বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

সর্বজনীন পেনশন মানবেনই না বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা

আপডেট : ১৪ মে ২০২৪, ০৭:০২ এএম

চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর থেকে স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার চাকরিতে যারা যোগ দেবেন, তারা বিদ্যমান ব্যবস্থার মতো আর অবসরোত্তর পেনশন সুবিধা পাবেন না। তার বদলে নতুনদের সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিমে বাধ্যতামূলকভাবে আওতাভুক্ত করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তবে সরকারের এই নতুন সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

তারা বলছেন, এ প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হবেন। একই বেতন স্কেলের আওতাধীন শিক্ষক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য সরকারের ভিন্ননীতি সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই প্রজ্ঞাপন বাতিল না করা হলে আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন শিক্ষক নেতারা। একই দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, সর্বজনীন পেনশন আইনের আওতায় স্কিমটি আকর্ষণীয় এবং আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে কার্যকর।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, দেশের সব স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা বা কর্মচারী চলতি বছরের ১ জুলাইয়ের পর যোগ দেবেন, সরকার তাদের সর্বজনীন পেনশনের আওতাভুক্ত করল। স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিলে প্রায় ৪০০ সংস্থা রয়েছে, যেগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৪ লাখের বেশি। এ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় পেনশন কর্র্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচিকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে সরকার, তারই অংশ হিসেবে এ দফায় নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

পেনশন-সংক্রান্ত এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিসহ দেশের প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ফুঁসে উঠেছেন। দাবি আদায় না হলে বৃহত্তর আন্দোলনেও যেতে পারেন শিক্ষকরা। যেটি হবে ৯ বছর পর শিক্ষকদের সর্বজনীন বৃহত্তর আন্দোলন। সর্বশেষ ৯ বছর আগে ২০১৫ সালে স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন এবং সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল বহাল রাখার দাবিতে টানা ৮ মাস আন্দোলন করেন শিক্ষকরা। দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সে সময় কর্মবিরতি পালন করেন। শিক্ষকদের এই নজিরবিহীন কর্মবিরতিতে সে সময় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায়। এরপর আর শিক্ষকদের এমন বৃহৎ আন্দোলন দেখা যায়নি।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুল ইসলাম এবং মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া এক বিবৃতিতে ওই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবি জানান। তারা বলেন, এই প্রজ্ঞাপন জারির ফলে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে চরম হতাশা ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়েছে। এটি কার্যকর হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চরম বৈষম্যের শিকার হবেন। এই প্রজ্ঞাপন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাদর্শনের প্রতি চরম অবমাননা প্রদর্শনের শামিল।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই প্রজ্ঞাপনের ফলে মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে আগ্রহী হবেন না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। এটি দুরভিসন্ধি কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে অনতিবিলম্বে এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবি জানায় ফেডারেশন।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইনে অন্তর্ভুক্ত করলে শিক্ষকরা বিদ্যমান আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন বলে একমত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতি। গত ২৯ এপ্রিল ঢাবি শিক্ষক সমিতির কার্যকরী পরিষদের জরুরি সভায় সদস্যরা এ বিষয়ে একমত হন। নতুন প্রজ্ঞাপনের প্রতিবাদে গত ৩০ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত ঢাবি শিক্ষকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেখানে ১০৬১ জন শিক্ষক এই প্রজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর করেন।

এ বিষয়ে ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি এটি একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। বর্তমান পেনশন স্কিমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে সুবিধা পাবেন, আগামী দিনে যারা চাকরিতে ঢুকবেন তারা সেটি পাবেন না। আমরা অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও কথা বলেছি, তারাও বলছেন শিক্ষকরা এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, এখানে কোনো আইন প্রবর্তন করতে হলে সিনেট, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করেছি, চিঠিও প্রদান করেছি। আমরা তাকে অনুরোধ করেছি আগামী সিনেটে যাতে এটা উপস্থাপন না করেন। কোনোভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এটি পাস হতে দেবে না। আর অন্য কোনো প্রক্রিয়ায়ও যদি এটি পাস করানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনে যাব। আমাদের দাবি আদায় না হলে পরে ধাপে ধাপে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’

পেনশন স্কিম বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতি। হাবিপ্রবি গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. শ্রিপতি সিকদার বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিম শিক্ষকদের জন্য চরম বৈষম্যমূলক। এ ধরনের স্কিম অতীতে কখনো ছিল না। শিক্ষা খাতকে ধ্বংস করে, শিক্ষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা করার এ নীলনকশা আমরা প্রত্যাখ্যান করছি।’

এ ছাড়া প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে কালো ব্যাজ ধারণ ও মৌন মিছিল করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) শিক্ষক সমিতি। শাবিপ্রবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সর্বজনীন পেনশন স্কিমের সমালোচনা করে বলেন, ‘শিক্ষকদের নিয়ে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র চলছে, আমরা ইতিমধ্যে লক্ষ করছি কিছুদিন আগে আমলারা তাদের সন্তানদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে, যা অশুভ কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। এভাবে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশটা তাদের দখলে নিতে চাচ্ছে।’

একই দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

শুধু শিক্ষকরা নন, এই প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। গত রবিবার ঢাবির স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে মানববন্ধনে করেছে ঢাবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন। একই দিন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারাও। এ ছাড়া মানববন্ধন করেছে ঢাবি কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। নতুন প্রজ্ঞাপনটিকে বৈষম্যমূলক আখ্যায়িত করে দ্রুত তা প্রত্যাহারের দাবি জানান তারা।

ঢাবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হলে আমাদের চেতনায় আঘাত করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হবে।’

এদিকে এসব প্রতিষ্ঠানকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক তৈরি হওয়ায় ব্যাখ্যা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় বলে, ‘প্রত্যয় স্কিম চালু হলেও বিদ্যমান কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে না বরং তাদের বিদ্যমান পেনশন বা আনুতোষিক সুবিধা অক্ষুন্ন থাকবে। তবে যাদের ন্যূনতম ১০ বছর চাকরি অবশিষ্ট আছে, তারা চাইলে প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।’

সংস্থাগুলোতে নতুন নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সুবিধা কমবে কি না জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্র্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা আপেক্ষিক। তবে অনেক দিন চর্চা ও বিশ্লেষণের পরই আমরা এমন সিদ্ধান্তে এসেছি।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত