মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

১৩ দিনে ঘরে ঢুকে ৫ খুন, অপহরণ ১

  • ঘরে ঢুকে খুন ও অপহরণের মতো ঘটনার হার বেড়েছে
  • দুই মাসে সারা দেশে হত্যাকাণ্ডের শিকার ১৪৬ নারী-শিশু: এমএসএফ
  • চুরি ও ডাকাতির সংখ্যা আশঙ্কাজনক
আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০০ এএম

বাসায় ঢুকে খুন ও অপহরণের মতো ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। চলতি মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে রাজধানী, সিলেট ও বগুড়ার শেরপুরে ঘরে ঢুকে পাঁচটি খুন ও একটি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ছয় ভুক্তভোগীর চারটিই শিশু। এ ছাড়া রাজধানীতে ছিনতাই, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ ও পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কলহের ঘটনায় আরও ৬ জন খুন হয়েছে। এসব ঘটনা বাসার বাইরে ঘটেছে বলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্রে জানা গেছে।

এসব অপরাধের ঘটনা নিরাপত্তা নিয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আর গত দুই মাসে সারা দেশে খুনসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ)’ গত দুই মাসের পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ে সারা দেশে শুধু নারী ও শিশু খুন হয়েছে ১৪৬ জন। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ৬২ জন আর অক্টোবরে ৮৪ জন।

দেশ জুড়ে ঘরে-বাইরে এসব ঘটনার জন্য সার্বিকভাবে নিরাপত্তার ঘাটতিকে দায়ী করছেন সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে এসব ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন অপরাধ-বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক। গতকাল তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশু নির্যাতন, অপহরণ, হত্যা কিংবা ঘরের  ভেতর প্রবেশ করে খুন করার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কিন্তু এই অপরাধ কমানোর জন্য বা এখান থেকে বের হতে হলে আমাদের যা করণীয় সেটা রাষ্ট্রের বা সরকারের দিক থেকে দেখা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে বড় পরিবর্তন এলেও অপরাধের ধরন বুঝতে পারছেন না অনেক কর্মকর্তা। যে কোনো ঘটনায় দ্রুত কী করণীয় সেই বিষয়গুলোও বুঝতে হবে।’ শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ বলেও মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ।

গত দুই দিনে রাজধানীর ধানমন্ডি ও পল্লবী এলাকায় নিজ ঘরে খুন হয়েছে দুই শিশুসহ তিনজন। এছাড়া আজিমপুরে ডাকাতির মালামালের সঙ্গে দুধের শিশুকেও নিয়ে গেছে ডাকাতরা। গতকাল পল্লবীতে দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যার পর বাবা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

ডাকাতির সময় শিশু অপহরণ : গত শুক্রবার সকালে রাজধানীর আজিমপুর এলাকার একটি বাসায় ডাকাতি হয়। ডাকাতরা মালামালের সঙ্গে আট মাসের দুধের শিশু আরিসা জান্নাত জাইফাকে নিয়ে যায়। ডাকাতি ও অপহরণের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ফাতেমা আক্তার শাপলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিংয়ের একটি বাসা থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

শিশুটিকে উদ্ধারের পর সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস বলেন, ‘লালবাগ থানাধীন আজিমপুর মেডিকেল স্টাফ কোয়ার্টারের একটি বাসা থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার ডাকাতির সময় শিশুটিকে অপহরণ করা হয় মুক্তিপণ আদায়ের জন্য।’

র‌্যাব জানায়, চাচাতো ভাই পরিচয় দিয়ে ফাতেমা আরও তিন যুবককে বাসায় নিয়ে এ ঘটনা ঘটান।

ধানমন্ডিতে প্রবাসী চিকিৎসককে খুন : ধানমন্ডির একটি বাসায় ঢুকে যুক্তরাজ্য প্রবাসী চিকিৎসক এ কে এম আব্দুর রশিদকে (৮৫) ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৮/এ রোডের একটি পাঁচতলা বাড়ির দোতলায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

জানা গেছে, ওই বাড়ির মালিক আব্দুল রশিদ। তিনি গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসেন। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে হঠাৎ তাদের বাসা থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে বাড়ির ভাড়াটিয়ারা ছুটে আসেন। তখন কয়েকজন পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় মামলা হলেও গতকাল পর্যন্ত কোনো আসামিকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।

এ বিষয়ে হাজারীবাগ থানার ওসি সাইফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে ওই ভবনে ৩ ব্যক্তিকে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। দ্রুতই আসামি গ্রেপ্তার করা হবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা ও পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় খুনের মামলা হয়েছে ৪৬০টি। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরেই হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪৮টি। এছাড়া আগস্টে ১১৯টি, জুলাইয়ে ৫৯টি, অক্টোবরে ৫৮টি, মার্চে ১৮, মে মাসে ১৬, এপ্রিলে ১৪, জুনে ১৩, জানুয়ারিতে ১১ ও ফেব্রুয়ারিতে হত্যা মামলা হয়েছে ৪টি। এছাড়া গত ১০ মাসে দস্যুতার ১৮৩টি, ডাকাতির ২৯টি, অপহরণের ৮৭টি ও চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫০৯টি। এর মধ্যে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দস্যুতার মামলা ৩৯টি, ডাকাতি ১৪টি, অপহরণের ৪৭টি ও চুরির মামলা হয়েছে ৯৬টি। তবে পুলিশের ঝামেলা এড়াতে চুরি-ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিতে যান না অনেকেই। এ কারণে অপরাধের সঠিক চিত্র মামলার এই পরিসংখ্যানে উঠে আসে না।

ঢাকা মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. ওবায়দুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মাসভিত্তিক খুন বা হত্যার ঘটনায় মামলার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে অনেক বেশি মামলা হয়েছে। ওই তিন মাসে খুনের মামলা হয়েছে মানেই ওই মাসগুলোতেই খুনের ঘটনা ঘটেছে এমন নয়। অনেকে বিগত দিনের খুনের ঘটনায়ও মামলা করছেন।’

সিলেটে গৃহশিক্ষিকার হাতে পাঁচ বছরের শিশু মুনতাহা খুন : সিলেটের কানাইঘাট থেকে শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনকে (৫) অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুমের জন্য ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। গত তিন নভেম্বরে গৃহশিক্ষিকা শামীমা বেগম মর্জিনার পরিকল্পনায় অপহরণের পর বস্তাচাপা দিয়ে শিশুটিকে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায়, মুনতাহার পরিবারের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। কয়েক মাস আগে মুনতাহার গৃহশিক্ষিকা ছিলেন তাদেরই প্রতিবেশী শামীমা। তার চলাফেরা ভালো মনে না হওয়ায় মুনতাহাকে আর পড়াতে হবে না বলে শামীমাকে নিষেধ করেন শিশুটির বাবা শামীম। সে কারণে ক্ষোভ থেকে শিশুটিকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। ১০ নভেম্বর মুনতাহার মরদেহ উদ্ধার হয় বাড়ির পাশে ডোবা থেকে। এ ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা সবাই শিশু মুনতাহার প্রতিবেশী।

বগুড়ায় ভাড়াটিয়ার হাতে গৃহিণী খুন : গত ১১ নভেম্বর দুপুরে দুপচাঁচিয়ার জয়পুরপাড়া এলাকায় ‘আজিজিয়া মঞ্জিল’ নামে চারতলা বাড়ি থেকে সালমা খাতুনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই গৃহবধূকে হত্যার পর ডিপ ফ্রিজে রাখার ঘটনায় তারই ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব। তবে পুলিশের তদন্তে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। পুলিশ বলেছে, গৃহবধূ হত্যায় ছেলে নয়, বাড়ির ভাড়াটিয়া জড়িত। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ছেলে বাদেও তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে একজন শুক্রবার বিকেলে বগুড়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢিলেঢালা অবস্থায় যখন থাকে তখন অপহরণ, ছিনতাই, ডাকাতি ও প্রকাশ্যে খুনের ঘটনাও ঘটে বলে মন্তব্য করেছেন অপরাধ-বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। তিনি বলেন, ‘আগে অপরাধীরা অপরাধ করতেন পেটের তাড়নায়, কিন্তু এখন এই ধরনের অপরাধগুলো পেশা হয়ে গেছে। যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে ধীরগতি আসে তখন অপরাধীরা সেই সময়টি বেছে নেয় এবং অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যায়। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। বেশ কিছু উদ্যেগ নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও এই ধরনের অপরাধ বেড়ে গেছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই ধরনের ঘটনায় দ্রুত ৯৯৯-এ ফোন দিতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানোর আগে থানা পুলিশকে জানান। থানা-পুলিশ দ্রুত সহযোগিতা করবে এবং আসামিদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা করবেন। শিশু অপহরণ, শিশুহত্যা, ছিনতাই, ডাকাতি, খুনসহ প্রতিটা বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে। দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনাই সমান গুরুত্ব দিয়ে থানা-পুলিশ তদন্ত করছে।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত