বাংলাদেশে পরিবহন খাতে দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা যায় বলে উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে। ২০২৩ সালে বিভিন্ন খাতে দেড় হাজারের মতো শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলেও তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও আইএলওর সহযোগিতায় এ সম্মেলন আয়োজন করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফ)। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান। এতে সভাপতিত্ব করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক ওমর মো. ইমরুল মহসিন।
অনুষ্ঠানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক মো. মতিউর রহমান ‘পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত’ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এই প্রবন্ধে আইএলও এর তথ্য তুলে ধরে বলা হয় বাংলাদেশে ২০২৩ সালে কর্মক্ষেত্রে ১ হাজার ৪৩২ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন ৫০২ জন। অনানুষ্ঠানিক খাতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১ হাজার ১০৩ জনের। সবচেয়ে বেশি ৬৩৭ জন মারা যান পরিবহন খাতে। এ ছাড়া নির্মাণ খাতে ১৪৯ জন এবং দৈনিক মজুরিভিত্তিক খাতে ২২০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
প্রবন্ধে উল্লিখিত আইএলওর তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, সারাবিশ্বে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা রোগে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন শ্রমিক মারা যান। শ্রমিকদের এমন মৃত্যুর কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে বৈশি^ক অর্থনীতি। শুধু এই কারণেই বছরে বৈশ্বিক জিডিপি হারাতে হচ্ছে ৪ শতাংশ।
প্রবন্ধে আইএলওর ২০১৯ সালের তথ্য তুলে ধরে মতিউর রহমান জানান, বিশ্ব জুড়ে বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা রোগে ২৭ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিকদের মৃত্যু হয়। যেখানে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে মারা যান একজন শ্রমিক। বছরে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় আহত হন ৩৭ কোটি ৪০ লাখ শ্রমিক। এতে বৈশ্বিক জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয় একা কাজ করতে পারে না। যেমন ধরেন শিপবিল্ডিং, এটি শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতায় না, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতায়। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনক যেকোনো ইনফরমাল সেক্টর শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতায় নেই। কোনো কনস্ট্রাকশন ফার্ম রেজিস্টার না। যদি কোনো কনস্ট্রাকশন ফার্ম শ্রম আইনের আওতায় নিবন্ধিত না হয়, তাহলে সেই ফার্ম সরকারি কোনো দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না।
কয়েকটি কারখানা শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছে না উল্লেখ করে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শ্রম সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, আজ একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতনের ২০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা টাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি। অন্য একটি কারখানার আগামী ৭ মে শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের টাকা দেওয়ার কথা, তারাও এখনো পর্যন্ত টাকার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এমন একটা প্রেক্ষাপটে আমরা ওএসএইচ (পেশাগত সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য) ডে পালন করছি। তিনি বলেন, যেখানে শ্রমিক তার তিন বছর, দুবছর, তিন মাস, ৮ মাসের বেতনই পায়নি সেখানে আমার কাছে মনে হয় এই জায়গাগুলোতে অনেক গ্যাপ রয়ে গেছে।
শ্রম সচিব আরও বলেন, ফার্মাসিউটিক্যালস বা একটি গ্রিন ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকরা সুন্দর পরিবেশে কাজ করছে। আর নির্মাণ শ্রমিকরা বা শিপবিল্ডিংয়ে যারা আছে তাদের মধ্যে গ্যাপটা কীভাবে মিনিমাইজ করা যায়, সেটাই টার্গেট হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এখানে গভর্নেন্স খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পরিবেশ ছাড়পত্র দেওয়া হয়। অথচ যেভাবে পরিবেশ দূষণ হয়, তাতে পরিবেশ ছাড়পত্র কীভাবে আসে?
আইএলওর বাংলাদেশ কান্ট্রি ডিরেক্টর টুওমো পুটিয়াইনেন বলেন, কর্মস্থলের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিতে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আইএলও পাশে রয়েছে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে আইএলওর মৌলিক কনভেনশন, বিশেষ করে কনভেনশন ১৫৫ (পেশাগত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা) এবং কনভেনশন ১৮৭ (প্রচার কাঠামো) গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি প্রদান করে। প্রতিরোধমূলক কৌশলে বিনিয়োগ, তথ্যভিত্তিক নীতিমালা গ্রহণ এবং ত্রিপক্ষীয় সংলাপের মাধ্যমে কর্মীদের অধিকার সুরক্ষা এবং সবার জন্য মর্যাদাপূর্ণ কাজ নিশ্চিত করা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আরিফ আহমেদ খান। বাংলাদেশে নিযুক্ত আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর তুওমো পুটিআইনেনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে একটি প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য তাসলিমা আখতার, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের মহাসচিব ও সিইও ফারুক আহমেদ, বাংলাদেশ বিজনেস অ্যান্ড ডিজ্যাবিলিটি নেটওয়ার্কের ট্রাস্টি রূপালী চৌধুরী এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিলের উইমেন সেক্রেটারি চায়না রহমান।
এতে ‘বাংলাদেশে পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেইফটি : অগ্রগতি ও করণীয়’ শীর্ষক আর একটি প্রেজেন্টেশন দেন সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং বিভাগের পরিচালক প্রফেসর ড. হাসনাত এম আলমগীর।