‘শিক্ষক’ ছোট্ট একটি শব্দ। তাতে মিশে আছে অনেক প্রীতি। অনেক আবেগ ও অনুভূতি। জড়িয়ে আছে প্রচণ্ড ভালোবাসা। শব্দটি আদর-শাসনে আবৃত। শিক্ষক জ্ঞানবৃক্ষ। শিক্ষক মহিরুহ। শিক্ষক এমন এক আলোকবর্তিকা, যিনি দিবস-রজনী আলো দেন দিক-দিগন্তে, পথ-প্রান্তরে।
শিক্ষার্থীর কোমল মনে জ্ঞানের বীজ বুনে দেন শিক্ষক। তাদের আত্মায় খোরাক জোগান তিনি। শিক্ষকরা নিরলসভাবে কাজ করেন শিক্ষার্থীদের জন্য, জাতির জন্য এবং আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত এসব মানুষ নিঃস্বার্থভাবে আলো ছড়ান সমাজে। পথ দেখান পথভোলাকে। শিক্ষক ছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। তিনি বলেছেন, আমাকে শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হয়েছে। (মিশকাতুল মাসাবিহ)
জন্মের পর নির্দিষ্ট একটি সময় পেরোলে মা-বাবা সন্তানকে মানুষ বানানোর জন্য পাঠিয়ে দেন শিক্ষকের কাছে। শিক্ষক স্নেহ-মমতা আর আদর-শাসনে সন্তানকে মানুষ বানান। তাদের বিকশিত করেন। মননে পরিয়ে দেন জ্ঞানের মাল্য। জ্ঞানে গুণে সমৃদ্ধ করেন। জীবন গঠনে তার ভূমিকা অসামান্য। কী আশ্চর্য, সেই শিক্ষককে অনেক ছাত্র ভুলে যায়। তার কথা মতো চলে না। এখন যেন একাই সে সব। কাউকে সমীহ করে চলার প্রয়োজন বোধ করে না। শিক্ষাবিষয়ক মুরব্বি হিসেবে মানতে চায় না। তার পরামর্শের কোনো তোয়াক্কা করে না। অথচ হাদিসে রাসুল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, তোমরা জ্ঞান অর্জন করো এবং শিষ্টাচার ও আদব শিখ। আর তাকে সম্মান করো যার থেকে জ্ঞান অর্জন করেছ। (আল মুজামুল আওসাত) শিক্ষক মাত্রই বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থীর প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে পিতা-মাতার চেয়ে শিক্ষকদের অবদান কম নয়। যে জাতি যত শিক্ষিত সেই জাতি তত উন্নত। আর শিক্ষকরা জাতির প্রধান চালিকাশক্তি। সত্য ও সুন্দরের পথ হচ্ছে একজন আদর্শ শিক্ষকের দর্শন। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা দেশ ও জাতি তার দ্বারা উপকৃত হয়। এ জন্য শিক্ষকদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো উচিত। রাসুল (সা.) যে ঐশী জ্ঞান লাভ করেছেন, আল্লাহ প্রদত্ত সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষাদান করে নিজের পরিচয় তুলে ধরে বলেছেন, ‘শিক্ষক হিসেবে আমি প্রেরিত হয়েছি।’ (জামে তিরমিজি)
মানবসভ্যতা বিকাশে শিক্ষক সমাজের রয়েছে বড় অবদান। শিক্ষাকে সব উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে ধরলে শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার বিকল্প নেই। তাই তো পবিত্র কোরআনের প্রথম নাজিলকৃত আয়াতে জ্ঞানার্জন তথা বিদ্যাশিক্ষার অধিকারী হতে বলা হয়েছে। এ মর্মে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘পড়ো! তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়ো! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক, আয়াত ১-৫)
হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.) স্বীয় ছাত্র শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক (রহ.) সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘শিক্ষকের দোয়ার দ্বারা কী হয়, তা যদি তোমরা দেখতে চাও, তাহলে আজিজুল হককে দেখো।’
তাই কল্যাণকামী শিক্ষকের স্নেহ-মমতা যেন আমরা ভুলে না যাই। আমরা যেন অকৃতজ্ঞ না হই। শিক্ষককে পাশ কাটিয়ে জীবন গড়ার সুযোগ নেই। শিক্ষকের ছায়াতলেই জীবন গড়তে হবে। শিক্ষককে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। তাকে রাখতে হবে সামনে। সবার আগে। সর্বাগ্যে। তার আলো থেকেই আলো নিতে হবে। তার জ্ঞানের স্ফুলিঙ্গ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করতে হবে। তার আদর-শাসনই জীবনের পাথেয়।