উত্তরের শিক্ষার বাতিঘর শিক্ষার্থীদের স্বপ্নে ভরা সবুজ আচ্ছাদনে আবৃত অদম্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাক উত্তরের জনপদের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। উত্তরের শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের ক্যাম্পাস বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) আজ তার প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পূর্তি উদযাপন করছে। ২০০৮ সালের ১২ অক্টোবর উত্তরাঞ্চলের জনপদ রংপুরে এ বিদ্যাপীঠটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। শুরু থেকেই নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে, সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আজ দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পর, রংপুরবাসীর প্রাণের দাবি পূরণ করে বেরোবি উত্তরাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার নতুন দ্বার উন্মোচন করে।
প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে রংপুর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একটি পরিত্যক্ত ভবনে বেরোবির কার্যক্রম শুরু হয়। মাত্র ৩০০ শিক্ষার্থী, ১২ জন শিক্ষক এবং ৬টি বিভাগ দিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আজ পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে। ২০১১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ একর জায়গায় স্থায়ী ক্যাম্পাসের উদ্বোধন করেন, যা উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল জলিল মিয়া। ওনার দৃঢ় নেতৃত্বে পরবর্তীতে ৬ অনুষদ এবং ২১ টি বিভাগ খোলা হয়। ব্যাপক অবকাঠামগত উন্নয়ন এবং সর্বাধিক জনবল নিয়োগ সম্পন্ন হয় এই সময়ে। ২০০৮ সালের ১২ ই অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও ২০০৯ সালে এর নাম পরিবর্তন করে নারী জাগরণের অগ্রদূত, মহীয়সী নারীর নামে নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ৪ ই জানুয়ারি ২০১১ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৫ একরের স্থায়ী ক্যাম্পাসের শুভ উদ্বোধন করেন। ২০১১ সালে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি চারটি একাডেমিক ভবন এবং প্রশাসনিক ভবন নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাত্রা শুরু করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। আজ সেই বিশ্ববিদ্যালয় ১৬ বছর পূর্তি করবে । নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অসীমের সন্ধান করে চলছে। ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দেশে এবং দেশের বাহিরে নানা জায়গায় নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর বহন করে চলছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও দেশের বাহিরে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা, শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি খেলাধুলায় অনেক সুনাম অর্জন করেছে। আলোকিত সুনাগরিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতোমধ্যে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের নীলাভূমির দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থান করে নিয়েছে সমসাময়িকদের শীর্ষে। জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান সৃষ্টি এবং বিতরণে নিরলসভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ভর্তি হয়েছে ১৬ টি ব্যাচ। তৃতীয় উপাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ কে এম নূর উন নবী। চতুর্থ উপাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডক্টর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক ঘটনা হয়ে আছে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। ইংরেজি বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদের জীবন হারানোর মধ্য দিয়ে আন্দোলনটি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে। শিক্ষার্থীরা বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়। আবু সাঈদের এই আত্মত্যাগ কেবল বেরোবির শিক্ষার্থীদের নয়, গোটা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি নতুন চেতনার জন্ম দেয়। তার মৃত্যুতে পুরো দেশে আন্দোলনের ঝড় ওঠে, যার প্রতিক্রিয়ায় ৯ আগস্ট উপাচার্য অধ্যাপক মো. হাসিবুর রশীদ পদত্যাগ করেন।
আবু সাঈদের ত্যাগ এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে বেরোবি প্রশাসন নতুন করে পুনর্গঠিত হয় এবং এর নেতৃত্বে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী। তার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়টি একাডেমিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পুনরায় নতুন গতিতে এগিয়ে চলেছে। তবে আবু সাঈদের মৃত্যু শুধু একটি ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি বেরোবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকার ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করার এক স্থায়ী চেতনা হিসেবে রয়ে গেছে। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে ৬ ষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রংপুরের কৃতি সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী, যার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় আবারো নতুন গতিতে এগিয়ে চলেছে, বিশেষ করে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে। নব নিযুক্ত উপাচার্যের নিকট প্রত্যাশা অনেক।
শিক্ষা ও গবেষণায় বেরোবির সাম্প্রতিক সাফল্যগুলো বেশ উল্লেখযোগ্য। ২০২৩ সালের সিমাগো র্যাংকিং অনুযায়ী, বেরোবি দেশের সেরা ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে এবং গবেষণায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। এই সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের একনিষ্ঠ পরিশ্রমের ফল। বর্তমানে ২২টি বিভাগ, ৮৫০০ শিক্ষার্থী, ২০৫ জন শিক্ষক, এবং ৪৪৯ জন কর্মচারীর সমন্বয়ে এই ক্যাম্পাস একটি গতিশীল শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করেছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশে তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছে। অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এবং দেশের বাইরেও সফলতা অর্জন করেছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির সামনে অবকাঠামো সংকট, শিক্ষক স্বল্পতা, ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে, তারপরও সেশনজট মুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে এর সুনাম শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড় অর্জন। একাডেমিক কার্যক্রমের দ্রুত বাস্তবায়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার মাধ্যমে বেরোবি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী কোনো রকম বিতর্কে না জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই সবার প্রত্যাশা।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে যুগের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে আধুনিক এবং যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু গ্রেজুয়েট সৃষ্টি করে না। বিশ্ববিদ্যালয় ভালো মানুষ তৈরীর কারখানা। দক্ষ ও যোগ্য মানুষ তৈরি করার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগের কোন বিকল্প নাই । একজন শিক্ষক আলোকবর্তিকার নেয় ।ভালো শিক্ষক এবং গবেষক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এ অতীব প্রয়োজন । একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত আয়োজন হওয়া উচিত শিক্ষার্থী বান্ধব। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফোকাস থাকা উচিত গবেষণা ও যুগোপযোগী শিক্ষা।
এক্ষেত্রে সুন্দর পরিবেশ, অত্যাধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ করার প্রয়োজন আছে। ছাত্র অনুপাতে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের অনুকূল পরিবেশ প্রদান করা অপরিহার্য । বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও গবেষণাগারের বিকল্প নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরো বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় ব্রান্ডিং হয়। সেশনজট নিরসন করার সাথে সাথে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দান করা হোক আমাদের উদ্দেশ্য।
বর্তমান চাকরির বাজারে নিয়োগকর্তাদের চাহিদা অনুযায়ী গ্রাজুয়েট সৃষ্টি করা দরকার ।একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ব্র্যান্ডিং করার জন্য প্রতিটি শিক্ষার্থী এক একজন সিপাহসালার হিসেবে ভূমিকা পালন করে । বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে দেশ এবং দেশের বাইরে যোগ্যতম শিক্ষার্থী ও মানবসম্পদ তৈরিতে ভূমিকা রাখছে বলেই আমাদের বিশ্বাস। আরো অনেক দূর যেতে হবে। শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রগতি এবং সামাজিক নানা জায়গায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অবদান গুরুত্বের সহিত পালন করে যাচ্ছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে বড় শক্তি হচ্ছে তার শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের গবেষণা এবং নিয়মিত পাঠ দানের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা ক্ষেত্রে আশার সঞ্চার করেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে গবেষণা মাধ্যমে দেশ এবং জাতির সম্মান বৃদ্ধি করছে। অপার সম্ভাবনার নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর। সীমাহীন ভালোবাসা প্রিয় ক্যাম্পাস বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের জন্য সবসময়। সংকট থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করা এ বিশ্ববিদ্যালটি আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা। সেজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী,কর্মকর্তা-কর্মচারী এলাকাবাসী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ব্যক্তিত্বদের যৌথ প্রচেষ্টা অতীব প্রয়োজন। মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে মানবতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যত নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম মানব সম্পদ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এবং বিকশিত করার ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাদের সকলের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও নিরন্তর ভালোবাসা। ভালো থাকুক আমাদের প্রাণের ক্যাম্পাস, আলো ছড়াক যুগ যুগ ধরে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ইতিমধ্যেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষা, গবেষণা, সংস্কৃতি, এবং খেলাধুলায় বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। আবু সাঈদের মতো ছাত্রদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় তার মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে। আমাদের প্রত্যাশা, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাতির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।
লেখক
সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান
মার্কেটিং বিভাগ।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।