স্বাধীনতা তুমি রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা স্বাধীনতা শব্দটিকে এইরকম উচ্ছ্ব্াস নিয়ে বিবরণ দিয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। স্বাধীনতা মানুষের জীবনে এক অবিস্মরণীয়, অপার্থিব অনুভূতি। আজকের দিনে, ৫৪ বছর আগে আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম। পেয়েছিলাম নতুন পতাকা। যে পতাকা পেলে কবি আর বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা লিখবেন না বলেছিলেন। যেই পতাকায় পাতা কুড়ানির মেয়ে শীতের সকালে ওম নেবে জাতীয় সংগীত শুনে পাতার মর্মরে। তবু আজ অবধি স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ ধরা দেয়নি জাতির জীবনে। নানা মাত্রায়, নানান প্রেক্ষিতে ভূলুণ্ঠিত হয় নাগরিকের আত্মসম্মান। পাশাপাশি আমাদের দেশ হয়তো আর্থিক সচ্ছলতা দিতে পারেনি, হয়তো আমাদের অনেক সমস্যা, কিন্তু স্বাধীনতার যে গৌরব, যে সম্মান, তা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, আমরা ২০২৪ সালে জুলাই মাসের পর নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছি। আমাদের জন্য এখন কেবল একাত্তরের গৌরবগাথা নয়, আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে ২৪ সালের আত্মত্যাগ, একতা আর আত্মসম্মানের এক অনবদ্য গল্প। বাংলাদেশের বয়স ৫৪ বছর হলেও আমাদের আশার আলো তরুণরা, যারা দেশ থেকে স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথর সরাতে নেতৃত্ব দিয়েছে। স্বাধীনতার চেতনা আমাদের লড়াই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। আমাদের লক্ষ্য ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিমূলক সরকার। নানা মতের, পথের, বিশ্বাসের মানুষ একত্র হয়ে যেমন স্বৈরাচারকে হটিয়েছিল, সেই বৈচিত্র্যের একতায় এগিয়ে নেওয়াটাই স্বাধীনতা দিবসের চ্যালেঞ্জ।
স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার। স্বাধীনতা তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিল পেশি।
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
তবে, আমাদের স্বাধীনতা তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে যখন এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকা দুর্নীতির রাহুকে ধ্বংস করা যাবে। এই দেশের মেহনতি মানুষের ভাত, কাপড় আর জমির অধিকার রক্ষা করা যাবে। এই দেশের প্রতিটা মানুষকে নাগরিকের সম্মান দেওয়া যাবে। স্বাধীনতা কোনো স্থির বস্তু নয়, স্বাধীনতার চেতনা স্রেফ বায়বীয় নয়, যেমনটা বহু সুযোগসন্ধানী দেখাতে চান। স্বাধীনতা হচ্ছে দেশের সবচেয়ে নিপীড়িত মানুষদের অধিকার আদায়ের প্রেরণা, মানবমুক্তির, দেশকে সত্যিকারের একটা বাসযোগ্য করে তোলার যাত্রা। এই যাত্রায় আছে কত ত্যাগ, তিতিক্ষা।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র। তুমি আসবে বলে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
আমাদের যে নতুন দিনের সংগ্রাম তাতেও অকাতরে জীবন দিয়েছেন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতিরা। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে তারা স্বৈরাচার তাড়িয়েছে। একজন আবু সাঈদ গোটা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। তার দুই হাত তুলে প্রতিবাদের ছবি পৃথিবীর ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে গেছে শোষণের বিরুদ্ধে, অপশক্তির বিরুদ্ধে, প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের স্বাধীনতা আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবে। আমাদের মুগ্ধ হয়ে আছেন সহমর্মিতা, নাগরিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে। আমাদের জানা, অজানা শহীদরা আমাদের দেখিয়েছেন স্বাধীনতা জীবনের চেয়েও দামি। আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ থেকে পাওয়া প্রেরণা আমাদের সামনের দিনের পাথেয় হয়ে থাকবে।
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্য, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক এই বাংলায়
তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।