সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

পুলিশের প্রতি বার্তা ও মাঠের বাস্তবতা

আপডেট : ২০ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪৬ এএম

পুলিশকে শক্ত থাকার বার্তা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বাহিনীর যে বদনাম হয়েছে সেখান থেকে তাদের বের হতে হবে।’ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাত মাসেরও বেশি সময় পর পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত বিশেষ এ বৈঠকে বাহিনীর ১২৭ কর্মকর্তা অংশ নেন। সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে বলেন, ‘নির্বাচন আগামী ডিসেম্বরে হবে। যেহেতু নির্বাচন আসছে, নানা সমস্যা হবে, নানা চাপ আসবে। সবাই বেপরোয়া হয়ে যাবে। পুলিশ কর্মকর্তাদের দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করতে হবে।’ প্রধান উপদেষ্টার পুলিশ বাহিনীকে ‘শক্ত হওয়ার’ নির্দেশ দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, পুলিশ কি শক্ত হওয়ার মতো অবস্থায় আছে? মাঠের বাস্তব অবস্থাই বা কেমন? বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ এখন এক বৈরী পরিবেশের মুখোমুখি। জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাহিনীর একটি বড় অংশ নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলে, যা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। তাদের মধ্যে আস্থার সংকট বিরাজ করছে। এর প্রধান দায়ভার পতিত স্বৈরাচার সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার। আর অনেকখানি দায়ভার বর্তায় অতিউৎসাহী ও রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট শীর্ষ এবং মধ্যম সারির বিরাট সংখ্যক কর্মকর্তার ওপর। এই কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে জুলাই হত্যাকা-ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভ দমনে ১৮ থেকে ২১ জুলাই টানা চারদিন নির্বিচারে গুলিবর্ষণের প্রধান অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে। হত্যাকা-ের কিছু কিছু ঘটনা সারা দেশকে কাঁপিয়ে দেয়। বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, ‘গুলি করলে মরে একটা, একটাই যায়, বাকিডি যায় না। এটাই সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগের বিষয়।’ ভাইরাল হওয়া ফুটেজে দেখা যায়, পতিত সরকারের পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মোবাইলে ছবি দেখিয়ে কথা বলছিলেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। পাশে দাঁড়ানো পুলিশের সাবেক আইজি (হত্যা মামলায় বর্তমানে কারাগারে) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। আশুলিয়ায় ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটিয়ে লাশের স্তূপ তৈরি করা হয়েছিল। লাশের এই স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। বিদেশে পালাতে গিয়ে তিনি বিমানবন্দরে আটক হন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যু। আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়েছিলেন। পুলিশ দুবার গুলি চালালে সাঈদ তার বুক চেপে ধরেন। সাঈদ ভাবতেই পারেননি, পুলিশ সরাসরি তার বুকে গুলি করবে। জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভ ও বিক্ষোভের পর সংঘাত দমনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অপ্রয়োজনীয় ও মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের’ গুরুতর ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কিছু ব্যক্তির লাঠি, ইট বা প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহারের বিপরীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাবার বুলেট, শটগান, হ্যান্ডগান, রাইফেলসহ প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, জুলাই গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা দেড় সহস্রাধিক। এর মধ্যে রয়েছে ৬৬ শিশু-কিশোর। আহত ২০ হাজারের বেশি। যাদের অধিকাংশ এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অনেকে পা হারিয়েছেন, অনেকে হারিয়েছেন হাত। চোখ নষ্ট হয়েছে চার শতাধিকের।

বিপরীতে পুলিশ যে মাত্রায় আক্রমণের শিকার হয়েছে, অতীতে আর কখনো এমনটি হয়নি। এসব আক্রমণে পুলিশের ৪৪ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আগুনে পুড়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে থানা, ফাঁড়ি, রাজধানীর থানা, পুলিশ বক্সসহ চার শতাধিক স্থাপনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সহকর্মীদের নির্মম হত্যাকান্ড, থানা-ফাঁড়িতে আগুনের ঘটনা পুলিশ বাহিনীকে বিপর্যস্ত করেছে। কমবেশি সব সরকারের আমলেই পুলিশ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ফ্যাসিবাদী আমলের মতো আর কখনো এমনটি হয়নি। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের প্রধান কারিগর ছিল পুলিশ। এক পর্যায়ে পুলিশ রাষ্ট্রের বাহিনী না থেকে অনেকটা সরকারি দলের বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে পুলিশের মধ্যসারি থেকে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। জড়িয়ে পড়েন দুর্নীতিতে, অনেকেই গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করার পর শেখ হাসিনা ভাবতে শুরু করেন যে, তিনি আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন। একই সঙ্গে শীর্ষ কর্মকর্তাসহ পুলিশ বাহিনীর একটি বড় অংশ বিশ্বাস করত, আওয়ামী লীগই লাগাতারভাবে ক্ষমতায় থাকবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সফল পরিণতিতে ৫ আগস্টের পর পুলিশ সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। যা সম্ভবত বাহিনীর কল্পনারও বাইরে ছিল। প্রথম দিকে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পুরো পুলিশ বাহিনীকে সক্রিয় করতে অনেকটা সময় চলে যায়। তবে আইনশৃঙ্খলায় তারা এখনো পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা আছে। গ্রেপ্তার, হত্যা মামলা, চাকরি থেকে অব্যাহতিসহ ঢালাওভাবে ওএসডি করা তাদের সুস্থির হতে দিচ্ছে না।  

পুলিশও মব হামলার শিকার হচ্ছে। থানায় ঢুকে পুলিশ কর্মকর্তাকে আক্রমণ করা হচ্ছে। পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিলে বাধা দেওয়ায় এক পুলিশ সদস্যকে পেটানো হয়। কোথাও কোথাও পুলিশকে হত্যার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বাহিনী এককভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। অধিকাংশ জায়গায় পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে নির্বাচনের আগে পুলিশ আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করলেন। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তাদের একগুচ্ছ দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘পুলিশ মানে আইন ও শৃঙ্খলা। সরকার যা কিছুই করতে চাক না কেন, শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাত দিয়েই করতে হয়। পুলিশ সামনের সারির মানুষ। জনগণের আস্থার জায়গা। পরাজিত শক্তির সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে পুলিশকে সেই আস্থা আইনের মধ্যে থেকে অর্জন করতে হবে।’ গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তি দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রদের দল বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ না দেখিয়ে কাজ করতে পুলিশের প্রতি নির্দেশ দেন। প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ গুরুত্ব দেন, নারীর সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রাখার জন্য। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নারীরা যেন সবখানে নিরাপদে থাকে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। নারী-শিশু যেন হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’

বিশেষ এ বৈঠকে বিভিন্ন মহানগর কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার এবং ক্রাইম বিভাগের সদস্যসহ ১২৭ কর্মকর্তা যোগ দেন। বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা বর্তমানে কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরেন। তারা জনবল সংকটের পাশাপাশি যানবাহন সংকটের কথা তুলে ধরেন। একজন কর্মকর্তা হাটহাজারী থানার উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই থানায় চার লাখ মানুষ বসবাস করেন। অথচ এখানে পুলিশের মাত্র দুটি গাড়ি আছে। এই দুটি গাড়িও সমস্যায় আক্রান্ত। এক জেলার এসপি তার জেলার জনবল সংকটের কথা জানিয়ে বলেন, যে জনবল দরকার তারচেয়ে ৩০০ জন কম আছে। একজন মহিলা এসপি বৈঠকে বলেন, বাহিনীতে নারীর সংখ্যা অনেক কম। শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তারা বাহিনীতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা বিশেষভাবে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তারা ভবিষ্যতে কোনো সরকার যাতে পুলিশকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য পুলিশ কমিশন গঠনের দাবি জানান। বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করেন, পুলিশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে স্বাধীন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করা না গেলে, আগামীতে রাজনৈতিক সরকারের আমলে এটি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পুলিশকে সত্যিকার অর্থে আইনের রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে বাহিনীর খোলনলচে বদলানো সম্ভব না হলেও, অনেক কিছুই বদলাতে হবে। সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পুলিশকে যথার্থ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দেখা যাবে। দুর্নীতি নিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনী জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হবে। এখন দেখার বিষয়, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার পর পুলিশ প্রশাসনে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসে কি না। আগামী জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাদের এখনই আইনশৃঙ্খলায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনমনে পুরোপুরি আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত