মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

হালদা-কর্ণফুলী

লবণের দাপটে দিশেহারা ওয়াসা

আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৫, ০৭:৫৮ এএম

চট্টগ্রাম মহানগরীর পশ্চিম ফিরোজশাহ এলাকার বাসিন্দা ওয়াহিদুজ্জামান। গত মাস থেকেই ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততা। কোনোভাবেই তা পান করা যাচ্ছে না। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী প্রতি লিটার পানিতে ৬০০ মিলিগ্রাম লবণ সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এর বেশি হলে তা পানযোগ্য নয়। কিন্তু ওয়াসা যে পয়েন্ট (হালদা নদীর ইনটেক) থেকে পানি সংগ্রহ করে সেই পয়েন্টে প্রতি লিটারে সর্বোচ্চ লবণ পাওয়া গেছে ১৪২০ মিলিগ্রাম (গত ১৫ জানুয়ারি) এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি পাওয়া গেছে ১৪০০ মিলিগ্রাম। গত ডিসেম্বর থেকেই নদীর পানিতে লবণের মাত্রা বাড়ছিল। এই বাড়তি লবণের মাত্রা অব্যাহত থাকবে পুরো শুষ্ক মৌসুম। অর্থাৎ, বর্ষা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত নগরবাসীকে লবণসহনশীল পানি পান করতে হবে। যদিও চট্টগ্রাম ওয়াসা গভীর নলকূপের পানি এই পানির সঙ্গে মিশিয়ে নগরবাসীকে সরবরাহ করছে তারপরও পানিতে লবণের প্রভাব থেকেই যাচ্ছে।

প্রথম লবণ পানি কখন পাওয়া গেল?

১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে সমীক্ষার মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরের প্রান্তসীমা মোহরায় হালদা নদীর পানি পরিশোধন করে নগরীতে পানি সরবরাহের প্রকল্প গ্রহণ করে। সেই প্রকল্পটি চালু হয় ১৯৮৭ সালে। দৈনিক ৯ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার প্রকল্পটিতে সর্বপ্রথম লবণের প্রভাব পড়ে ১৯৯৫ সালে। সে বছর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রথম ১৫ দিন হালদার পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। ১৯৯৫ সালের পর ২০০২ সালের মার্চে সর্বোচ্চ ১১০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণ পাওয়া গিয়েছিল প্রতি লিটার পানিতে। ২০০২ সালের পর হালদা নদীর পানিতে লবণের মাত্রা কমে আসার পর ২০০৭ সালে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সে বছর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত টানা লবণের প্রভাব ছিল। জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম, ফেব্রুয়ারিতে ৭ হাজার ২৫০ মিলিগ্রাম, মার্চে ৬ হাজার ৭০০ মিলিগ্রাম ও এপ্রিলে ২ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম লবণ পাওয়া যায়। পরে এক বছর গ্যাপ দিয়ে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু করে ২০০৯ সালের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাস পর্যন্ত বেড়ে যায় লবণের মাত্রা। পরে কয়েক বছর গ্যাপ দিয়ে ২০১৪, ২০১৫, ২০২১ সালের মে মাসে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মে এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসের পর এ বছরের জানুয়ারি থেকেই বেড়ে গেছে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ। 

ওয়াসা কি লবণ পানি সংগ্রহ করে?

নদীর পানিতে যখন লবণ বেশি থাকে তখন ওয়াসা পানি সংগ্রহ বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পানিতে লবণের মাত্রা বেশি থাকলে আমরা সর্বোচ্চ জোয়ারের সময় পানি সংগ্রহ বন্ধ রাখি। এতে প্রায় চার ঘণ্টা পানি সংগ্রহ বন্ধ থাকলে ২৪ ঘণ্টার উৎপাদন কমে যায়।’

কী পরিমাণ উৎপাদন কমে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এবারের লবণাক্ততা হালদা পাড়ের মোহরা প্ল্যান্টে আগে যেখানে ৯ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা যেত এখন তা ৬ কোটিতে নেমে এসেছে, একইভাবে মদুনাঘাটে ৯ কোটির স্থলে ৬ কোটি উৎপাদন করা যাচ্ছে। অন্যদিকে কর্ণফুলীতে তুলনামূলক লবণের মাত্রা কম থাকলেও সেখানে পানির স্তর কমে যাওয়ায় কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-১ ও ২ থেকে যেখানে আগে দিনে ২৮ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করা যেত এখন সেখানে করা যাচ্ছে ২৬ কোটি লিটার। চাহিদা অনুযায়ী পানি উৎপাদন করা যাচ্ছে না বলে নগরীতে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে।’

জোয়ারের সময় পানি না নিলেও পানিতে লবণ কেন থাকছে? এ প্রশ্নের জবাবে মাকসুদ আলম বলেন, ভরা জোয়ারের সময় পানি না নিলেও অন্য সময় তো আমরা পানি সংগ্রহ করছি। তখন তো পানিতে কিছুটা হলেও কম লবণ থাকে। যদিও এই পানির সঙ্গে আমরা গভীর নলকূপের পানি মিশ্রিত করে লবণের তীব্রতা কমিয়ে আনি। তারপরও অনেক সময় লবণের প্রভাব থেকে যায়। এজন্য নগরীর কিছু কিছু এলাকায় মানুষ লবণ পানি পেয়ে থাকে। 

পানিতে লবণাক্ততা কেন বাড়ে?

হালদা ও কর্ণফুলী মিলিত হয়েছে নগরীর কালুরঘাট রেলওয়ে সেতুর উজানে। এর ২৫ কিলোমিটার ভাটিতে কর্ণফুলীর মোহনা, যেখানে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলিত হয়েছে কর্ণফুলী নদী। বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি হালদা ও কর্ণফুলীতে আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উজান (হালদা ও কর্ণফুলীর) থেকে পানির প্রবাহ থাকলে তা বেশিদূর ভেতরে যেতে পারে না। একসময় হালদা নদীতে অনেকগুলো ছরা ও খাল ছিল। সেগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং অপরিকল্পিত সøুইস গেটের কারণে খালগুলো মরে গিয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে হালদায় স্বাদু পানির প্রবাহ কমে গেছে। তাই শুষ্ক মৌসুমে যখন উজান থেকে পানি আসা কমে যায় তখন সাগরের জোয়ারের পানি হালদার ভেতরে প্রবেশ করে। জোয়ার যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ হালদার পানিতে লবণ থাকে বলে সে সময় হালদা নদীর পানি ওয়াসা সংগ্রহ করতে পারে না। আর যদি সংগ্রহ করে তাহলে সেই পানিতে লবণ থাকে। পানি সংগ্রহ না করলে পানি উৎপাদন কমে গিয়ে নগরীতে পানি সমস্যা দেখা দেয়।

অন্যদিকে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠায় শুষ্ক মৌসুমে তারা পাঁচটি টারবাইনের মধ্যে মাত্র একটি টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ফলে উজান থেকে খুব কম পানি নেমে আসে এবং কর্ণফুলী নদীর প্রবাহ প্রায় থাকে না বললেই চলে। আর না থাকার কারণে সাগরের জোয়ারের লবণ পানি কর্ণফুলীর উজানে অনেক দূর পর্যন্ত চলে যায়। এদিকে কর্ণফুলীর পানির ওপর ভিত্তি করে রাঙ্গুনিয়ার পোমরায় গোডাউন ব্রিজ এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে ওয়াসার কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-১ ও কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্প-২। এ দুই প্রকল্পের মাধ্যমে দিনে ২৮ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। এর বিপরীত পাড়ে বোয়ালখালীর ভান্ডালজুড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে দিনে ৬ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতার আরও একটি প্রকল্প। কিন্তু কাপ্তাই বাঁধ থেকে পানি না ছাড়ার কারণে কর্ণফুলীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারে লবণ পানির দাপট বেড়ে গেছে শুষ্ক মৌসুমে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ওয়াসার পানি উৎপাদন। লবণাক্ততার কারণে ওয়াসার প্রকল্পগুলো থেকে দিনে ৮ কোটি লিটার পানি কম উৎপাদিত হচ্ছে। 

প্রতিকার কি?

হালদা ও কর্ণফুলীতে স্বাদু পানির প্রবাহ বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তবে হালদায় যেহেতু নতুন করে পাহাড়ি ছরা তৈরি করা যাবে না তাই এই নদীর সঙ্গে যুক্ত খালগুলোতে পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। খালগুলো সক্রিয় করলে হালদার প্রবাহ কিছুটা বাড়বে। একই সঙ্গে রাবার ড্যামও রাখা যাবে না। অন্যদিকে কর্ণফুলী নদীর নাব্য রক্ষায় অবশ্যই শুষ্ক মৌসুমে কমপক্ষে দুটি টারবাইন সচল রাখতে হবে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সিদ্ধান্ত রয়েছে শুষ্ক মৌসুমে দুটি টারবাইন চালু রাখার জন্য। কিন্তু পিডিবি দুটির পরিবর্তে একটি চালু রাখায় কর্ণফুলীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় জোয়ারের সময় সাগরের লবণ পানি প্রবেশ করছে।এতে পানি সংগ্রহ করতে পারছে না ওয়াসা। এতে নগরীতে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে।’

এদিকে টারবাইন চালু না করা প্রসঙ্গে পিডিবি কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, এখন যদি দুটি টারবাইন চালু রাখি তাহলে এপ্রিল-মে মাসে লেকে কোনো পানি থাকবে না। তখন উজানের অনেক উপজেলায় যাতায়াতের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। লেকের পানি দিয়েই ওইসব এলাকায় মানুষ যাতায়াত করে। তাই জনস্বার্থে আমরা রেশনিং করে একটি টারবাইন চালু রাখছি। এতে হয়তো চট্টগ্রাম শহরে পানির সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত