ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির সূত্রপাত ১৯৭২ সালের ১৭ জুন সকালে, যখন ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সে অবস্থিত ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির অফিস থেকে বেশ কয়েকজন চোরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এটি কোনো সাধারণ চুরি ছিল না: অপরাধীরা রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের পুনর্নির্বাচনের প্রচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং তারা ফোনে আড়িপাতা এবং নথি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল।
নিক্সন তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন ষড়যন্ত্রে তার অংশগ্রহণ প্রকাশ করলে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি আমেরিকার রাজনীতিকে চিরতরে বদলে দেয়, যার ফলে অনেক আমেরিকানই তাদের নেতাদের নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং প্রেসিডেন্সি সম্পর্কে আরও সমালোচনামূলকভাবে চিন্তা করে।
এক নজরে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির ওয়াটারগেট সদর দফতরে ঢুকে টপ-সিক্রেট নথির কপি চুরি এবং অফিসের ফোনে আড়িপাতার অভিযোগে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তারা ষড়যন্ত্র, চুরি ও আড়িপাতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির উৎপত্তি ছিল ১৯৭২ সালে। যখন রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি রিচার্ড এম নিক্সন পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রার্থী হয়েছিলেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তাই প্রেসিডেন্ট ও তার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার কাছে জোরালো নির্বাচনী প্রচারণা অপরিহার্য বলে মনে হয়েছিল। তাই তারা অবৈধ গুপ্তচরবৃত্তির সুযোগ নেয়। নিক্সনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে তার নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্য (ব্যঙ্গাত্মকভাবে ক্রিপ নামে পরিচিত) ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির ওয়াটারগেট সদর দফতরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে তারা গোপনীয় নথির কপি চুরি করে এবং অফিসের ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র স্থাপন করে।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির উন্মোচন
আড়িপাতার যন্ত্রগুলো সঠিকভাবে কাজ না করায় ১৯৭২ সালের ১৭ জুন পাঁচজন চোরের একটি দল ওয়াটারগেট ভবনে ফের প্রবেশ করে। নতুন মাইক্রোফোন নিয়ে যখন অফিসে ঢোকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন এক নিরাপত্তারক্ষী লক্ষ্য করেন, কেউ একজন ভবনের দরজার তালা টেপ দিয়ে আটকে রেখেছে। প্রহরী পুলিশকে ফোন করলে তাদেরকে হাতেনাতে আটক করা হয়। তাদের কাছে পাওয়া যায় আড়িপাতার যন্ত্র আর ২ হাজার ৩০০ ডলার।
চোররা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে জড়িত কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও গোয়েন্দারা চোরদের জিনিসপত্রের মধ্যে হোয়াইট হাউসের ফোন নম্বরের অনুলিপি পাওয়ার পর সন্দেহ তৈরি হয়। এ ঘটনায় রিপাবলিকান প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনকে ঘিরে গণমাধ্যমের সন্দেহ শুরু হয়। তবে আগস্টে দেওয়া এক বক্তৃতায় নিক্সন বলেন, ‘এ ঘটনায় তিনি বা তার দলের কেউ এ ঘটনায় জড়িত নন। এসব অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র’। বেশিরভাগ ভোটার তাকে বিশ্বাস করে এবং ১৯৭২ সালের নভেম্বরে বিশাল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইনের তদন্ত
ততদিনে ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন, ট্রায়াল বিচারক জন জে সিরিকা ও সিনেটের তদন্ত কমিটির সদস্যরাসহ কয়েকজন নিক্সনকে সন্দেহ করতে শুরু করেন। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে অনুপ্রবেশকারীরা ৪ বার ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির কার্যালয়ে প্রবেশ করে। বেনামী হুইসেলব্লোয়ার ‘ডিপ থ্রোট’ উডওয়ার্ড এবং বার্নস্টেইনকে মূল তথ্য সরবরাহ করেছিল।
সেই ডিপ থ্রোটের পরিচয় বের হয় ২০০৫ সালে। তিনি ছিলেন সিআইএয়ের সাবেক এজেন্ট মার্ক ফেল্ট। নিক্সনের পদত্যাগের দুই মাস আগেই ১৯৭৪ সালের ১৫ জুন প্রকাশিত হয় কার্ল বার্নস্টেইন ও বব উডওয়ার্ডের লেখা বই ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’। বছর দুই পরে যা নিয়ে বানানো হয় সাড়া জাগানো সিনেমা। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে কতটা লড়াই করতে হয়েছে, তা ফুটিয়ে তোলা হয় এই সিনেমায়।
ন্যায়বিচারে নিক্সনের বাধা
নিক্সন ও তার সহযোগীরা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিকে (সিআইএ) অপরাধের বিষয়ে এফবিআইয়ের তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিসসহ হোয়াইট হাউসের গুরুত্বপূর্ণ সব টেলিফোন আলাপ গোপনে রেকর্ড করে সুরক্ষিত রাখা হতো। এটা চালু করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমল (১৯৩৩-৪৫) থেকে। কিন্তু নিক্সন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, সব টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
হোয়াইট হাউসের কাউন্সেল জন ডিনসহ নিক্সনের কয়েকজন সহযোগী রাষ্ট্রপতির অপরাধ সম্পর্কে গ্র্যান্ড জুরির সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন; তারা আরও সাক্ষ্য দিয়েছিল যে নিক্সন ওভাল অফিসে ঘটে যাওয়া প্রতিটি কথোপকথন গোপনে টেপ করেছিলেন। প্রসিকিউটররা যদি ওই টেপগুলো হাতে পেতেন, তাহলে তাদের কাছে প্রেসিডেন্টের অপরাধের প্রমাণ থাকত।
নিক্সনের আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতির নির্বাহী বিশেষাধিকার তাকে টেপগুলো নিজের কাছে রাখার অনুমতি দিয়েছে। তবে বিচারক সিরিকা, সিনেট কমিটি এবং সরকারি কৌঁসুলি আর্চিবাল্ড কক্স সেগুলো উদ্ধারের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। অন্যদিকে তদন্তকারীরাও চাপ অব্যাহত রাখছিলেন। টেপ না দিয়ে আর উপায় নেই নিক্সনের। তিনি টেপ দিলেন ঠিকই কিন্তু ১৯৭২ সালের ২০ জুনের একটি কথোপকথনের ১৮ মিনিট গায়েব করে দেন নিক্সনের সেক্রেটারি রোজ মেরি ওডস। এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর জবাব, ওই অংশটি নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি টেপগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজে তদন্তকারীরা নিশ্চিত হলেন ওয়াটারগেটের ঘটনার সঙ্গে নিক্সন জড়িত।
শনিবার রাতের গণহত্যা
প্রসিকিউটর আর্চিবাল্ড কক্স টেপগুলো দাবি করলে নিক্সন তাকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন। কক্সকে চাকরিচ্যুতের প্রতিবাদে বিচার বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা পদত্যাগ করলে নিক্সন টেপগুলো দিতে রাজি হয়। (১৯৭৩ সালের ২০ অক্টোবর সংঘটিত এই ঘটনাগুলো স্যাটারডে নাইট ম্যাসাকার নামে পরিচিত)।
নিক্সনের পদত্যাগের ঘোষণা
১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা উন্মোচিত হতে শুরু করে। ১ মার্চ নতুন স্পেশাল প্রসিকিউটরের নিয়োগ করা গ্র্যান্ড জুরি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিভিন্ন অভিযোগে নিক্সনের সাবেক ৭ সহযোগীকে অভিযুক্ত করে। জুরি, নিক্সনকে ‘সহ-ষড়যন্ত্রকারী’ বলে অভিহিত করে।
জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট নিক্সনকে টেপগুলো হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। প্রেসিডেন্ট যখন তার পা টেনে ধরেছিলেন, হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটি ন্যায়বিচারে বাধা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপরাধমূলক ধামাচাপা দেওয়া এবং সংবিধানের বেশ কয়েকটি লঙ্ঘনের জন্য নিক্সনকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেয়।
অবশেষে, ৫ আগস্ট নিক্সন টেপগুলো প্রকাশ করেন, যা ওয়াটারগেট অপরাধে তার জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ। কংগ্রেসের প্রায় নিশ্চিত অভিশংসনের মুখে নিক্সন ৮ আগস্ট লজ্জাজনকভাবে পদত্যাগ করেন এবং পরদিন হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করেন।
ছয় সপ্তাহ পরে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেওয়ার পর নিক্সনকে সব অপরাধের জন্য ক্ষমা করেছিলেন। তবে ছাড় পাননি নিক্সনের অন্য সহযোগীরা।
অ্যাটর্নি জেনারেল জন মিচেল এই কেলেঙ্কারিতে তার ভূমিকার জন্য ১৯ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন। প্রাক্তন এফবিআই এজেন্ট ও ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির মাস্টারমাইন্ড জি গর্ডন লিডি সাড়ে ৪ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপরাধে নিক্সনের চিফ অব স্টাফ এইচ আর হ্যাল্ডম্যান ১৯ মাস এবং জন এহরলিচম্যান ১৮ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে নিক্সনের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতার অপব্যবহার আমেরিকান রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব এবং হতাশা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করেছিল। যদিও অনেক আমেরিকান ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে গভীরভাবে হতাশ হয়েছিল এবং রবার্ট এফ কেনেডি, মার্টিন লুথার কিং এবং অন্যান্য নেতাদের হত্যাকাণ্ডে দুঃখ পেয়েছিল।