বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

ভারতে মোদির উত্থান 

অমিত সাফল্যের কারিগর অমিত ভাই 

আপডেট : ০৪ মে ২০২৪, ০৮:৫৮ পিএম

নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মতো জিতে রেকর্ড করতে পারবেন কি না সেটা তিনি জানতে পারবেন সামনের জুন মাসে। এক দশকের ক্ষমতায় তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বারবার। তবে কম আলোড়িত একজন রাজনীতিবিদকে সব সময় তার পাশে দেখা গেছে, যিনি কৌশলপ্রণেতা হিসেবে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অসাধারণ উত্থানে সাহায্য করে গেছেন। তিনি অমিত শাহ। তিনি নরেন্দ্র মোদির শক্তিশালী পুরনো বন্ধু, সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন এবং তার নির্বাচনী সিদ্ধান্তের নেপথ্যের মস্তিষ্ক। কট্টরপন্থি হিন্দু জাতীয়তাবাদী অমিত শাহ দলের কর্মীদের মধ্যে ‘অমিত ভাই’ নামেই বেশি পরিচিত। তার হাত ধরেই ভোটের মাঠে টানা সাফল্য আসছে বিজেপির তথা মোদির।

বিবিসি গুজরাটের সাংবাদিক গীতা পাণ্ডের ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মতো তারকাখ্যাতি অমিত শাহর নেই। তিনি নিজের গণ্ডিতে চলতেই পছন্দ করেন। তবে তিনি একজন দক্ষ সংগঠক, প্রচার কৌশলবিদ, একজন ঝানু রাজনীতিবিদ এবং মোদির মতোই বিভাজনের রাজনীতির জন্য পরিচিত। সমর্থকরা তাকে ‘হিন্দু আদর্শের মহান রক্ষক’ হিসেবে দেখেন; কিন্তু কেউ তার সঙ্গে টক্করে যাওয়ার সাহস দেখালে, তার জন্য তিনি ভয়ংকর প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন।
অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, কাশ্মীরের আংশিক স্বায়ত্তশাসন বাতিল করাসহ ভারতের কিছু বিতর্কিত আইনের নেপথ্যের ব্যক্তি এই অমিত শাহ। কাশ্মীরের বিষয়টি কয়েক দশক ধরেই বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল। নতুন নাগরিকত্ব আইন করার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, যে আইনকে মুসলমানদের জন্য বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অমিত শাহর বন্ধু ও সহকর্মী, যারা তাকে স্কুলে পড়ার সময় থেকে, কিংবা পেশাজীবনের প্রথম থেকে চেনেন; এমনকি জেল খাটার সময়ও পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এই বিজেপি নেতার প্রথম দিককার জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন বিবিসির গীতা পাণ্ডে। অমিত ভাইয়ের অসাধারণ সাফল্যের পেছনে কী কী কাজ করেছে, তা বর্ণনা করেছেন তারা। দলীয় কর্মীদের প্রতি তার গভীর স্নেহ আর কঠোর পরিশ্রমের মানসিকতার কথা তারা বলেছেন।

প্রধান কৌশলবিদ : অমিত শাহ জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে প্রথম আলোচনায় উঠে আসেন এক দশক আগে, যখন তিনি ভারতের নির্বাচনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিজেপির জন্য একটি অসাধারণ জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হন। বছরের পর বছর ধরে উত্তর প্রদেশকে অজেয় হিসেবে দেখেছে বিজেপি। তবে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলটি এই রাজ্যের ৮০টি আসনের মধ্যে ৭১টিতে অভ‚তপূর্ব জয় তুলে নেয়। 
অমিত শাহর সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করা বিজেপির প্রাক্তন রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী যতিন ওঝা বলছেন, অমিত শাহর জন্য ঈশ্বরের একটি উপহার আছে, তা হলো চাণক্যের চেয়েও তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক।

পরে অমিত শাহর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলেও যতিন ওঝা বলেন, বন্ধু, এমনকি প্রতিদ্বন্ধীরাও একমত হবেন যে, অমিত শাহ তার দক্ষতা সবচেয়ে নিখুঁতভাবে ব্যবহার করেছেন নির্বাচনের সময়।
২০১৪ সালের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ ও ২০২২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জয় তুলে নিয়ে ইতিহাস গড়েন অমিত। ২০১৯ সালেও বড় জয় পায় তার দল। যতিন ওঝা বলছেন, প্রথম থেকেই তার মনে হতো, অমিত শাহ এক দিন ‘ক্ষমতার চূড়ায়’ পৌঁছে যাবেন। তিনি বলেন, ‘আমি তার মধ্যে সেই স্ফুলিঙ্গ দেখেছি, তার মধ্যে সেই রাজনৈতিক দীপ্তি দেখেছি। তিনি সেই ঘোড়া, যে বড় রেশ জিততে যাচ্ছেন।

যেখানে সবকিছুর শুরু : ১৯৬৪ সালের ২২ অক্টোবর গুজরাটের ছোট্ট শহর মানসায় জন্মগ্রহণ করেন অমিত শাহ। তার বাবা অনিল চন্দ্রের ছিল পিভিসি পাইপ তৈরির একটি ছোট ব্যবসা। মা কুসুমবেন ছিলেন গৃহিণী। ১৬ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে গুজরাটের সবচেয়ে বড় শহর আহমেদাবাদে চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অমিত শাহ যেখানে থাকতেন, বন্ধুদের সঙ্গে যে বাগানে ক্রিকেট ও মার্বেল খেলতেন, সেই পারিবারিক পরিসর বিবিসির গীতা পাণ্ডেকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন অমিত শাহর বাল্যবন্ধু সুধীর দর্জি। অমিত শাহদের বারোয়ারি ভিটাও আছে এর মধ্যে। 
পাশের যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অমিত শাহ এবং সুধীর দর্জি পড়তেন, তাদের সেই খেলার মাঠ, শ্রেণিকক্ষ, খেলনার আলমারি আর স্কুলের ঘণ্টা যেন অর্ধশতাব্দীতেও বদলায়নি।

সুধীর বলেন, অমিত শাহ বেশ শান্ত স্বভাবের ছিল। দুজন ছাত্র তাকে উত্ত্যক্ত করত, একবার তার সেটা ভেঙে দিয়েছিল। দুপুরের খাবার চুরি করত। ওই রকম বাজে আচরণের জন্য প্রায়ই অধ্যক্ষের অফিসে তাদের ডাক পড়ত।

এক গাড়ির দুই চাকা : ১৯৮২ সালে উগ্র ডানপন্থি সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে (আরএসএস) যোগ দেন অমিত শাহ। ওই সময়ই আহমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়। মোদি তখন আরএসএসের একজন প্রচারক। তিনি তার অনুজ সহকর্মীকে (অমিত শাহ) বিজেপির ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদে যোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন। অল্পদিনেই দুজনের মধ্যে দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়। মোদির পদোন্নতি হতে থাকে দ্রæত, অমিত শাহরও তাই। সমর্থকরা তাদের নাম দেন ‘এক গাড়ির দুই চাকা। হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের দুই ভাই রাম ও ল²ণের সঙ্গেও তাদের তুলনা চলতে থাকে। চলতি শতাব্দীর শুরুর দশকে গুজরাটে টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কিংশুক নাগ। তিনি বলেছেন, মোদি আর অমিত পরস্পরের জন্য একেবারে উপযুক্ত ছিলেন। মোদি জনসাধারণকে মুগ্ধ করতে পারতেন, তিনি সামনেই থাকতেন। তবে অমিত নিজের মতো করে থাকা মানুষ, কিছুটা লাজুক স্বভাবের, যিনি লাইমলাইট থেকে দূরেই থেকেছেন। অমিত শাহ কাজ করেছেন পর্দার আড়ালে, নিজের ভিত্তি তৈরি করেছেন, বন্ধু ও অনুসারীদের মন জয় করেছেন এবং নির্বাচনে পরাজিত করেছেন প্রতিদ্বন্ধী ও প্রতিপক্ষকে।

গুজরাটেই উত্থান : অমিত শাহ রাজনৈতিক কারিকুরি শিখেছেন তার নিজ রাজ্যে; বছরের পর বছর ধরে তিনি নিজেকে নরেন্দ্র মোদির ডান হাত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ১৯৮৭ সাল থেকে তাকে চেনেন এমন একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী আরডি দেশাই। তিনি বলেছেন, তিনি (অমিত শাহ) প্রতিভা খুঁজে বের করতে পারদর্শী। যাদের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেন, সেই তরুণদের তিনি সমর্থন দিয়ে যান। কিন্তু রাজনীতিতে আসার পর দেড় দশকের বেশি সময় তিনি নিজে কোনো নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্ধিতা করেননি, বলেছেন ‘আগে আমাকে সংগঠন গড়তে হবে।’ 
অমিত শাহ প্রথমবার গুজরাট বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৯৭ সালে। নরেন্দ্র মোদি তাকে বিধানসভার সারখেজ আসনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯৮, ২০০২ ও ২০০৭ সালেও একই আসন থেকে জয়ী হন শাহ। ২০০৮ সালে আসনটি বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি নারায়ণপুরায় চলে যান। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে (লোকসভা) অমিত শাহ প্রার্থী হননি। তবে ২০১৯ সালে গান্ধীনগর থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং এবারও তিনি একই আসন থেকে বিজেপির প্রার্থী।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং তার পরের ঘটনাপ্রবাহ মোদি-অমিত সম্পর্কের নতুন পটভূমি তৈরি করে, পরে যা আরও বিকশিত হয়েছে। মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। দাঙ্গার কয়েক মাস পরে বিজেপি যখন ধর্মীয়ভাবে দারুণ বিভক্ত গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করল, অমিত শাহকে তখন এক ডজন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো। 
রাজ্যপুলিশ এবং প্রসিকিউশন তখন অমিত শাহর অধীনে। দাঙ্গা নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল তার অধীনে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিছু মামলার তদন্তে গাফিলতির জন্য সুপ্রিম কোর্টে ভর্ৎসনার শিকার হয়েছিলেন তদন্তকারীরা। এটিকে ‘ন্যায়বিচারের বিচ্যুতি’ হিসেবে বর্ণনা করেছিল ভারতের শীর্ষ আদালত। 
গুজরাট সরকারও তখন আদালতে স্বীকার করেছিল, মামলা নথিভুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজ্যপুলিশের পক্ষ থেকে এবং সাক্ষীদের প্রমাণ রেকর্ড করার ক্ষেত্রে প্রসিকিউশনের কিছু ‘ত্রুটি’ হয়েছে।

দাঙ্গায় ভূমিকার জন্য অমিত শাহর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে বছরের পর বছর ধরে। সেসব অভিযোগ তিনি বরাবরই অস্বীকার করে গেছেন। বিবিসি লিখেছে, এসব বিষয়ে কথা বলতে অমিত শাহর অফিসে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাননি তারা।
খুনের অভিযোগ ও জেলখানার দিনগুলো : ২০০৮ সালে অমিত শাহর জীবন জটিল হয়ে উঠতে থাকে। তিন বছর আগে, ২০০৫ সালে সোহরাবুদ্দিন শেখ এবং তার স্ত্রী কউসার বাইকে বিচারবহিভর্ভূতভাবে হত্যার জন্য অমিত শাহকে দায়ী করা হয় সে সময়। অমিত শাহ ওই অভিযোগ ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অস্বীকার করেন। তারপরও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১০ সালে তার বিরুদ্ধে হত্যা ও অপহরণের অভিযোগও আনা হয়। 
নরেন্দ্র মোদির উত্তরসূরি হিসেবে গুজরাটের ভবিষ্যৎ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাকেই দেখছিল রাজ্যের মানুষ। তবে ওই ঘটনাপ্রবাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল এবং তিন মাসের বেশি তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। অমিত শাহ জামিনে মুক্তি পেলে সাক্ষীদের প্রভাবিত করা থেকে বিরত রাখতে তাকে গুজরাট ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ছয় মাস পর আদালত অমিত শাহকে খালাস দেয়। বিচারক এমবি গোসাভি রায়ে বলেন, তার (অমিত শাহ) বিরুদ্ধে অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

দুর্নীতির অভিযোগ : নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ প্রায়ই প্রতিদ্ব›দ্বীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন। তবে ২০১৭ সালে দ্য অয়্যার নামে একটি নিউজ পোর্টাল অমিত শাহর একমাত্র ছেলে ব্যবসায়ী জয় শাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। তখন জয়কে বাঁচাতে অমিত শাহর পাশে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। জয় শাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর তার ব্যবসা ১৬ হাজার গুণ বেড়েছে। তবে জয় শাহ ও তার বাবা অভিযোগ অস্বীকার করেন। তারা প্রতিবেদনটিকে ‘মিথ্যা, অবমাননাকর এবং মানহানিকর’ আখ্যা দেন। তারা দ্য অয়্যারের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। এখনো সে মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।
বিরোধী নেতারা ২০২১ সালের জানুয়ারিতে অমিত শাহর বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছিলেন। তখন তার ছেলে জয়কে ভারতের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সচিব করা হয়। বিবিসি লিখেছে, অমিত শাহ যখন তার ছেলেকে রক্ষা করে যাচ্ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছিলেন নীরব। অমিত তার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা তারও ইঙ্গিত। 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত