স্কাউটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবী রচনায় এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই বিপ্লবে বাংলাদেশের স্কাউট সদস্যদের অংশগ্রহণ গৌরব ও অহঙ্কারের উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি সারা বিশ্বের স্কাউটসের জন্য বিশেষ গৌরবের।
গতকাল সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বাংলাদেশ স্কাউটসের দেশব্যাপী আয়োজিত কাব কার্নিভালের উদ্বোধন ও শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা কাব স্কাউটদের সর্বোচ্চ অ্যাওয়ার্ড ‘শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড’ এবং জুলাই আন্দোলনে শহীদ আট স্কাউটের সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য তাদের পরিবারের সদস্যদের হাতে বাংলাদেশ স্কাউটস-এর ‘গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড’ তুলে দেন।
স্কাউটার মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ, রোভার রোহান আহমেদ খান, রোভার তাঞ্জির খান মুন্না, স্কাউট শরিফ উদ্দিন আহমেদ আহনাফ, স্কাউট মাহবুব আলম, স্কাউট গোলাম নাফিজ, স্কাউট তাহির জামান প্রিয়, স্কাউট আরিফুল ইসলাম সাদের পরিবারের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাত থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করেন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আজকে স্কাউটিং ইতিহাসে একটা বিশেষ দিন। শুধু বাংলাদেশের স্কাউটিংয়ের ক্ষেত্রে নয়, পুরো বিশ্বের স্কাউটিংয়ের জন্য আজকের দিনটা বিশেষ গৌরবের। যে আট স্কাউট আত্মাহুতি দিল দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার জন্য সেটা দিয়েই এই ইতিহাসের সৃষ্টি। স্কাউটিংয়ের ইতিহাসে এ রকম নজির আর কোথাও নাই। বাংলাদেশের স্কাউটরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে বলে আমরা সারা বিশ্বের পক্ষ থেকে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।’
পুরস্কারপ্রাপ্তদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা পুরস্কার পেল এবং যারা আজ উপস্থিত আছ, তোমাদের সবার দায়িত্ব হলো, দরজা খোলা। দরজা বন্ধ বলে আক্ষেপের দিকে থেকে গেলে হবে না। দরজা তোমাকেই খুলতে হবে। যেহেতু তুমি অনেকদূর এগিয়ে এসেছ, এগিয়ে এসেছ বলেই তুমি স্কাউট হয়েছ, তোমার স্কুলের বাকিরা হয় নাই। কাজেই তোমার দায়িত্ব হলো অন্যদের জন্যও দরজা খুলে দেওয়া। তুমি যদি না খোল, এ দরজা বন্ধ থেকেই যাবে।’
তিনি নিজেও একজন স্কাউট পরিবারের গর্বিত সদস্য উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা তার ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণ করেন। ১৯৫৫ সালে ১৫ বছর বয়সে ড. ইউনূস বয় স্কাউট দলের সঙ্গে কানাডায় অনুষ্ঠিত দশম বিশ্ব বয় স্কাউট জাম্বুরিতে অংশ নেন। সেসময় তিনি ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলেন।
৭০ বছর আগে স্কাউট হিসেবে ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তখন উড়োজাহাজের ভাড়া অনেক বেশি। তাই লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে জাহাজে করে নিয়ে গেল। এতে আফসোস করার কথা, কিন্তু হয়ে গেল আনন্দের। আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া যাত্রায় পুরো জাহাজ মাতিয়ে ফেলল স্কাউটের কয়েক জন বাচ্চা বাচ্চা ছেলে। গান-বাজনায়, উৎসাহ ও ফুর্তিতে পুরো জাহাজের নিয়ন্ত্রণ চলে এলো তাদের হাতে। আসার পথেও নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন পর্যন্ত জাহাজে।’
তিনি বলেন, ‘উড়োজাহাজের ভাড়া বেশি হওয়ায় সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বক্স ওয়াগন কোম্পানির কাছ থেকে সস্তা দামে তিনটি মাইক্রোবাস কিনলাম। টাকা বাঁচানোর জন্য ৬ মাস ধরে পুরো ইউরোপ ভ্রমণ করে পাকিস্তান পর্যন্ত ফিরে আসলাম। ইউরোপের কোনো জায়গা ভ্রমণ থেকে বাদ পড়েনি।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এ এক মস্ত বড় সুযোগ; পৃথিবীকে আবিষ্কার করার, তার চাইতে বড় নিজেকে আবিষ্কার করার। না হলে গৎবাঁধা জীবনে নিজের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। তোমরা যাতে স্কাউটিংয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতের পৃথিবী রচনা করতে পার, সে কথাটা মনে রাখতে হবে।’
স্কাউটিংয়ের ব্যবহারিক দিক ও সৃজনশীলতা তাকে খুব আকর্ষণ করত উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘এখানে নতুন কিছু করার সুযোগ থাকে। নতুন কিছু করার সুযোগের কারণে আনন্দ পেতাম। প্রতিযোগিতা করারও সুযোগ রয়েছে এখানে।’
তিনি বলেন, বর্তমান স্কাউটিংয়ে পৃথিবীকে দেখার, অন্য দেশের মানুষকে চেনার এবং তাদের ভাষা জানার সুযোগ রাখতে হবে। বিশ্ব নাগরিকের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সুযোগ যেন থাকে। এর মাধ্যমে একজন কিশোর নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে। কিশোর বয়সে দুনিয়াকে দেখা এবং ভিন দেশের মানুষ সম্পর্কে জানা প্রতিটি মানুষের জীবনে অতি মূল্যবান।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশ স্কাউটস-এর এডহক কমিটির আহ্বায়ক মো. এহছানুল হক এবং সদস্য সচিব মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ বক্তব্য রাখেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ স্কাউটস প্রোগ্রাম বিভাগের পরিচালনায় বাংলাদেশের সব উপজেলা ও বাংলাদেশ স্কাউটসের বিশেষ জেলায় একযোগে কাব কার্নিভাল বাস্তবায়ন হচ্ছে।
সারা দেশে ৪৯৫টি উপজেলা, ৫টি মেট্রোপলিটন, ৫টি উপএলাকা ও ২২টি বিশেষ স্কাউট জেলা মিলিয়ে মোট ৫২৭টি স্থানে একযোগে কাব কার্নিভাল উদ্বোধন ও শাপলা কাব অ্যাওয়ার্ড বিতরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে।