শিশুসাহিত্যিক, লেখক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হায়াৎ মামুদ ছাত্র হিসেবে খুবই মেধাবী হলেও নিয়মিত ক্লাস করতেন না। স্কুলে-কলেজের এই অভ্যাস বজায় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও। তবে ভালো ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র হওয়ায় সব সময়ই আশু মুশকিল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটা না একটা উপায় ঠিকই পেয়ে যেতেন। ক্লাস না করার ফলে এই পার্সেন্টেজ শর্ট হওয়ার বিষয়টিসহ কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় জীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরেছেন তার ‘কোটি মন্বন্তরে ভুলিব না’ নিবন্ধে।
হায়াৎ মামুদ পড়েছিলেন ঢাকার বিখ্যাত সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে। সেখান থেকে পাস করে ভর্তি হন নটর ডেম কলেজে। তখন সবে শিক্ষালয়টি লক্ষ্মীবাজার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে মতিঝিলে। তখনও নটর ডেম কলেজ শিক্ষার মানের পাশাপাশি নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার জন্য বিখ্যাত ছিল। নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্লাসে উপস্থিতি না থাকলে টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি মিলত না। সেসব জানা থাকা সত্ত্বেও হায়াৎ মামুদ কিন্তু তার স্বভাবটি শুধরে নিতে পারলেন না। নিজেই বলেছেন, স্কুল পালানোর সেই অভ্যাসটি তিনি ছাড়তে পারেননি। অর্থাৎ তিনি কলেজে ভর্তি হওয়ার পরেও নিয়মিত ক্লাস মিস করতেন। ফলে নিয়মনিষ্ঠ নটর ডেম কলেজ থেকে টেস্ট পরীক্ষা দিতে দেবে না, এটি এক রকম ঠিক হয়েই গিয়েছিল। যদিও কলেজ কর্র্তৃপক্ষ তাকে জানায়নি। তারই এক পরিচিত শিক্ষক যিনি তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন, তিনি হায়াৎ মামুদকে জানালেন যে, তোমার তো পার্সেন্টেজ নেই, টেস্ট পরীক্ষায় বসতে দেবে না। আর যখন তোমাকে জানাবে তখন অন্য কলেজে ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিতে পারবে না। হায়াৎ মামুদ জানতে চাইলেন, এখন তবে উপায়? সেই শিক্ষকই চিঠি লিখে দেন কায়েদে আজম কলেজের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ) ভাইস প্রিন্সিপালকে। তিনি মামুদকে ভর্তি করে নেন এবং সেখান থেকে টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এবং নিশ্চিত একটি বছর নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যান।
তবে ঘটনার শেষ এখানেই নয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তিনি আর সবার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন পাস কোর্সে, সেই নটর ডেম কলেজে। কিন্তু আবারও সেই ক্লাস ফাঁকি দেওয়া আর পার্সেন্টেজ শর্ট হওয়ার ফাঁদে পড়ে ঠিক করলেন যে, পাস কোর্স নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। কিন্তু ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেছে। ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। তবে তার ভাগ্য ভালো যে, বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করার পর এই সমস্যারও একটা সুরাহা হয়। তখনকার বিভাগীয় প্রধান মুহম্মদ আবদুল হাই তার সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকার নিয়ে সন্তুষ্ট হন এবং ভর্তি ফরম পূরণ করে জমা দিয়ে সরাসরি ভর্তি হতে বলেন।
ভর্তি তো হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, কিন্তু সেই যে ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার যে স্বভাব সেটির কিন্তু কোনো পরিবর্তন হলো না। তিনি নিয়মিত ক্লাস ফাঁকি দিয়েই অনার্স শেষ করলেন। তবে শিক্ষকদের পছন্দের ছাত্র ছিলেন, যে অল্প কদিন ক্লাস করেছেন তাতেই শিক্ষকদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল আবার সেই পার্সেন্টেজ শর্টেজ। তিনি তখন স্বপ্নে বিভোর, এমএ পাস হয়ে গেলেই বন্ধুকে দিয়ে পিতাকে জানাবেন তার প্রণয়ের কথা এবং যেন পরিণয় ঘটে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ। এর মাঝে মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের তলব, তোমাকে তো পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না, পার্সেন্টেজ নেই। পরে উপায় বাতলে দিলেন তিনিই। শিক্ষকদের বাসায় বাসায় গিয়ে পার্সেন্টেজ বাড়িয়ে আনতে বললেন। সবাই মুক্তহস্তে দেওয়ার পরে দেখা গেল মাত্র ৬০% হয়েছে। পরীক্ষা দিতে প্রয়োজন ৭৫% উপস্থিতি। তবে আশার ব্যাপার হলো, ন্যূনতম ৬০% উপস্থিতি থাকলে একটি জরিমানা দিয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যায়। কিন্তু তাতে শিক্ষকদের অনুমতি লাগে। শিক্ষকদের মিটিংয়ে কথাটি উঠল। অধ্যাপক কাজী দীন মুহম্মদ সবে ফিরেছেন বিদেশ থেকে ডিগ্রি নিয়ে। হায়াৎ মামুদকে তেমন চেনেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা পড়াশোনায় কেমন, ফেল করবে? উত্তর এলো, না। তবে কি থার্ড ক্লাস পাবে? না, তাও না। সেকেন্ড ক্লাস পাবে এবং ভালো মতোই পাবে। অধ্যাপক দীন মুহম্মদ তখন বললেন, তবে আর তাকে নিয়ে কথা বলছি কেন আমরা? অনুমতি দেন, পাস করে আপদ বিদায় হোক। নইলে তো পরের বছরও জ্বালাবে!
অধ্যাপক দীন মুহম্মদের এই উক্তির জোরেই হায়াৎ মামুদ পরীক্ষায় বসার অনুমতি পান আর প্রিয়পাত্রীকে ঘরণি করার সাধও তার পূর্ণ হয়।