বৃষ্টি হলেই পানি জমবে। তা রাস্তা হোক কিংবা ঘর। পানি থেকে মুক্তি নেই নগরবাসীর। কয়েক বছর ধরে প্রতিবছরের বৃষ্টিতে এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু ঘরের ভেতর বা দোকানে পানি প্রবেশ করলে আসবাবপত্র ও দোকানের পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। একবার পানি উঠলে তা নেমে যেতে সর্বনিম্ন একঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ কয়েক ঘণ্টাও থাকতে পারে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা কিন্তু হয়ে যায়। আমাদের বর্তমান সময়ের অনেকের মন্তব্য হলো পানি তো বেশিক্ষণ ছিল না, দ্রুত নেমে গেছে। তাদের কাছে প্রশ্ন ঘরের ভেতর পানি প্রবেশ করায় ফার্নিচার কিংবা দোকানের নষ্ট হওয়া পণ্য কি আর অক্ষত ফিরে পাওয়া যাবে?
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন ও ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী এম আলী আশরাফ। প্রয়াত এই প্রকৌশলী বিভিন্ন সভা-সেমিনার কিংবা নিজের প্রবন্ধে একটি কথা সবসময় উল্লেখ করতেন ‘জলাবদ্ধতায় একটি ঘরের কিংবা দোকানের পণ্যের যে আর্থিক ক্ষতি হয়, তা যদি টাকার অঙ্কে কনভার্ট করা হতো, তাহলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটিতে গিয়ে পৌঁছাত। আমরা কেউ সেই ক্ষতিকে আমলে নিই না। আমরা শুধু রাস্তাঘাটে দুর্ভোগের চিত্রই দেখি।’ আলী আশরাফ জীবদ্দশায় জলাবদ্ধতা প্রকল্পের শুরু দেখে গিয়েছেন কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তা যে বহমান, এর যে শেষ হওয়ার উপায় দেখা যাচ্ছে না, তা তিনি দেখে যেতে পারেননি।
কাজের অগ্রগতি ৮০ শতাংশে ঘুরছে
জলাবদ্ধতা নিরসনে পাঁচটি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে একটি প্রকল্প শেষ হলেও বাকি চারটি প্রকল্প এখনো চলমান রয়েছে। সাগর পাড়ে নির্মিত আউটার রিং রোড প্রকল্পটি উপকূলীয় বেড়িবাঁধ কাম সড়কটি নির্মিত হয়েছে। এই প্রকল্পে কয়েকটি রেগুলেটর রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর ও কাট্টলী এলাকার পানি এ সড়ক কাম বাঁধ দিয়েই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের ড্রেনেজ সিস্টেমের অন্যতম মহেশখাল, এই খালের দুটো প্রান্তে রয়েছে বঙ্গোপসাগর এবং তৃতীয় প্রান্তটি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন ৮ হাজার ৬২৬ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পটি ২০১৭ সালের জুলাই মাসে একনেকে অনুমোদনের পর চলমান কাজ এখনো শেষ হয়নি। এখন পর্যন্ত ৮৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। নগরীর চাক্তাই খাল থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীতীর ঘেঁষে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ কাম চার লেনের সড়ক নির্মিত হচ্ছে। এই প্রকল্পে ১২টি রেগুলেটর রয়েছে। ২ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকার এই প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৮৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। একই চিত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ১ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩টি রেগুলেটর নির্মাণ প্রকল্পেও। ২০১৯ সালের প্রকল্পটির অগ্রগতি ৭১ শতাংশ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বারইপাড়া খাল খনন প্রকল্পটি ২০১৪ সালের জুনে একনেকে অনুমোদন পেলেও এখন পর্যন্ত এর অগ্রগতি ৮৪ শতাংশ। আর সবগুলো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে জুন ২০২৬-এর মধ্যে। আগামী এক বছরের মধ্যে কি বাকি কাজ শেষ করতে পারবে?
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা বারইপাড়া খাল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই শেষ করতে পারব। আর তা করা গেলে জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে নগরবাসী মুক্তি পাবে।’ একই আশাবাদ ব্যক্ত করেন চাক্তাই থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীতীর ঘেঁষে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের পরিচালক ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী রাজীব দাশ। তিনি বলেন, ‘আমাদের ১২টি রেগুলেটরের মধ্যে ১০টির কাজ শেষ। পাম্প হাউজও নির্মাণ হয়ে গেছে। বাকি যেসব কাজ রয়েছে, সেগুলো আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আর এতে সাগরের বাড়তি জোয়ারের পানি নগরে প্রবেশ করতে পারবে না।’
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া সুফল আসবে না
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, যে শহরের নদীর তলদেশে ছয় ফুট গভীর পর্যন্ত পলিথিনের স্তর থাকে, যে শহরে খালের মধ্যে লেপ-তোশক পাওয়া যায়, সেই শহরে যদি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা না যায়, তাহলে নালা খাল সব ভরাট হয়ে যাবে। তাই বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তরের প্রকল্প নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
একই মন্তব্য করেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা খালগুলো একদিকে পরিষ্কার করে যাই, অন্যদিকে খালে পলি জমে ভরাট হয়ে যায়।’
তাই খালপাড়ের মানুষদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রকল্প নিতে হবে সিটি করপোরেশনকে।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আমরা বর্জ্যকে শক্তিতে রূপান্তর করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করছি। আর তা করা গেলে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আসবে।