বাংলাদেশের ফুটবলের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা রিফাত মাসুদ মাইক্রোফোন ছেড়ে কলম ধরেছেন দেশ রূপান্তর-এর অনুরোধে। হামজা চৌধুরীকে কোন ভূমিকায় দেখা যেতে পারে বাংলাদেশের একাদশে? খুব কাছ থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দলকে দেখা রিফাতের বিশ্লেষণ
লেস্টার সিটির হামজা চৌধুরীর ওপর বেশ কিছুদিন ধরেই নজর রাখছিল শেফিল্ড ইউনাইটেড। প্রিমিয়ার লিগে ফিরে লেস্টার সিটি আবার খাবিই খাচ্ছিল। সেই দায়ে কোচ স্টিভ কুপারকেও ছাঁটাই হতে হলো। লেস্টার সিটি কোচ হিসেবে নিয়ে এলো রুড ফন নিস্তেলরয়কে। ডাচ কোচের পরিকল্পনায় যে হামজা থাকছেন না, সেটা নিস্তেলরয়ের অধীনে দুই ম্যাচ যাওয়ার পরই বোঝা গেল।
ততদিনে হামজা বাংলাদেশের হয়ে গেছেন। শেফিল্ড ইউনাইটেড কোচ ক্রিস ওয়াইল্ডারের সঙ্গে হামজার সম্পর্কটা পুরনো। ওয়াটফোর্ডে এই জুটি এক সঙ্গে কাজ করেছে, সফলও হয়েছে। শেফিল্ডের দরকার প্রমোশন, আর হামজার দরকার গেইম টাইম। ধারে লেস্টার সিটি থেকে তাই হামজাকে আবার ফিরিয়ে আনলেন ওয়াইল্ডার, বললেন, ‘হামজা চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার, ও ছিল আমাদের এক নম্বর ট্রান্সফার টার্গেট। সে বহু বছর ধরেই লেস্টার সিটিতে আছে, সেখানেও সফল হয়েছে। আমরা দারম্নণ আনন্দিত যে ওর মতো ফুটবলারকে আমরা রাজি করাতে পেরেছি। হামজা অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে নিয়ে আসছে, সঙ্গে দলের মানটাও বাড়বে।’
হামজার প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব থেকে চ্যাম্পিয়নশিপের ক্লাবে ধারে চুক্তির কারণ এ সবই। শেফিল্ড যে আশায় হামজাকে নিয়েছে, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম কি? ওয়াইল্ডারের বলা কথাগুলো কেউ যদি বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরার উক্তি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়, তাও কারও অবিশ্বাস করার কথা নয়।
হামজা যে কাজটা শেফিল্ডে করে যাচ্ছেন, একই কাজ বাংলাদেশ জাতীয় দলেও করতে চাইবেন। তবে পরিসর হয়তো বাড়বে, দায়িত্বও কমবে না। আর চ্যালেঞ্জ? সেটাও আরও বড়ই হচ্ছে, ছোট নয়।
ফুটবলের আরেক পরিচয়, এই খেলাটা মহাদেশীয়। সব মহাদেশে একটা ভিন্ন ধাঁচ থাকে। মোটা দাগে যা দিয়ে ওই অঞ্চলের ফুটবলের সংজ্ঞা দাঁড় করানো যায়। যেমন, লাতিন আমেরিকানরা চোখ ধাঁধানো জাদুকরী ফুটবল খেলে বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। এই মানদ-গুলো মূলত তৈরি হয়েছে কিংবদন্তি সব ফুটবলারদের কারণে, কিন্তু কেউ যদি ধরে নেন ওটাই শেষ কথা, তাহলে তাকে ব্যতিক্রম উদাহরণও দেখানো সম্ভব। দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব অথবা কোপা আমেরিকায় আপনি শরীরনির্ভর ফুটবলটাই বেশি দেখবেন। কারণ ওই অঞ্চলের কলম্বিয়া বা চিলির মতো দলগুলো নিজেরাও জানে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা থেকে পিছিয়ে তারা। দলে যতই হামেশ রদ্রিগেজ অথবা অ্যালেক্সিস সানচেজের মতো বিশ্বকাঁপানো তারকা থাকুক না কেন, ম্যাচ জিততে হলে এসব দলকে ডিফেন্সের দিকেই নজরটা দিতে হয় বেশি। তাতে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের মতো দলগুলো ভিন্ন আঁটসাঁট রড়্গণের বিপড়্গে গোল পেতে হিমশিম খায়, খেলায় তাই অনেক ড়্গেেত্রই হয়ে যায় ‘ফিজিক্যাল’ দাপটটা ভিন্ন এক মাত্রা তৈরি করে দেয়।
এই রীতি যেমন ইউরোপ-আমেরিকায় আছে, তেমন এশিয়া বা দক্ষিণ এশিয়াতেও প্রায় একই ঘটনাই ঘটে। সে কারণেই কোনো এক মেসির আগমনেই রাতারাতি পাল্টে যায় না ভাগ্য। কিন্তু পরিবর্তন হয় ঠিকই।
‘হামজা মিডফিল্ডে শক্তি বাড়াবে, ওর উপস্থিতিই দলকে পাল্টে দিতে পারে’ এই কথাও ক্রিস ওয়াইল্ডারই বলেছিলেন। একই কথা বলেছেন হাভিয়ের কাবরেরাও। আসলে প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দুই দলের জন্য হামজার প্রভাব প্রায় সমান। বাংলাদেশ কোচ জানেন, হামজার মতো ফুটবলার দলে থাকা ভাগ্যের ব্যাপার, আবার ওই মাপের ফুটবলারের জন্য সঠিক ট্যাকটিক্যাল দর্শন খুঁজে বের করাও মাথাব্যথার কারণ।
কাবরেরার ভাবনার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য দুই রকম। যারা দেশেই ক্লাব ফুটবল খেলেন তাদের নাড়ি-নক্ষত্র তার জানা। যেহেতু নিজে আগে ছিলেন অ্যানালিস্ট, তাতে হামজা সম্পর্কেও তার যে অগাধ জ্ঞান সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু এই দুইয়ের মিশ্রণ এক করলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে আর কাগুজে সব হিসাব মাঠের খেলায় কেমন দেখাবে তা জানা যায় না। কিন্তু অনুমান করা যায় ঠিকই।
কাবরেরার অধীনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত বিল্ড আপ ফুটবল খেলার আত্মবিশ্বাস অর্জন করাটা। পায়ে বল রাখতে বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হয়, সেই মাপের ফুটবলার না থাকার পরও সেই মানের খেলা দেখা গেছে কাবরেরার দলের কাছ থেকে। কিন্তু ওই বিল্ড আপে যখনই প্রতিপড়্গ প্রেসিং-এ নেমেছে বাংলাদেশের ফুটবলও হাত গুটিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।
বাংলাদেশ দলে ৮ নম্বর জার্সিটা চেয়ে নিয়েছেন হামজা। বাংলাদেশ দলেও সম্ভবত ব্যাকরণ মেনে নাম্বার এইটের ভূমিকাতে বেশি পার্থক্য গড়তে চাইবেন হামজা। নাম্বার এইটের সঙ্গে সিক্সের তফাৎটা হলো একজন আক্রমণে সাহায্য করবেন বেশি, অন্যজন থাকবেন পেছনে। সিক্সের যোগসূত্র ডিফেন্ডারদের সঙ্গে যতখানি অটুট, নাম্বার এইটের ক্ষেত্রে সেটা তার সামনের দুজন অর্থাৎ টেন বা নাইনের সঙ্গে মজবুত। আর আধুনিককালে এ সবের সংকর বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার। এই ভূমিকাতে বাংলাদেশ দলে হামজাকে দেখার ভাবনাটা সবচেয়ে জনপ্রিয়। গেল কয়েক বছর ধরেই হোল্ডিং মিডফিল্ডারের পজিশনে খেলছেন মোহাম্মদ হৃদয়। ইন্টারসেপশন ও বিল্ড আপে ভালোই করেছেন তরম্নণ মিডফিল্ডার। মিডফিল্ডে এতদিন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া ও সোহেল রানাকে। কাজেম শাহও আছেন সুযোগের অপেক্ষায়। মিডফিল্ডে একটা প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু সেটা অবধারিত ভাবেই হামজাকে ঘিরে নয়। বরং হামজার সঙ্গে জোট বাঁধবেন কারা, তাই নিয়ে।
দলবদলের জটিলতায় জামালের আবার খেলা হয়নি এই মৌসুমে। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ না খেললেও জামালের ফিটনেস নিয়ে তেমন শঙ্কা নেই। তবে ম্যাচ ফিটনেসের হিসাবটা নিশ্চয়ই কষবে কোচিং প্যানেল। পাজেলটা মেলানোর ভার তাই স্প্যানিশ কোচের ওপর।
এর পেছনে কারণও আছে। বাংলাদেশে সিঙ্গেল পিভোট বা নাম্বার সিক্স রোলে একজনকে খেলানোর পদ্ধতির প্রচলন নেই বললেই চলে। আর হামজা যেহেতু একজন, তার সঙ্গে আরও দশজন মিলেই একটা দল সে হিসেবে যতই হামজাকে কেন্দ্র করে কৌশল সাজানো হোক, বাংলাদেশের ট্যাকটিক্যাল বিবর্তনের ধারাটাকেও একেবারে অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
তবে এসবের ভিড়ে হামজা জাদুকরও বনে যেতে পারেন। তার টাচ, পেস্নয়িং স্টাইল, ভিশন, স্ক্যানিং, চার গজের পাস অথবা ১০ গজের পাসের মেধা গোটা এশিয়ার বিচারেও বিশ্বমানের। বাংলাদেশ চায় নিচ থেকে খেলা বিল্ড আপ করতে, প্রতিপড়্গরে প্রেসিংয়ের চোখ রাঙানি উপেড়্গা করে মিডফিল্ড থেকে লাইন ব্রেকিং রান নিয়ে ফরোয়ার্ড পর্যšত্ম পাস পৌঁছে দিতে। তাতে মাঠের অন্যপাশে যে জায়গা তৈরি হয় তা দিয়েই গোল হয়, তাতেই ম্যাচের ফল নির্ধারণ হয়। আধুনিককালেও ফুটবলের গল্পটা আছে আগের মতোই, জায়গা তৈরি করম্নন, খালি জায়গা ধরে আক্রমণ করা। সংখ্যায় এগিয়ে থাকলে এরপর বাকিটা ফিনিশিং-এর খেলা।
শেফিল্ডে বেশ কিছু ম্যাচে রাইটব্যাক পজিশনে খেলেছেন হামজা। সেটা অবশ্য বাধ্য হয়ে। নিয়মিত রাইটব্যাক আলফি গিলক্রিস্ট চোটে পড়ায় রাইটব্যাকে সার্ভিস দিয়েছেন তিনি। আর মূলত বেশিরভাগ ম্যাচে শুরম্ন করেছেন রাইট সাইডেড মিডফিল্ডার হিসেবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চাহিদা অনুযায়ীই ব্যবহার হবেন তিনি।
বাংলাদেশের সেই চাহিদার অবশ্য শেষ নেই। গোল করা থেকে করানো ডিফেন্ডিং, সবকিছুতেই দরকার উদ্ধারকারী হামজার প্রভাব। এসবের বিচারেই ট্যাকটিক্যাল সমাধান বের করবেন কোচ। জার্সির নাম্বারের মতো সেটা কার্যকরী নাম্বার এইটই হতে পারে। সময়ের প্রয়োজনে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, অসময়ের প্রয়োজনে স্ট্রাইকার, সবই বনে যাওয়ার সুযোগ আছে তার সামনে।
এখন তো আর শুধু শেফিল্ড নয়, গোটা একটা দেশের নজরই হামজার দিকে। নিজের সামর্থ্যরে চেয়ে বরং নিজ গুণে বাকিদের সামর্থ্যরে কতখানি উন্নতি তিনি ঘটাতে পারেন সেটাই বোধ হয় বাংলাদেশের ফুটবলের নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াবে।