মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

উচ্চশিক্ষার ‘বাধা’ শিক্ষক রাজনীতি

পড়ানোর চেয়েও রাজনীতিতে প্রাধান্য অনেক শিক্ষকের

  • নিয়োগ ও পদোন্নতি হয় দলীয় বিবেচনায়
  • বাধ্য হয়ে রাজনীতি করেন অনেকে
আপডেট : ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৭ পিএম

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর ছাত্র এবং শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ হয়েছে। শিক্ষক রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সে রাজনীতিও বন্ধ হয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজের বড় একটি অংশ শিক্ষক রাজনীতির বিরুদ্ধে। তারা বলছেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অতীতেও শিক্ষকদের ছিল। তবে এখনকার মতো এত ভয়াবহ ছিল না। রাজনীতির কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। তাদের অভিমত, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষকদের আরেকটি অংশ বলছে, শিক্ষকদের রাজনীতি করার অধিকার থাকুক তবে সেটি লেজুড়বৃত্তির নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ না হলে ক্লাসরুমের শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন বলেও মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শিক্ষক রাজনীতি থাকাই উচিত নয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে শিক্ষক রাজনীতিতে নেতিবাচক কর্মকা-ই বেশি। শিক্ষক রাজনীতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। নিয়োগ, পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হন অনেক শিক্ষক। রাজনীতি না করলে এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সরাসরি রাজনৈতিক দলের সদস্য। তারা শিক্ষকতার চেয়ে বেশি সময় দেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে। কেউ কেউ আওয়ামী লীগ-বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের চেয়েও বেশি দলীয় অবস্থান প্রদর্শনে ব্যস্ত থাকেন। এর প্রভাব পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বস্তরে। শিক্ষকদের স্বার্থরক্ষায় তেমন কাজ করতে দেখা যায় না এ শিক্ষকদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থি এবং বামপন্থি শিক্ষকরা সাধারণত নীল দলের রাজনীতি করেন, বিএনপি-জামায়াতপন্থিরা ও বামপন্থি শিক্ষকরা সাদা দলের রাজনীতি এবং বামপন্থি হিসেবে পরিচিত শিক্ষকদের কেউ কেউ গোলাপি দলের রাজনীতি করেন। গোলাপি দল এখন আর সেভাবে সক্রিয় নেই। এখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামে প্রগতিশীল ও বাম মতাদর্শের শিক্ষকদের একটি সংগঠন বেশ পরিচিত। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) ব্যানারে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক ও ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) ব্যানারে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা রাজনীতি করেন।

সাম্প্রতিক কোটা আন্দোলন কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক-রাজনীতি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অনেক শিক্ষক রাজনৈতিক প্রভাব হারানোর ভয়ে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াননি। অনেক শিক্ষক চাইলেও সাহস করতে পারেননি। ফলে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে চিড় ধরেছে। শিক্ষার্থীরা এখন দাবি জানাচ্ছে, তারা আর ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি চায় না। তাদের দাবি মেনে অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ, বগুড়া জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতিসহ সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী এবি জোবায়ের দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষক রাজনীতি শিক্ষার্থীদের কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজে আসছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান খারাপ হওয়ার পেছনে শিক্ষক রাজনীতি দায়ী বলে আমি মনে করি।’

শিক্ষকরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চেয়েও প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনীতি। বেশিরভাগ শিক্ষক নিয়োগ হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। তরুণ শিক্ষকদের শুরু থেকেই রাজনৈতিক এজেন্ডায় যুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। রাজনীতির বাইরে গেলে পদোন্নতি, স্কলারশিপ, আবাসিক শিক্ষক হওয়াসহ নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হন। অনেক শিক্ষক নেতা ক্লাসও ঠিকমতো নেন না। ঢাবিতে অন্তত ১০ জন শিক্ষক নেতা রয়েছেন, যারা নিয়মিত ক্লাস নেন না। রাজনীতিতে বেশি সময় দেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের এক শিক্ষক বলেন, ‘আমি সরকারি দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হওয়ার কারণে বছরের পর বছর আমার পদোন্নতির ফাইল আটকে ছিল। যারা রাজনীতি করতেন, শিক্ষক নেতাদের সারাক্ষণ সময় দিতেন, রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতেন তাদের পদোন্নতি হয়েছে দ্রুত। এমনও শিক্ষক নেতা আছেন যিনি মাসে একটা-দুইটার বেশি ক্লাস নেন না, প্রশ্নও তৈরি করেন না। সিনেট, শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে কাকে আমি ভোট দেব সেটাও ছবি তুলে দেখাতে হতো। এ ধরনের রাজনীতি না থাকাই ভালো।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নীল দলের এক শিক্ষক দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ হওয়ার পর থেকেই রাজনীতির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই রাজনীতি করি। না করলে সব সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। আমি কার সঙ্গে মিশব, ফেসবুকে কী লিখব সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিপরীতে গেলেই জবাবদিহির আওতায় আসতে হয়।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থাকার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যে রাজনীতি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে শিক্ষকদের অধিকার পাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে, তেমন রাজনীতি থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।’

ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষক রাজনীতি করি শিক্ষকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য। অধ্যাদেশ অনুযায়ী সে স্বাধীনতা আমাদের আছে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করতে চাই না। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে চাই, কেউ যদি অত্যুৎসাহী হয়ে গা-চাটামি করে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। ছাত্ররা বিপদে পড়লে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি, এখানে আমাদের স্বার্থ নেই। ছাত্রদের ন্যায়সংগত আন্দোলনে আমরা তাদের পক্ষে ছিলাম। কেউ কেউ শিক্ষক রাজনীতির নেগেটিভ বিষয় ধারণ করছে বলে রাজনীতি বন্ধ করতে হবে এটা আমি মনে করি না।’

তিনি বলেন, ‘তরুণ একজন শিক্ষার্থী শিক্ষক হওয়ার পর তাকে প্রেশারে রাখা হয়। ভিন্নমতাবলম্বী শিক্ষকদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতেও ভয় পায় তারা। ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি না করলে পদোন্নতি হয় না, আবাসিক শিক্ষক হওয়া যায় না, স্কলারশিপ পাওয়া যায় না। এমনকি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে কাকে ভোট দিয়েছে সেটা ছবি তুলে দেখাতে হয়। শিক্ষক রাজনীতিকে একটা নোংরা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা সেটি চাই না। আমরা চাই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে রাজনীতি করবে।’

শিক্ষক রাজনীতির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কিছু বলতে চাননি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের শিক্ষক নেতা ও ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী। সে অনুযায়ীই সবকিছু পরিচালনা হবে। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষক রাজনীতি কাম্য নয়। শিক্ষকরা কোনো রাজনীতি করবেন না। কারণ দলীয় রাজনীতি করলে তারা যখন শ্রেণিকক্ষে যাবেন, তখন তার রাজনীতি যারা পছন্দ করেন না তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হারাবেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের মধ্যে আস্থা খুব গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেণিকক্ষে রাজনীতি নিয়ে গেলে সে আস্থা হারাতে হতে পারে। স্বস্তির বিষয় হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকই তাদের রাজনীতি নিজেদের ভেতরেই রাখেন।’

তিনি বলেন, ‘যারা সরকারি দলের রাজনীতি করেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করেন। কারণ সরকারের আদেশ-নির্দেশ তখন তাদের পালন করতে হয়। আমাদের উপাচার্যরা সবসময় দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পান। এ চর্চা অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমি মনে করি শিক্ষক সমিতি শিক্ষার্থীদের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থরক্ষা করবে। শিক্ষকদের কর্মকা- সব শিক্ষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত। অধিকার সচেতন ও নিষ্ঠাবান শিক্ষকদের দিয়েই এসব পরিচালিত হওয়া উচিত।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত