বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

৪১৫ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মে জড়িত সোনালী ব্যাংক এমডি

আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২২ এএম

দেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন মো. শওকত আলী খান। যার বিরুদ্ধে ৪১৫ কোটি টাকার ঋণ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। তবে এই ঋণ অনিয়মের ঘটনা তার পুরনো কর্মস্থল রূপালী ব্যাংকে ঘটেছে বলে জানা গেছে।

রূপালী ব্যাংকের প্রায় ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বোচ্চ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এই কর্মকর্তা। তবে রূপালী ব্যাংক এক বিশেষ অডিট করে তার কর্মকালে যখন তিনি সহকারী মহাব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সে সময়ে ১৯টি ঋণ অনিয়মের সঙ্গে তার জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।

অডিটে উঠে এসেছে, ভুয়া জামানত, বন্ধকী সম্পত্তির অতিমূল্যায়ন, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদনসহ বিভিন্নভাবে ঋণ বিতরণে অনিয়ম করা হয়েছে। যে ঋণগুলোর বেশিরভাগই এখন আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে একাধিকবার, কোনো কোনো ঋণ আদায়ের জন্য মামলাও করেছে রূপালি ব্যাংক। 

বড় অঙ্কের ঋণ অনিয়মে মো. শওকত আলী খানের নাম জড়ালেও তিনি আওয়ামী সরকারের আমলে পেয়েছেন বড় পদোন্নতি। ২০২৩ সালের ১০ মে রূপালী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে সরকার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় এই কর্মকর্তাকে। তিনি ১৯৯৮ সালে রূপালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করে পদোন্নতির মাধ্যমে সর্বশেষ উপব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রূপালী ব্যাংকে কর্মকাল শেষ করেন।

তবে কৃষি ব্যাংকে বেশিদিন দায়িত্ব পালন করতে হয়নি তাকে। গত বছরের আগস্টে দেশের পটপরিবর্তন হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর গত বছরের ৩০ অক্টোবর এই কর্মকর্তাকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সোনালি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন।

রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, তিনি যখন রূপালী ব্যাংকে চাকরি করেছেন তখন তার বিরুদ্ধে এসব অনিয়ম নিয়ে কথা বলা বা তদন্ত করার সুযোগ ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কৃষি ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পরই তার অনিয়মের তদন্ত শুরু হয়।

রূপালী ব্যাংকের নিরীক্ষা ও পরিদর্শন বিভাগ-১ তার বিরুদ্ধে বেশকিছু ঋণে গুরুতর অনিয়ম খুঁজে পায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মোট ১৯ ঋণ অনিয়মে মো. শওকত আলী খানের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। যে ঋণগুলো রূপালী ব্যাংক আদায় করতে পারছে না। এই ঋণগুলোর বিপরীতে বর্তমানে আটকে আছে ৪১৫ কোটি ৮২ লাখ টাকার বেশি।

আটকে থাকা ঋণগুলোর মধ্যে হালিমা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে রূপালী ব্যাংক ৭ কোটি ২৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছে। ২০১৪ সালের এই ঋণ দেওয়ার আগে সম্পত্তি জামানতের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে চূড়ান্ত স্বাক্ষর করেন এজিএম হিসেবে দায়িত্বে থাকা মো. শওকত আলী খান। এ ছাড়াও তৎকালীন ডিজিএম মো. শফিকুল ইসলাম ও জিএম খন্দকার আনিসুর রহমান এতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু রূপালী ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, নামসর্বস্ব অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া জামানত গ্রহণের মাধ্যমে এই ঋণটি প্রদান করা হয়েছে। যেখানে রূপালী ব্যাংকের বর্তমান পাওনা ৭ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি। একইভাবে ভুয়া জামানতের বিপরীতে ঋণ ৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে মেসার্স গড়াই প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংকে। যেখানে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বর্তমান সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। যার কোনো টাকাই আদায় হয়নি।

মেসার্স ড্রিম নিটিং (বিডি) লিমিটেডকে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার বেশি ঋণ দিয়েছিল রূপালী ব্যাংক। ঋণটি অনিয়মিত এবং ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংকের পাওনা ৬৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। তদন্তে দেখা গেছে, পিসিআর সম্পন্ন না করে পর্ষদের সিদ্ধান্ত ও অনুমোদনপত্রের বিভিন্ন শর্ত লঙ্ঘন করে চলতি মূলধন হিসেবে ঋণ বিতরণ করা হয়। আইনগত মতামতের শর্ত না মানাসহ নানা অনিয়ম ধরা পড়েছে এই ঋণ বিতরণে। সেখানেও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে এই কর্মকর্তার।

এ ছাড়া মেসার্স ভার্গো এন্টারপ্রাইজকে অনিয়মের মাধ্যমে ২৪৩ কোটি টাকার বেশি ঋণ দেওয়া হয়েছিল। যেখানে এখন ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২৪২ কোটি টাকা। ঋণটি বর্তমানে পুনঃতফসিলকৃত। কিন্তু পুনঃতফসিলের সুবিধা নিলেও প্রতিষ্ঠানটি ঋণ পরিশোধ করছে না। এ ধরনের নানা অনিয়মকৃত ১৯টি ঋণ প্রদানে সংশ্লিষ্টতা মিলেছে সোনালি ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনালি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এগুলো অনেক পুরনো বিষয়। যেহেতু ডিজিএম ছিলাম এবং আমার উপরের পদের দায়িত্বে থাকা ম্যানেজারসহ সিনিয়র ও জুনিয়র অনেক নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে অনেক ঋণ প্রস্তাবেই কাজ করতে হয়েছে। তবে কোনটায় কোন জটিলতা ছিল কি না, এতদিন পর মনে নেই। সারা জীবন সততার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেছি।’

তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে, নামসর্বস্ব কাউকে ঋণ দেওয়া হয়নি। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে। তারপরও ভাল গ্রাহক অনেক সময় নানা কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। তখন আবার গ্রাহকের কাছ থেকে ঋণের টাকা আদায়ের জন্য নিয়ম মোতাবেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হয়। এটা বিতর্কের বিষয় নয়।’

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত