চট্টগ্রামের বাতাসে আজও বহে নতুন গল্পের সুবাস। একদিন এই মাটিতে স্বপ্ন বুনেছিল এক সাকিব, সময়ের আঁচড়ে বড় হয়ে উঠেছিল এক ইতিহাস। আজ সেই একই মাটিতে আরেক সাকিব ছুঁয়ে দিলো সম্ভাবনার প্রথম তারা। প্রজন্ম বদলায়, নামের মাঝে বুনে যায় মিল। আর ইতিহাসের পাতায় জন্ম নেয় এক নতুন কবিতা।
চট্টগ্রাম যেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের আবেগের শহর। সমুদ্রের নোনা হাওয়া আর সবুজ মাঠের মাঝে বহু ক্রিকেটার দেখেছেন স্বপ্নের জন্ম। ২০০৭ সালের মে মাসে, এই মাটিতে টেস্ট ক্যাপ হাতে নিয়েছিলেন এক তরুণ — সাকিব আল হাসান। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক, তবে প্রথম উইকেটের স্বাদ পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল তৃতীয় টেস্টের চতুর্থ ইনিংস পর্যন্ত। তার সেই যাত্রা শুরু হয়েছিল ধীরে, যেন নদী প্রথমে ছোট্ট ধারা হয়ে এগোয়, পরে বিস্তৃত হয় মহাসাগরে।
আজ ২০২৫ সালের এপ্রিলে একই চট্টগ্রামে জন্ম নিলো নতুন গল্প। তানজিম হাসান সাকিব তরুণ পেসার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট ক্যাপ মাথায় পরলেন। তবে সাকিব আল হাসানের মতো দীর্ঘ অপেক্ষা নয়; নিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই উইকেটের স্বাদ পেলেন সাকি। অভিষেকেই ব্যাটসম্যানের স্টাম্প উপড়ে এক টুকরো স্বপ্ন ছুঁয়ে দিলেন তিনি।
তবে মিল শুধু নামে কিংবা মাঠেই নয়। দুজনেই বুকভরা সাহস নিয়ে নামছেন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। পার্থক্য প্রেক্ষাপটের। সাকিব আল হাসানের দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেট ছিল কেবল শিকড় গাঁথার চেষ্টা চালানো এক তরুণ গাছ। আর তানজিমের সময়ে বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে সাহসী উচ্চতার দ্বারপ্রান্তে।
আজ যখন পেছন ফিরে দেখি, সাকিব আল হাসানের অর্জন চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। ৬৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে তুলেছেন ৪৬০০ রানের বেশি, সঙ্গে নিয়েছেন ২৩৫টি উইকেট। ওয়ানডেতে তার সংগ্রহ ২৫০টির বেশি ম্যাচে ৭০০০ রানের ওপরে ও ৩০০টির বেশি উইকেট। আর টি-টোয়েন্টিতে তিনি বাংলাদেশের হয়ে খেলেছেন ১২০টিরও বেশি ম্যাচ, করেছেন ২৫০০’র বেশি রান আর শিকার করেছেন প্রায় ১৪০ উইকেট। তিন ফরম্যাটেই ব্যাটে-বলে অলরাউন্ডার কিংবদন্তির বিরল খেতাব অর্জন করেছেন তিনি। এমন ক্রিকেটার বিশ্ব ক্রিকেটেও হাতে গোনা।
সাকিবের এই মহীরুহ হয়ে ওঠার পেছনে ছিল অগণিত দিন-রাত্রির যুদ্ধ। ইনজুরি, নিষেধাজ্ঞা, সমালোচনা সব পেরিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম।
অন্যদিকে তানজিম হাসান সাকিবের যাত্রা এখনো অঙ্কুর। তবে তার শুরুটা সাহসী। ৬টি ওয়ানডে খেলে এখন পর্যন্ত নিয়েছেন ৮টি উইকেট, সেরা বোলিং ফিগার ৩ উইকেটের জন্য ৩২ রান। টি-টোয়েন্টিতে ২টি ম্যাচ খেলে পেয়েছেন ২টি উইকেট, দেখিয়েছেন দারুণ নিয়ন্ত্রিত লাইন-লেন্থের ঝলক। আর আজ, অভিষেক টেস্টেই প্রথম উইকেটের উল্লাসে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি আসছেন নিজের আলাদা পরিচয় গড়তে।
চট্টগ্রাম যেন আজও বয়ে বেড়ায় সেই পুরনো আবেগ আর নতুন স্বপ্নের মিশ্র সুর। একসময় এখানে হাতেখড়ি হয়েছিল সাকিব আল হাসানের, যিনি সময়ের পরীক্ষায় গড়ে তুলেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। আজ সেই একই মাঠে নতুন অধ্যায়ের শুরু করলেন তানজিম হাসান সাকিব — যিনি হয়তো একদিন আরেকটি উজ্জ্বল নাম হয়ে উঠবেন বিশ্ব ক্রিকেটের আকাশে।
সময়ের নদীতে গল্পগুলো বারবার ফিরে আসে। নামের মিল, মাঠের মিল — আর এখন ইতিহাসের পাতাতেও শুরু হলো মিলের নতুন অধ্যায়। দুই সাকিব, দুই শুরু — অথচ একই গন্তব্যের স্বপ্ন: বাংলাদেশের পতাকা আরও উঁচুতে ওড়ানোর।
সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই কিছু গল্প বারবার ফিরে আসে।আজ চট্টগ্রামের বাতাসে মিশে আছে সেই পুরনো স্মৃতি আর নতুন স্বপ্নের গন্ধ। যেখানে দুই ‘সাকিব’ হাত ধরেছে সময়ের এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে, বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্তরাধিকারের কবিতায়।