হাতে আইফোন দেখে বিস্ময় হচ্ছে? সেই ১৯৮৩ সালে হংকং গিয়ে ফেলুদা যদি মাইক্রো ক্যাসেট রেকর্ডার কিনতে পারে, তাহলে ২০২৪ সালে এসে তার কাছে লেটেস্ট আইফোন থাকবে না!) ম্যাপে হোটেলের লোকেশন পাওয়া গেল। তারপর বলল, ‘লালমোহন বাবু, আপনি একটু বৈকুণ্ঠ মল্লিক ঢাকার যানজট নিয়ে কোনো কবিতা লিখেছেন কি না সেটা মনে মনে বের করুন, আমি আর তোপসে একটু বেড়িয়ে আসছি।’ জটায়ু আমতা-আমতা করে বললেন, ‘একযাত্রায় পৃথক ফল, সে কি করে? থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ঢাকা এলো আর প্রথমেই আমাকে আউট করে দিলেন।’ ফেলুদা বলল, ‘আপনি বিখ্যাত লেখক, আপনাকে লোকে চিনে ফেললে আমাদের কার্যসিদ্ধি হবে না। আপনার ইনিংসের সময় হলে আপনি ঠিক খেলতে নেমে যাবেন।’ বলেই দীননাথ বাবুকে বলল, ‘ড্রাইভারকে বলুন গাড়ি বের করতে। হোটেল ইন্টারগ্যালাকটিক যেতে হবে।’
ঢাকার বিখ্যাত যানজট ঠেলে হোটেল ইন্টারগ্যালাকটিকের কাছাকাছি যেতেই দেখি অডি, মার্সিডিজ, প্রাডো গাড়ির লম্বা লাইন। লাখ টাকার সোনার জিলিপি খেতে বড়লোকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছে! ফেলুদা টুক করে তার আইফোনে গিম্বেলটা লাগিয়ে নিয়ে ওয়্যারলেস কলার মাইকটা সেঁটে নিল। তারপর আমার হাতে ফোনটা দিয়ে বলল, ‘শোনো, আমরা হচ্ছি খাই টিউবের বিখ্যাত ফুড ভ্লগার খাদকদা, সঙ্গে তুই আমার ভাইপো নীড়। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি শুধু এই সোনার জিলিপি নিয়ে ভ্লগ বানাতে বুঝেছিস। আর শোন, কথা বলার সময় একটু স্যাম বাজারের সসি বাবু হয়ে যাবি। এখানকার লোকে তাহলে আমাদের অথেন্টিক মনে করবে।’ কথাগুলো শুনে গাড়ি থেকে নামলাম, ফেলুদা হেঁটে যাচ্ছে আর আমি তাকে ভিডিও করছি। গ্রাউন্ড ফ্লোরেই সোনার জিলিপি বিক্রির কাউন্টার, বেশ কজন আর্মড গার্ডও আছে। বিজ্ঞানীর মতো মাস্ক পরে দুজন লোক ডিজিটাল স্কেলে মেপে সোনার জিলিপি তুলে তুলে মেপে প্যাকেট করছে। এদের সামনে গিয়েই ফেলুদা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলতে শুরু করল, ‘হ্যাল্লো গাইজ দিস ইস খাদকদা আর সঙ্গে আছে ভাইপো। আমরা চলে এসেছি কলকাতা থেকে, তোমাদের দেখাব ঢাকায় কি করে লোকে সোনার জিলিপি খাচ্ছে।’ আমি মনে মনে বললাম, সোনার কেল্লা দেখা হয়েছে, তবে সোনার জিলিপিও যে দেখতে হবে সেটা জন্মেও ভাবিনি। কলকাতা থেকে এসেছি শুনেই হোটেলের ম্যানেজার বিগলিত হয়ে বললেন, ‘আগে সোনার বিস্কুট আনাতাম, এখন জিলিপি আনাচ্ছি। এই সময়টায় জিলিপির কদর ভালো। আমাদের জিলিপির সোনা ১০০ ভাগ খাঁটি। বিমানবন্দরে চোরাচালানিদের কাছ থেকে যে সোনাগুলো ধরা হয়, সেসব ইমপোর্টেড সোনা আমরা গোপনে কিনে নিই। সেই সোনা দিয়ে বানানো হয় আমাদের এই স্পেশাল জিলিপি। দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, অসৎ ব্যবসায়ী, এরাই আমাদের খদ্দের। সাধারণ মানুষ তো গুড়ের জিলাপি খেতেই হিমশিম খাচ্ছে, সোনার জিলিপি কী করে খাবে? আল্লাহর রহমতে আমাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে। ২০ কেজি করেছিলাম, সব বিক্রি হয়ে গেছে। দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। এয়ারপোর্টের গোডাউন থেকে আমরা পেয়েছিলামই ৫৫ কেজি, আজই অর্ধেকের মতো শেষ। আবার চালানের ফ্লাইট না নামলে আমরা খুব বেশিদিন ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারব না।’ সব শুনে ফেলুদা তাকে খুব করে ধন্যবাদ দিয়ে একদম ফুড ভøগারদের কায়দায় চোখমুখ নাচিয়ে কথা বলে বিদায় জানানোর পর বলল, ‘চ তোপসে। এবার যাওয়া যাক।’
আলম সাহেবের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ফেলুদা বলল, ‘আলম সাহেব যে এখান থেকেই মিসিং হয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কে তাকে কিডন্যাপ করল। মুক্তিপণ চাইছে না কেন?’ ড্রাইভারকে এফএম রেডিওটা ছাড়তে বলল ফেলুদা, টিউন করতে করতেই একটা খবরে আমরা সবাই বাকরুদ্ধ, ‘দেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ ধনী ব্যক্তিকে কাল রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করা হলে তাদের গণসংযোগ বিভাগ এই ব্যাপারে কোনো তথ্য না জানালেও নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি বিশিষ্ট শিল্পপতি আলম খান, ব্যবসায়ী সামলান চৌধুরি ও পোশাকশিল্প মালিক খয়ের খাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না’। এসব শুনতে না শুনতেই হঠাৎ ফেলুদার ফোন বেজে উঠল, কলারের নাম দেখি গুরুদেব। ধরেই ফেলুদা ইংরেজিতে বলল, ‘তিনজন বোধহয় এক জায়গাতেই আছে। একই মানুষ বা দলের কীর্তি মনে হচ্ছে।’ ওপাশ থেকে চোস্ত ব্রিটিশ উচ্চারণ শোনা যাচ্ছিল, আমি শুধু শুনলাম ধাক্কা। ফোন রেখেই ফেলুদা বলল, ‘গুরুদেব এসে গেছেন। শার্লক হোমস চলে এসেছেন ঢাকায়। খয়ের খাঁর কোম্পানির বানানো কোট আর হ্যাট শার্লকের খুবই পছন্দ। এমন বিপদের দিনে তাই না করতে পারেননি। চার্টার্ড প্লেনে করে শার্লক চলে এসেছেন। গ্যালাকটিক হোটেলেই উঠেছেন। আমায় ভøগ করতেও দেখেছেন। ডেকে পাঠিয়েছেন। ড্রাইভার গাড়ি ঘোরাও’। অতএব ফের হোটেলে। রিসিপশন থেকে গ্র্যান্ড স্যুইটের হদিস জেনে নিয়ে উঠে পড়লাম নির্ধারিত লিফটে। গিয়ে দরজা নক করতেই ডাক্তার ওয়াটসন দরজা খুলে দিয়ে বললেন, ‘ফ্যালু মাই বয়। নাইস ঠু সি ইউ। অ্যান্ড ঠোপশে, ইউ হ্যাভ বিকাম আ বিগ বয়।’ ওয়াটসনের আলিঙ্গন এড়িয়ে ভেতরের রুমের দিকে যেতেই দেখা গেল হোমস বেহালা বাজানোয় ব্যস্ত। ছড়ি ঘষছেন, কিন্তু সুর বের হচ্ছে না। চোখ জানালায়। নিচে হোটেলের পুলসাইড দেখা যাচ্ছে। বেহালা নামিয়ে হোমস বললেন, ‘আমি ২ ঘণ্টা ধরে দেখছি, একটা হাউজ কিপিং স্টাফ বারবার একটা পুলসাইড চেঞ্জ রুমের দিকে যাচ্ছে। তার ট্রলিতে অনেক টাওয়েল। কিন্তু গত ২ ঘণ্টায় সেই রুম থেকে কাউকে বের হয়ে পুলে নামতে দেখিনি।’
তাহলে সে নিশ্চয়ই তোয়ালে ঢাকা দিয়ে কিছু নিয়ে যাচ্ছে। কী আছে ওখানে, নাকি কে? ‘বলল ফেলুদা। এখুনি জানবার উপায় নেই। তবে একটা কাজ করতে পার। হোটেলের আশপাশের ফার্মেসিগুলোতে অ্যাডাল্ট ডায়াপার আছে কি না দেখে আসো তো।’
‘তা নিশ্চয়ই’, বলল ফেলুদা, ‘ঢাকায় এসেই কি পেটের গোলমাল বাঁধিয়ে বসলেন নাকি গুরুদেব। অবশ্য অনেককাল আগে, যখন আপনার স্বজাতিরা যখন ভারতবর্ষে আসতেন, তখন মসলাদার খাবার খেয়ে তাদের পেট ছেড়ে দিত। এই অসুখটার নাম তখন দেওয়া হয়েছিল দিল্লি বেলি।’
‘জ্ঞান কপচানো ছাড়ো’, বিরক্তি নিয়ে বললেন হোমস, ‘তোমার অনেক আগে থেকে এ লাইনে আছি আর সঙ্গে একখানা মিলিটারি ডাক্তার নিয়ে ঘুরি। ওসব আমার হবে না, তোমায় যেটা বলছি সেটা করো’। ফেলুদা বেরিয়ে গেল, আমি ওয়াটসনের সঙ্গে আলাপ করছি আর হোমস বেহালায় ছড়ি ঘষছেন বেসুরো ভঙ্গিতে। ওয়াটসন জানতে চাইল, ‘হাউ ইট ফিলস টু বি আ সাইড কিক?’ আমি বুঝলাম না কাকে সাইড করে লাথি মারতে বলছে, এত ময়দান নয় যে গোরা সৈনিক ফুটবলারের সঙ্গে খেলতে নেমেছি সেই ১৯১১ সালে। হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে বলল, ‘ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, আ সাইড কিক ইজ আ...’ এসব বলতে বলতেই হোমসের গলা, ‘ওয়াটসন মাই ডিয়ার, দাদা মাইক্রোফটকে ফোন করে একটু বলবে ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে যেন একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করে দেয়। এখানে তো ট্যাক্সি নেই’।
এসব আলাপের মাঝেই ফেলুদা উপস্থিত। বলল, এদিকের কোন দোকান, ফার্মেসি, সুপার শপে অ্যাডাল্ট ডায়াপার নেই। শুনেই হোমস তড়াক করে বেহালা ফেলে দিয়ে বলল, ‘চল নিচে। ওখানেই খেলার বাকি অংশ।’ নিচে পুলসাইডে নেমেই শার্লক নাক উঁচু করে কি যেন শুঁকে শুঁকে হাঁটতে লাগল। পুল পার হয়ে পাশের চেঞ্জিং রুমের দিকে এসে বলল, ‘কিছু পাচ্ছো?’ ফেলুদা বলল, ‘ল্যাভেন্ডারের গন্ধ পাচ্ছি’। শার্লক বলল, ঠিক ধরেছো। এই এয়ার ফ্রেশনারটা লবিতে আর লাউঞ্জ এরিয়াতে ব্যবহার করা হয়। পুলসাইডে এটা ব্যবহার করার কথা না। এটা এখানে করা হচ্ছে তার মানে কোনো একটা কিছুর গন্ধ ঢাকা হয়েছে, সেই কিছু একটা কী? ‘পুলসাইডের চেঞ্জিং রুমটা তালাবদ্ধ। ডিজিটাল কি কার্ড, শার্লক তার ফোনটা লকপ্যাডের সামনে ধরে কিছুক্ষণ কি যেন করতেই কিররর শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে এয়ার ফ্রেশনারের তীব্র গন্ধ। বেশ কয়েকটা বড় বড় লকার। দরজা বন্ধ করা। একটা বেঞ্চ পাতা, একদিকে আয়না। হঠাৎ খুট করে একটা আওয়াজ হলো, মনে হলো আলমারিগুলোর ভেতরে কেউ আছে। এই আলমারিগুলোতে তালা-চাবি দেওয়া, চাবি থাকে হেলথ ক্লাব বা সুইমিং পুলের মেম্বারদের কাছে যারা মাসিক বা বার্ষিক চুক্তিতে হোটেলে এসে সাঁতার কাটে বা জিম ব্যবহার করে। এর মালিকদের কোথায় পাব? খাঁটি বাঙালি বুদ্ধির খেল দেখাল ফেলুদা। পকেট থেকে বের করল চাবির রিং-এর সঙ্গে আটকানো তালা খোলার যন্ত্র। সেটা দিয়ে কিছুক্ষণ গুঁতোগুঁতির পর একটা আলমারির কপাট খুলতেই দেখা গেল ভেতরে সামলানো চৌধুরির দেহ। সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটসন দেখলেন গলার কাছটা, পালস দেখলেন। বললেন, ‘কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে রাখা হয়েছে। বেঁচে আছেন। হঠাৎই সবার নাকে একটা বাজে গন্ধ এসে লাগল। শার্লক বললেন, বুঝতে পেরেছো, কেন অ্যাডাল্ট ডায়াপারের কথা বলেছিলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘ম্যানেজারকে ডাকি। ক্লিনারদের তো ডাকতে হবে। সামলান সাহেবকে এই অবস্থায় সামলানো তো যার তার কাজ নয়।’ শার্লক বলল, ‘তোমার বুদ্ধি হবে কবে? এই হোটেলে এসব কান্ড ঘটছে আর ম্যানেজার জানবে না। আমার বিশ্বাস সেই পালের গোদা। এক কাজ কর। এরপর আবার যখন এই ব্যাটার ডায়াপার বদল করতে আসবে তখন ওদের চেপে ধরব’। বেশ একটা পরিকল্পনা দাঁড়িয়ে গেল। আমরা চৌধুরিকে সেই লকারের ভেতরেই রেখে দরজার বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই হাউজ কিপিং স্টাফের। আধঘণ্টা পর ফের দেখা গেল তোয়ালের ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে আসছে সেই বান্দা। বয়সে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের কোটায়, শক্ত সমর্থ গড়ন। একে কাবু করা মুশকিল। লালমোহন বাবু সঙ্গে থাকলে তার বুমেরাং বা নেপালি ভোজালি দিয়ে নিশ্চয়ই কিছু একটা করতে পারতেন। তবে ওয়াটসনও কম নন। ‘এক্সকিউজ মি’ বলে তাকে থামালেন, সাহেব অতিথি দেখে লোকটাও থামল। এরপর হাসিমুখে আলাপ করে দুই পা এগিয়েই পেছনে থেকে নিজের হাঁটার ছড়িটা দিয়ে যেভাবে লোকটার মাথায় ঘটাং করে মেরে অজ্ঞান করে দিলেন, তাতে ব্রিটিশদের বেইমানি বুদ্ধির প্রশংসা করতেই হলো। অজ্ঞান লোকটাকে তোয়ালে মোড়া করে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হলো চেঞ্জিং রুমে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফেরানো হলো। এরপর জেরা করল ফেলুদা আর শার্লক মিলে। গরগর করে সব উগরে দিল সে। জানা গেল, সোনার জিলিপির খদ্দেরদের পেট থেকে সোনা বের করার জন্যই এই চক্রান্ত করেছিল হাউজ কিপিং স্টাফ আর ম্যানেজার মিলে। সোনার জিলিপির সঙ্গে জোলাপ খাইয়ে দেওয়া হয়েছিল তিনজনকে। ফলে তাদের পেট থেকে সোনা, পাচার হওয়া ডলার, দখল করা জমিসহ অনেক কিছুই বের হয়ে আসছিল, যা জমা হচ্ছিল অ্যাডাল্ট ডায়াপারে। সেসব হাতিয়ে নিয়ে উগান্ডায় পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল দুষ্ট হোটেল ম্যানেজারের। তবে ফেলুদা আর শার্লক হোমসের যৌথ তৎপরতায় তারা অল্পের জন্য সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচে গেছেন। ম্যানেজার আর হাউজ কিপিং বিভাগের কর্মীদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, আর আলম খান, খয়ের খাঁ, ও সামলান চৌধুরি যাচ্ছেন সিঙ্গাপুরে, উন্নত চিকিৎসার জন্য। আর ব্রিটিশ হাইকমিশনের গাড়িতে আমরা চলেছি পুরান ঢাকার পথে। জিলিপি নয়, বিরিয়ানি আর কাবাব খেতে।