বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
দেশ রূপান্তর

আপনি নিজ যোগ্যতায় ভিসি হননি, আমরা আপনাকে বসিয়েছি- বক্তব্যের নেপথ্যে

আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫০ পিএম

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের বিতর্কিত শিক্ষক ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি ড. কুশল বরণ চক্রবর্ত্তীর পদোন্নতি বোর্ড আয়োজন করায় তোপের মুখে পড়েন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। বোর্ড বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের কার্যালয়ে গেলে তাদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। এ সংক্রান্ত একটা ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায় উপাচার্যকে শিক্ষার্থীরা বলছেন, আপনি নিজের যোগ্যতায় ভিসি হন নি, আমরা আপনাকে বসিয়েছি।

শুক্রবার (৪ জুলাই) দুপুর তিনটায় চবি উপাচার্যের কার্যালয়ে উপাচার্যের কার্যালয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির, ইসলামি ছাত্র আন্দোলন ও ইনকিলাব মঞ্চসহ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শিক্ষার্থীরা বোর্ড বাতিলের দাবি করার এক পর্যায়ে উপাচার্যের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সূত্রে জানা গেছে, বিতর্কিত শিক্ষকের পদোন্নতি বোর্ডের খবর পেয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে একে একে এসে উপস্থিত হয় শিক্ষার্থীরা। শুরু হয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের, ‘বাহ! ভিসি চমৎকার, স্বৈরাচারের পাহারাদার’, ‘একটা একটা লীগ ধর, ধরে ধরে জেলে ভর।’ এ সময় প্রশাসনের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে বিকেল ৩টার দিকে ভিসি কার্যালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বোর্ড বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থী ও উপাচার্যের মধ্যে বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।

উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে এসে উপস্থিত হন স্বয়ং কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের মধ্যে উচ্চবাচ্য হয়। তবে কোনও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেনি। এদিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উচ্চবাচ্যের সময় উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য ও দুই উপ-উপাচার্য। এরপর উপ-উপাচার্যদ্বয় ধমক দিয়ে ওই শিক্ষককে বলেন, তোমাকে কেউ কি এখানে ডেকেছে? তুমি এখানে কেন এসেছো? পদোন্নতি বোর্ডে তোমার কি কাজ? জবাবে কুশল বরণ বলেন, এখানে নাকি মব করার চেষ্টা হচ্ছিল, তাই দেখতে এসেছি। পরে উপাচার্যের নির্দেশে তাকে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর বোর্ড উপাচার্য ও শিক্ষার্থীদের মাঝে ফের বাকবিতণ্ডা শুরু হয়।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী তাহসান হাবীব উপাচার্যকে বলছেন, ‘স্যার আপনাকে আমরা বসিয়েছি। আপনি আমাদের কথা মানতে বাধ্য।’ এরপর উপাচার্য বলেন, ‘না’ । উপাচার্যের এই কথার সঙ্গে সঙ্গেই নেতাকর্মীরা হইচই শুরু করেন। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাবেক নেতা শাখাওয়াত হোসেন উপাচার্যকে বলেন, ‘এখানে আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি।’ এরপর তাহসান হাবীব আবারও বলেন, ‘স্যার আপনাকে আমরা এনে এখানে বসিয়েছি। আপনি এখানে নিজ যোগ্যতায় বসেননি।’ তখন উপাচার্য বললেন, ‘কী করেছি আমি?’ তাহসান তার উত্তরে বললেন, ‘আপনি কেন ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রমোশন দিচ্ছেন? আমাদের রক্তের সঙ্গে, আমাদের বিপ্লবের সঙ্গে বেইমানি করে।’

উপাচার্য আরও বলেন, আমাদের শৃঙ্খলা কমিটি ও ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিসহ অন্যান্য কমিটিগুলো ধীরে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেকোনো ব্যক্তিকে কোর্টের মতো বিচার করতে পারে না। আমরা কারও জেল জরিমানাও করতে পারি না। এটা আমাদের এখতিয়ারভুক্ত নেই।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে আরও জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা ভিসি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর টানা ১ ঘণ্টা বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অবরুদ্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন। এ সময় ভবনে ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ড. মো. শামীম উদ্দিন খান, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, ছাত্রছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. আনোয়ার হোসেন এবং পদোন্নতি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গতবছর ২৬ নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে চিন্ময় কৃষ্ণের অনুসারীদের হামলার শিকার হন। এ সময়ে তিনি কিরিচের কোপে মাথায় গুরুতর জখম হন এবং তার ডান হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনায় বাদী হয়ে তিনি গত ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রধান আসামি করে ১৬৪ জনের নামে মামলার আবেদন করেন। এই মামলার ২০তম আসামী হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী।

উপাচার্যকে উদ্দেশ্য করে বলা বক্তব্যের বিষয়ে সাবেক ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতা তাহসান হাবীব বলেন, আমি ঠিক এভাবেই বলিনি। আসলে ভিসি স্যারের যে যোগ্যতা রয়েছে, তিনি অনেক আগেই ভিসি হতেন বা হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কিন্তু ফ্যাসিবাদী আমলে সেটা সম্ভব হয়নি। জুলাইয়ের পরবর্তী সময়ে যোগ্য ব্যক্তিদের যোগ্যস্থানে বসানো সম্ভব হয়েছে এবং এটার জন্য আমাদের সংগ্রাম রক্ত, ঘাম-শ্রম দিতে হয়েছে, আন্দোলন করতে হয়েছে। গতানুগতিক ধারা বা নিয়মতান্ত্রিকের বাইরে গিয়ে ছাত্র-জনতা তাদের বসিয়েছেন। মূলত এটাই বুঝানো হয়েছে।

গেল বছরের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণ-অভ্যুত্থানের কারণে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা তৎকালীন প্রশাসনের পদত্যাগ দাবি করেন। এরপরই একই দিনে পদত্যাগ করেন উপাচার্য, দুই সহ-উপাচার্য, ছাত্র উপদেষ্টা, পরিবহন দপ্তরের প্রশাসক, প্রক্টরিয়াল বডির ১০ সদস্য ও ১৪টি হলের প্রাধ্যক্ষ। পরে আবার নতুন উপাচার্য নিয়োগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যান। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ও কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ অনুযায়ী উপাচার্য নিয়োগ হওয়ার কথা সিনেটের মাধ্যমে। তবে সর্বশেষ ৯০’এর দশকে সিনেট অধিবেশনের মাধ্যমে চবিতে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। 

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত