জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের অধ্যাদেশ বাতিল করে রাজস্ব ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার নিশ্চিত করার দাবিতের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কলম বিরতি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দিনের মতো কলম বিরতি পালন করেন এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অন্যদিকে বহিরাগতদের দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এমন দুজন সমন্বয়কের দেখাও মিলেছে এনবিআরে। এ ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমে এনবিআরের চেয়ারম্যান ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে কথা বলার ঘোষণা দিয়েও পরে কথা বলেননি।
আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেসব দাবি উত্থাপন করেছেন তা হচ্ছে- প্রণীত রাজস্ব অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ক শ্বেতপত্র আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সব অংশীজনদের মতামত নিয়ে সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করা।
এ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে তারা তিনদিনের কলম বিরতি কর্মসূচি পালন করছেন। এর মধ্যে গতকাল বুধবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ও বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কলম বিরতি পালন করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন দেশের সব কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ কর্মসূচির মধ্যে আরও রয়েছে আগামী শনিবার সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত কলম বিরতি।
আন্দোলনের পরিস্থিতি জানাতে বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একই সময়ে পাল্টা সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেয় এনবিআর কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে নানা নাটকীতার উদ্ভব হয় এনবিআর ভবনে। এনবিআর চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে কথা বলবেন বলে সাংবাদিকদের অবহিত করেন এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা আল-আমিন। কিন্তু পরে কোনও সংবাদ সম্মেলন করেননি এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান।
এদিকে অধ্যাদশে বাতিলের আন্দোলন ঠেকাতে চেয়ারম্যানের পক্ষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বহিরাগতদের এনবিআরে ডেকেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করার চেষ্টাও করেন এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা। তবে এনবিআর সদস্য বেলাল হোসাইন চৌধুরী দাবি করেন, তার পূর্ব পরিচিত একজন সমন্বয়ক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তবে আন্দোলনরত কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের আন্দোলন দমাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বহিরাগতদের এনবিআরে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে। আর কলম বিরতি কর্মসূচি চলাকালে দুপুরের দিকে ২০ থেকে ৩০ জন্য ব্যক্তি এনবিআরে হাজির হন একটি ব্যানার নিয়ে। পুলিশ পাহারায় কিছুক্ষণ সমাবেশ করে চলে যান তারা। তারা এনবিআর চেয়ারম্যানসহ অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন ও পদত্যাগ দাবি করেন।
এর মধ্যে দুপুর আড়াইটার দিকে জনসংযোগ কর্মকর্তা বার্তা পাঠান, তিনটায় সংবাদ সম্মেলন করবেন এনবিআর চেয়ারম্যান। এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে সেখানে উপস্থিত হন অনেক সাংবাদিক। এনবিআর চেয়ারম্যান সংবাদ সম্মেলনে না এলেও কয়েকজন বহিরাগতকে দেখিয়ে তাদের বক্তব্য নিতে বলেন জনসংযোগ কর্মকর্তা। বহিরাগত ইসমাইল সম্রাট নামের এই যুবক নিজে একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চান। এনবিআরের বিষয়ে তিনি কেন কথা বলবেন, এমন প্রশ্ন করলে শুরু হয় বাকবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে জানান, এনবিআর সদস্য বেলাল হোসাইন চৌধুরীর ডাকে তারা এসেছেন।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন সাংবাদিকরা। সেখানেও একজন ছাত্র নেতার দেখা মেলে। ক্যামেরায় বক্তব্য না দিলেও বেলাল চৌধুরী দাবি করেন, এলাকার লোক হিসেবে দেখা করতে এসেছিলেন ঐ যুবকরা।
এদিকে কলমবিরতির দ্বিতীয় দিন শেষে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে বক্তব্য দেন উপকর কমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান ও কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার সিফাত-ই-মরিয়ম। তারা এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশের বিষয়ে বলেন, কোনও সংস্কার মডেলের অনুসরণে রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্ত করে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা বোধগম্য নয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার মডেলের পরিপন্থী। বাংলাদেশে বর্তমানে যে মডেলটি রয়েছে, তা ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৪ সালের সেন্ট্রাল বোর্ড অব রেভিনিউ অ্যাক্টের মাধ্যমে গঠিত বোর্ডের মডেল। এই মডেলের দুই উত্তরসূরী ভারত ও পাকিস্তান এই মডেল বহাল রেখেছে, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকতর শক্তিশালী করা হয়েছে। গত ২০ বছরে যত সফল রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার হয়েছে, কোথাও এরকম ডিভিশন মডেলের দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। সুতরাং আমরা কোন মডেল অনুসরণ করছি, সেটিও স্পষ্ট নয়।
কর্মকর্তারা বলেন, আমরা এনবিআর তথা রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের বিরোধী নই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের দাবি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে। আমরা চাই এই সংস্কার যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে, দেশের স্বার্থ ও উন্নয়নধর্মী দর্শন এতে প্রতিফলিত হবে, রাজস্ব প্রশাসন অধিকতর কার্যকর, প্রগতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত হবে, এবং সংস্কার কোনো গোষ্ঠীগত কায়েমি স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হবে না।
অধ্যাদেশের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তারা বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমের প্রকৃতি অত্যন্ত বিশেষায়িত এবং আইননির্ভর। আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাটসহ রাজস্ব আইন ও নীতিমালার প্রয়োগে দীর্ঘমেয়াদী অভিজ্ঞতা, পেশাগত দক্ষতা ও নীতিগত গভীরতা প্রয়োজন হয়। প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষায়িত জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে নীতিনির্ধারণে অসামঞ্জস্য ও বাস্তবায়নে বিঘ্ন ঘটবে- যা সরাসরি রাজস্ব আহরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কর্মকর্তারা বলেন, সংস্কার হলে তা হবে ভালোর জন্য, উত্তম কিছু অর্জনের জন্য। রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারের জন্য জারিকৃত অধ্যাদেশের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি নিদারুনভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। জারিকৃত অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিদ্যমান যে নেতৃত্বগত সমস্যা রয়েছে, সেটাকেই রাখা হয়েছে, অন্য ফরম্যাটে, একটু ঘুরিয়ে পেচিয়ে। অর্থাৎ, সমস্যাকে স্বীকার তো করা হয়ই নি, বরং দুই বিভাগের সর্বোচ্চ পদে দুই নেতাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে সমস্যা আরো বাড়বে। বর্তমানে এনবিআরের প্রধান সরকার নিয়োগ করেন সচিবদের মধ্য থেকে, এনবিআরের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নয়। এনবিআরের মতো একটি অতি টেকনিক্যাল ও পেশাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের সীমাবদ্ধতা। জারিকৃত অধ্যাদেশের মাধ্যমে পূর্বের ধারাবাহিকতাই বহাল রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো সংস্কার হয়নি, যেটি এনবিআর কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। এর ফলে রাজস্ব প্রশাসনে উড়ে এসে জুড়ে বসার প্রথা চলতে থাকবে, যা রাজস্ব আদায় কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করবে।
তাদের ভাষ্য, এনবিআরকে বিভক্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের লক্ষ্যে একটি বিশেষ পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য সংস্কার-সংক্রান্ত কমিটির প্রতিবেদনসমূহ যথারীতি সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও, এই বিশেষ পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদনটি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি, এমনকি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও সরবরাহ করা হয়নি। ফলে যে প্রতিষ্ঠানের সংস্কার নিয়ে আলোচনা চলছে, সেই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাগণ বিষয়টি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত সকল সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পাবলিক করা হলেও এই রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক বিশেষ পরামর্শক কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ না করেই তড়িঘড়ি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বিলুপ্ত করা হলো প্রত্যাশী সংস্থার সাথে কোনো আলোচনা ব্যতিরেকেই, যা গভীর সন্দেহের উদ্রেক করে। এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাঠামোগত সংস্কার সময়ের দাবি। তবে এই সংস্কার হতে হবে বাস্তবমুখী, অংশীজনের মতামতভিত্তিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ মূল্যায়নের মাধ্যমে। জারিকৃত অধ্যাদেশটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি বিনষ্ট হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।