শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

বেহাত শতকোটির সরকারি জমি

আপডেট : ১৪ জুন ২০২৫, ০৩:৫৯ এএম

চট্টগ্রামে শতকোটি টাকার সরকারি সম্পদ রাষ্ট্রপক্ষের ‘নিষ্ক্রিয়তায়’ বেহাতের কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি ওই সম্পদের কথিত ওয়ারিশ দাবিদারের পক্ষে ঘুষ নিয়ে নামজারি খতিয়ান সৃজনের ঘটনাও অনুসন্ধান চালাচ্ছে সংস্থাটি।

গত ৫ মার্চ নগরের সদরঘাট রোডে অবস্থিত ৫২ দশমিক ৬৯ শতাংশ জমিতে ব্রিটিশ আমলে গড়ে ওঠা ভবনের ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করে জনৈক আলবার্ট সরকারকে বুঝিয়ে দেয় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। এ জমির প্রকৃত মালিক ডেভিড ইজিক্যাল নামে এক ইহুদি। আলবার্ট সরকার ডেভিড ইজিক্যালের নাতি বলে দাবি করেন। ডেভিড ইজিক্যাল চট্টগ্রামে ব্যবসা করতেন। ১৯৩৬ সালের দিকে চট্টগ্রামে পরিবারকে রেখে কলকাতা হয়ে যুক্তরাজ্যে পাড়ি দেন ইজিক্যাল। অনুসন্ধানের বিষয়টি নিশ্চিত করে দুদক চট্টগ্রাম মেট্রো শাখার উপপরিচালক সুবেল আহমেদ জানান, আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ জোরালো ভূমিকা রাখলে মূল্যবান সরকারি এ সম্পদ আজ হারাতে হতো না। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কোন কোন কর্মকর্তা ঘুষ বাণিজ্য করে কথিত ওয়ারিশকে শতকোটি টাকার জমি পাইয়ে দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে। সংস্থার উপপরিচালক সাঈদ এমরান অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

সরকারি একটি সংস্থার ভাষ্য, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার অবহেলার কারণে সংঘবদ্ধ চক্র পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রের দখলে থাকা ‘খ’ তফসিলভুক্ত অর্পিত ওই জমি বেহাত হয়েছে। ওই জমি নিজেদের করে নিতে ঘাটে ঘাটে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা খরচ করেছে। ঘুষের এই টাকার বড় একটি অংশ পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট আমলারা।

চট্টগ্রাম জেলা রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর আলাউদ্দিন বলেন, “ওই জমি ‘খ’ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি। আলবার্ট সরকার নামে এক ব্যক্তি এই সম্পত্তির ওয়ারিশ হিসেবে আদালতে প্রমাণ করেছেন। আদালতের নির্দেশে আলবার্টকে ওই জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি রক্ষায় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন যদি আদালতে যথাযথ ভূমিকা পালন করত তাহলে শতকোটি টাকার সরকারি এ সম্পদ বেহাত হতো না।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ওই সম্পত্তি দ্রুত নিজেদের দখলে নিতে সংঘবদ্ধ একটি চক্র ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের ওপর চাপ তৈরি করে। সর্বোচ্চ আদালতে আলবার্ট সরকার নিজেকে ডেভিড ইজিক্যালের নাতি হিসেবে ‘প্রমাণ’ করার পর থেকে খোদ জেলা প্রশাসকের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে সংঘবদ্ধ ওই চক্র। চাপ সৃষ্টির বিষয়টি দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকারও করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম। রাষ্ট্রীয় এই সম্পত্তি রক্ষায় রাষ্ট্রের কোনো অবহেলা ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেক দিনের ইস্যু। আমরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছি।’

অভিযোগ আছে, ইহুদি ব্যবসায়ীর এই সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে ডেভিড ইজিক্যালকে খ্রিস্টান দেখিয়ে তার মৃত্যু, সমাধিস্থ ও ওয়ারিশ সনদ জালিয়াতি করেন কথিত আলবার্ট সরকার। জালিয়াতির বিভিন্ন প্রমাণপত্র দেশ রূপান্তরের হাতে সংরক্ষিত আছে।

জানা গেছে, আলবার্ট সরকারের নামে ৫২.৬৯ শতক জমি নামজারি খতিয়ান সৃজন করতে গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাকলিয়া থানার সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ডকে নির্দেশনা দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। পরের দিন ১৯ ফেব্রুয়ারি আলবার্টের নামে নামজারি খতিয়ানের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন এসিল্যান্ড। ভুক্তভোগী সেকান্দর জামান অভিযোগ করে বলেন, ‘পাঁচ দশক ধরে আমাদের কাছ থেকে রাজস্ব নিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। অথচ আদালতে অর্পিত সম্পত্তি বিভাগের কর্মকর্তা অনুপ স্বপন বলেছেন, ‘ওই জায়গা রাষ্ট্রের দখলে নেই।’

ডেভিড ইজিক্যাল ভবনের ভাড়টিয়া মো. আলী অভিযোগ করে বলেন, “শতকোটি টাকার সরকারি এ সম্পদ হাতিয়ে নিতে ১৪-১৫ বছর আগে থেকেই তৎপর হয়ে ওঠে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। ওই চক্রের প্রধান সুকান্ত কাসারী। তার বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার চিচিঙ্গা গ্রামে। আলবার্ট সরকারকে ডেভিড ইজিক্যালের ‘ওয়ারিশ বানিয়ে’ সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের ‘পরিকল্পনা’, উচ্চ আদালতে লড়াই এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করাসহ সবকিছুর নেপথ্যে ছিলেন এই সুকান্ত কাসারী।”

অভিযোগ আছে, অর্পিত ওই সম্পত্তি আলবার্ট সরকারের নামে নামজারি খতিয়ান সৃজন করে দিতে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা নেন চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক, বর্তমানে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অভিযোগ সত্য নয়। আপনারা যাচাই করে দেখেন। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে জন্য নামজারি খতিয়ান সৃজনের নির্দেশনা দিয়েছিলাম।’

অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী অনুপ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘আলবার্ট সরকার ডেভিড ইজিক্যালের ওয়ারিশ নন। তিনি ইজিক্যাল পরিবারের সঙ্গেও সম্পর্কিত নন। আদালতকে বিষয়টি জানিয়েছি। তার (আলবার্ট) সনদগুলো চট্টগ্রাম নগরের হাজারিগলির দোকান থেকে জাল করার বিষয়টিও আমি আদালতকে বলেছি। কিন্তু আদালতকে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি দিতে না পারায় রায় তাদের পক্ষে চলে যায়।’

ডেভিড ইজিক্যালের কথিত নাতি আলবার্ট সরকার ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারি, ৩৩, ৩৪ ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর লুৎফুন্নেছা দোভাষের (বেবী) দপ্তর থেকে ‘ইস্যু’ করা যে ওয়ারিশ সনদ আদালতে দিয়েছেন সেগুলো ভুয়া বলে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন আলোচ্য দুই কাউন্সিলর।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত