বর্তমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবে স্থানীয় অর্থনীতিতেও রয়েছে অস্থিরতা। এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, ব্যবসায়িক হয়রানি, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদ, আয়কর ও ভ্যাট প্রদানে জটিলতা এবং যানজটের কারণে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিস্থিতি আশানুরূপ নয় বলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) মতবিনিময় সভায় জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই পরিস্থিতির উন্নতির মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বিনিয়োগের নিরাপদ পরিবেশ চান ব্যবসায়ীরা।
গতকাল শনিবার ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও আদাবর অঞ্চলের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা, আয়কর ও ভ্যাট, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদহার এবং যানজট’বিষয়ক মতবিনিময় সভা হয় টোকিং কনভেনশন সেন্টারে। সভায় ব্যবসায়ীরা এসব তথ্য তুলে ধরেন।
সভায় ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মিলন শেখ এবং ঢাকা ডিএমপির অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মো. আলমগীর কবির মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন। এ সময় বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্যে উদ্ভূত নানা চ্যালেঞ্জ। কর ও ভ্যাটব্যবস্থার জটিলতা, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট, আমদানি-রপ্তানির প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, ‘এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমাদের এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে একটি নিরাপদ, স্থিতিশীল ও পূর্বানুমানযোগ্য ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।’
ডিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে আসন্ন বাজেটে উৎসে করের হার যৌক্তিকভাবে হ্রাস করা, মূসক হার সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণ ও অনানুষ্ঠানিক খাতের জন্য ১ শতাংশ হারে মূসক নির্ধারণ এবং ভ্যাট অ্যাপ চালুর প্রস্তারের পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রস্তাব করা হয়েছে।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, শিল্পায়নের ধারা অব্যাহত রাখতে উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণপ্রাপ্তি প্রক্রিয়ার সহজীকরণ, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে অটোমেশন বাস্তবায়নের মাধ্যমে গতিশীলতা আনয়ন এবং সরকারের পক্ষ থেকে যুগোপযোগী নীতি সহায়তার কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীরা কর দিতে চায়; কিন্তু কোনো হয়রানি চায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১৭ মার্চ একটি মাস্টার সার্কুলার জারি করেছে। যেখানে এসএমইদের ঋণপ্রাপ্তির সীমা বৃদ্ধির পাশাপাশি মেয়াদি ঋণের সময়সীমা পাঁচ বছর থেকে সাত বছরে উন্নীত করা হয়েছে। এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন স্কিমের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট ২৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল রয়েছে, যেখানে এ খাতের উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এ ঋণের হার মাত্র ৫ শতাংশ।
মো. মিলন শেখ বলেন, সরকারের মোট রাজস্বের প্রায় ৮০ শতাংশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আহরণ করতে হয়, যা অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় এ বছর ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত তিন মাসে এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ভাটের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, ভ্যাটের আওতা এবং ভ্যাট আদায় বৃদ্ধিতে মোবাইল অ্যাপ প্রবর্তনের প্রস্তাব সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে পারে। ভ্যাটের বিষয়টিকে জটিল ভেবে দূরে না থেকে এ বিষয় জানার পরিধি বাড়ানোর জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (তেজগাঁও বিভাগ) মো. আলমগীর কবির বলেন, গত দুই মাসে এ অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে, সেই সঙ্গে মামলার পরিমাণ কমেছে। গত ২৭ মার্চে পুলিশের ব্লক রেইডের মাধ্যমে ৬৩ জন চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং সম্প্রতি শুধু মোহাম্মদপুর এলাকায় একদিনে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ৭১ জনকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আসন্ন কোরবানি ঈদ উপলক্ষে মোহাম্মদপুরের শপিং মলগুলোয় নিরাপত্তা দিতে পুলিশকে অবহিত করার জন্য এলাকাবাসী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান।
মুক্ত আলোচনায় টোকিও স্কয়ার দোকান মালিক সমিতির সদস্য মোহাম্মদ হীরু এবং ফারুক আহমেদ, রাপা প্লাজা দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোতাহার হোসেন, টাউন হল বাজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি লুৎফর রহমান বাবুলসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা বলেন, ভ্যাট প্রদানের প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি, ভ্যাটের অ্যাপ প্রবর্তন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, চাঁদাবাজি বন্ধ, যানজট নিরসন, ঋণের সুদের হার হ্রাস ও ঋণপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানি কমানোর বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।