
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, এর ঐতিহাসিকতা প্রজন্মের জন্য সঠিক আলোকবর্তিকা হতে পারে। কিন্তু একে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে বারবার। মানতে হবে ইতিহাসের সত্য ফিরে আসেই। মূর্খই শুধু ইতিহাসকে অস্বীকার করে।
৭ মার্চের ভাষণ ছিল সমকালীন রাজনীতির এক অনিবার্য পরিণতি। বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে তারা জানেন এ মাটি পরাভব মানেনি কোনোকালে। খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার অব্দে বাংলার মানুষ অস্ট্রিক, নিষাদ, সাঁওতালরা আর্য আগ্রাসনকে থামিয়ে দিয়েছিল। আর্যগ্রন্থ এ মর্মজ্বালা ভুলতে পারেনি। ভারত গ্রাস করে আর্য আগ্রাসন বাংলার প্রতিরোধে থমকে যাবে এমনটি ভাবা খুব কঠিন ছিল। তাই মুখরক্ষার জন্য গল্প ফেঁদেছে আর্য গ্রন্থগুলো। বলেছে অস্পৃশ্য বর্বর দেশ বাংলা। এখানে মানুষ পাখির মতো কিচির মিচির করে কথা বলে। নীল রক্তের ধারক আর্যরা তাই ইচ্ছে করেই প্রবেশ করেনি বাংলায়। এ ধরনের ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে প্রভুত্ব করার বাসনা সুপ্ত থাকে। একই মানসিকতা থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিজ অঞ্চলের তরুণ সমাজকে শেখাত বাঙালিকে ঘৃণা করতে, নিকৃষ্ট জাত হিসেবে বিবেচনা করতে। এসব শাসক-পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মারা এখন চেষ্টা চালায় বাঙালির গৌরবের দিন-ক্ষণগুলো ধোঁয়াচ্ছন্ন করে দিতে। সেদিন যেমন বাংলার মানুষের বীরত্বগাথাকে আড়াল করতে চেয়েছিল আর্যরা, তেমনি ৭ মার্চের ভাষণের মহিমা ভিন্ন খাতে বইয়ে দেওয়ার কসরত কম হয়নি এদেশের রাজনীতিতে।
বাংলার ইতিহাসে যেসব গৌরবগাথা প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে সংযোজিত হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণকে তা থেকে বিযুক্ত করার উপায় নেই। ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সাধারণ সূত্র বলবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের আর কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। অন্যদিকে ৭ মার্চের ভাষণটিও হঠাৎ কোনো বিস্ফোরণ ছিল না। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতাই জন্ম দিয়েছিল ৭ মার্চের।
বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের মুখে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন পাকিস্তানের কথিত লৌহমানব আইয়ুব খান। সামরিক প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছিল তাকে। উত্তপ্ত অবস্থা সামাল দিতে ইয়াহিয়া খান জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এদেশের মানুষ বিপুল উৎসাহে ১৯৭০-এর নির্বাচনে অংশ নেয়। নিরঙ্কুশ বিজয় আসে আওয়ামী লীগের পক্ষে। আওয়ামী লীগসহ সব বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্ন তখনো স্পষ্ট হয়নি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে যখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে পড়ে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই স্বাধিকারের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। বাঙালি মানসিকভাবে পরিত্যাগ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায় অস্থির প্রহর গুনে বাঙালি।
৭ মার্চে সে সময়ের রেসকোর্স ময়দানের প্রতি সবার দৃষ্টি আর মন আছড়ে পড়ে। সংগ্রামী বাঙালির মিছিল জড়ো হতে হতে রেসকোর্স ছাড়িয়ে প্রায় পুরো ঢাকা সয়লাব হয়ে যায়। দৃঢ়চিত্ত বঙ্গবন্ধু বজ্রকঠিন অথচ কাব্যময়তার মধ্য দিয়ে তার অসাধারণ ভাষণটি দিলেন। স্বাধীনতা ঘোষণার আর কি কিছু বাকি থাকে তখন! শব্দ চয়নে ছিল প্রাজ্ঞ রাজনীতিকের বিচক্ষণতা। কোনো হঠকারী সিদ্ধান্তকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। বোঝা গেছে পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার দিন শেষ হয়ে গেছে। তবে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি চাই। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ সবশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে সব জল্পনার অবসান করলেন।
বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে বিধ্বস্ত বিএনপির নেতৃত্ব তাদের নেতা জিয়াউর রহমানকে অপমান করে ইতিহাসের সত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়েছিলেন। অথচ ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান স্মৃতিচারণমূলক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘সম্ভবত ৪ মার্চে আমি ক্যাপ্টেন অলি আহমদকে ডেকে নিই। ...আমি তাকে সোজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। ...৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল মনে হলো।’
এভাবে ৭ মার্চের ভাষণ সব পক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় মেসেজ পৌঁছে দিয়েছিল। এ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের সমুদয় প্রশাসন চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। এই ভাষণের পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে বাঙালি। শ্রমিকরা চট্টগ্রামে জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করে। ২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবস’ বা ‘লাহোর প্রস্তাব দিবস’-এ পূর্ব পাকিস্তানের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। গ্রামে-গঞ্জে পাড়ায়-মহল্লায় যুবকরা ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।
সুতরাং ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় কিছুটা অস্পষ্টতা রেখে মুক্তিযুদ্ধেরই ডাক দিয়েছিলেন। তা বাঙালির মনে মর্মভেদী হয়ে প্রবেশ করেছিল। এই ভাষণের পর স্বাধীনতা ঘোষণার আর কি প্রয়োজন ছিল? এভাবে ৭ মার্চের ভাষণ বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন হয়ে রইল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ দুনিয়ার সব ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে একটি উজ্জ্বল জায়গা করে নিয়েছে। তবে মানতে হবে এই ভাষণের তাৎপর্য ছিল একটু আলাদা। পৃথিবীর তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি ঐতিহাসিক ভাষণের সঙ্গে তুলনা করলে তা আরও স্পষ্ট হয়। আঠারো শতকে প্যাট্রিক হেনরি যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে আমেরিকাবাসীদের মুক্ত করার অভিপ্রায়ে। একই সঙ্গে দাসত্বপ্রথার বিরুদ্ধেও তার বক্তব্য ছিল। তার বক্তব্য নিশ্চয় সে সময় আমেরিকানদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল। তা পরবর্তী সময়ের উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে ভূমিকা রেখেছিল। দাসত্বপ্রথা বিরোধী ভাবনাকেও অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিল। তবে তাৎক্ষণিক ফললাভ তখনো হয়নি।
ফ্রেডারিক ডগলাস এরও প্রায় ৭০ বছর পর তার বিখ্যাত ভাষণ উপস্থাপন করেছিলেন। তার ভাষণে বোঝা যায় আমেরিকায় স্বাধীনতা এলেও মানুষের মুক্তি আসেনি। দাসত্বপ্রথা একইভাবে বহাল রয়েছে। পালিয়ে আসা দাস ডগলাস তাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে তার আবেগ ও ক্ষোভ ধরে রাখতে পারেননি। তিনি বেশ সাহসী বক্তব্য রেখেছিলেন। এই স্বাধীনতা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল। দাসত্বপ্রথাকে টিকিয়ে রেখে তিনি এমন দিবসের আনন্দকে স্বীকার করতে পারেননি। মানুষের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু দাসত্বপ্রথার বিলোপ সাধন তখনো অনেকটা পথ বাকি ছিল।
আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গ ভাষণ গৃহযুদ্ধ অবসানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। দাসত্বপ্রথা অবসানের বিষয়েও তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ছিল তার। তবে আব্রাহাম লিঙ্কনের মৃত্যুর পর প্রায় শতবর্ষ অপেক্ষা করতে হয়েছিল দাসত্বপ্রথা অবসানের জন্য।
আব্রাহাম লিঙ্কনের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার প্রত্যয় নিয়েই যেন মার্টিন লুথার কিং এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ বক্তৃতায় প্রধানত দাসত্বপ্রথার অবসান ও মানুষের প্রতি সমতা স্থাপনের স্বপ্ন তিনি আমেরিকানদের দেখিয়েছিলেন। দাসত্বপ্রথা অবসানের লক্ষ্যে এই ভাষণ যেমন আমেরিকানদের মনোবল দৃঢ় করেছিল, তেমনি আবেগাপ্লুত করেছিল বিশ্ববাসীকে।
নিগৃহীত জাতিগোষ্ঠী ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য এসব উজ্জ্বল বক্তৃতা পৃথিবীর ইতিহাসে গৌরবের জায়গা দখল করে থাকবে। তবে এসব ভাষণের পাশে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে রাখলে একইভাবে আলো ছড়াবে। তুলনামূলক আলোচনা করা নিরর্থক। তবে বিশেষ মূল্যায়নের অবকাশ রাখে। ওপরে উল্লিখিত কোনো ভাষণ দেওয়ার সময়েই এই উজ্জ্বল মানুষগুলোকে প্রতিপক্ষের ভয়ংকর চাপের মুখে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে হয়নি। গণমানুষ তাদের নেতার ওপর বিশেষ কোনো দাবিও চাপিয়ে দেয়নি। এরমধ্যে শেষ দুটো ভাষণ, অর্থাৎ আব্রাহাম লিঙ্কন ও মার্টিন লুথার কিং-এর ভাষণ ছিল লিখিত। ভাষণের আগে পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল। বলা যায় মহড়া করেই বক্তৃতার মঞ্চে তারা এসেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু এ ধরনের কোনো সুযোগই পাননি। একদিকে সাধারণ মানুষ ও বিশেষ করে ছাত্রদের কাছ থেকে দাবি ছিল স্বাধীনতা ঘোষণার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানেন সে সময় আসেনি। এ ধরনের সরাসরি ঘোষণা দিলে তা হঠকারী কাজ হয়ে যাবে। অমন ঘোষণা পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তুলে দেবে অস্ত্র। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করবে। ঝাঁপিয়ে পড়বে বাঙালির ওপর। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি কোথায় বাঙালির। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু এ সত্যটিও বুঝেছিলেন যে স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির আর কোনো বিকল্প নেই। দেশের সব মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ৭ মার্চ নেতার কাছ থেকে নির্দেশ পাওয়ার জন্য। অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের কাছ থেকে চাপ বাড়ছে। চারদিকে মারণাস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত পাকিস্তানি বাহিনী। রেসকোর্স ময়দানের ওপরে ঘন ঘন উড়ছে সামরিক জঙ্গি বিমান ও হেলিকপ্টার।
এমন এক বাস্তবতায় জ্বরে আক্রান্ত বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন বক্তৃতার মঞ্চে। রাতভর যা ভেবেছিলেন তা জমা রেখেছেন মগজের কোষে। মাত্র উনিশ মিনিটের মোহনীয়, কাব্যময় অথচ তেজোদ্দীপ্ত ভাষণে সবার প্রত্যাশাই পূরণ করলেন। ভাষা ও শব্দবিন্যাসের কৌশলে ও মেধায় বিভ্রান্ত করতে পারলেন পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা এলো না এলো নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকারী দলের নেতার ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যৌক্তিক দরকষাকষির কথা। তবে ক্ষমতালাভের বিষয়টিও প্রাধান্য পেল না। প্রাধান্য পেল বাঙালিকে নিপীড়ন করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বক্তব্য। পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার পক্ষেই যেন কিছু শর্ত আরোপ করলেন। আর ভাষণের উপসংহারে এসে বিশেষ নৈপুণ্যে জানিয়ে দিলেন এসব দাবিকে যদি পাকিস্তানের সামরিক শাসক অগ্রাহ্য করে তবে যাতে বাঙালি প্রস্তুতি নেয়। এই কৌশলের ভেতর থেকে তিনি ছড়িয়ে দিলেন প্রত্যাশিত অমোঘ বাণী ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলার অবকাশ রইল না। আর বাঙালি পেয়ে গেল তাদের আরাধ্য নির্দেশ। তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা গণহত্যা শুরু করলে আতঙ্কে বিভ্রান্ত হয়নি বাঙালি। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দখলদার বাহিনীর ওপর। নয় মাস যুদ্ধ করে শত্রুমুক্ত করেছিল স্বদেশ। আর পুরো মুক্তিযুদ্ধকালীন সব বাঙালিকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণিত করেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। একটি ভাষণ কোনো জাতিগোষ্ঠীকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা এনে দিতে পারে এমন সত্য ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। এদিক বিচারে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে অনন্যই বলতে হয়। ৭ মার্চের ভাষণ থেকে ২৬ মার্চের স্বাধীনতা এসব যেন অভিন্ন সুতোয় বাঁধা। এভাবেই উত্তাল মার্চ ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে যাচ্ছে বাঙালির জীবনে।
লেখক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
দেশের মোট শ্রমশক্তির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এমন শ্রমিকদের মধ্যে যে অংশটি সারা দেশে পারিবারিক পরিধির মধ্যে শ্রম বিক্রি করেন তাদের এককথায় গৃহকর্মী হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, মানুষের ঘর-সংসারে নিত্যদিন শ্রম দেওয়া এই গৃহকর্মীরা এখনো আমাদের সমাজে খুবই অবহেলিত। গৃহকর্মীরা শ্রমের যথাযথ মূল্য থেকে বঞ্চিত এবং নানারকম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলেও তাদের সুরক্ষায় শক্তিশালী কোনো আইনি কাঠামো নেই। আর সাধারণ আইনে যতটুকু সুরক্ষা গৃহকর্মীরা পেতে পারেন সেটাও সমাজের বিদ্যমান বাস্তবতায় তাদের অধরাই থেকে যায়।
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। চার বছর আগে ৪ জানুয়ারি, ২০১৬ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় গৃহকর্মীদের সুরক্ষায় ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫’ প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের গ্রামীণ বর্ধিষ্ণু পরিবার থেকে শুরু করে ক্রমপ্রসারমান নগর জীবনের পারিবারিক আবাসস্থল, মেস এবং ক্ষেত্রবিশেষে ডরমিটরি
প্রভৃতি গৃহকর্মীদের কর্মস্থানের প্রধান ক্ষেত্র। নীতিতে বলা হয়েছে : হালকা কাজের জন্য গৃহপরিচারিকাদের ন্যূনতম বয়স ১৪ হতে হবে। কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সের গৃহপরিচারিকারা ভারী কাজের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। এ ছাড়া ১২ বছর বয়সের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে রাখতে হলে তার আইনানুগ অভিভাবকের সঙ্গে তৃতীয় কোনো পক্ষের উপস্থিতিতে নিয়োগকারীকে আলোচনা করতে হবে। প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করতে হবে। গৃহকর্মীকে মাতৃত্বকালীন ১৬ সপ্তাহ সবেতন ছুটি দিতে হবে। গৃহকর্মীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হলে ফৌজদারি দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনসহ বিদ্যমান আইনে বিচার হবে। কোনো গৃহকর্মী শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে তিনি সরকারি ব্যয়ে আইনি সহায়তা পাবেন।
কিন্তু রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের শহরাঞ্চলে নিয়োজিত গৃহকর্মীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই যে সরকারের ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি’-তে বর্ণিত সুযোগ-সুবিধা পান না সেটা বলা বাহুল্য। ধনী-দরিদ্র কিংবা শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে বিভিন্ন পরিবারে গৃহকর্মী নির্যাতনের যেসব খবর প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় সেখান থেকেই গৃহকর্মীদের বিষয়ে নাগরিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যাচ্ছে গত বছর ৪৪ জন গৃহকর্মী মারাত্মক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ জনের রহস্যজনক মৃত্যুসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ জন। শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে চরমভাবে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ১২ জন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন আরও ৪ জন। এই পরিসংখ্যান কেবলই পুলিশের কাছে দাখিল হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে তৈরি।
গৃহকর্মে নিয়োজিতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত। এই বিপুল সংখ্যক গৃহকর্মীর প্রাপ্য শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এটা খালি চোখেই দেখা যায় যে, কোনো লিখিত চুক্তি না থাকায় গৃহকর্মীরা বেতন এবং ছুটির অধিকার থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার চেয়ে বেশি কাজ করতে বাধ্য হন। আর অমানবিক আচরণ এবং নিপীড়ন-নির্যাতনও সইতে হয় তাদের। গৃহকর্মীদের সঙ্গে নাগরিকরা কেমন আচরণ করবেন সেটা বোঝার একটা মানদন্ড হতে পারে, গৃহশ্রমকে নাগরিকরা কীভাবে দেখেন। যে সমাজে পরিবারের নারী সদস্য বা সদস্যদের প্রাত্যহিক গৃহশ্রমই ‘শ্রমের মর্যাদা’ পায় না, সেখানে গৃহকর্মীর শ্রমকে কতটা মূল্যায়ন করা হবে সে প্রশ্ন এড়ানো কঠিন। অন্যদিকে, বলা যেতে পারে, গৃহকর্মীদের পরিচালনার দায়িত্বটা মূলত পরিবারের নারী সদস্যরা করলেও দেখা যায়, নারী বা শিশু গৃহকর্মীর প্রাপ্য যথাযথ মর্যাদাপূর্ণ আচরণের বিষয়ে তারাও সচেতন নন। ফলে এই সংকট সমাধানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বড় ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ও সামাজিক সচেতনা তৈরি করা প্রয়োজন।
গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিতে সার্বিক দিক বাস্তবায়ন ও তদারকির লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি মনিটরিং সেল গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এই নীতি ভঙ্গ বা কোনো নির্যাতনের শিকার হলে গৃহশ্রমিকরা সরকারের মনিটরিং সেলে মৌখিক বা লিখিত অভিযোগ করতে পারবেন। এখন এই সেলকে সক্রিয় করতে হলে সমাজে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণার পাশাপাশি অভিযোগ দাখিলের প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গৃহকর্মী সুরক্ষার কাজে যুক্ত করা গেলে স্থানীয় পরিসরে তার সুফল মিলতে পারে। একই সঙ্গে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিকে পূর্ণাঙ্গ আইনে পরিণত করা যায় কি না সে বিবেচনাও জরুরি।
শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার মানবজীবনের অলংকার। শুদ্ধাচার বেশ রাশভারী একটি শব্দ। শুদ্ধ ও আচার শব্দের সমন্বয়ে সৃষ্টি শুদ্ধাচার শব্দের। এর অর্থ চরিত্রনিষ্ঠা। সাধারণত ‘নৈতিকতা ও সততা’ দ্বারা প্রভাবিত আচরণ ও উৎকর্ষ সাধনকে শুদ্ধাচার বলা হয়। শুদ্ধ বলতে সহজ ভাষায় বুঝি পবিত্র, সাধু, খাঁটি, পরিষ্কার, শোধিত, নিষ্কলুষ, নিষ্কণ্টক, নির্ভুল ও নির্দোষ ইত্যাদি। একজন মানুষের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য যখন সমাজ এই অভিধাগুলোর ব্যবহার ও প্রয়োগ করে, তখনই সেই মানুষ ‘শুদ্ধ মানুষ’ হিসেবে গণ্য হন। এ জন্য সত্য, সুন্দর ও কল্যাণকর, নৈতিক আদর্শকে চরিত্রে ধারণ ও বাস্তবে রূপায়ণ করতে হয়। ব্যক্তি ও পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবন ধারণের জন্য ভালো আচরণ, ভালো রীতিনীতি, ভালো অভ্যাস রপ্ত ও পরিপালন করা অত্যাবশ্যক।
শুদ্ধাচারের বিপরীত গর্ব, অহমিকা, দুরাচার কলঙ্ক ও অন্ধকার। এর সবগুলোই মানুষের মন্দ বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা আমল করে নাও এসবের আগেই। ওই দারিদ্র্য, যা আত্মবিস্মৃৃত করে দেয়, ওই প্রাচুর্য যা দাম্ভিক করে তোলে, ওই রোগব্যাধি যা জরাগ্রস্ত করে ফেলে, ওই বার্ধক্য যা বুদ্ধিহীন করে ছাড়ে।’সুনানে তিরমিজি: ২৩০৬
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসের আগে পাঁচটি জিনিসের মূল্যায়ন করো। যৌবনকে বার্ধক্যের আগে, অবসরকে ব্যস্ততার আগে, সময়কে সময় চলে যাওয়ার আগে, সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, জীবনকে মৃত্যুর আগে।’সুনানে তিরমিজি ও আবু দাউদ
শুদ্ধাচার দ্বারা একটি সমাজের কালোত্তীর্ণ মানদন্ড, নীতি ও প্রথার প্রতি আনুগত্য বোঝানো হয়। ব্যক্তি পর্যায়ে শুদ্ধাচারের অর্থ হলো কর্তব্যনিষ্ঠা ও সততা, তথা চরিত্রনিষ্ঠা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেবা খাতে শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্নমুখী আলোচনা হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অসাধুতা ও অনৈতিকতার চর্চারোধে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি দমনে শুদ্ধাচার প্রতিপালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের সেবা খাত। সেখানে শৃঙ্খলা, সুশাসন এবং সর্বোপরি শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের আশা করা বৃথা। শুদ্ধাচারের চর্চা না থাকলে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, দুর্নীতি সহসাই বাসা বাঁধে। ফলে সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া চরম হুমকির মধ্যে পড়ে।
বিবেকবোধই হলো নৈতিকতার ‘উৎস’। বিবেকও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞাহীন। তবে বিবেক বলতেনিজের জন্য যা প্রত্যাশা, তা অন্যের জন্যও চাওয়া। বিবেকের তাড়নায় তাড়িত হয়ে ভালো কাজ করতে, সৎপথে চলতে মানুষ উৎসাহিত হয়। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষ, পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ঠ জিনিসটি পেতে চায়। বর্ণ, রং, উচ্চতা, চিন্তাশক্তি, আকৃতি, গঠনভেদে মানুষ আলাদা হলেও আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে সব মানুষের চাওয়া অভিন্ন। মন্দ জিনিসটি নিজের জন্য নিতে চায় না, সবাই ভালোটি পেতে চায়। কেউ চায় না তার সঙ্গে কেউ দুর্ব্যবহার করুক কিংবা কেউ তার ক্ষতি করুক। নৈতিকতা হলো মানুষের মনের এই নিরন্তর চাওয়া-পাওয়ার নীতি। নৈতিকতার চর্চা আমাদের অন্যের প্রতি যতœশীল, সহমর্মী, দয়ালু ও অন্যের অধিকার বজায় রাখার ও অন্যের ক্ষতি হতে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। প্রেরণা যোগায় সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করার।
নৈতিকতা থেকে উৎসারিত হয় সৎসাহস, দেশপ্রেম সত্যবাদিতা ও দৃঢ় প্রত্যয়। যা একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ, স্থিতিশীল এবং শুদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের অন্যতম শর্ত। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির সমষ্টিতে যেমন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়। তেমনি ব্যক্তির সম্মিলিত লক্ষ্যই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যে প্রতিফলিত হয়। একজন মানুষের নৈতিকতা শিক্ষা শুরু হয় পরিবারে এবং শুদ্ধাচার অনুসরণের ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নৈতিক জীবন গঠনে যার গুরুত্ব অপরিসীম। তৃতীয় ধাপে রয়েছে তার কর্মস্থল। শুদ্ধাচার নির্ভর করে প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিক চর্চার ওপর। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বিষয়ে ইসলামসহ প্রত্যেক ধর্মেই নির্দেশনা রয়েছে।
ইসলামি স্কলারদের মতে, আত্মপর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনার মাধ্যমে শুদ্ধাচারের যথাযথ চর্চা সম্ভব। কোরআনে কারিমে শুদ্ধাচার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে যথাযথ ভয় করো এবং প্রকৃত মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কোরো না।’সুরা আলে ইমরান: ১০২
কোরআনে কারিমের অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে ব্যক্তি শুদ্ধাচার করেছে সেই সফল, আর যে নিজেকে কলুষিত করেছে সে ব্যর্থ মনোরথ হয়েছে।’
উল্লিখিত আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, পরকালে মুক্তির জন্য শুধু বাহ্যিক আমল যথেষ্ট নয়, বরং শুদ্ধাচার জরুরি। তাই নবী করিম (সা.) নিজের অন্তরকে ঠিক করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অন্তরের শুদ্ধতা করে নৈতিকতা শিক্ষার পূর্ব শর্ত। সততা ও নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষই মূল শুদ্ধাচার। শুদ্ধাচার ছাড়া সভ্যতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর শুদ্ধাচার অর্জনে ধর্মচর্চা ও নৈতিকতা শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : মুফতি ও ইসলামবিষয়ক লেখক
বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম পর্বের প্রধান লেখকদের একজন মীর মশাররফ হোসেন। যদিও তার এই কৃতি অনুমোদনের প্রশ্নে বঙ্কিমচন্দ্রের সার্টিফিকেটমূলক বাণী আজ বেশ হাসির, আর একই সঙ্গে বাংলায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অন্তঃস্রোতে বহে চলা ‘আমরা’ ও ‘ওরা’-কেও ধ্বনিত করে। সে সুর বেদনার। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, এই লেখকের লেখা পড়ে মনে হয় না এটা কোনো মুসলমানের রচনা, এ ‘তাদের’ মতন কোনো বর্ণহিন্দুরই লেখা। এখানে হিন্দুর রচনা কথাটা লিখলে আমাদের জন্যে বোঝাবুঝি খানিকটা সহজই হতো। কিন্তু হচ্ছে না যে তার কারণ, বরদায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের বাংলার শিক্ষক ছিলেন দীনেন্দ্রকুমার রায়। তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দু। এই ভদ্রলোক কিংবা ছোটলোক ভালো বাংলা জানতেন। লিখেছেন, তার লেখা পড়ে কলকাতার ভদ্র তথা বর্ণহিন্দু সমাজের পয়লা উপলব্ধি ঘটেছিল, এটা কোনো বর্ণহিন্দুরই রচনা। রায় তো ব্রাহ্মণেরও পদবি।
তা হতে পারে বইকি! কিন্তু লেখা পড়ে এমন ধারণার পেছনে আছে সেই কথা, ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ছাড়া আর কারও এত ভালো বাংলা লেখা বা গদ্য লেখা সম্ভব নয়। চিন্তার কী দীনতা! বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই এর শুরু নাকি ভবানীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে? কে জানে। অথচ মধ্যযুগে মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দু কবির আনাগোনা বেশ। তারা বৈষ্ণব পদ, বড় বড় কাব্য অনেকই রচনা করেছেন। রামী ধোপানি, মীননাথ ধীবর। বাংলা ভাষার পক্ষে এখনো পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ পদযুগলের রচয়িতা আবদুল হাকিম যে মুসলমান সে কথা লেখাই বাহুল্য। মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাস? কিংবা জ্ঞানী বিদুর? বাকিদের কথা থাক। কারণ অনেক সাহিত্য-ঐতিহাসিক আর ইরাবতী কাব্যে ও প্রতিভা বসু তো একেবারে নির্দিষ্ট করেই দিয়েছেন, মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আসলে আর্য-অনার্যের লড়াই। এখানে পা-বরা অনার্য। কৃষ্ণ কালো। গোপ। অর্জুনও তাই। অভিমন্যু কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রা আর অর্জুনের সন্তান। যুদ্ধান্তে একসময়ে অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিৎ ভারতরাজ! আর আধুনিক কাহিনীগদ্যে অদ্বৈত মল্লবর্মণ জেলেজীবন নিয়ে একটি অসাধারণ উপন্যাস লিখেছেন, যেন সেটি তার লেখারই কথা; কিন্তু যে অনন্য সাধারণ নদীবাহিত গদ্য তিনি সেই উপন্যাসে ব্যবহার করেছেন, এমন উদাহরণ বাংলা ভাষায় বিরল।
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া কাজের কথা নয়। মীর মশাররফ হোসেনের প্রধান পরিচয় এখন ‘বিষাদ সিন্ধু’র রচয়িতা। কারবালার পুঁথির কাহিনী রূপ। যদিও তিনি ঔপন্যাসিকের কল্পনার যথেষ্ট ব্যবহার করেছেন। এটি বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রধান বইগুলোরও একটি। হয়তো এই একখানি বইয়ের অপ্রতিদ্বন্দ্বী খ্যাতি তার অন্যান্য সাহিত্যকৃতিকে পেছনে সরিয়ে রেখেছে। পাঠক হিসেবে তা একদিক থেকে দীনতারও প্রকাশ। অন্তত, আজও পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রচিত আত্মজীবনীগুলোর ভেতরে তার ‘উদাসী পথিকের মনের কথা’, ‘আমার জীবন’ ও ‘আমার জীবনীর জীবনী কুলসুম-জীবন’ অসাধারণ। বাঙালি জাতি হিসেবে কপট। আত্মজীবনী রচনার ক্ষেত্রে তো বটেই। বাঙালির আত্মজীবনী মাত্রই স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী নয়। আত্মজীবনী অন্য জিনিস। সেখানে গদ্যে ঔপন্যাসিকের কলমের জড়তাহীনতার পাশে লাগে নিজেকে অনর্গল খুলে তুলে ধরা। যেমন উত্তমপুরুষের রচিত উপন্যাস। কিন্তু বাঙালির রচিত বেশির ভাগ আত্মজীবনী ভালো কথার সমাহার, দেবতার আত্মচরিত প্রায়, সেখানে খোল যেমন থাকে না নলচেও না, বরং খোল আর নলচে কী করে এক জায়গায় হয়েছে সেই স্মৃতির কাহনেই পূর্ণ। ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই তা নয়, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। মীর মশাররফ তার আত্মজীবনীতে নিজেকে মেলে ধরেছেন অর্গল খুলে, জমিদারনন্দনের কোনো ঢালই সেখানে নেই। উত্তরপুরুষকে ঢাল দেওয়াই প্রচলিত আত্মজীবনীর কাজ, মীর মশাররফ সেই কালে তো বটেই যে কোনো কালের বিবেচনায় ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রম। হয়তো কলকাতার বাবু কালচার আর গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত মানসিকতার থেকে অনেক দূরে কুমারখালির লাহাড়িপাড়ায় অবস্থানও একটি কারণ। কিন্তু সৎ সাহস তো শুধু দূরবর্তিতার বিষয় নয়, সেটি যে কোনো লেখকের অন্তর্গত চৈতন্যে প্রবহমান না থাকলে, অমন গলগল করে বেরিয়ে আসে না।
আর একটি দিক। মীর মশাররফের নাটক রচনা। দীনবন্দু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে নানান কারণে মাইলফলক। এই নাটকটি এক রাতে ইন্ডিগো প্লান্টিং মিরর নামে অনুবাদ করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, এমন ধারণা প্রচলিত। যদিও মাইকেল মধুসূদন কিংবা দীনবন্ধু মিত্র কারোর জীবনীকাররা এ তথ্যের পক্ষে খুব সহায়ক মতামত পেশ করেননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সেই সময়ে’ সে কথা লিখেছেন ঔপন্যাসিকের বর্ণনায়। এক রাতে এই নাটকটি অনুবাদ করেছেন মধুসূদন। পরদিন সকালে পাওয়া যায় ঘরময় ছড়ানো নাটকের পা-ুলিপি আর গোটা কতক রামের বোতল। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, এই ‘নীল দর্পণ’-এর ইংরেজি অনুবাদের কারণে ব্রিটিশরাজ নাটক রদ আইন করে, যার ফলে কোনো নাটক মঞ্চায়নের আগে জেলা প্রশাসক বা তার প্রতিনিধির কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। অর্থাৎ নাটক লিখবেন নাট্যকার, কিন্তু সেটি মঞ্চায়ন করা যাবে কি না তার অনুমতি দেবেন জেলা প্রশাসক। যার একটি সংলাপ লেখারও যোগ্যতা নেই, তিনি অনুমতিদাতা! জিভ নেই যার, সে জানাবে স্বাদ। সেন্সর বোর্ড সম্পর্কে এ কথা বলেছেন সত্যজিৎ রায়। স্বাধীন বাংলাদেশেও বহুদিন নাটক রদ আইন বহাল ছিল।
ইংরেজ সরকার আইনটি করেছিল তার প্রয়োজনে। যে কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি তখত রক্ষায় এমন কত আইন করে। শোষিত ওপরে তা মানতে বাধ্য, ভেতরে মানে না। জেলখানায় রচিত ‘কবর’ সেই কারণে মঞ্চস্থ হয় নিচু আলোয়। যাক, নীল দর্পণের যে ভূমিকা, এর পাশাপাশি রেখে পড়লে মীর মশাররফ হোসেনের ‘জমিদার দর্পণ’-এর ভূমিকাকে বিন্দুমাত্র খাটো করে দেখবার সুযোগ নেই। বরং, একটি দিক থেকে তা বেশি। সেখানে শাসক ইংরেজের একনিষ্ঠ সেবক চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমস্ত সুফলভোগী জমিদারের যে রূপ মীর মশাররফ প্রকাশ করেছেন, তা সেই সময়কার বাংলাদেশের এতটাই দগদগে চিত্র যে, সেখান থেকে আড়চোখে তাকানোর সুযোগ নেই। বরং, কৃষিভিত্তিক এই সমাজে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর কারণে বাংলার কৃষকের যে দশা হয়েছিল, আবু মোল্লার তার প্রতিনিধি। সে শোষিত জমিদারের হাতে। মীর মশাররফ সে পক্ষের। সহায়ক ইংরেজ সরকার, তার পুলিশ ও বিচারক। আবু মোল্লার স্ত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করেছে জমিদার, সে কাজ মীর মশাররফের পরিবার থেকেই হয়তো সংগঠিত হয়েছে। শারীরিক লাঞ্ছনার জন্যে নুরুন্নাহার আত্মঘাতী হয়। তার সেই লাঞ্ছনার সহায়ক কতজন। সবই জমিদারের তাঁবেদার। ওই শ্রেণির তখন কি এখন কোনো সময়েই তো তাঁবেদারের অভাব ছিল না। অন্যায়কারী জমিদারেরও ইংরেজ তোষণের সব কায়দা জানা। তারা পরস্পরের পরিপূরক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রে তারা সে বন্ধনে আবদ্ধ। আর রায়ত বা প্রজা বা কৃষককে সেই চিরকালীন শোষণের কায়দা ও এর বদৌলতে উপঢৌকন প্রদানও তারা নিজেদের ব্যবস্থায় রাখেন।
‘জমিদার দর্পণ’ তো আর শুধু জমিদারকে দেখার আয়না নয়, বরং জমিদারের কৃতকর্মের হিস্যা, যা মীর মশাররফ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সূত্রেই অর্জন করেছেন। কিন্তু সে অর্জন তো সবাইকে একেবারে আগাপাশতলা দেখানোর মতন করে লিখবার সাহস জোগায় না, সে সাহস সবার থাকেও না। মীর মশাররফের ছিল। বাংলা গদ্যের ভিত্তিভূমিতে, ‘মুসলমান পরিবারের’ সন্তান হয়েও তিনি যেমন বর্ণহিন্দুর চোখ কচলে ধাঁধা ধরানো মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। একই সাহস তিনি দেখিয়েছেন ‘বিষাদ সিন্ধু’ রচনায় ঔপন্যাসিকের স্বাধীনতা নিয়ে, আত্মজীবনীতে ব্যক্তিজীবন উন্মোচন করে, আর ‘জমিদার দর্পণ’-এর মতন অসাধারণ নাটকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এক দগদগে ক্ষতকে সামনে এনে। প্রতিভাবান লেখকমাত্রই শিল্পের শর্ত রক্ষা করে যে কাজটি করেন।
তবু পশ্চিমবাংলায় তো অবশ্যই, বাংলাদেশেও, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ এই যাত্রায় মাঝখানে মীর মশাররফের নামটা অনেক গদ্যলেখকের হিসেবে থাকে না। সাহিত্যের ইতিহাসকার রাখেন কালের ধারাবাহিকতায়, যেখানে অনেক গৌণ নামও থাকে। তা স্বাভাবিক। কারণ, সাহিত্যের ইতিহাস সব সময়েই গৌণ লেখকদের অংশগ্রহণেই বহমান। মীর মশাররফ সেখানে ব্যতিক্রম। আজ যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের হিড়িক, যা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সহযোগী ‘দেশ’-পত্রিকা উৎসারিত, তারও তো প্রথম দিককার সফল কারিগর মীর মশাররফ। আর আত্মজীবনী রচনায় তার যে অকপট কলম, সে কলমকে সবসময়েই কুর্নিশ জানাতে হয়।
০৪ ফাল্গুন ১৪২৭ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১। সিলেট
লেখক কথাসাহিত্যিক
চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী রফিকুল ইসলাম ২০১৮ সালের ৫ মার্চ মারা যান। তার জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ১৯৩৬ সালে। তিনি ডায়রিয়া নিরাময়ের জন্য খাবার স্যালাইন (ওরস্যালাইন) আবিষ্কারের জন্য পরিচিত। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যানসেট তার আবিষ্কৃত খাবার স্যালাইনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বলে উল্লেখ করেছিল। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্রিটেনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ওষুধ ও স্বাস্থ্যবিধি (ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও হাইজিন) বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। এমবিবিএস পাস করার পর তিনি ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশে যোগদান করেন এবং ২০০০ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে অবসরে যান। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন ওষুধ নিয়ে গবেষণা করেন। তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো খাবার স্যালাইন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলোতে কলেরা ছড়িয়ে পড়লে একমাত্র চিকিৎসা হিসেবে শিরায় স্যালাইন (ইনট্রাভেনাস) দেওয়া হতো। কিন্তু ইনট্রাভেনাসের স্বল্পতা ছিল। বিকল্প হিসেবে তার আবিষ্কৃত খাবার স্যালাইন দিয়ে এই রোগ থেকে সুস্থতা লাভ সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডায়রিয়ার চিকিৎসায় স্যালাইনের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। ফলে এটি ‘ঢাকা স্যালাইন’ নামেও পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮০ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ওরস্যালাইনকে স্বীকৃতি দেয়। এ ছাড়া বাংলাদেশি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক এই খাবার স্যালাইনকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার সকালে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এরপর দুপুরে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখানে মূলত আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে দেশের রাজনীতিতে যে উত্তাপ দেখা দিয়েছে তা নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে আনিসুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন, তাদের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মূলত শ্রম আইন নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রম আইন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরামর্শ ছিল। বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এ মাসেই জেনেভা যাওয়ার কথা রয়েছে।
পরে বেলা ১টা ১০ মিনিটে মার্কিন দূতাবাসে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব। এরপর বেলা আড়াইটার দিকে তিনি দূতাবাস থেকে বের হন। রাতে মির্জা ফখরুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই নীতি দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হবে আমরা মনে করি বলে রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রদূতকে আমি জানিয়েছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া আওয়ামী লীগের অধীনে দেশে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। দেশের জনগণও তাই মনে করে। এ ছাড়া নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমাদের কোনো আলাপ হয়নি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছিলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করবেন।” তার এমন বক্তব্য নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠলে পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কীভাবে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের সংবিধানে কী আছে তা-ও জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত।’
বাসায় তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার পর বিষক্রিয়ায় মারা গেছে রাজধানীর বারিধারা এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষারের দুই ছেলে। তার মেয়ে এখনো অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। গত শনিবার ‘ডিসিএস অরগানাইজেন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওই ব্যবসায়ী। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা বাসায় ওষুধ দিয়ে ছয় ঘণ্টা পরে ঢুকে ঘর পরিষ্কার করতে বলেছিলেন। পরিবারটি ৯ ঘণ্টা পরে বাসায় ঢুকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ সময় তাদের সবারই পেট খারাপ, বমির মতো উপসর্গ দেখা দেয়।
ওই পরিবারের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, সেই পেস্ট কন্ট্রোল কোম্পানি পোকামাকড় নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট (গ্যাস ট্যাবলেট) ব্যবহার করেছিল, যেটা থেকে বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। সেই গ্যাসের বিষক্রিয়াতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এদিকে রাজধানীতে গত পাঁচ বছরে এই বিষক্রিয়ায় বেশ কয়েকজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রার এই কীটনাশক বাসায় ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ বিভিন্নভাবে সাধারণ কীটনাশক হিসেবে দেদার বিক্রি হচ্ছে সারা দেশে।
সূত্র বলছে, রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক শতাধিক পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব কোম্পানির প্রায় ৯৫ ভাগের কোনো অনুমোদন নেই। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এসব দেখভাল করার কথা থাকলেও তারাও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না।
পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস প্রতিষ্ঠান সেবা নিন প্ল্যাটফর্ম লি.-এর চেয়ারম্যান শামসুল আলম বলেন, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। অধিক মুনাফার আশায় তারা এক ধরনের নিষিদ্ধ ট্যাবলেট ব্যবহার করে। আবার অনেকে লিকুইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে। কিন্তু কোন মাত্রায় এসব ব্যবহার করতে হয় তার প্রশিক্ষণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত।
রাজধানীর বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে দেয়াল লিখন ও অনলাইনের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে চটকদার বিজ্ঞাপন। অথচ চাষাবাদ ছাড়া অন্য কাজে যার ব্যবহার নিষিদ্ধ। বদ্ধ ঘরে এই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করলে যে কারও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে মাইকিং করে এসব কীটনাশক বিক্রি করছিলেন কাঞ্চন মিয়া। এ ধরনের কীটনাশক বিক্রির অনুমতি তার আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের অনুমতি লাগে না। দশ বছর ধরে এই ব্যবসা করি। কেউ তো কিছু বলে না। কোথা থেকে এসব পণ্য সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশিরভাগ পুরান ঢাকা থেকে সংগ্রহ করি। গাজীপুর সাভার থেকেও এসে দিয়ে যায়। এসব ব্যবহারে মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে তা জানেন না বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন কীটনাশক জাতীয় একপ্রকার ওষুধের জেনেটিক বা গ্রুপ নাম হলো অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড। বাজারে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট আকারে ফসটক্সিন, সেলফস, কুইকফস, কুইকফিউম, ডেসিয়াগ্যাস এক্সটি ইত্যাদি নামে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট গ্যাস ট্যাবলেট নামেও পরিচিত। বাতাসের সংস্পর্শে এসে জীবনবিনাশী ভয়াবহ টক্সিক গ্যাস ফসফিন উৎপাদন করে। এই ট্যাবলেট সাধারণত গুদামজাত শস্যের পোকা দমন, ধান ক্ষেতের পোকা দমন, কলাগাছের পোকা দমন ও ইঁদুর দমনে ব্যবহার হয়ে থাকে। গত এক দশকে দেশে এই বিষাক্ত কীটনাশক মানুষের বাসাবাড়িতে ব্যবহার বাড়ছে। দেশের বাজারে ট্যাবলেট আকারে সহজলভ্য। রাজধানীতে ছারপোকা দমনে প্রায় যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে এই ট্যাবলেট।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বালাইনাশক গ্রহণ করলে সেটা দ্রুত ফুসফুসে শোষিত হয় এবং রক্তে মিশে যায়। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ বালাইনাশক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তাহলে নাক, গলা ও ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারের যে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান রয়েছে এসব বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোন কোন কীটনাশক কোন মাত্রায় কোন কোন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হবে সেটি নির্দিষ্ট করে নিশ্চিত করতে হবে। আমদানির সময়ও বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। অথবা দেশেই যদি তৈরি করতে হয় তাহলে যথাযথ কর্র্তৃপক্ষের লাইসেন্স নিয়ে উৎপাদন করতে হবে। এটির গুণগত মান থাকছে কি না তারও পরীক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি ওই বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানটি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করেছে। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত না। আমার মতে এটা আরও বেশি তদন্ত করা উচিত। সরকারের যে প্রতিষ্ঠান এসব বিক্রির অনুমোদন দেয় তাদের এই তদন্ত করে জানানো দরকার কী ধরনের কেমিক্যাল সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল। কারণ পেস্ট কন্ট্রোলের নামে কী ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় এটা জানাটা জরুরি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের কীটনাশক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার কোনো নীতিমালা নেই। কীটনাশকগুলো সাধারণ কৃষিজমিতে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরে এরকম বিষ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা উচিত। তাছাড়া রাস্তাঘাটে এসব জিনিস অহরহ বিক্রি হচ্ছে। এসবও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
আরও এক কর্মী গ্রেপ্তার : দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় টিটু মোল্লা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি বালাইনাশক কোম্পানিটির কর্মকর্তা। গত সোমবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ভাটারা থানার ওসি আবুল বাসার মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, ওই ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব প্রকাশ্যে চলে এসেছে। কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আরও বেশি দৌড়ঝাঁপ শুরু করছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের দূরত্ব এখন স্পষ্ট। আলোচনা আছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পশ্চিমা এ দেশটি হঠাৎ আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেছে।
জানা গেছে, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের মতপার্থক্য ছিল না। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা করছে দেশটি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ নিয়ে কোনো দ্বিমত করেনি। এরই মধ্যে, ভিসানীতি ঘোষণা করে সরকারকে বড় চাপ দেওয়ার পূর্বাভাস দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি একে অন্যকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। তবে ভিসানীতি যে সরকারের ও আওয়ামী লীগের ওপরই বেশি চাপ তৈরি করেছে, সেটা ভেতরে-বাইরে আলোচনা আছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় ও কূটনীতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পাল্টে নির্বাচনের স্বার্থে প্রয়োজনে সংবিধানের বাইরে যেতে হবে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে চলেছে। ওই সূত্রগুলো দাবি করেছে, গত মাসের শেষের দিকে অথবা চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাসভবনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পিটার হাস ওই বৈঠকে রাজনৈতিক সমঝোতায় না আসলে সব দলের অংশগ্রহণে জাতীয় সরকারের আদলে একটা কিছু করার বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছেন। তা না হলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানসম্মত করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও দেওয়া হয়েছে। আনিসুল হকের সঙ্গে শ্রম আইন নিয়েও দীর্ঘ আলাপ করেন এ রাষ্ট্রদূত।
আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের ওই প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে গেলে তাতে বড় আপত্তি তোলা হয়। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এটা ধরেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরুর বার্তা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে। তারা স্বীকার করেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্রমেই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তবে নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা করবে ধরে নিয়েই সরকারি দল আওয়ামী লীগ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পিটার হাস সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও নির্ধারিত-অনির্ধারিত বৈঠক করা শুরু করেছেন। গত সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে পিটার হাসকে উদ্দেশ্য করে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে আইনি ব্যবস্থা নেবে সরকার।
আগামী নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় হয়ে ওঠার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর এক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘নাহি ছাড়ি’ অবস্থান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে।
সরকারের দুই মন্ত্রীও দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের বিপক্ষে যেতে শুরু করেছে। ‘অন্যায় হস্তক্ষেপ’ বেড়েছে পিটার হাসের।
আওয়ামী লীগের কূটনীতিসম্পৃক্ত এক নেতা বলেন, সরকার বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কাজ করে চলেছে। বিকল্প দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে নির্বাচন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে মাইনাস করে চলার এক ধরনের কৌশল গ্রহণ করা হবে। এ কৌশলে নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রর সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করা হবে নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর আরেক সদস্য দেশ রূপান্তরকে বলেন, ভিসানীতি মূলত সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। অনেকেই ভিসানীতিকে সব গেল বলে ধরে নিয়ে অবস্থান টলমলে করে তুলতে চায়। এরকম অবস্থা আওয়ামী লীগকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সমালোচনা নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ কি তাদের অবস্থান থেকে সরতে শুরু করবে? আবার প্রশ্নও আছে যে, নির্বাচন কি হবে? জাতীয় সরকার আসবে খুব শিগগিরই, এমন গুঞ্জনও রয়েছে জোরালোভাবে। শুধু তাই নয়, বাতিল হওয়া নির্বাচন পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এমন গুঞ্জনও শুরু হয়েছে। যদিও এসবে কোনো ভিত্তি রয়েছে মনে করেন না আওয়ামী লীগ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তারা দাবি করেন, সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে। এ ইস্যুতে কোনো শক্তির সঙ্গেই আপস করবেন না আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, কোনো দেশের চাওয়ায় বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন হবে না। দেশের মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সংবিধানসম্মতভাবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, সবার মতো করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে বদ্ধপরিকর।
কূটনীতিসম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের আরেক নেতা বলেন, দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে মনে করা হলেও সেপ্টেম্বরের আগে পশ্চিমা এ দেশটি তার চূড়ান্ত অবস্থান পরিষ্কার করবে না বলে তারা মনে করছেন। ওই নেতা বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারত সফর রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। মূলত সেই সফরেই বোঝা যাবে সরকার কোনদিকে যাবে। এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের ডিপ্লোম্যাসি (পররাষ্ট্রনীতি) পরস্পরের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নীতি। কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশি-বিদেশি অনেক নেতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। সেই আস্থা-বিশ্বাসও প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমাদের রয়েছে।’
এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে না ওঠায় সরকার ও আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করতেন, দেশটিকে তারা বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রমাণ করে না যে, ক্ষমতাধর দেশটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের বোঝাপড়া ঠিক আছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণার পরই দেশটির অবস্থান আওয়ামী লীগের পক্ষে আছে এমন কথা কেউ আর বিশ্বাস করছে না।
আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমেরিকাকে মাইনাস ধরেই এগিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আগের চেয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে তারা ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি একটাই বুঝি, একটাই জানি, আগামী নির্বাচন সংবিধানসম্মতভাবেই হবে। এ জায়গা থেকে একটুও নড়বে না সরকার।’
রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁ থেকে জামায়াতে ইসলামীর বনানী শাখার ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
তাদের মধ্যে বনানী থানা জামায়াতের আমির তাজুল ইসলাম এবং সেক্রেটারি আব্দুর রাফি রয়েছেন।
বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ওয়ারলেস গেটে অবস্থিত নবাবী রেস্টুরেন্টে গোপন মিটিং করাকালে বনানী থানা জামায়াতে ইসলামী আমির তাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা রাফিসহ ১০ নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটক ১০ জনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাও রয়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদরের বেলগাছা ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে সিমিত চন্দ্র (১২) নামের এক স্কুলছাত্রের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার (৭ জুন) ভোরে ওই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বেলগাছা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত এক কিশোরকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে।
পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া সিমিত চন্দ্র বেলগাছা গ্রামের মানিক চন্দ্র ড্রাইভারের ছেলে। অভিযুক্ত কিশোর (১৬) একই গ্রামের প্রদীপ চন্দ্রের (দর্জি) ছেলে।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আর সাঈদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের গীতা সংঘ অনুষ্ঠান দেখতে যায় সিমিত ও তার বড় ভাই। সিমিতকে অনুষ্ঠানস্থলে রেখে বাড়িতে ফেরে তার বড় ভাই। পরে অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে সিমিতের সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরের কথা কাটাকাটি হয়। এ ঘটনায় সিমিতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ওই কিশোর। পরে তাদের একটি পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের গর্তে সিমিতের মরদেহ পুতে রাখে। অনুষ্ঠান শেষে সিমিত বাড়িতে না ফিরলে স্বজনরা তার খোঁজে বের হয়। অভিযুক্ত কিশোরকে সিমিতের বিষয়ে জিজ্ঞাস করলে সে অসংলগ্ন আচরণ করে। পরে তার বাবা প্রদীপ চন্দ্র তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির পেছনের একটি গর্তে সিমিতের মরদেহ দেখিয়ে দেন। বুধবার ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ উদ্ধার করে।
আটক কিশোরের স্বীকারোক্তিতে সদর থানার ওসি এম আর সাঈদ বলেন, অভিযুক্ত কিশোরের সঙ্গে একটি মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু মেয়েটির অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। এ নিয়ে সিমিতসহ অনেকেই ওই কিশোরকে খোঁচা দিত। গত রাতে সিমিত ওই কিশোরের সাথে এ নিয়ে আবারও খোঁচা দিলে সে সিমিতের গলা চেপে ধরে। এত শ্বাসরোধ হয়ে শিশুটি মারা যায়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কিশোর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনা স্বীকার করেছে। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৩ ধরনের জ্বালানি তেল ও পেট্রোলিয়াম পণ্যের ওপর থেকে বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর প্রত্যাহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার। অন্যদিকে উৎপাদন পর্যায়ে তরল করা পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেল আমদানিতে প্রতি লিটারে ১৩ দশমিক ৭৫ টাকা করে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ ছাড়া অন্যান্য জ্বালানি জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল, লুব বেইজ অয়েল, কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রতি টনে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এসব জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ ছিল।
আমদানি করা পণ্যের যথাযথ মূল্য নির্ধারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ও ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাত দুটি হেডিংয়ের আওতায় ১২টি এইচএস কোডের বিপরীতে ট্যারিফ মূল্য এবং একটি হেডিংয়ের আওতায় একটি এইচএস কোডের বিপরীতে ন্যূনতম মূল্য বহাল আছে।
পেট্রোলিয়াম ও এর উপজাতগুলোর মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিনিয়ত ওঠানামা করার কারণে অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
এলপিজি সিলিন্ডারের বিষয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল ইস্পাতের পাত (স্টিল শিট) ও ওয়েল্ডিংয়ের তার আমদানির করছাড় সুবিধা তুলে নেওয়া হয়েছে। এলপিজি সিলিন্ডার উৎপাদনকারীরা কাঁচামালে শুল্ককর ছাড় ১২ বছর ধরে ভোগ করে আসছে। তাই রাজস্ব আহরণের স্বার্থে শুধু দুটি উপকরণে ছাড় তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে অন্যান্য করছাড়ের মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে।
পেট্রোলিয়াম তেল এবং বিটুমিনাস খনিজ থেকে প্রাপ্ত তেলের ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫ শতাংশ। নতুন বাজেট অনুযায়ী এসবের প্রতি ব্যারেলের দাম ১ হাজার ১১৭ টাকা (লিটার প্রতি ৭.০২ টাকা) হতে পারে। প্রতি টন ফার্নেস অয়েলের সুনির্দিষ্ট শুল্ক ৯ হাজার ১০৮ টাকা (লিটার প্রতি ৯.১০ টাকা) করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য নতুন অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার ৮২৫ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং জ্বালানি খাতে ৯৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা নতুন বাজেটে এই বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৭ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, উৎপাদন ও বিতরণ সক্ষমতা সম্প্রসারণের ফলে দেশের শতভাগ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২০০৯ সালে ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বর্তমানে ২৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, তরল জ্বালানি, দ্বৈত জ্বালানি, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রামপালে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিট ও পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে মোট ১২ হাজার ৯৪ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৩৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন এবং ২ হাজার ৪১৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া, ১০ হাজার ৪৪৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ৩৪টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
মুস্তফা কামাল বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে পাশর্^বর্তী দেশগুলো থেকে প্রায় ৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে ভারত থেকে ১১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পাশাপাশি ঝাড়খ-ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। নেপালের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশ, ভুটান ও ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক সই হতে যাচ্ছে শিগগিরই। তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন নিশ্চিত করতে পারব বলে আশা করছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া ২০৪১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে সংগ্রহ করতে চাই। এরসঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, ৬০ লাখ সোলার সিস্টেম স্থাপনের মাধ্যমে অফ গ্রিড এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে বিদ্যুৎ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ডিজেলচালিত পাম্পের জায়গায় সৌরচালিত পাম্প স্থাপন করার অংশ হিসেবে সেচকাজে ইতিমধ্যে ২ হাজার ৫৭০টি পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৮৯৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সর্বোপরি, রাশিয়ার সহায়তায় রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।’
উৎপাদিত বিদ্যুৎ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে গত ১৪ বছরে ৬ হাজার ৬৪৪ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, সঞ্চালন লাইন ১৪ হাজার ৬৪৪ কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া বিতরণ লাইন ৩ লাখ ৬৯ হাজার থেকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার কিলোমিটারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুতের সিস্টেমলস ১৪ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার কিলোমিটারে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের অপব্যবহার রোধের লক্ষ্যে গত ৫ বছরে প্রায় ৫৩ লাখ প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার স্থাপন করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী কামাল বলেন, ২০০৯ সালের তুলনায়, জ্বালানি তেলের মজুদ ক্ষমতা ৮ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন থেকে বৃদ্ধি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৬০ হাজার টন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই মজুদ ক্ষমতা ৩০ দিনের পরিবর্তে ৬০ দিনে বাড়ানোর বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি উদ্বোধন করা ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইনের মাধ্যমে আমদানি করা জ্বালানি তেল (ডিজেল) দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এবং সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ‘একমাত্র তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন থেকে ৪৫ লাখ টনে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। পায়রা সমুদ্রবন্দর এলাকায় একটি বৃহৎ সমন্বিত তেল শোধনাগার স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণের সিদ্ধান্ত আছে। সম্প্রতি ভোলার ইলিশা গ্যাসক্ষেত্রে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় প্রতিদিন গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর পর দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ৯৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট বেড়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে আরও ৪৬টি কূপ খনন করা হবে। এতে অতিরিক্ত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মুস্তাফা কামাল বলেন, ‘সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন হওয়ায় আমরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি এবং স্পট মার্কেট থেকেও কেনা হচ্ছে। এছাড়া কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ড বেইজড এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বাজেট বক্তৃতায় আরও বলা হয়, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও অন্যান্য এলাকায় ২১৪ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণের কাজ চলছে। ২০২৬ সালের মধ্যে পায়রা ও ভোলা থেকে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য আরও ৪২৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় রোধে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের কাজও চলছে।
চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরের সামগ্রিক বাজেট আকারে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হলেও আগামী বছরের শিক্ষা-বাজেট দশমিক ৪৪ শতাংশ কমেছে। তবে টাকার অঙ্কে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৬ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা বেড়েছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে মোট বাজেটের ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু শিক্ষা খাত হিসাব করলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। টাকার অঙ্কে তা ৮৮ হাজার ১৬২ কোটি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ১২ দশমিক ০১ শতাংশ বা ৮১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা।
ইউনেস্কো, শিক্ষাবিদ বা অংশীজনরা অনেক দিন ধরেই শিক্ষায় জিডিপির কমপক্ষে ৪ শতাংশ বরাদ্দের কথা বলছেন। এটাকে তারা বরাদ্দ হিসেবে না দেখে আগামী দিনের বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে বলছেন। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষায় বরাদ্দ ১২ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছিল। জিডিপির হিসাবে তা ছিল ২ শতাংশের কাছাকাছি। চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়াচ্ছে জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগামী বাজেটে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে, তার সঙ্গে শিক্ষায় বরাদ্দের সংগতি নেই। বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। এজন্য দক্ষ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কিন্তু এ জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ। বরাবরের মতো এবারও শুভংকরের ফাঁকি লক্ষ করছি। শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে আকার বড় করা হলেও চলতি অর্থবছরের চেয়েও বরাদ্দ কমেছে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও বাজেটে দিকনির্দেশনা দেখছি না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষায় জিডিপির ২ শতাংশের নিচে বরাদ্দ কাক্সিক্ষত নয়। আগামী অর্থবছরে অন্তত ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ দিলে ভালো হতো। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত ছিল। সেটা আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেখা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের বাজেটে মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে, যা খুবই ভালো। যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণে জোর দিতে হবে। শিক্ষায় বরাদ্দের সঠিক ব্যবহারের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আগামী অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে তা ছিল ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৪২ হাজার ৮৩৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের জন্য ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের জন্য ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার।
বাজেট ঘিরে প্রতি বছরই বেসরকারি শিক্ষকদের অন্যতম দাবি থাকে শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ বাড়ি ভাড়া ও শতভাগ উৎসব-ভাতা প্রদান। নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রাখাও তাদের অন্যতম দাবি। কিন্তু সেসব বিষয়ে বাজেটে স্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। তবে এমপিওভুক্তির জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে আগামী অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য খাতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দ বেড়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে এবার বরাদ্দ ১ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা বা ৩ দশমিক ২২ শতাংশ বাড়লেও মোট বাজেটের তুলনায় তা কমেছে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে খাতটিতে বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী বাজেটে তা ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় সংসদে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাজেটে স্বাস্থ্যসেবা এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ১৫০ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় ১৭ হাজার ২২১ কোটি টাকা ও উন্নয়ন ব্যয় ১২ হাজার ২১০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্য-শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এই বরাদ্দ থেকেই নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, এবার টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় (বর্তমান ২০২২-২৩ অর্থবছর) ১ হাজার একশ কোটির মতো বেড়েছে। কিন্তু বাজেট শেয়ারে সেটা কমেছে। সামগ্রিক বাজেটের গ্রোথ বা বৃদ্ধি ১২ শতাংশ, কিন্তু স্বাস্থ্যের বাজেটের বৃদ্ধি ৩ শতাংশ। তারমানে রাষ্ট্রীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব কমেছে। সেই কারণে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, এবার কমার যৌক্তিক কারণ আছে। সেটা হলো স্বাস্থ্য বিভাগের সেক্টর প্রোগ্রামে উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ আসে। সেই সেক্টর প্রোগ্রাম এই অর্থবছরে শেষ হয়ে প্রস্তাবিত অর্থবছর থেকে নতুন সেক্টর প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান সেক্টর প্রোগ্রাম সময়মতো বাস্তবায়ন করতে না পারায় সেটার সময় আরও এক বছর বাড়ানো হয়েছে। এই এক বছরের জন্য নতুন বাজেট থাকে না, পুরনো বাজেট থেকেই ব্যয় করতে হয়। ফলে বরাদ্দ না বাড়িয়ে পাঁচ বছরের বাজেট যদি ছয় বছরে গিয়ে ঠেকে, তাহলে প্রতি বছর টাকা কমে যায়। মূলত এ কারণে এবার টাকা কমে গেছে।
সরকার স্বাস্থ্য খাতে এবারও কিছু থোক বরাদ্দ রাখতে পারত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অর্থনীতির এই শিক্ষক। তিনি বলেন, কভিড ছাড়াও আমাদের অনেক জরুরি খাত আছে। এখন ডেঙ্গু চলছে। এটি ইমার্জেন্সি হয়ে যাবে। ফলে এটার জন্য যে ফান্ড দেওয়া আছে হাসপাতালে, রোগী বাড়লে সেটা দিয়ে হবে না। এরকম ইমার্জেন্সি আরও আসতে পারে। এরকম একটা থোক বরাদ্দ রাখলে স্বাস্থ্যের ইমার্জেন্সিতে সেখান থেকে ব্যয় করা যেত। কিন্তু সেটাও নেই। তার মানে কভিডের শিক্ষা থেকে আমরা কিছুই শিখিনি। প্রস্তাবিত বাজেটে সেটার প্রতিফলন নেই।
সামগ্রিকভাবে বাজেটে রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাবে বলেও মনে করছেন এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, এতে স্বাস্থ্যসেবা ও ওষুধসহ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
যদিও এবারের বাজেটে ওষুধ, চিকিৎসাসামগ্রী ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসা আরও সুলভ করার জন্য ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, আইভি ক্যানুলা উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপাদান সিলিকন টিউবসহ আরও কিছু বিদ্যমান ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তামাক জাতীয় পণ্য যেমন তরল নিকোটিন, ট্রান্সডারমাল ইউস নিকোটিন পণ্যের বিপরীতে ১৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খরচ বাড়ছে। কোনো যাত্রী আকাশপথে ভ্রমণ করলেই তাকে দিতে হবে ২০০ টাকার কর। একই সঙ্গে বিদেশগামী বিমানযাত্রীদের কর ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে সরকারের তৃতীয় মেয়াদের শেষ (২০২৩-২৪ অর্থবছর) বাজেট উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এদিকে পর্যটন খাত ও বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে।
পর্যটন খাত : অর্থমন্ত্রীর তার
বক্তৃতায় বলেন, ডলার সাশ্রয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ হ্রাস করা, কৃচ্ছ্রতার অভ্যাস গড়ে তোলা এবং নতুন রাজস্ব আয়ের খাত তৈরি করতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণ কর ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ৩৩ শতাংশ বেড়ে ৪ হাজার এবং অন্যান্য দেশে ৫০ শতাংশ বেড়ে ৬ হাজার টাকা ভ্রমণ কর দিতে হবে।
পর্যটন খাত নিয়ে ব্যাপক পরিকল্পনা : অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় আরও বলেছেন, পর্যটন খাতকে সমৃদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিক মানের আবাসন ও বিনোদন সুবিধা নিয়ে কক্সবাজার জেলায় সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় দেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে এ শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকার ১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে। বাংলাদেশে পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোতে উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে একটি পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পর্যটনের উন্নয়ন ও বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ৩৬টি জেলার পর্যটন ব্র্যান্ডিং অনুসারে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার পর্যটন এলাকার ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানগুলো সংরক্ষণে এবং পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান বিষয়ে ডকুমেন্টারি ও টেলিভিশন কমার্শিয়াল প্রস্তুত করা হচ্ছে।
বিমানবহর সম্প্রসারণ ও বিমানবন্দর উন্নয়ন : অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের বিমান পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। আকাশপথে যাত্রীদের চাহিদা বিবেচনায় চলতি বছরে মালদ্বীপ ও কানাডার টরন্টোতে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণকাজ ২০২৩ সালের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বর্তমানে দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে রানওয়ে সম্প্রসারণ ও নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করে সেখানে একটি আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবকাঠামো, রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, হ্যাঙ্গার ও আমদানি-রপ্তানি পণ্য সংরক্ষণের শেডগুলো সংস্কার ও উন্নয়নসাধনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।