সম্প্রতি রাজধানীর ডেমরা এলাকায় কুকুরের আক্রমণে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় এক শিশুর। বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়েছিল পাঁচ বছরের শিশু মাহিনুর। হঠাৎ একটি বেওয়ারিশ কুকুর তার ওপর আক্রমণ করে। পরে আরও তিনটি কুকুর শিশুটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শিশুটির চিৎকারে আশপাশের লোকজন কুকুরগুলো তাড়ানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে বাঁশ দিয়ে আঘাত করলে কুকুরগুলো পালিয়ে যায়। ততক্ষণে কুকুরের কামড়ে-আঁচড়ে শিশুটির মুখ-মাথা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। পরে গুরুতর অবস্থায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শুধু শিশু মাহিনুর কিংবা নিহত ইজাজুলকেই নয় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কুকুরের আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্বিচার কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেয়। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে কুকুরকে বন্ধ্যা (প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া) করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দেয় সরকার। দুই বছর পর তাও বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২০ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানী থেকে হাজার হাজার কুকুর সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণাও থেমে যায় এক রিট আবেদনে। একদিকে কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা, অন্যদিকে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় রাজধানীতে বেড়েছে বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব। এতে কেউ কেউ প্রাণও হারাচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২৩ সালে সারা দেশে ৬ লাখের বেশি মানুষ কুকুরের কামড় খেয়ে জলাতঙ্ক রোগের টিকা নিয়েছে। ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫ লাখের সামান্য কম। এর মধ্যে শিশুদের সংখ্যা বেশি। এই দুই বছরে জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৮৬ জন। শুধু তাই নয়, ২০১২-২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে কুকুরের কামড়ে মারা গেছে ৭৭১ জন। তবে ২০১০ সালের আগে দেশে প্রতিবছর জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে আড়াই হাজার মানুষ মারা যেত। জলাতঙ্ক রোগ নির্মূলে সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা কমে এসেছে। তবে আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি। ২০২০ সালে জলাতঙ্কের টিকা নিয়েছিলেন ১ লাখ ৫২ হাজার ১৪ জন, ২০২১ সালে ২ লাখ ৭৮ হাজার।
দেশে সংক্রামক রোগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্র মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এই হাসপাতালে কুকুর-বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আক্রমণে আহত হয়ে ২০২৩ সালে চিকিৎসা নেয় ৯৪ হাজার ৩৮০ জন। ২০২২ সালে চিকিৎসা নেওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৯ হাজার ৯২৮ জন। তবে এর মধ্যে সিংহভাগই কুকুরের আক্রমণে আহত হয়।
এদিকে ঢাকার রাস্তায় প্রায়ই অসুস্থ কুকুরকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এসব কুকুর শহরে ঘুরে বেড়ায়। ফলে তাদের থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। ঢাকার রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে অসংখ্য মানুষ রাত কাটায়। এই মানুষগুলো সহজে অসুস্থ কুকুরের সংস্পর্শে গিয়ে অসুখ ছড়াতে পারে। একইভাবে রাস্তার পাশে খোলা দোকানেও এসব কুকুর থেকে সংক্রামক ব্যাধি ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সিডিসি ও বিভিন্ন প্রাণিকল্যাণ সংগঠনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে প্রায় ১৭ লাখ কুকুর রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আছে ৫০ হাজারের বেশি ও উত্তর সিটিতে আছে ৪০ হাজার কুকুর। স্বাস্থ্য
২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বেওয়ারিশ কুকুর স্থানান্তর কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। প্রাণিকল্যাণ সংগঠন ‘অভয়ারণ্য’র সভাপতি রুবাইয়া আহমেদ, পিপলস ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল ও অভিনেত্রী জয়া আহসানের পক্ষে ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব এই রিট করেছিলেন। বেওয়ারিশ কুকুর নিধনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা ও কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজধানী জুড়ে বাড়ছে কুকুরের উৎপাত ও আক্রমণের শিকার হয়ে আহতের সংখ্যা।
নগর-পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘বেওয়ারিশ কুকুর শিশু ও নারীদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আবার যেকোনো মানুষের জন্যও কুকুর নানা সমস্যা তৈরি করছে। উন্নত বিশ্বে রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে বেওয়ারিশ কুকুর দেখা যায় না। কুকুর নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সারা বিশ্বেই বেওয়ারিশ কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যত্বকরণ কার্যক্রম চালানো হয়। আমাদের দুই সিটি করপোরেশন এমন উদ্যোগ একাধিকবার নিলেও আর্থিক ও জনবল সংকটের কারণে তা সফল হয়নি।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গণমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে, দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫০ হাজারের ঊর্ধ্বে বেওয়ারিশ কুকুর রয়েছে। সুতরাং বেওয়ারিশ কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে আমাদের একটি স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। সেজন্য সারা বিশ্বের মতো বেওয়ারিশ কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যত্বকরণ কার্যক্রম শুরু করছি। বড় বড় শহর বা উন্নত শহরগুলোতে বেওয়ারিশ কুকুর বা অন্যান্য প্রাণী যত্রতত্র চলাচল করতে পারে না। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে। নাগরিকরা সেগুলোর পরিচর্যা করেন, নিয়ন্ত্রণে রাখেন এবং সেভাবেই একটি সুন্দর শহর গড়ে ওঠে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যাপারে নজর না দেওয়ার কারণে ঢাকা শহরে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েছে।’
কুকুরের বংশবিস্তার নিয়ন্ত্রণে বন্ধ্যত্বকরণের লক্ষ্যে উভয় সিটি করপোরেশন কার্যক্রম চালালেও তা ধীরগতিতে চলছে। দক্ষিণ সিটির ১০টি অঞ্চলে ৩ জন ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ও ১০ পরিদর্শকের জায়গায় মাত্র ৩ জন রয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় জনবলের সংকট রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটির ১০টি অঞ্চলে কোনো ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ও পরিদর্শক নেই। ফলে কুকুরের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গত বছরের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা ১ হাজার ৩০০ কুকুরকে টিকা দিয়েছি। আমাদের এই কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’ জনবল সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের কয়েকজন ভেটেরিনারি কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় এই মুহূর্তে তিনজন রয়েছেন। আমরা নতুন করে ভেটেরিনারি কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’