শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

হাসিনাশাহীর আইয়ামে জাহেলিয়াত 

আপডেট : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা উন্নয়নের বয়ান দিতেন, বাংলাদেশকে উন্নত ও আধুনিক করে তোলার কৃতিত্ব নিতেন। অথচ হাসিনার বর্বরতা মধ্যযুগীয় নৃশংসতাকে হার মানায়। মধ্যযুগে যেভাবে নিষ্ঠুরতম উপায়ে প্রতিবাদীদের নির্যাতন ও অত্যাচার করা হতো, হাসিনার আমলে তাও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। যারাই আওয়ামী অপশাসনের বিরোধিতা করত কিংবা যাদের হুমকি মনে হতো, তাদের তুলে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে দিনের পর দিন অমানুষিক পরিবেশে রাখা হতো। আলো, বাতাসহীন ছোট প্রকোষ্ঠে দিনের পর দিন নিষ্ঠুরতম উপায়ে অত্যাচার করা হতো। টয়লেটে যাওয়ার পর্যন্ত ব্যবস্থা ছিল না। ইলেকট্রিক শক, ক্রমাগত প্রহার, নিষ্ঠুরভাবে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি উচ্চশব্দ ও আলো ব্যবহার করে মানসিকভাবে সর্বোচ্চ পীড়ন করা হতো। ঘুমাতে দেওয়া হতো না। কেউ কেউ সইতে না পেরে মারা গেছেন, কেউ উন্মাদ হয়ে গেছেন, কেউ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। দেশ জুড়ে এ রকম অসংখ্য নির্যাতনকেন্দ্র ছিল বলে ধারণা করা হয়। এই জায়গাগুলো ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

বুধবার ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাতি পাওয়া তিনটি গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ভুক্তভোগীরা নির্যাতনের ভয়াবহতার প্রতীক হিসেবে কচুক্ষেত বন্দিশালার দেয়ালগুলো দেখান। এ সময় নির্যাতন পেরিয়ে বেঁচে ফিরে আসা আটজন ভুক্তভোগী, সরকারের ছয়জন উপদেষ্টা, গুম হওয়াদের সন্ধানে গঠিত কমিশনের সদস্য এবং প্রেস উইংয়ের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন। গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন শেষে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়া (অন্ধকার যুগ) বলে একটা কথা আছে না, গত সরকার আইয়ামে জাহেলিয়া প্রতিষ্ঠা করে গেছে। এটা (গোপন বন্দিশালা) তার একটি নমুনা।’ বিভিন্ন সংস্করণে দেশ জুড়ে এমন বন্দিশালা রয়েছে, যেগুলোর সংখ্যা নিরূপণ করা যায়নি বলেও উল্লেখ করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘কেউ কেউ এসব আয়নাঘরে ৮-৯ বছর পর্যন্ত কাটিয়েছেন। বাংলাদেশে যত আয়নাঘর আছে, সব খুঁজে বের করা হবে। গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আমরা জেনেছি এটার সংখ্যা ৭০০-৮০০টি। এগুলো শুধু ঢাকায় নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রত্যন্ত অঞ্চলেও আয়নাঘর ছিল।’

আয়নাঘর বাংলাদেশের এক নিষ্ঠুর শাসনামলের প্রতীক, যেই শাসনামল শেষ হয়েছিল গণঅভ্যুত্থানে। যেদিন জাতির সামনে আয়নাঘর উন্মোচন করলেন প্রধান উপদেষ্টা, সেদিনই জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের রিপোর্ট প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘তৎকালীন সরকার এবং তার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা, আওয়ামী লীগ, এর সহিংস গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। ওএইচসিএইচআরের অনুমান, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মিলিটারি রাইফেল এবং প্রাণঘাতী মেটাল প্যালেটস লোড করা শটগানে। বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ গুরুতরভাবে আহত হয়েছে, কেউ কেউ স্থায়ীভাবে আজীবনের জন্য কর্মক্ষমতা হারিয়েছে।’

আয়নাঘর ও জুলাই গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচার না করতে পারলে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগোবে না। দেশকে জবাবদিহিতা ও ন্যায্যতার আওতায় আনা সম্ভব হবে না। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সব ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখানে সব মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে।’ তার এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতেই হবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত