বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি শুরুর পর এক বছরে ভারতের আদানি পাওয়ারের নিট মুনাফা ১০ হাজার ৭২৭ কোটি রুপি বা ১৫ হাজার ১৭ কোটি টাকা (১ রুপি=১.৪ টাকা) থেকে বেড়ে ২০ হাজার ৮২৯ কোটি রুপি (২৯ হাজার ১৬০ কোটি টাকা) হয়েছে। মুনাফা বাড়ার হার ৯৪.২ শতাংশ। এ সময়ে তাদের আয়বৃদ্ধির অর্ধেকেরও বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ভারতে তাদের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের মোট উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৩,৬৫০ মেগাওয়াট। পরের বছর বাংলাদেশে বিক্রির জন্য নির্মিত ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পর তাদের উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ১৫,২৫০ মেগাওয়াট।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ তারা রপ্তানি করছে তা আদানির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ১০ শতাংশ। এক বছরে প্রতিষ্ঠানটির তর তর করে বাড়তে থাকা আয়-ব্যয়ে বাংলাদেশের বড় অবদান থাকার প্রমাণ মিলেছে তাদের সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে।
আদানির আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে মোট ৫৩.৪ বিলিয়ন (৫ হাজার ৩৪০ কোটি) ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আয় হয়েছে ৩৭,২৬৮ কোটি রুপি বা ৫২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরুর পর এক বছরে উৎপাদন বেড়ে হয় প্রায় ৮০ বিলিয়ন (৮ হাজার কোটি) ইউনিট। আয় হয়েছে ৫০ হাজার ৯৬০ কোটি রুপি বা ৭১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে তাদের আয় বেড়েছে প্রায় ১৯ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রির জন্য নির্মিত গড্ডা কেন্দ্র থেকেই আয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্যমতে, ভারতে সদ্যসমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয় ও মুনাফা বেড়েছে। নতুন উৎপাদনে আসা গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি মুন্দ্রা, উদুপি ও মহন বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও ভূমিকা রয়েছে। আয় ও মুনাফা বৃদ্ধির বিষয়ে তারা বলছে, ভারতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার বিপরীতে জ¦ালানির দাম কমায় উৎপাদন খরচ কমেছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় কমায় মুনাফা বেড়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যুৎবিক্রি বাবদ যে আয় হয়েছে সেটি মুনাফাবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রেখেছে।
আদানির আর্থিক প্রতিবেদন মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯৮৪ কোটি রুপি লোকসান করার পর পরের অর্থবছরে লোকসান কমে ২৭৫ কোটি রুপি হয়। এরপর তাদের মুনাফা বাড়তে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ২৭০ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯১২ কোটি রুপি মুনাফা হয়। দুই বছরে মুনাফা বেড়ে এখন ২০ হাজার ৮২৯ কোটি রুপি হয়েছে।
আদানির বিদ্যুৎ আমদানির জন্য কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২৫ বছরের জন্য ২০১৭ সালের শেষ দিকে বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি। এ আইন অনুযায়ী, আদানির সঙ্গে চুক্তিতে অসংগতি থাকলেও আদালতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যুৎ রপ্তানির চুক্তির পর ঝাড়খন্ডে দুই ইউনিটের ১৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু করে মাত্র সাড়ে ৩ বছরে কেন্দ্রটির কাজ শেষ করে। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে প্রথম ইউনিটের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করে আদানি, জুনেই দ্বিতীয় ইউনিট থেকেও বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে তারা। ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। প্রতি ইউনিটের দাম পড়ছে গড়ে ১৪ টাকা।
আদানির সঙ্গে করা ওই চুক্তিকে অসম চুক্তি আখ্যা দিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, এ চুক্তির ফলে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের লাভ বেশি হবে। আর ক্ষতি হবে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এক্সটার্নাল ডেট ও ভারতের গ্রোথওয়াচের যৌথ গবেষণায় বলা হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী আদানির বিদ্যুতে পিডিবি তার স্বাভাবিক ‘মেরিট অর্ডার ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতি অনুসরণ না করে ‘প্রায়োরিটি বেজড ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতি অনুসরণ করবে।
‘মেরিট অর্ডার ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতিতে অল্প টাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কেন্দ্রগুলোকে আগে উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া হয়। আর ‘প্রায়োরিটি বেজড ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতিতে মূল্য যাই হোক, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমদানির বিদ্যুৎ প্রাধান্য পাবে। ফলে দেশীয় বিদ্যুতের দাম কম হলেও আদানির বিদ্যুৎ আমদানি করতে হবে। আদানির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, গড্ডা কেন্দ্রের সক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট অংশের কম বিদ্যুৎ কেনা হলে বাংলাদেশকে উল্টো জরিমানা দিতে হবে। এ কারণে এবার শীতে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকলেও আদানি বিদ্যুৎ বেচে সবচেয়ে বেশি আয় করেছে।