নানা জটিলতায় আট বছরেও শেষ হয়নি এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের টাঙ্গাইল অংশের কাজ। এতে আসন্ন ঈদেও যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা করছেন পরিবহন চালকরা। পরিবহন চালকরা বলছেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ও তদারকির অভাবই কাজে ধীরগতির মূল কারণ। আর যাত্রীরা বলছেন, সঠিক তদারকি হলে প্রতিবছরই মহাসড়কে যানজট নামে এ দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।
তবে নির্মাণ কাজের ধীর গতির কথা অস্বীকার করে যথাযথভাবেই কাজ হচ্ছে বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক। মহাসড়কে যান চলাচল নির্বিঘ্ন রাখতে সড়ক নিরাপত্তায় সাড়ে ৭০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়ক। রাজধানী ঢাকার সাথে সড়ক পথে উত্তরবঙ্গের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম এ মহাসড়ক। শুধু ঢাকা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত মহাসড়কে টাঙ্গাইলের অংশ ৬৫ কিলোমিটার। ঈদের সময় ঘরমুখো মানুষের যানবাহনের ভিড়ে মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রতিবছর ঈদে এ মহাসড়ক দিয়ে উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ যাতায়াত করেন- যা বছরের অন্য সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এ মহাসড়ক দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ২৪ জেলার যানবাহন চলাচল করে। তাই এই সড়কে গাড়ির চাপ থাকে বেশি। এ কারণে প্রতিবছর ঈদে এ মহাসড়কে যানবাহনের চাপে জটলা বাঁধে।
যমুনা সেতু-ঢাকা মহাসড়কে ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এবারের ঈদে মহাসড়ককে চারটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। মহাসড়কে ৭৫০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। লিংক রোডগুলোতে বাঁশ কল বসানো হবে। পুলিশের পাশাপাশি টাঙ্গাইল শ্রমিক ফেডারেশন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করবে।
পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতির পরেও যানজটের আশঙ্কা করছেন এ মহাসড়কে চলাচলকারী পরিবহন চালক ও সাধারণ যাত্রীরা।
পরিবহন চালকরা বলছেন, ঈদ এলেই মহাসড়কে তড়িঘড়ি কাজ শুরু হয়। এতে গাড়ির গতি ঠিক থাকে না এবং দেবে যাওয়া রাস্তায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। আর মহাসড়কের চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত।
এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত চারলেনের কাজ করছে। এর ফলে মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, যমুনা সেতুতে টোল আদায়ের সফটওয়ারে সমস্যার কারণে টোল আদায় দীর্ঘক্ষণ বন্ধ থাকলে এবং সেতুর উপর দীর্ঘ সময় গাড়ি আটকা থাকলে যানজট হয়। অপরদিকে যমুনা সেতু পশ্চিম অংশে সিরাজগঞ্জের অংশে গাড়ি ঠিক মতো পাস না হয় তাহলে যানজটের শঙ্কা রয়েছে। গত কয়েক ঈদেও সিরাজগঞ্জের অংশে গাড়ি ঠিক মতো পাস হওয়ার কারণে যমুনা সেতুতে টোল আদায় বন্ধ থাকে। ফলে টাঙ্গাইলের অংশে দীর্ঘ যানজট হয়। প্রতি বছরই ঈদকে সামনে রেখে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা সড়কে লক্করঝক্কর এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি বের করে। এসব গাড়ি হঠাৎ করেই মহাসড়কে বিকল হয়ে যায়। এতে উভয় পাশের গাড়ি থেমে পড়ে। একপর্যায়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় চালকের অদক্ষতা, সড়ক দুর্ঘটনা এবং গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যানজট হয়।
সরেজমিনে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, মহাসড়কের এলেঙ্গার পর থেকে বিভিন্ন পয়েন্টে উন্নয়ন কাজ চলছে। ঈদ উপলক্ষে অতিরিক্ত শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। উত্তরবঙ্গগামী লেনে পুরোদমে কাজ চলছে। বিশেষ করে ব্রিজের কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। ঢাকাগামী লেন দিয়ে যানবাহন চলাচল করছে।
মহাসড়কের আনালিয়াবাড়ী এলাকায় ব্রিজের কাজ করা শ্রমিক সেলিম মিয়া বলেন, ঈদের আগে ব্রিজের কাজ শেষ করার তাগিদ রয়েছে। আমরা আট জন শ্রমিক মিলে এখানে সার্বক্ষণিক কাজ করছি। আশা করছি যথা সময়ে কাজ শেষ করতে হবে।
ধলাটেঙ্গর এলাকায় শ্রমিক খলিলুর মিয়া ও সজিব মিয়া বলেন, গত দিন ধরে আমাদের কাজ করা জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা যতটা সম্ভব দ্রুত কাজ করছি।
উত্তরবঙ্গগামী পরিবহনের চালক ফরহাদ হোসেন বলেন, মহাসড়কে পুলিশের সঠিক তদারকি প্রয়োজন। এছাড়া এলেঙ্গা থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত কাজ করছে। কাজ শেষ না হলে এবারও মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা করছি। গতবছরও এ মহাসড়কে যানজট হয়েছিল। প্রতিবছরই আমাদের যানজটের কবলে পড়তে হয়।
অপর বাস চালক করিম চৌধুরী বলেন, সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে এবারও মহাসড়কে যানজটের আশঙ্কা রয়েছে। মহাসড়কে পুলিশকে আরও দায়িত্বশীল হয়ে কাজ করতে হবে। ৫ আগস্টের পর সারাদেশে পুলিশের ভূমিকা অনেকটা ম্রিয়মাণ। এ কারণে যদি পুলিশ মহাসড়কে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে তাহলে যানজট হবে।
আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রজেক্ট ম্যানেজার রবিউল আওয়াল বলেন, এলেঙ্গা থেকে সেতু পর্যন্ত মহাসড়কের সাড়ে ১৩ কিলোমিটারের ৪০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তবে ঈদের আগেই মহাসড়কের এই অংশের উত্তরঙ্গগামী পুরো লেন চলাচলের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে। দ্রুতই এ লেনে যানবাহন চলাচল করতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
টাঙ্গাইল সড়ক বিভাগের(সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী সিনথিয়া আজমিরী খান জানান, ঈদের ১০ দিন আগে থেকে মহাসড়কে মেরামতের কাজ বন্ধ থাকবে। এছাড়া গোবিন্দাসী সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্যও প্রস্তুত রাখা হবে।
টাঙ্গাইল জেলা বাস কোচ মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন জানান, মহাসড়কে কম-বেশি যানজট হবেই। তবে যানজট যাতে সহনীয় পর্যায়ে থাকে এদিকে পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা রাখতে হবে। যানজট হওয়ার সাথে সাথেই নিরসনে ভূমিকা রাখতে হবে। মহাসড়কে যানজট নিরসনে পুলিশের সাথে এবারও তারা স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করবেন।
যমুনা সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল জানান, ঈদযাত্রায় যমুনা সেতু দিয়ে সার্বক্ষণিক টোল চালু রাখার চেষ্টা করা হবে। এবার সেতুর দুই প্রান্তের ৯টি করে বুথ দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হবে। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের জন্য ২টি করে আলাদা বুথ থাকবে।
তিনি আরও জানান, সাধারণত প্রতিদিন যমুনা সেতু দিয়ে গড়ে ২০ থেকে ২১ হাজার যানবাহন পারাপার হয়। ঈদযাত্রায় তা বেড়ে দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি যানবাহন পারাপার হয়।
এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর চারলেন প্রকল্পের পরিচালক ওয়ালিউর রহমান জানান, ২০১৬ সালে প্রকল্প হাতে নিলেও টেন্ডার জটিলতায় ২০২১ সালে মহাসড়কের এই অংশের কাজ শুরু হয়। মাটি ভরাটের কিছু সমস্যা থাকায় কোনো কোনো জায়গায় কাজ করতে সমস্যা হয়েছে। সে সব সমস্যা কাটিয়ে কাজ এগিয়ে চলছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। তবে তারা আশা করছেন- ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারবো। আর সার্ভিসলেনের কাজ ঈদের আগেই শেষ হয়ে যাবে। ফলে মানুষ চার লেনের সুবিধা পাবে।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, ইতোমধ্যে যানজট নিরসনে সংশ্লিষ্টদের সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে। যানজট নিরসনে টাঙ্গাইলের অংশে ৬৫ কিলোমিটারে জেলা পুলিশের ৭৫০ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া মহাসড়কে মোবাইল টিম ও প্রিকেট টিম কাজ করবেন। এ ছাড়া মহাসড়কে ৪টি সেক্টর ভাগ করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আগামী ২৫ মার্চ থেকে পুলিশ মহাসড়কে ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে। ঈদের পরেও যানজট নিরসনে পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। এবার মহাসড়কে যানজট সৃষ্টি হবে না বলে আশা করছেন পুলিশ সুপার।