বিচারফলের জ্ঞানকাণ্ড
মঈদুল ইসলাম | ১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
জ্ঞান বাবু মারা গেলেন। একদা আমার আদালতে বিচারপ্রার্থী বাদী ছিলেন। তার আগে তিনিই ছিলেন সেই আদালতের বিচারক, সেকালের মুন্সেফ। গত সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১ জীবনাবসান হয়েছে তার। মুন্সেফগিরির অবসান হয়েছিল একেবারে শুরুতেই। ছাঁটাই (কেতাবি ভাষায় টারমিনেট) করা হয়েছিল জ্ঞানেন্দ্র নাথ বাঁড়ৈকে বিনা নোটিসে। বিসিএস (জুডিশিয়াল) ১৯৭৬ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়ে মুন্সেফ হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৭-এর ২৬ এপ্রিল। যশোরে শিক্ষানবিশি শেষে সে-বছরেই ২২ আগস্টের আদেশে নড়াইল দ্বিতীয় মুন্সেফ আদালতে এসে মুন্সেফি শুরু করেন। ১৯৭৮-এর ৩০ এপ্রিলেই তার মুন্সেফি সাফ হয় আমাদের আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ের ১২ এপ্রিলের এক খোঁচাতে। বে-ইনসাফি কিছু করেছিলেন! জি-না। তবে গোস্তাকি মস্ত কিছু! জি-না। কসুর কিছু! তবে তো আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ের সেই ইংরেজি আদেশটা একবার দেখতে হয়:
“Whereas Mr. Jnanedra Nath Barai, son of late Jadu Nath Barai, Now Munsif, Narail in the District of Jessore was appointed on ad-hoc basis as temporary Munsif; and Whereas the appointment of the said Jnanendra Nath Barai is terminable without showing any reason whatsoever; Now therefore, the Government is pleased to terminate the temporary appointment as Munsif of the said Mr. Jnanendra Nath Barai with effect from the afternoon of the 30th April, 1978.
By order of the President,
A.R Cowdhury, Secretary
Ministry of Law, Justice and Parliament Affairs.’’
সোজা কথা আইন-বিচারের মাননীয় সচিবের, জ্ঞান বাবুকে নিয়োগটা দান করা হয়েছিল ক্ষণিকের বিশেষ প্রয়োজনে অস্থায়ী মুন্সেফিতে, যেটা কারণ দর্শানো ছাড়াই অবসানযোগ্য তাই, সরকার বাহাদুর এখন খুশির চোটে তার সেই মুন্সেফগিরি ১৯৭৮ এর ৩০ এপ্রিল বিকেল থেকে ছুটিয়ে দিয়েছে। কসুর তবে কার কীসে! জনস্বার্থের নামে এসব কাম চালাবার কায়দা রপ্ত হয়নি তখনো বোধ করি! নড়াইলে সদর সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে বিচারকাজে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৯৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর। নভেম্বর গেছে বাসা জোটানো আর গোছানোর ঝামেলা মাথায় নিয়ে। ডিসেম্বরটা সিভিল কোর্ট ভ্যাকেশন। কাজ শুরু বলতে গেলে ১৯৯৫ থেকে। এপ্রিল-মে’র দিকে একদিন সাক্ষী-শুনানি সব শেষ করে স্বভাবমতো জানতে চাইলাম, আর কী আছে! পেশকার জানালেন, ৫/৬টা ‘পিএইচ’-এর মামলা আছে, সবটাতেই ‘টাইম পিটিশন’, অনাপত্তি অপরপক্ষের। চলে গেছেন দু-পক্ষের আইনজীবী একসঙ্গে মিলে। কোনো পক্ষেই কেউ নেই এজলাসে। মহাখুশিতে এজলাস থেকে নেমে যাওয়াই রেওয়াজ বেশির ভাগের। বাদী-বিবাদী রাজি তো কেয়া করেগা কাজি! সংখ্যালঘু আমি বরাবরই, আমার পড়ে নারাজি। দেন তো দেখি, কী মামলা কত দিনের! দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল মোটাসোটা এক নথি। মোটা দেখলে হুজুররা ঘাঁটেন না এমনিতেই, অনাপত্তির টাইম পিটিশনে আর কী দেখার থাকে! এমনটাই জানা পেশকারের। আমার জানা, নথি মোটা হয় ঐ টাইম পিটিশন আর হাজিরার ভারে। মামলার আরজি-জবাব, হাজিরা-পিটিশন, দলিল-দস্তাবেজ ‘এ’ থেকে ‘ডি’ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ফাইলে ভাগ করার নির্দেশনা আছে সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারসের ১৭ নম্বর চ্যাপ্টারে। ভাগ করে রাখা পাইনি কোনোখানেই, আমি গিয়েই করিয়েছি সেরেস্তাদার-পেশকারদের। এখানেও তাই। দেখলাম মামলাটা ১৯৭৮ সালের, ১৯৭৯-তে ‘পিএইচ’-এ উঠে চলছে শুধু টাইম পিটিশনেই।
‘পিএইচ’ বলা হয় আদালতে সংক্ষেপে ‘পিরিয়েম্পটরি হেয়ারিং’, মানে চূড়ান্ত শুনানি, মানে সাক্ষীসাবুত দেওয়া-নেওয়ার শুনানিকে। আরজি লাগালেই তো সাক্ষী শুরু হয় না। লিখিত জবাব আসতে হবে বিবাদীর, সেটা এলে হবে ইস্যু (বিচার্য বিষয়) গঠন। তারপরেই হওয়ার কথা সাক্ষীসাবুতের পালা। কিন্তু, বছর দেড়েকের আগে সাক্ষীর দিন ফেলার জায়গা থাকে না আদালতের ডায়েরিতে মামলার চাপে। এখন তবে কী হবে! থাকবে ‘এসডি’-তে, মানে ‘সেটলিং ডেট ফর পিএইচ’। সাক্ষীর জন্য কবে দিন পড়বে তাই ঠিক করার দিন পড়তে থাকবে দু-তিন মাসে মাসে। ডায়েরিতে জায়গা হলে একদিন ‘পিএইচ’-এ উঠবে। ‘পিএইচ’-এ উঠলেই তো হলো না, সাক্ষী চলবে তো আগে ‘এফপিএইচ’-এর। দু-তিন মাসে মাসে ‘পিএইচ’-এ পড়তে পড়তে এক-আধটু সাক্ষী-শুনানি হলে পরে হয় ‘এফপিএইচ’, ‘ফার্দার পিরিয়েম্পটরি হেয়ারিং’। মানে আরও সাক্ষী-শুনানি চলবে। এইটাকে আবার ‘পার্ট হার্ড’-ও বলে, আংশিক শুনানি বাকি থাকল। এইবার শুরু আসল শুনানি, কোনো একদিন শেষ হওয়ার ভরসা। এত সব হ্যাপা পার করে ’৭৮ সালের মামলাটা ’৭৯-তে ‘পিএইচ’-এ উঠে পড়ে আছে ‘পিএইচ’-এই! এক-আধটু সাক্ষী-শুনানি করারও ফুরসত হয়নি ১৭ বছরে! নিশ্চয়ই মেরিট নেই, মামলা বাধিয়ে বাদী টাইম কাটাচ্ছে! কিন্তু, হাইকোর্ট যাওয়া-আসা হয়নি একবারও, খারিজ-ছানি নেই একটাও। ১৭ বছর ধরে শুধু টাইম পিটিশন মঞ্জুরই চলছে! আবারও টাইম পিটিশন! আর কত? ডেকে আনালাম পিটিশনকারী বাদীর আইনজীবী সুবাস বোসকে। বলি, ব্যাপার কী? মামলা করে শুধু টাইম পিটিশনই চালাচ্ছেন? বললেন, হুজুররা করতে না চাইলে তো টাইম পিটিশনই চলে! বাদী ঘুরে ঘুরে এসব দেখে আশা ছেড়ে আসাও ছেড়ে দিয়ে ফরিদপুরে ওকালতি করছে। টাইম পিটিশন দিয়ে আমিই চালিয়ে যাচ্ছি, যদি কোনোদিন কোনো হুজুরে করেন। হুজুর কি করবেন? বলি, কেন, না করার কী আছে? বললেন, হুজুর শুধু সালই দেখলেন, আরজিটা একটু দেখেন। দেখি, ১৯৭৮ সালের ৪৫৫ নম্বর এই দেওয়ানি মামলার বাদী নড়াইলের সাবেক মুন্সেফ জ্ঞানেন্দ্র নাথ বাঁড়ৈই। বিবাদী আছে ১ নম্বরেই আইন-বিচার সচিব, ২ নম্বরে স্বরাষ্ট্র সচিব, সবশেষ ৩ নম্বরে নড়াইলের জেলা প্রশাসক। দাবি, মুন্সেফি থেকে তাকে ছাঁটাইয়ের আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশটা বেআইনি, অকার্যকর এবং মুন্সেফিতে তিনি বহাল আছেন বলে ঘোষণার ডিক্রি।
মামলা বহুতই গম্ভীর! বিচারীর বিরুদ্ধে বিচারীর আনা মামলার বিচার করতে হবে বিচারীকে! হুজুরকে দেখিয়া হুজুরেরা দুরুদুরু! টাইম কাটায়েছে টাইম পিটিশনে! ১৭ বছর মামলা পড়ে আছে বিনা বিচারে। এ কি রঙ্গালয় না বিচারালয়! বিচার হবে মামলার মেরিট দেখে, হুজুর মজুর দেখার কী আছে? ঘোর অবিচার বিচারালয়ে! ধিক্কার জানাব কোন ভাষাতে! বলি, বাদীকে বলুন সামনের দিন হাজির থাকতে, না হলে মামলা খারিজ হবে। মাসখানেকের টাইম দিতে হলো। পরের তারিখও পার করে বাদী হাজির হলেন পরের তারিখে। শোনা হলো দুপক্ষের মামলা। বাদীর দাবি, তার বাপ-দাদা চোদ্দপুরুষ এদেশে ফরিদপুরের কোটালীপাড়ার চালিকাবাড়ি গ্রামের আজন্ম অধিবাসী, তারও জন্ম সেখানেই ১৯৪৯-এর ১৫ জানুয়ারি। ১৯৬৪-তে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণের দায়ে আশ্রয় নেন ভারতে। লেখাপড়া করেন চব্বিশ পরগনার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে, সেখান থেকে ১৯৬৭-তে এস.এস.সি এবং শেষে ১৯৭০-এ বি.এ পাস করেন। ১৯৭২-এ ফেরেন নিজ দেশে। বরিশালের ডিডিপিআই (ডেপুটি ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন, এখনকার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা উপ-পরিচালক)-এর অনুমোদিত নিয়োগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর পিএন স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকরিতে লাগেন। ১৯৭৬-এ খুলনা সিটি ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে বার কাউন্সিলের সনদ পেয়ে পটুয়াখালী জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। বিসিএস (জুডিশিয়াল) ১৯৭৬ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়ে পাস করে মুন্সেফ হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৭-এর ২৬ এপ্রিল। যশোরে শিক্ষানবিশি শেষে সে-বছরই ২২ আগস্টের আদেশে নড়াইল দ্বিতীয় মুন্সেফ আদালতে এসে ইনসাফের সঙ্গে মুন্সেফি করছিলেন। পুলিশ ভেরিফিকেশনের মিথ্যা এক রিপোর্টে আইন-বিচার মন্ত্রণালয় জবাব না চেয়েই তাকে ১৯৭৮-এর ১২ এপ্রিল টারমিনেট করেছে বেআইনি ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থীভাবে । তিন বিবাদী মিলে সরকারের অজুহাত, ১৯৫৩-তে বাবা মারা গেলে বাদী আর তার ভাই বসতবাড়ি, জমিজিরাত বিক্রি করে ভারতে যায় চিরতরে। সেই থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত এদেশে বাদীর কোনো স্থায়ী নিবাস ছিল না। বাদী আর এদেশের নয় ভারতের নাগরিক। ১৯৭২-এ দেশে ঢুকেছে অবৈধপথে। এসবের সঙ্গে ভারতে শিক্ষালাভের কথাও চেপে রেখে বিসিএস (জুডিশিয়াল) পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করায় তাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে মুন্সেফ নিয়োগ দেওয়া হয় পুলিশ ভেরিফিকেশন সাপেক্ষে। পুলিশ ভেরিফিকেশনে আসল সত্যটা বেরিয়ে এসেছে। বাদীর অস্থায়ী নিয়োগ ছিল বিনা নোটিসে টারমিনেট করার শর্তেই, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও তার চাকরি ক্ষতিকর বলে সংবিধানের ১৩৫(২)(ই) অনুচ্ছেদের বলে আইন ও ন্যায়সংগতভাবেই তাকে টারমিনেট করা হয়েছে।
মামলা তো দেখি মহা কঠিন! বাদীর আইনজীবীকে বলি, শুধু ঘোষণার ডিক্রিই চাইলেন! তাতেই যদি মুন্সেফিতে বহাল না করে তো কী করার থাকবে! ডিক্রি তো হবে আসলেই কাগুজে। আদালত কি বেকার আওয়াজ দেবে! বুঝলেন তিনি নিজের ভুল, কাম হয় না এমন ডিক্রি কোর্ট দেয় না (''Court not to pass a decree which may be infructuous.'') ফ্যাঁকড়ার ফাঁক বন্ধ করার আছে। বললেন, সামনের তারিখে পুনর্বহালের নির্দেশনার প্রার্থনা যোগ করে দেবেন। মামলার আটঘাট আগেই দেখে নেওয়া আমার স্বভাব, সারাবার মতো ফাঁকফোকর আগেই সারিয়ে বিচার হবে আইনে, মেরিটে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল হয়েছে ১৯৮০-র আইনে ১৯৮১-তে। তার আগের মামলা যেখানে ছিল সেখানেই চলবে। সুতরাং সাবেক মুন্সেফের ছাঁটাইয়ের মামলাটা দেওয়ানিতেই চলবে। ‘পার্ট হার্ড’ হলো মামলা। বাদীর নিজের ওকালতি আছে ফরিদপুরে, টাইম হলো মাসখানেকের। (পরবর্তী অংশ আগামী কিস্তিতে)
লেখক প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক
শেয়ার করুন
মঈদুল ইসলাম | ১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

জ্ঞান বাবু মারা গেলেন। একদা আমার আদালতে বিচারপ্রার্থী বাদী ছিলেন। তার আগে তিনিই ছিলেন সেই আদালতের বিচারক, সেকালের মুন্সেফ। গত সোমবার, ২২ নভেম্বর ২০২১ জীবনাবসান হয়েছে তার। মুন্সেফগিরির অবসান হয়েছিল একেবারে শুরুতেই। ছাঁটাই (কেতাবি ভাষায় টারমিনেট) করা হয়েছিল জ্ঞানেন্দ্র নাথ বাঁড়ৈকে বিনা নোটিসে। বিসিএস (জুডিশিয়াল) ১৯৭৬ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়ে মুন্সেফ হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৭-এর ২৬ এপ্রিল। যশোরে শিক্ষানবিশি শেষে সে-বছরেই ২২ আগস্টের আদেশে নড়াইল দ্বিতীয় মুন্সেফ আদালতে এসে মুন্সেফি শুরু করেন। ১৯৭৮-এর ৩০ এপ্রিলেই তার মুন্সেফি সাফ হয় আমাদের আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ের ১২ এপ্রিলের এক খোঁচাতে। বে-ইনসাফি কিছু করেছিলেন! জি-না। তবে গোস্তাকি মস্ত কিছু! জি-না। কসুর কিছু! তবে তো আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ের সেই ইংরেজি আদেশটা একবার দেখতে হয়:
“Whereas Mr. Jnanedra Nath Barai, son of late Jadu Nath Barai, Now Munsif, Narail in the District of Jessore was appointed on ad-hoc basis as temporary Munsif; and Whereas the appointment of the said Jnanendra Nath Barai is terminable without showing any reason whatsoever; Now therefore, the Government is pleased to terminate the temporary appointment as Munsif of the said Mr. Jnanendra Nath Barai with effect from the afternoon of the 30th April, 1978.
By order of the President,
A.R Cowdhury, Secretary
Ministry of Law, Justice and Parliament Affairs.’’
সোজা কথা আইন-বিচারের মাননীয় সচিবের, জ্ঞান বাবুকে নিয়োগটা দান করা হয়েছিল ক্ষণিকের বিশেষ প্রয়োজনে অস্থায়ী মুন্সেফিতে, যেটা কারণ দর্শানো ছাড়াই অবসানযোগ্য তাই, সরকার বাহাদুর এখন খুশির চোটে তার সেই মুন্সেফগিরি ১৯৭৮ এর ৩০ এপ্রিল বিকেল থেকে ছুটিয়ে দিয়েছে। কসুর তবে কার কীসে! জনস্বার্থের নামে এসব কাম চালাবার কায়দা রপ্ত হয়নি তখনো বোধ করি! নড়াইলে সদর সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে বিচারকাজে যোগ দিয়েছিলাম ১৯৯৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর। নভেম্বর গেছে বাসা জোটানো আর গোছানোর ঝামেলা মাথায় নিয়ে। ডিসেম্বরটা সিভিল কোর্ট ভ্যাকেশন। কাজ শুরু বলতে গেলে ১৯৯৫ থেকে। এপ্রিল-মে’র দিকে একদিন সাক্ষী-শুনানি সব শেষ করে স্বভাবমতো জানতে চাইলাম, আর কী আছে! পেশকার জানালেন, ৫/৬টা ‘পিএইচ’-এর মামলা আছে, সবটাতেই ‘টাইম পিটিশন’, অনাপত্তি অপরপক্ষের। চলে গেছেন দু-পক্ষের আইনজীবী একসঙ্গে মিলে। কোনো পক্ষেই কেউ নেই এজলাসে। মহাখুশিতে এজলাস থেকে নেমে যাওয়াই রেওয়াজ বেশির ভাগের। বাদী-বিবাদী রাজি তো কেয়া করেগা কাজি! সংখ্যালঘু আমি বরাবরই, আমার পড়ে নারাজি। দেন তো দেখি, কী মামলা কত দিনের! দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল মোটাসোটা এক নথি। মোটা দেখলে হুজুররা ঘাঁটেন না এমনিতেই, অনাপত্তির টাইম পিটিশনে আর কী দেখার থাকে! এমনটাই জানা পেশকারের। আমার জানা, নথি মোটা হয় ঐ টাইম পিটিশন আর হাজিরার ভারে। মামলার আরজি-জবাব, হাজিরা-পিটিশন, দলিল-দস্তাবেজ ‘এ’ থেকে ‘ডি’ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ফাইলে ভাগ করার নির্দেশনা আছে সিভিল রুলস অ্যান্ড অর্ডারসের ১৭ নম্বর চ্যাপ্টারে। ভাগ করে রাখা পাইনি কোনোখানেই, আমি গিয়েই করিয়েছি সেরেস্তাদার-পেশকারদের। এখানেও তাই। দেখলাম মামলাটা ১৯৭৮ সালের, ১৯৭৯-তে ‘পিএইচ’-এ উঠে চলছে শুধু টাইম পিটিশনেই।
‘পিএইচ’ বলা হয় আদালতে সংক্ষেপে ‘পিরিয়েম্পটরি হেয়ারিং’, মানে চূড়ান্ত শুনানি, মানে সাক্ষীসাবুত দেওয়া-নেওয়ার শুনানিকে। আরজি লাগালেই তো সাক্ষী শুরু হয় না। লিখিত জবাব আসতে হবে বিবাদীর, সেটা এলে হবে ইস্যু (বিচার্য বিষয়) গঠন। তারপরেই হওয়ার কথা সাক্ষীসাবুতের পালা। কিন্তু, বছর দেড়েকের আগে সাক্ষীর দিন ফেলার জায়গা থাকে না আদালতের ডায়েরিতে মামলার চাপে। এখন তবে কী হবে! থাকবে ‘এসডি’-তে, মানে ‘সেটলিং ডেট ফর পিএইচ’। সাক্ষীর জন্য কবে দিন পড়বে তাই ঠিক করার দিন পড়তে থাকবে দু-তিন মাসে মাসে। ডায়েরিতে জায়গা হলে একদিন ‘পিএইচ’-এ উঠবে। ‘পিএইচ’-এ উঠলেই তো হলো না, সাক্ষী চলবে তো আগে ‘এফপিএইচ’-এর। দু-তিন মাসে মাসে ‘পিএইচ’-এ পড়তে পড়তে এক-আধটু সাক্ষী-শুনানি হলে পরে হয় ‘এফপিএইচ’, ‘ফার্দার পিরিয়েম্পটরি হেয়ারিং’। মানে আরও সাক্ষী-শুনানি চলবে। এইটাকে আবার ‘পার্ট হার্ড’-ও বলে, আংশিক শুনানি বাকি থাকল। এইবার শুরু আসল শুনানি, কোনো একদিন শেষ হওয়ার ভরসা। এত সব হ্যাপা পার করে ’৭৮ সালের মামলাটা ’৭৯-তে ‘পিএইচ’-এ উঠে পড়ে আছে ‘পিএইচ’-এই! এক-আধটু সাক্ষী-শুনানি করারও ফুরসত হয়নি ১৭ বছরে! নিশ্চয়ই মেরিট নেই, মামলা বাধিয়ে বাদী টাইম কাটাচ্ছে! কিন্তু, হাইকোর্ট যাওয়া-আসা হয়নি একবারও, খারিজ-ছানি নেই একটাও। ১৭ বছর ধরে শুধু টাইম পিটিশন মঞ্জুরই চলছে! আবারও টাইম পিটিশন! আর কত? ডেকে আনালাম পিটিশনকারী বাদীর আইনজীবী সুবাস বোসকে। বলি, ব্যাপার কী? মামলা করে শুধু টাইম পিটিশনই চালাচ্ছেন? বললেন, হুজুররা করতে না চাইলে তো টাইম পিটিশনই চলে! বাদী ঘুরে ঘুরে এসব দেখে আশা ছেড়ে আসাও ছেড়ে দিয়ে ফরিদপুরে ওকালতি করছে। টাইম পিটিশন দিয়ে আমিই চালিয়ে যাচ্ছি, যদি কোনোদিন কোনো হুজুরে করেন। হুজুর কি করবেন? বলি, কেন, না করার কী আছে? বললেন, হুজুর শুধু সালই দেখলেন, আরজিটা একটু দেখেন। দেখি, ১৯৭৮ সালের ৪৫৫ নম্বর এই দেওয়ানি মামলার বাদী নড়াইলের সাবেক মুন্সেফ জ্ঞানেন্দ্র নাথ বাঁড়ৈই। বিবাদী আছে ১ নম্বরেই আইন-বিচার সচিব, ২ নম্বরে স্বরাষ্ট্র সচিব, সবশেষ ৩ নম্বরে নড়াইলের জেলা প্রশাসক। দাবি, মুন্সেফি থেকে তাকে ছাঁটাইয়ের আইন-বিচার মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশটা বেআইনি, অকার্যকর এবং মুন্সেফিতে তিনি বহাল আছেন বলে ঘোষণার ডিক্রি।
মামলা বহুতই গম্ভীর! বিচারীর বিরুদ্ধে বিচারীর আনা মামলার বিচার করতে হবে বিচারীকে! হুজুরকে দেখিয়া হুজুরেরা দুরুদুরু! টাইম কাটায়েছে টাইম পিটিশনে! ১৭ বছর মামলা পড়ে আছে বিনা বিচারে। এ কি রঙ্গালয় না বিচারালয়! বিচার হবে মামলার মেরিট দেখে, হুজুর মজুর দেখার কী আছে? ঘোর অবিচার বিচারালয়ে! ধিক্কার জানাব কোন ভাষাতে! বলি, বাদীকে বলুন সামনের দিন হাজির থাকতে, না হলে মামলা খারিজ হবে। মাসখানেকের টাইম দিতে হলো। পরের তারিখও পার করে বাদী হাজির হলেন পরের তারিখে। শোনা হলো দুপক্ষের মামলা। বাদীর দাবি, তার বাপ-দাদা চোদ্দপুরুষ এদেশে ফরিদপুরের কোটালীপাড়ার চালিকাবাড়ি গ্রামের আজন্ম অধিবাসী, তারও জন্ম সেখানেই ১৯৪৯-এর ১৫ জানুয়ারি। ১৯৬৪-তে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণের দায়ে আশ্রয় নেন ভারতে। লেখাপড়া করেন চব্বিশ পরগনার নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে, সেখান থেকে ১৯৬৭-তে এস.এস.সি এবং শেষে ১৯৭০-এ বি.এ পাস করেন। ১৯৭২-এ ফেরেন নিজ দেশে। বরিশালের ডিডিপিআই (ডেপুটি ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন, এখনকার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা উপ-পরিচালক)-এর অনুমোদিত নিয়োগে সাতক্ষীরার শ্যামনগর পিএন স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকরিতে লাগেন। ১৯৭৬-এ খুলনা সিটি ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে ১৯৭৭-এর জানুয়ারিতে বার কাউন্সিলের সনদ পেয়ে পটুয়াখালী জজকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। বিসিএস (জুডিশিয়াল) ১৯৭৬ পরীক্ষায় তৃতীয় হয়ে পাস করে মুন্সেফ হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৭৭-এর ২৬ এপ্রিল। যশোরে শিক্ষানবিশি শেষে সে-বছরই ২২ আগস্টের আদেশে নড়াইল দ্বিতীয় মুন্সেফ আদালতে এসে ইনসাফের সঙ্গে মুন্সেফি করছিলেন। পুলিশ ভেরিফিকেশনের মিথ্যা এক রিপোর্টে আইন-বিচার মন্ত্রণালয় জবাব না চেয়েই তাকে ১৯৭৮-এর ১২ এপ্রিল টারমিনেট করেছে বেআইনি ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থীভাবে । তিন বিবাদী মিলে সরকারের অজুহাত, ১৯৫৩-তে বাবা মারা গেলে বাদী আর তার ভাই বসতবাড়ি, জমিজিরাত বিক্রি করে ভারতে যায় চিরতরে। সেই থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত এদেশে বাদীর কোনো স্থায়ী নিবাস ছিল না। বাদী আর এদেশের নয় ভারতের নাগরিক। ১৯৭২-এ দেশে ঢুকেছে অবৈধপথে। এসবের সঙ্গে ভারতে শিক্ষালাভের কথাও চেপে রেখে বিসিএস (জুডিশিয়াল) পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করায় তাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে মুন্সেফ নিয়োগ দেওয়া হয় পুলিশ ভেরিফিকেশন সাপেক্ষে। পুলিশ ভেরিফিকেশনে আসল সত্যটা বেরিয়ে এসেছে। বাদীর অস্থায়ী নিয়োগ ছিল বিনা নোটিসে টারমিনেট করার শর্তেই, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্যও তার চাকরি ক্ষতিকর বলে সংবিধানের ১৩৫(২)(ই) অনুচ্ছেদের বলে আইন ও ন্যায়সংগতভাবেই তাকে টারমিনেট করা হয়েছে।
মামলা তো দেখি মহা কঠিন! বাদীর আইনজীবীকে বলি, শুধু ঘোষণার ডিক্রিই চাইলেন! তাতেই যদি মুন্সেফিতে বহাল না করে তো কী করার থাকবে! ডিক্রি তো হবে আসলেই কাগুজে। আদালত কি বেকার আওয়াজ দেবে! বুঝলেন তিনি নিজের ভুল, কাম হয় না এমন ডিক্রি কোর্ট দেয় না (''Court not to pass a decree which may be infructuous.'') ফ্যাঁকড়ার ফাঁক বন্ধ করার আছে। বললেন, সামনের তারিখে পুনর্বহালের নির্দেশনার প্রার্থনা যোগ করে দেবেন। মামলার আটঘাট আগেই দেখে নেওয়া আমার স্বভাব, সারাবার মতো ফাঁকফোকর আগেই সারিয়ে বিচার হবে আইনে, মেরিটে। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল হয়েছে ১৯৮০-র আইনে ১৯৮১-তে। তার আগের মামলা যেখানে ছিল সেখানেই চলবে। সুতরাং সাবেক মুন্সেফের ছাঁটাইয়ের মামলাটা দেওয়ানিতেই চলবে। ‘পার্ট হার্ড’ হলো মামলা। বাদীর নিজের ওকালতি আছে ফরিদপুরে, টাইম হলো মাসখানেকের। (পরবর্তী অংশ আগামী কিস্তিতে)
লেখক প্রবন্ধকার ও আইনগ্রন্থকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ও দুদকের সাবেক মহাপরিচালক