একটি সভ্য সমাজে কখন, কেন ধর্ষণ হয়? মনস্তাত্ত্বিকভাবে এর বিশ্লেষণ জটিল এবং দীর্ঘ। একটি আধুনিক সমাজে যখন এ ধরনের ঘটনা নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে যায়, তখন ভাবতে হবে আমরা অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে, কেবল যৌন চাহিদা পূরণের জন্যই এমন কাজ হচ্ছে। ধর্ষণ হচ্ছে, চলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন যা দীর্ঘদিন ধরেই এ দেশে অহরহ ঘটছে। আইনের প্রতি কোনো ধরনের ভয় না থাকার কারণেই এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। সুজান ব্রাউনমিলার তার সাড়া জাগানো বইঅমধরহংঃ ঙঁৎ ডরষষ : গবহ, ডড়সবহ ধহফ জধঢ়ব-এ ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করেছেন পুরুষাধিপত্য প্রতিষ্ঠার কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে। তার মতে, ধর্ষণ শুধু কিছু মনোব্যাধিগ্রস্ত মানুষের কাজ নয়, এটি পুরুষতন্ত্রের ফসল। লৈঙ্গিক রাজনীতিতে ধর্ষণ একটি বড় হাতিয়ার, নারীকে অধীনে রাখার পুরুষের চরম উপায়। আমরা কি এটা মেনে নিয়ে কালিমালিপ্ত সভ্যতাকেই আঁকড়ে ধরব?
বর্তমানে ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে উত্তাল সারা দেশ। দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নির্যাতনের ঘটনায় এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২৯৪ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৬ জন, যার মধ্যে ৪৪ জন শিশুও রয়েছে। মাগুরায় আলোচিত ধর্ষণের শিকার ৮ বছরের শিশুটি পৃথিবীর মায়া ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে। তার মৃত্যুতে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে দেশবাসী। বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সকালে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় একে একে দুবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় ওর। এরপর দুপুরে তৃতীয়বার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের পর আর হৃৎস্পন্দন ফেরেনি অভিমানী হৃদয়ে। ঘৃণা, লজ্জা, অভিমানে জমে থাকা শ^াস চিরমুক্তি নিয়ে অসীমে মিলিয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পারিবারিক কলহের জেরে করা মামলা থেকে স্বামীর নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে গৃহবধূকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। কৌশলে সেই ঘটনার ভিডিও করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করা হয়। একই দিন মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় নিজ ক্লিনিকের নার্সকে ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় শিবচর ইউনাইটেড হাসপাতালের মালিক আপেল মাহমুদকে (৪২) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ রকম ঘটনা প্রচুর। বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মধ্যেই এসব মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করার জন্য বিদ্যমান আইনে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে আইন পরিবর্তন করা হলেও সেটি বাস্তবায়ন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ধর্ষণ মামলার বিচার নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
ধর্ষণ ও নারী নিপীড়ন ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষিত হওয়ার পর থেকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের নানা প্রান্তে আন্দোলনে মুখর হয়েছে ছাত্র-জনতা। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল জানিয়েছেন সাত দিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু করা হবে। পাশাপাশি এটাও বলেছেন ‘সাত দিনের মধ্যে বিচারকাজ শুরু হলেও কত দিনে শেষ হবে, তা বলতে পারছি না। তবে ৭-৮ দিনে বিচারকাজ শেষ করার নজির রয়েছে। আমরা নতুন একটি আইন করছি, আশা করা যায়, রবি বা সোমবার নতুন আইন তৈরি হবে। শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।’
শিশু ধর্ষণের ঘটনায় শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। গত বছর অ্যাকশন এইডের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের শতকরা ৮৮ জন নারী রাস্তায় চলার পথে যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্যের মুখোমুখি হন। এদের ৮৬ ভাগ গণপরিবহনের চালক ও হেলপারদের দ্বারা হয়রানিমূলক মন্তব্যের শিকার হয়। তুচ্ছ কারণে ধর্ষণের মতো ঘটনা তখনই সংঘটিত হয়, যখন রাষ্ট্রে বিচারহীনতার পরিবেশ বিদ্যমান থাকে। এ সমস্যাটি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এ কারণে যে, এ দেশে ধর্ষণের বিচার করার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের দুর্বলতা ও দীর্ঘসূত্রতা প্রকট। ‘ধর্ষণ ব্যক্তির ঘটনা হলেও, রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে।’ আইন উপদেষ্টার এই কথার বাস্তবায়ন হলেই মঙ্গল। আইনের প্রয়োগ এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেখতে চায় সবাই। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা থামছে না। এই অসভ্যতা ও সহিংসতার পেছনে কোনো উগ্র গোষ্ঠীর উসকানি বা মদদের মাধ্যমে একটি পক্ষ কি দেশকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লোটার অপচেষ্টা করছে? সভ্যতার নামে যে অসভ্যতা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, যে বিপর্যয়ের দিকে আমরা ক্রমে অগ্রসর হচ্ছি, তা কোনোভাবেই শুভ বার্তা দেয় না।