মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

সংস্কার সুপারিশের ৪২ প্রস্তাবে এলডিপির দ্বিমত

আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৫, ০২:১৬ এএম

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পায়। ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলো বাদে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সব দলই সংস্কার ইস্যুতে অভিন্ন মত দেয়। সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার গঠিত ছয়টি কমিশন এরই মধ্যে তাদের প্রস্তাব ও সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে। এরপর প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে ছয় কমিশনের প্রধানকে নিয়ে গঠন করা হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে সংলাপ এবং মতামত নিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে এরই মধ্যে চিঠি পাঠিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। আগামী কয়েক সপ্তাহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার পর তাদের কাছ থেকে আসা সুপারিশ ও প্রস্তাব নিয়ে বসবে ঐকমত্য কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে সংস্কারের প্রশ্নে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রথম দিনে এলডিপির সঙ্গে বৈঠকে বসে কমিশন। জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে সংলাপে দলটি তাদের অবস্থান তুলে ধরে।

বৈঠকের পর দলটির চেয়ারম্যান অলি আহমদ বলেছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্নমালার মধ্যে ১২০টির বিষয়ে এলডিপি একমত। বাকি ৪২টি প্রস্তাবের সঙ্গে এলডিপি একমত নয়। দুটো প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। আর দুটি প্রস্তাবের বিষয়ে তারা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কোন কোন প্রস্তাবের সঙ্গে এলডিপি একমত বা একমত নয়, তা খোলাসা করেননি তিনি।

সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।

এলডিপির আট সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। দলে আরও ছিলেন মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য নেয়ামূল বশির, আওরঙ্গজেব বেলাল, কে কিউ সাকলায়েন, ওমর ফারুক, উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মাহবুবুর রহমান এবং যুগ্ম মহাসচিব বিল্লাল হোসেন মিয়াজী।

এ সংলাপে এলডিপি নেতারা রাজনৈতিক সংস্কারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং কমিশনের সুপারিশগুলোর ব্যাপারে তাদের মতামত তুলে ধরেন। কমিশন আগামী দিনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

এর আগে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুপারিশগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট মতামত সংগ্রহের জন্য ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ১৭টি রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জমা দিয়েছে। গতকাল জামায়াতে ইসলামী তাদের লিখিত মতামত দেয়। বিএনপি আগামী রবিবার তাদের মতামত দেবে বলে জানা গেছে।

তবে সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার প্রস্তাবের সুপারিশগুলো চূড়ান্ত করে যেতে পারে। নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকার এর বাস্তবায়ন করবে। আবার সরকারপক্ষ ও কিছু রাজনৈতিক দল চায় সংস্কার প্রস্তাবের বাস্তবায়ন। এ নিয়ে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রচেষ্টা ভেতর ও বাইরে থেকে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে, বিশেষত পরাজিত শক্তিগুলো বর্তমান কাঠামো টিকিয়ে রাখতে চায়। তিনি বলেন, নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও মতামত ছাড়া এ প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের স্বাক্ষরিত চিঠি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয় গত সপ্তাহে। চিঠির সঙ্গে স্প্রেডশিটে ছয়টি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর সারসংক্ষেপ ছক আকারে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলোশ্বে সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলোশ্বে ‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’শ্বে এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে বলা হয়েছে।

দ্বিতীয়তটি হলো, প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ছয়টি ঘর রয়েছে। সেগুলো হলো : সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নশ্বে ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’ ‘নির্বাচনের পর সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, যেসব সুপারিশের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব স্পষ্টীকরণ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়ন করা; একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া; প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সর্বোচ্চ দুই মেয়াদে সীমিত করা; দুবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অযোগ্য করা; একই ব্যক্তি একই সঙ্গে যাতে দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হতে না পারেন, তার বিধান করা; ১০০টি আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা; উচ্চকক্ষে আনুপাতিক পদ্ধতিতে আসন বণ্টন; বিরোধী দলকে সংসদের ডেপুটি স্পিকারের পদ দেওয়া; সরাসরি ভোটে ৪০০ প্রতিনিধির সমন্বয়ে সংসদের নিম্নকক্ষ গঠন; যার মধ্যে নিম্নকক্ষের ১০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা এবং সেগুলোয় ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সরাসরি ভোট করা; দলনিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা; জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষের সদস্য এবং স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বৃহত্তর নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন; জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা; নির্বাচন কমিশনকে দায়বদ্ধ করা; মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখতে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করা ইত্যাদি।

গোলটেবিল বৈঠকে যা আলোচনা হলো : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রচেষ্টা ভেতর ও বাইরে থেকে নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল ‘রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, বর্তমান শাসনব্যবস্থার কাঠামো স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। তবে এ সংস্কার প্রক্রিয়া নির্বাচনের সঙ্গে বিরোধী নয়, বরং সমান্তরালে চলতে পারে। প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার সম্পন্ন করেই নির্বাচন আয়োজন করা উচিত।

আলী রীয়াজ বলেন, ১৬ বছরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও ভঙ্গুর করে দিয়েছে। বিচার বিভাগ কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে, যার ফলে কাঠামোগত সংস্কার এখন অপরিহার্য।

সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিতর্ক আলোচনায় সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ নিয়ে মতপার্থক্যের প্রসঙ্গও উঠে আসে। এক বক্তার প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন কমিশন স্বাধীনভাবে সুপারিশ করেছে, তবে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি প্রধান দায়িত্বশ্বে স্বৈরাচার প্রতিরোধে সংস্কার, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। এগুলো একসঙ্গে চলতে পারে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ সংস্কার চায়। রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করা। ঢাবির সহযোগী অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, নাগরিকদের চাপ না থাকলে সংস্কার কমিশনও নীরব হয়ে যাবে।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত