‘‘এক বিলিয়ন ঘণ্টা আগে, পৃথিবীতে জীবনের আবির্ভাব হয়েছিল এক বিলিয়ন মিনিট আগে, খ্রিস্টীয়বাদের সূচনা হয়েছিল
এক বিলিয়ন সেকেন্ড আগে, বিটলস সংগীতের দুনিয়া পালটে দিয়েছিল
এক বিলিয়ন কোকা-কোলা আগে গতকাল সকাল ছিল”
ওপরের চারটি লাইন ১৯৯৭ সালে বলেছিলেন কোকা-কোলা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী রবার্ট গোইজুয়েটা। এর কয়েক বছর আগে সোভিয়েতের পতন হয়েছে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়াতে এককভাবে রাজত্ব করছে। মুক্তবাজার অর্থনীতি আর নব-উদারতাবাদ তখন দুনিয়া কব্জা করে ফেলার অহমে উড়ছে। তাই বলে কি একটা পানীয় কোম্পানির একজন নির্বাহীর এই দম্ভ সাজে?
ইতিহাসটা জানা থাকলেও বলতেই হয়। অতি অবশ্যই। বিংশ শতাব্দী মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল। পারমাণবিক যুদ্ধ, দুনিয়ার রাজনীতি আর বিশ্বাসের ভিত্তিমূল পাল্টে যাওয়া, বিশ্বায়ন, কঞ্জুমারিজমের অবিশ্বাস্য উত্থান আর সর্বোপরি মার্কিন রাজত্ব। অথচ এই সমস্ত জটিল ও বিস্তৃত পরিবর্তনকে কেবলমাত্র একটি প্রতীক দিয়ে বোঝানো সম্ভব কোকা-কোলা। ব্রিটিশ রাজত্বকে যদি নানা রকম ভিক্টোরিয়ান আদর্শ দিয়ে বোঝানো যায় তবে মার্কিন রাজ বুঝতে এই একটি পানীয়, এর বাজারজাতকরণ ও প্রভাবই যথেষ্ট।
তবে, মার্কিন দখলদারিত্ব যেমন বিনা বাধায় পার পায়নি, কোকের বিরুদ্ধেও বাধা এসেছে নানা সময়। প্রচন্ড প্রভাবশালী ও অর্থশালী এই কোম্পানি চাপে পড়েছে, জনতার প্রত্যাখ্যান সহ্য করেছে। বাংলাদেশের বাজারেও যে সম্প্রতি তেমনি একটি চাপ পড়ল, তা বোঝা গেছে এদের সাম্প্রতিক একটি বিজ্ঞাপনে। বলা ভালো, বিজ্ঞাপনের নামে পিআর ডিজাস্টারে।
বাজেরকমভাবে নির্মিত বিজ্ঞাপনটিতে দেখা যায়, একজন কোক বিক্রেতা এলাকার বাকি যুবকদের কটাক্ষ করছে কোক প্রত্যাখ্যানের কারণে। এবং তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন যে, কোক কোনোভাবেই ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্ত নয়। এমনকি সেই দোকানদার দাবি করেন, কোক এমনকি ফিলিস্তিনেও আছে এবং খুব দম্ভভরে আহ্বান জানান সবাই যাতে কোকের সত্যটা ইন্টারনেটে খুঁজে বের করে। একে তো, ভোক্তাকে ‘সত্য জানে না’ বলে এক ধরনের কটাক্ষ করা উপরন্তু আগ্রহী ভোক্তার মনে এই প্রশ্ন জাগাচ্ছে যে, কোকের কোম্পানি কি ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতে স্থাপিত?
এই বিজ্ঞাপনের ফলে কেবল যে পণ্য আর কোম্পানি হিসেবে কোক বাংলাদেশে আরও বেশি অপছন্দের মুখোমুখি হতে পারে তাই নয়, এমনকি এই বিজ্ঞাপনের ফলে মুদি দোকানদাররা পর্যন্ত কোক রাখার কারণে ক্রেতার রোষের শিকার হতে পারেন। এখন প্রশ্ন আসে, কোকের বিজ্ঞাপনের ওপর ভর করে এর বেচাবিক্রি কেন ওঠানামা করে? কারণ কোক কোনো আবশ্যক বস্তু নয়। কোকের অভাবে কেউ মারা যায় না। আর কোক নিয়ে কার্ল মার্কসের কমোডিটি ফেটিশ তত্ত্বের আলাপে সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা দেন দার্শনিক স্ল্যাভোই জিজেক। জিজেক ২০১৩ সালে প্রকাশিত ডকুমেন্টারি দি পার্ভার্ট’স গাইড টু আইডলজিতে বলেন কোকা-কোলা কঞ্জুমারিজমের আদর্শ পণ্য, কারণ কোক আমাদের ভোগের শূন্যতাকে বিক্রি করে।
জিজেক বলতে থাকেন, ‘‘মার্কস বহু আগে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে একটি ভোগ্যপণ্য কেবলমাত্র একটি বস্তু নয় যা আমরা কিনি ও ভোগ করি। একটি ভোগ্যপণ্য হচ্ছে এমন একটি বস্তু যার রয়েছে ধর্মতাত্ত্বিক, এমনকি আদিভৌতিক সূক্ষ্মতা। এর উপস্থিতি সবসময় একটা অদৃশ্য সর্বোৎকৃষ্টতার প্রতিফলন ঘটায়। আর কোকের যে ধ্রুপদী বিজ্ঞাপন তা এই অনুপস্থিত, অদৃশ্য গুণের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে। কোকের বিজ্ঞাপন বলতে থাকে কোক হচ্ছে ‘আসল ব্যাপার’ আর ভোক্তাদের আহ্বান জানায় ভোগ, ভোগ আরও ভোগের।”
জিজেক আরও বলতে থাকেন ‘এতে কেবল পণ্য হিসেবে কোকের যে গুণাবলি তুলে ধরা হয় তাই না, এতে ধারণা দেওয়া হয় এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যের। উদগ্র আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তোলার এক অবর্ণনীয় অতিরিক্ত কিছু। আমরা বাধ্য হই উপভোগ করতে। উপভোগ হয়ে ওঠে এক ধরনের অদ্ভুত অশ্লীল কর্তব্য। কোকের ধাঁধা হচ্ছে, আপনি তৃষ্ণার্ত, আপনি একে পান করবেন, কিন্তু সবাই জানে যে আপনি যত পান করবেন আপনি তত বেশি তৃষ্ণার্ত হতে থাকবেন।’
এই শেষ কথাটা হরেদরে কঞ্জুমারিজমের জন্য প্রযোজ্য। আপনি যত কিনবেন আপনার কেনার তৃষ্ণা আরও বাড়বে। মার্কিন পুঁজিবাদ নিজেদের আধিপত্যবাদের চূড়ান্ত সময়ে এই আচরণটাকে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বলে উপস্থাপন করতে চায়। রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, আর্থিক সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয় এই দর্শন প্রচারে। ফরাসি দার্শনিক আলথুসার দেখান কীভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজের সমস্ত শক্তি ও যন্ত্র ব্যবহার করে ভোগবাদের এই দর্শনই যে মানুষের প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি তা নাগরিককে বিশ্বাস করায়। শিক্ষাব্যবস্থা পর্যন্ত সেইভাবেই গড়ে তোলা হয়। প্রচারযন্ত্রগুলো সর্বদা ব্যস্ত থাকে নাগরিকের মস্তিষ্কে এই দর্শনকে হাতুড়িপেটা করে স্থায়ী করে দিতে।
কিন্তু, কোক তো আর ভাত-মাছ না। দিনশেষে একটা অজরুরি পানীয়ই। ফলে, এর ওপরে গভীর বিশ্বাস স্থাপনের, একে ভোগের জাদু কার্পেট ভাবার যে মোহ তা ভেঙে পড়লে এর সঙ্গে ভোক্তার এক প্রচন্ড বিবমিষার জন্ম হয়। হঠাৎ করেই মোহহীন হয়ে পড়া ভোক্তা একে ছুড়ে ফেলে মুক্ত হতে চায়। কোকের মতো যে কোনো ভোগ্যপণ্যের বেলাতেই একই রকম ব্যাপার ঘটতে পারে।
অবশ্য কোকের জন্য এই অভিজ্ঞতা নতুন না। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেমন প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়েছে, কোকও তাই। আরব দেশগুলো ১৯৬৭ থেকে ১৯৯১ সালে সরকারিভাবেই কোক বর্জন করেছিল ইসরায়েলে কারখানা করার প্রতিবাদে। ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ায় এই ধরনের বর্জন কখনো কখনো দেখা গেছে। কোক তার বিপুল ক্ষমতা দিয়ে সামলে নিয়েছে।
কিন্তু, গত অক্টোবর থেকে ইসরায়েল ফিলিস্তিনে যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে আগের অনেক হিসাব পাল্টে গেছে। পশ্চিমা মিডিয়া এত বছর যেভাবে ভাষ্য নির্মাণ করত তা পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ প্রত্যাখ্যান করা শুরু করেছে। এই গণহত্যা ঠেকাতে না পারলেও এর সহযোগীদের প্রতি ঘৃণা ও বর্জনকে নিজেদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ভাবছে দেশে দেশে বহু মানুষ। এই ডাক আরও জোরালো হচ্ছে দিনের পর দিন, খোদ মার্কিন মুলুকেই। এই ডাকের বিশ্বায়ন মার্কিন পুঁজিবাদ আর কনজুমারিজমকেও হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।
ফলে, কোকের একটা বিজ্ঞাপনের ব্লান্ডার এবং এর প্রতিক্রিয়াকে কেবল সামান্য বিজ্ঞাপন হিসেবে পাঠ করা ভুল হবে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।
লেখক : সাংবাদিক ও অনুবাদক