ফেনী জেলায় এবারের এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৩৯৪ জন শিক্ষার্থী। যার মধ্যে এসএসসিতে ১ হাজার ৮১৯ জন, দাখিলে ৪৫৬
জন ও এসএসসি (ভোকেশনাল) ১১৯জন শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিলেন। প্রথম দিন এসএসসি বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় ফেনীতে অনুপস্থিত ২৮৩ জন, অসদুপায়
অবলম্বনের দায়ে একজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে নবম শ্রেণিকে রেজিস্ট্রেশন করার পরেও এসএসসি, দাখিল ও ভোকেশনাল পরীক্ষার ফরম পূরন করেনি প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
জেলা প্রশাসন শিক্ষা শাখা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর ফেনী জেলায় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় জেলার ৩৭টি কেন্দ্রে। এতে মোট ২৯ হাজার ৬০৯ জন
শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এসএসসিতে ২২ হাজার ৫৪৯ জন, দাখিলে ৫ হাজার ৮৮৯ জন ও ভোকেশনালে ১ হাজার ১৭১ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায়
অংশ নেয়।
দুই বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পর বাকী পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার কারন জানতে চাইলে এক পরীক্ষার্থী জানান, প্রথম দুই বিষয়ে প্রশ্নপত্র কঠিন হয়েছে, পাশ করব
না, তাই পরে আর অংশ নিইনি। তবে আগামীবার ভালো করে পড়ালেখা করে আবার পরীক্ষা দিবে বলে জানান এ শিক্ষার্থী।
মনোয়ারা বেগম নামে একজন অভিভাবক বলেন, যেসব মেয়েদের বিয়ে হয়েছে তাদের কয়েকজনের পরিবার তার পরিচিত এবং প্রবাসী বা চাকরিজীবি পাত্র পেলে মূলত
দারিদ্রের কারণেই তারা মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেদের মধ্যে অনেকে দারিদ্রতার কারণে পরিবারের অর্থনৈতিক হাত বাড়াতে চাকরি করে।
সোনাগাজীর ওসমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান ফারুক বলেন, আমার বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনীকে ১০৬ রেজিষ্ট্রেশন করলেও এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেন ৬৭ জন। এছাড়া রেজিষ্ট্রেশনকৃত প্রায় ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফরম পূরন করেনি বলে জানান সুন্দরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আমির হোসেন।
জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) নাছরীন আক্তার বলেন, গত বছর ভয়াবহ বন্যার কারণে ফেনীতে দারিদ্র বেড়েছে। মোবাইল আসক্তির
কারণেও শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়তে পারে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া প্রসঙ্গে ইউএনও নাসরিন সুলতানা কান্তা বলেন, এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কোনোভাবেই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। তবে বাল্য বিয়ের খবর পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। এটি অবশ্য সত্য যে অনেক ক্ষেত্রে অভিনব কৌশলে কেউ কেউ বাল্য বিয়ে দিচ্ছেন।
অনুপস্থিত পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ না নেওয়ার কারণ তারা অনুসন্ধান করবেন বলে জানান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফি উল্লাহ। তিনি বলেন, প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে অনেকসময় প্রধান শিক্ষকরা এমন সব শিক্ষার্থীদের ফর্ম পূরণ করেন যারা ক্লাসে নিয়মিত নন এবং পরবর্তীতে দেখা যায় তাদের একটি বড় অংশই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে না। তবে এরা সবাই বিয়ের কারণে অনুপস্থিত কি-না কিংবা অনুপস্থিতদের মধ্যে ছাত্রী কতজন, বিস্তারিত এখনো জানা যায়নি। প্রধান শিক্ষকদের থেকে তালিকা নিয়ে তদন্তের মাধ্যমে বিস্তারিত জানা যাবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানরা যেটি বলছেন, অনেক শিক্ষার্থীই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে পরীক্ষা দিতে পারছে না। এর মধ্যে প্রেম বিয়েও একটি কারণ বলে তারা জানিয়েছেন।
সুসাশনের জন্য নাগরিক (সুজন) ফেনীর সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, এসএসসি পরীক্ষায় কেন শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে ও কম অংশগ্রহণ করেছে সেটা জানতে হলে আমাদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তদন্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের এভাবে ঝরে পড়াা আমাদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। বাল্যবিবাহ, পারিবারিক অসচেতনতা ও পারিবারিক চাপ এর পেছনে কাজ করছে বলে আমি মনে করি।
শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মিজ ফাতিমা সুলতানা বলেন, পরীক্ষার ভালো প্রস্তুতি না থাকা, অসুস্থতা, বাল্যবিবাহ এসব কারণেও অনেক সময় শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত থাকে। বন্যার কারনে অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষয়ক্ষতির কারনেও অনেকে অংশ নেয়নি। তবে অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবেও শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ অনুপস্থিত থাকছে বলে মনে করছেন জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, পরীক্ষায় অনুপস্থিতির একটা বড় কারণ হতে পারে অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব। এখনো অনেক অভিভাবক আছেন, সন্তান কিসে পড়ে, কেমন পড়ছে, তার বিস্তারিত জানেন না। আবার অভিভাবকদের অর্থনৈতিক কারণেও অনেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে পারে। বাল্যবিবাহের কারণেও কিছু ছাত্রীর পড়াশোনায় সমস্যা হতে পারে। এই সমস্যার সমাধানে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোন শিক্ষার্থীর পরিস্থিতি কেমন সেটি তাদেরকেই পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পরবর্তীতে সেই অনুযায়ী ওই সব শিক্ষার্থীর অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে কোনো পরীক্ষার্থীকে অনুপস্থিত থাকতে না হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, কুমিল্লার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর রুনা নাছরীন বলেন, ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় প্রতিদিন কিছুসংখ্যক পরীক্ষার্থী (ফরম পূরণকৃত) অনুপস্থিত থাকছে, যা উদ্বেগজনক। এই পরিপ্রেক্ষিতে যেসব পরীক্ষার্থী ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছিল, কিন্তু এক বা একাধিক বিষয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে না বা প্রথম দিন থেকেই অনুপস্থিত আছে, তাদের তথ্য গুগল ফরমের মাধ্যমে (লিংক সংযুক্ত) প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে জানতে চাইব। যা আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হবে।