সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

মুশফিকের মতো প্রথম সেঞ্চুরিটা রাঙা হলো না হৃদয়েরও

আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:১৮ পিএম

ক্রিকেটে সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য শুধু রানসংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা হয়ে ওঠে সংগ্রামের প্রতীক, লড়াইয়ের গল্প। তবে সবচেয়ে করুণ গল্পগুলো তখনই লেখা হয়, যখন এক ব্যাটসম্যান শতকের আলোয় দলকে খাঁদের কিনারা থেকে টেনে তুললেও জয় এনে দিতে পারেন না। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন দৃশ্য আগেও দেখা গেছে—মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম তাদের সেঞ্চুরি দিয়ে দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেও শেষ হাসি হাসতে পারেননি। এবার সেই তালিকায় যোগ দিলেন তাওহীদ হৃদয় হৃদয়। ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরিটা রাঙাতে পারলেন না হৃদয়। 

চলমান আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মঞ্চে ভারতের বিপক্ষে ৩৪তম ওয়ানডেতেই ক্যারিয়ারের প্রথম শতক হাঁকালেন হৃদয়। যখন বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন ধসে পড়ছিল, তখন একাই দলের ইনিংসকে টেনে নেন তিনি। তার ব্যাটে ভর করে দল দাঁড় করায় ২২৯ রানের সংগ্রহ। কিন্তু এই রান কি যথেষ্ট? ভারতের ইনিংসের শুরু দেখে মনে হচ্ছে, এই শতকের ভাগ্যও হয়তো মাহমুদউল্লাহ-মুশফিকদের মতোই হতে চলেছে—ব্যক্তিগত অর্জন, কিন্তু দলীয় ব্যর্থতা। 

চলুন ফিরে দেখা যাক, সেই তিন শতকের গল্প, যেখানে একেকজন ব্যাটসম্যান বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে দলকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অপূর্ণ থেকে গিয়েছিল। 

তাওহীদ হৃদয় হৃদয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আলো কাড়লেন। তারিখটা ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ভারতের বিপক্ষে, ক্যারিয়ারের ৩৪তম ওয়ানডেতে। শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি বাংলাদেশের। ভারতের বিপক্ষে ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম ১০ ওভারেই ৩৯ রানে ছিল না ৫ উইকেট! রানও আসছিল মন্থর গতিতে। কিন্তু একপ্রান্ত আগলে রেখে তাওহীদ হৃদয় হৃদয় ধীরে ধীরে দলকে গড়ে তুলতে শুরু করলেন। শুরুতে রক্ষণাত্মক, পরে আক্রমণাত্মক—শতকের পথে তার ইনিংস ছিল নিখুঁত ভারসাম্যের উদাহরণ। 

হৃদয় তার ১০০ রানের ইনিংসে ৬টি চার ও ২টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন। একসময় মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ ২০০ রানও করতে পারবে না, কিন্তু হৃদয়ের দৃঢ়তায় দল ২২৯ পর্যন্ত পৌঁছায়। তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন জাকের আলী হৃদয়। তবে ভারতীয় বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের কারণে অন্য ব্যাটসম্যানদের কেউই বড় ইনিংস খেলতে পারেননি। কিন্তু হৃদয়ের এই শতক দলকে জয় এনে দিতে পারেনি। মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর মতোই ব্যর্থতা আর হতাশার ইতিহাসের অংশ হতে যাচ্ছে। 

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ: বিশ্বকাপে সেঞ্চুরির অশ্রু 

(৯ মার্চ ২০১৫, নিউজিল্যান্ডে বিপক্ষে, ১১১তম ওয়ানডে) 

বিশ্বকাপের মঞ্চে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের প্রথম শতক ছিল ইতিহাসগড়া এক ইনিংস। বাংলাদেশের ব্যাটিং যখন ধুঁকছিল, তখন তিনি দায়িত্ব নেন একপ্রান্ত আগলে রাখার। ১০৩ রানের ইনিংস খেলতে তিনি মাত্র ১৩৮ বল নিয়েছিলেন। ৭টি চার ও ২টি ছক্কার ঝড়ে তিনি বাংলাদেশকে ২৭৫ রানের লড়াই করার মতো সংগ্রহ এনে দেন। 

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এই ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের জন্য ‘বাঁচা-মরার’ লড়াই। সেই চাপ মাথায় নিয়েই মাহমুদউল্লাহ ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। একসময় মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশ ২৫০ রানও করতে পারবে না, কিন্তু তার ইনিংস দলকে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেয়। যে ইনিংস বাংলাদেশকে ১৫ রানের জয় এনে দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে।

পরের ম্যাচটি ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। যদিও সেটা ছিল নিয়মরক্ষার। সেদিনও বিপদে হাল ধরে ১২৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। বাংলাদেশও পায় ২৭৫ রানের ইনিংস। কিন্তু রিয়াদের সেই সেঞ্চুরি সেদিন বাংলাদেশকে জেতাতে পারেনি। রিয়াদের এই সেঞ্চুরিও রয়ে যায় ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের নিদর্শন হয়ে। হৃদয়ের শতকও আজ সেই ভাগ্য বরণ করেছে। 

মুশফিকুর রহিম: হারারেতে একা লড়াই 

(১৬ আগস্ট ২০১১, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, ৫৬তম ওয়ানডে) 

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১১ সালে হারারের মাটিতে মুশফিকুর রহিম যে শতক করেছিলেন, সেটি ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম। তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বেশ অস্থির সময় পার করছিল। অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররা ফর্মে ছিলেন না, দল বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল। সেই পরিস্থিতিতে মুশফিক যখন ১০১ রানের ইনিংস খেললেন, তখন মনে হয়েছিল, হয়তো বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। 

মুশফিকের ১০১ রানের ইনিংসটি ছিল টাইগারদের প্রতিরোধের প্রতীক। ১০০ বল খেলে তিনি ৮টি চার ও ১টি ছক্কা হাঁকান। তার ইনিংসের সৌজন্যে বাংলাদেশ ২৫০ রানের কাছাকাছি সংগ্রহ গড়ে। কিন্তু জিম্বাবুয়ে সেই লক্ষ্য সহজেই তাড়া করে ফেলে, আর মুশফিকের শতক থেকে যায় পরাজয়ের আড়ালে। 

হৃদয়ের শতকের পর বাংলাদেশের ভাগ্যেও জয় লেখা যায়নি। তবে ইতিহাস বলে, যখনই কোনো বাংলাদেশি ব্যাটসম্যান দলের বিপর্যয়ের সময় শতক করেছেন, তার ইনিংস বড্ড একলা হয়ে গেছে। মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক—তারা লড়েছেন, বাংলাদেশকে লড়াইয়ে রেখেছেন, কিন্তু শেষ হাসি হাসতে পারেননি। তবে ব্যাতিক্রমও ছিল। যেমন ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশকে টেনে জয় এনে দেন মাহমুদুল্লাহ ও সাকিব আল হাসান। দুজনেই পেয়েছিলেন সেঞ্চুরির দেখা।

তামিম ইকবাল: মিরপুরে আইরিশ বধ

২০০৮ সালের ২২ মার্চ মিরপুরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে তামিমের ১২৫ রানের ইনিংস ছিল সাহসের প্রদীপ। ২৮তম ইনিংসেই শতকের দেখা পান এই ওপেনার। যদিও দল জিততে পারেনি, তবুও তার ইনিংস আত্মবিশ্বাসের মাইলফলক হয়ে ছিল।

সাকিব আল হাসান: কানাডার বিপক্ষে ধ্রুপদী শতক

২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০তম ইনিংসে সাকিব তার প্রথম শতক পান। সেন্ট জনসে কানাডার বিপক্ষে ১৩৪ রানের ইনিংসটি ছিল তার অলরাউন্ড সামর্থ্যের প্রথম বড় প্রকাশ। বাংলাদেশের ক্রিকেট তখনও শিখর ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছিল, সাকিবের ব্যাটে সেই স্বপ্নের ছন্দ তৈরি হচ্ছিল।

হৃদয়ও সেই ভাগ্য বদলাতে পারেননি। তার শতকও কেবল ব্যক্তিগত অর্জনের খাতায় যুক্ত হয়েছে। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিমের পথে হাঁটলেন তিনিও।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত