বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

ভারতের আগ্রাসী মনোভাব

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:২৪ পিএম

বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অনেক রকম নতুন পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।

ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরিবর্তন সর্ম্পকে আমরা সবাই বলা যায়, অনেকটা অসচেতন। কিন্তু তবু মূল্যবোধের সনাতন বিশ্বাস ভেঙে যাওয়ার ধারা মেনে নিতে বাধ্য হই। পাশর্^বর্তী ভারত বর্তমানে তার রাষ্ট্রচিন্তায় যেমন হঠাৎ ‘অখন্ড ভারতের’ অলীক স্বপ্নকে, তার মতাদর্শগত গুরু ‘আরএসএস’-এর কৃপায় বাস্তবায়নের সম্ভাবনায় দেখতে পায়। তাই তার বিদেশনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ যে আবার পাকিস্তান বা চীনের সঙ্গে কোনো নৈকট্য গড়ে তুলতে পারে, এ বাস্তবতা তার দর্শনে মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই এক ভয়াবহ প্রচার যুদ্ধে সে অবতীর্ণ হয়েছে। মাসের পর মাস নিরলস চিত্তে তার প্রচারমাধ্যমগুলো, বাংলাদেশের বিদেশনীতি ও এই সরকারকে অবৈধ আখ্যা দেয়। এটা আমাদের এক নতূন ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিপতিত করছে। আমাদের এখন নতুন করে শত্রু-মিত্র ধারণা বিকশিত করতে হচ্ছে। ভারতীয় রণকৌশলবিদরা তাদের সামরিক চিন্তায় বাংলাদেশের উত্তরাংশকে সংযোজন করতে রীতিমতো পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতিতে মনোনিবেশ করছে। শিলিগুড়ি, হাসীমারা, বাগডোগরা সামরিক ঘাঁটিগুলোতে উন্নত বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র নিয়োগ ও হাজার হাজারের প্যারাট্রুপারকে আক্রমণ প্রস্তুতির ওপর জোর দিয়েছে। এদের যদি সত্যি সত্যি ব্যবহার করা হয়, তাহলে আমরা উত্তরবঙ্গের একটা অংশ হারাতে পারি। ভারতীয় বিশ্লেষকরা এমন ভাষাও ব্যবহার করে যে, তারা তাদের একাত্তরের অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করবে। আমরা এসব ধারণা বিশ্বাস করি না। কেউ কি ভাবতে পারে যে, একটা সীমিত অংশ তা মেনে নেবে? ভূ-রাজনীতি আমাদের তাই নতুন প্রতিকার আবিষ্কার করতে বাধ্য করে।

বাংলাদেশের ভারত বাস্তবতা:

ভারত গত ষোল বছরের বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ অর্জনের ফলে, চীনের সঙ্গে তার দীর্ঘমেয়াদি সামরিক আলোচনায় এই দেশকে নিশ্চিত বন্ধনের অংশ রূপে দেখিয়ে তাকে কৌশলগত চাপে ফেলেছিল। কিন্তু এটা ভুল প্রমাণিত হওয়ায় চীন অভূতপূর্ব প্রয়াসে এ দেশকে ফের লুফে নিতে সর্বাত্মক সার্থক পদক্ষেপ নিল। মার্কিন বন্ধন সত্ত্বেও ইউনূস সাহেব চীনকে এদেশে সামরিক স্থাপনা গড়বার ও সৃষ্টির অনুমতি দিয়েছে। এর ফলে ভারত রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। আগামীতে যে কোনো সুযোগ এলেই ভারত বাংলাদেশকে ভাঙবে বা স্থায়ী করদরাজ্যে পরিণত করবে। এটা তার কৌশলগত নিরাপত্তার অপরিহার্য

দৃষ্টিভঙ্গি। তা না হলে আগামীর বাংলাদেশ নিশ্চিত অস্তিত্বের প্রয়োজনে চীনের সহযোগিতায় উত্তর-পূর্বে বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করবে এবং নিজের ভৌগোলিক সীমা চীনের সহযোগিতায় বৃদ্ধি করতে চেষ্টা করবেই। চীনকে লালমনিরহাটে বিমান ঘাঁটি গড়তে দেওয়ার গুজব যদি সত্যি হয়, তবে তা হবে এক যুগান্তকারী ভূ-রাজনৈতিক অর্জন। এর ফলে ভারতের শিলিগুড়ি করিডরকে বিস্তৃত করার অপচেষ্টা ও দূরভিসন্ধি সমাধিস্থ হবে ও আমাদের উত্তরাঞ্চল অটুট থাকবে। এই আশঙ্কায় ভারত এখনই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা বাংলাদেশে ঝটিকা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

চীনকে প্র:উ আগামী পঞ্চাশ বছর তিস্তায় উপস্থিতির যে আহ্বান করেছে, সেটা ভারতের মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। ভারত ভয়াবহ আক্রমণাত্মক নাটকীয়তায় লিপ্ত, আর অনেকটা অনুশোচনায় হতভম্ব। মার্কিনিরা দারুণ উপভোগ করছে, আর ট্রাম্প এই দেশের ভবিষ্যৎকে মোদির হাতে তুলে দিল ভেবে যেভাবে তারা হতবাক হয়েছিল, সেটা যে এক নিষ্ঠুর মস্করা ছিল, সে কথাটা বাংলাদেশের মানুষ মোদিকে ভালোই বুঝিয়ে দিতে পারছে। আমাদের দেশের অস্তিত্বের জন্য চীন এক আশীর্বাদ। আমাদের সীমান্তে ভারত শত শত মানুয হত্যা করে যাচ্ছে, তার উত্তর শুধু একটাই। একদিন বা কোনো এক নতুন ভবিষ্যতে, চীনা সৈন্যরা যদি ডোকলাম উপত্যকা ছাড়িয়ে দক্ষিণে প্রচ- আঘাত হেনে শিলিগুড়ি করিডর দ্বিখণ্ডিত করে, তাহলে আমাদের উত্তর সীমান্তে চীন শুধু প্রতিবেশীই হবে না, তারা সাতটি রাজ্যকে ভারত থেকে আলাদা করবে। তাই ভারত তার সর্বোচ্চ মানের সামরিক সম্ভার এই অঞ্চলে জমা করছে। সাতটি রাজ্যে উলফাসহ নানা বিদ্রোহী সংগঠন আবার পুনর্জীবিত হতে চলেছে। বাংলাদেশ তাদের জন্য আজ ভিন্ন অর্থ বহন করে। চীন-ভারত দ্বন্দ্ব এমন এক পরিণতিতে যাবে, যা মায়ানমার ভাঙন প্রক্রিয়ার পর চীন হয়তো এই স্থিতিশীল বাংলাদেশকে এক সামরিক মিত্রের অবস্থান দেবে।

ভারতীয় বিজেপি সরকারের আরএসএস প্রভাব যে আমাদের দেশের জন্য কতখানি সন্দেহ ও দুশ্চিন্তা বহনকারী, তার দৃষ্টান্ত একাধিক। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো এই যে, বছরখানেক আগে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর এক পশ্চিমা দেশের সাংবাদিককে ভারতীয় শক্তির উত্থান নিয়ে জয়জয়কার করতে গিয়ে বলে বসলেন যে বাংলাদেশের সৃষ্টি হওয়াটাই ছিল এক অভিশপ্ত ঘটনা। কেননা এর ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। অখ- ভারতের ধারণার প্রতি জয়শঙ্করের আনুগত্য গভীর। বাংলাদেশের মানুষদের যে সচেতনতা বোধ থাকতে পারে, আর আমরা তাদের মতোই স্বাধীন দেশ, এই বোধটুকু জয়শঙ্কর প্রত্যাখ্যান করলেন। তার উপযুক্ত জবাব ভারত হয়তো পেতে যাচ্ছে। আজ আমরা ভারতের বৃহৎ শক্তি মানসিকতার পরিমিতিগুলো মেনে নিতে অপারগ। তারা কোনো প্রতিবেশীর স্বাধীনতাকে সত্যিকারভাবে সম্মান জানাতে চায় না। কারণ ‘অখ- ভারত’ তত্ত্ব তাদের মতাদর্শগত ঔদ্ধত্যে অন্ধ করে দিয়েছে। ভারতীয় শাসকরা এখন আর পেছনে তাকাবে না। সুযোগ পেলেই তারা একাত্তরের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করবেই। বাঘ রক্তের স্বাদ পেয়েছে। আজ আমরা অভিশপ্ত হাসিনা আর তার এই দেশকে বলিদান করার অনিবার্য ধারা থেকে, নিষ্কৃতি পেতে চাই। 

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত