বিজয়ের মাসে ‘জয় বাংলা’র সফল প্রত্যাবর্তন হোক
এ কে এম শাহনাওয়াজ | ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০
১৯৭৫-এর পর থেকেই সচেতন বাঙালির আক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শক্তি ‘জয় বাংলা’ সেøাগান কার্যত নির্বাসিত হওয়ায়। দীর্ঘ রাজপথের আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি দেশের যখন জন্ম হয়, তখন অত্যন্ত তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে তার বিভিন্ন পর্যায়ের স্লোগান। স্লোগান শুধু স্লোগান থাকে না হয়ে পড়ে ইতিহাসের আকর সূত্র। কোনো কোনো স্লোগান খন্ডিত সময় আর বিষয়বস্তুকে ধারণ করে আবার কোনোটির ভেতর সামগ্রিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। এই স্লোগান থেকেই প্রজন্ম চলে যেতে পারে ইতিহাসের নির্দিষ্ট সময়কালে। ধারণ করতে পারে তাৎপর্য। জয় বাংলা স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের সময়কাল থেকেই উচ্চারিত হচ্ছিল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলেই তার বিস্ময়কর ভাষণ শেষ করেছিলেন। আর পুরো মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা ছিল বাঙালির অগ্নিমন্ত্র। তাই আমরা মনে করি যুগের পর যুগ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জীবন্ত রাখতে জয় বাংলা হতে পারে প্রতীকী স্লোগান।
এই শক্তির খোঁজ পাকিস্তানি পরাজিত শক্তির অজানা ছিল না। পাকিস্তানি দুষ্টচক্র এবং তাদের এদেশি দোসরদের কাছে জয় বাংলা ছিল ভীতিকর। তারা বুঝেছিল জয় বাংলা স্লোগানের তরঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশপ্রেমিক মানুষ দ্রুতই ঐক্যবদ্ধ হবে। তাই জয় বাংলাকে নির্বাসন দিতে হবে কৌশলে।
১৯৭৫-এর রক্তক্ষয়ী পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর যে কটি পাকিস্তানপন্থি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এর অন্যতম ছিল প্রজন্মের সামনে থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে আড়াল করা। এর বদলে পাকিস্তানের জাতীয় স্লোগান‘পাকিস্তান জিন্দাবাদে’র আলোকে আমাদের জাতীয় স্লোগান করলেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। একই সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানানো, গোলাম আযমকে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পাকিস্তানি শাসকদের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে থাকলেন।
আমাদের কাছে এটিও বিস্ময় যে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালেও সরকারিভাবে জয় বাংলা ফিরিয়ে আনা বিশেষ করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদের স্থলে জয় বাংলা পুনঃস্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তেমনভাবে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী জয় বাংলা ফিরিয়ে এনে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা দেওয়ার জন্য রিট আবেদন করেন। দীর্ঘ বিরতির পর ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর রায় হিসেবে আদালতের পর্যবেক্ষণ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। মাননীয় আদালত জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকালে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নানা স্লোগান আন্দোলনের মঞ্চ ও মিছিল মুখরিত করেছিল। প্রত্যেকটি স্লোগানই এখন ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে প্রজন্মকে ইতিহাসের কাছে পৌঁছে দেয়। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মধ্য দূরত্ব তৈরি হয়।
১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলার দীর্ঘদিনের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার বন্ধুত্বে প্রথমে ফাটল ধরে। সে সময় বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল পূর্ববাংলা। ইংরেজ শাসন আমলের অনুন্নত অঞ্চলগুলো একটি। সরকারের ভাষ্যে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর উন্নতির স্বার্থে বৃহৎ বাংলা ভেঙে দুটো প্রদেশে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয় ঢাকা। এখানকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর। দৃশ্যমান হতে থাকে পূর্ববাংলার উন্নয়ন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে থাকেন কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দু নেতারা। তাদের বিচারে বঙ্গভঙ্গ ছিল ইংরেজ শাসকদের ষড়যন্ত্রের অংশ। যেভাবেই ব্যাখ্যা হোক না কেন, বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় প্রায় ছশো বছরের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে ফাটল ধরে। বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হলে হতাশ হয়ে পড়ে মুসলিম সম্প্রদায়। ততক্ষণে ইংরেজরাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল ভারত ত্যাগ করার। তাই মুসলমান নেতারা নিজেদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাজ্য পাওয়ার জন্য ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে দরবার করতে থাকে। একসময় পাকিস্তান নামে নতুন দেশ পাওয়ার জন্য আন্দোলনে নামতে হয় মুসলমানদের। আর এই আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। এই পাকিস্তান আন্দোলন দেশভাগের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। এত আরাধ্য পাকিস্তান অর্জিত হলেও যাত্রার শুরুতেই স্বাধীনতার কটূস্বাদ অনুভব করল পূর্ববাংলা, অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি। ভাষা আন্দোলনের সূত্রেই পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি মোহ কাটতে থাকে বাঙালির।
জিয়াউর রহমান জয় বাংলা বিসর্জন দেওয়ার সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়েছিল। সংগোপনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ‘জয়ধ্বনি’ হিন্দু সংস্কৃত থেকে আসছে। তাই জয় বাংলা পরিত্যাজ্য শব্দ। এর বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ভালো। এভাবে ধর্মীয় ধুয়া তোলা পাকিস্তানি শাসকদের পুরনো অভ্যাস। ভাষা আন্দোলনের সময় বলেছিল বাংলা হিন্দুর ভাষা আর উর্দু কোরআনের(!) ভাষা। রক্তের বিনিময়ে ভাষার অধিকার অর্জিত হলেও পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। তাই আইয়ুব খান নানাভাবে সংকট তৈরি করতে থাকেন। অতঃপর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। এ সময় শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন করতে হয়।
বাঙালির অধিকারের প্রতি সম্মান না জানানোয় একপর্যায়ে দাবি তুলতে হয় স্বায়ত্তশাসনের। এ সময় থেকে ইতিহাস ধারণ করা কতগুলো স্লোগান কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে। যেমন ‘ঢাকা না পিন্ডি/ঢাকা ঢাকা’। এই স্লোগান বলে দেয় মানসিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পাকিস্তান থেকে। ছয় দফার স্লোগান গগনবিদারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। আন্দোলনকারী বাঙালি অবদমিত হবে ভেবে শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক করা হয়। কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি। স্লোগান তোলে ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো/ শেখ মুজিবকে আনবো।’ যে স্লোগানের তেজ এত দৃঢ় ছিল যে শেষ পর্যন্ত নিঃশর্তে মামলা উঠিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। সংঘটিত হয় ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। একপর্যায়ে বাঙালি স্বায়ত্তশাসন নয় স্বাধীনতার জন্যই যেন প্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে সত্য ধারণ করে আছে স্লোগান । এ সময়ের চেতনা কাঁপানো স্লোগান হচ্ছে, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ লক্ষ করলে দেখব প্রত্যেকটি স্লোগান ধারাবাহিকভাবে সমকালীন ইতিহাস ধারণ করে আছে।
এরপর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেল বাঙালি আর বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু স্লোগান তোলেন ‘জয় বাংলা।’ ক্রমে জয় বাংলা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রতীক হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জয় বাংলা স্লোগানটি বাঙালিকে মানসিকভাবে দৃঢ় করেছে শক্তি জুগিয়েছে। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের সময় এতটা প্রতীকী স্লোগান ছিল যে, সে সময় ভারতের মানুষ বিপ্লবী বাঙালিকে ‘জয় বাংলার লোক’ নামেই চিনত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন দুপক্ষের গুলিবিনিময়ের শব্দ শুনতাম; বুঝতে পারতাম পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্পে মুক্তিসেনারা আক্রমণ করেছে। কান পেতে থাকতাম। গুলির শব্দ বন্ধ হয়ে গেলে এবং পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হলে দূর থেকে ভেসে আসত জয় বাংলা স্লোগান । সাধারণত যুদ্ধ জয়ের পর মুক্তিবাহিনী জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে চলে যেত।
এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত জয় বাংলা প্রধান স্লোগান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরই ছন্দোচ্ছেদ ঘটে। বিএনপি নামের দল গঠনের আগেই জিয়াউর রহমান নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জয় বাংলা স্লোগান টিকে বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানের অনুকরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানকে রাষ্ট্রীয় স্লোগানে পরিণত করেন। পাকিস্তানি ভাবধারা বজায় থাকায় বিএনপির উত্তরসূরিরা জয় বাংলাকে সতর্কভাবে বর্জন করে। এর পেছনে সম্ভবত বড় কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রাখা। পাকিস্তান-ফেরত সেনা সদস্য এরশাদও একই ধারা বজায় রাখেন। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। তবে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান হিসেবে ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো চেষ্টা করেনি। শুধু বাংলাদেশ জিন্দাবাদকে এড়িয়ে ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ স্লোগান কেউ কেউ উচ্চারণ করে দায় মেটানোর চেষ্টা করেন।
বদ্ধ অর্গলের কড়া কাউকে না কাউকে নাড়তেই হয়। অ্যাডভোকেট বশির আহমদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তিনি কড়া নেড়েছেন। জয় বাংলা স্লোগান রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে ফিরিয়ে আনার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। মহামান্য আদালতকে ধন্যবাদ আবেদনটি আমলে আনার জন্য। ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য জয় বাংলা স্লোগান পুনর্বহালের পক্ষে পর্যবেক্ষণ দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু আদালতের রায়ের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও প্রজন্মের কাছে ‘জয় বাংলা’ তেমনভাবে পৌঁছানোর উদ্যোগ কোনো পক্ষ থেকেই গ্রহণ করা হয়নি।
ইতিহাসের দায়েই আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কে রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে বাস্তবায়ন দেখতে চাই। ইতিহাসের সত্য ধারণ করা এই অমোঘ স্লোগান এই বিজয়ের মাসে আবার দেশকে মুখরিত করুক আমাদের এটি একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার করুন
এ কে এম শাহনাওয়াজ | ৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০

১৯৭৫-এর পর থেকেই সচেতন বাঙালির আক্ষেপ ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শক্তি ‘জয় বাংলা’ সেøাগান কার্যত নির্বাসিত হওয়ায়। দীর্ঘ রাজপথের আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি দেশের যখন জন্ম হয়, তখন অত্যন্ত তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে তার বিভিন্ন পর্যায়ের স্লোগান। স্লোগান শুধু স্লোগান থাকে না হয়ে পড়ে ইতিহাসের আকর সূত্র। কোনো কোনো স্লোগান খন্ডিত সময় আর বিষয়বস্তুকে ধারণ করে আবার কোনোটির ভেতর সামগ্রিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। এই স্লোগান থেকেই প্রজন্ম চলে যেতে পারে ইতিহাসের নির্দিষ্ট সময়কালে। ধারণ করতে পারে তাৎপর্য। জয় বাংলা স্লোগান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের সময়কাল থেকেই উচ্চারিত হচ্ছিল। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলেই তার বিস্ময়কর ভাষণ শেষ করেছিলেন। আর পুরো মুক্তিযুদ্ধে জয় বাংলা ছিল বাঙালির অগ্নিমন্ত্র। তাই আমরা মনে করি যুগের পর যুগ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জীবন্ত রাখতে জয় বাংলা হতে পারে প্রতীকী স্লোগান।
এই শক্তির খোঁজ পাকিস্তানি পরাজিত শক্তির অজানা ছিল না। পাকিস্তানি দুষ্টচক্র এবং তাদের এদেশি দোসরদের কাছে জয় বাংলা ছিল ভীতিকর। তারা বুঝেছিল জয় বাংলা স্লোগানের তরঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দেশপ্রেমিক মানুষ দ্রুতই ঐক্যবদ্ধ হবে। তাই জয় বাংলাকে নির্বাসন দিতে হবে কৌশলে।
১৯৭৫-এর রক্তক্ষয়ী পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর যে কটি পাকিস্তানপন্থি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এর অন্যতম ছিল প্রজন্মের সামনে থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটিকে আড়াল করা। এর বদলে পাকিস্তানের জাতীয় স্লোগান‘পাকিস্তান জিন্দাবাদে’র আলোকে আমাদের জাতীয় স্লোগান করলেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। একই সঙ্গে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানানো, গোলাম আযমকে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার মতো পাকিস্তানি শাসকদের ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটাতে থাকলেন।
আমাদের কাছে এটিও বিস্ময় যে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালেও সরকারিভাবে জয় বাংলা ফিরিয়ে আনা বিশেষ করে বাংলাদেশ জিন্দাবাদের স্থলে জয় বাংলা পুনঃস্থাপন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি তেমনভাবে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী জয় বাংলা ফিরিয়ে এনে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদা দেওয়ার জন্য রিট আবেদন করেন। দীর্ঘ বিরতির পর ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর রায় হিসেবে আদালতের পর্যবেক্ষণ আমাদের আশাবাদী করে তুলেছে। মাননীয় আদালত জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগানের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছে। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকালে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে নানা স্লোগান আন্দোলনের মঞ্চ ও মিছিল মুখরিত করেছিল। প্রত্যেকটি স্লোগানই এখন ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে প্রজন্মকে ইতিহাসের কাছে পৌঁছে দেয়। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মধ্য দূরত্ব তৈরি হয়।
১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলার দীর্ঘদিনের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যকার বন্ধুত্বে প্রথমে ফাটল ধরে। সে সময় বেশির ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল পূর্ববাংলা। ইংরেজ শাসন আমলের অনুন্নত অঞ্চলগুলো একটি। সরকারের ভাষ্যে অনুন্নত অঞ্চলগুলোর উন্নতির স্বার্থে বৃহৎ বাংলা ভেঙে দুটো প্রদেশে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হয় ঢাকা। এখানকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর। দৃশ্যমান হতে থাকে পূর্ববাংলার উন্নয়ন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করতে থাকেন কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষিত হিন্দু নেতারা। তাদের বিচারে বঙ্গভঙ্গ ছিল ইংরেজ শাসকদের ষড়যন্ত্রের অংশ। যেভাবেই ব্যাখ্যা হোক না কেন, বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় প্রায় ছশো বছরের হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে ফাটল ধরে। বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষিত হলে হতাশ হয়ে পড়ে মুসলিম সম্প্রদায়। ততক্ষণে ইংরেজরাও প্রস্তুতি নিচ্ছিল ভারত ত্যাগ করার। তাই মুসলমান নেতারা নিজেদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাজ্য পাওয়ার জন্য ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে দরবার করতে থাকে। একসময় পাকিস্তান নামে নতুন দেশ পাওয়ার জন্য আন্দোলনে নামতে হয় মুসলমানদের। আর এই আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান ছাত্রদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। এই পাকিস্তান আন্দোলন দেশভাগের অন্যতম চালিকাশক্তি ছিল। এত আরাধ্য পাকিস্তান অর্জিত হলেও যাত্রার শুরুতেই স্বাধীনতার কটূস্বাদ অনুভব করল পূর্ববাংলা, অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি। ভাষা আন্দোলনের সূত্রেই পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি মোহ কাটতে থাকে বাঙালির।
জিয়াউর রহমান জয় বাংলা বিসর্জন দেওয়ার সময় মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়েছিল। সংগোপনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ‘জয়ধ্বনি’ হিন্দু সংস্কৃত থেকে আসছে। তাই জয় বাংলা পরিত্যাজ্য শব্দ। এর বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ভালো। এভাবে ধর্মীয় ধুয়া তোলা পাকিস্তানি শাসকদের পুরনো অভ্যাস। ভাষা আন্দোলনের সময় বলেছিল বাংলা হিন্দুর ভাষা আর উর্দু কোরআনের(!) ভাষা। রক্তের বিনিময়ে ভাষার অধিকার অর্জিত হলেও পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। তাই আইয়ুব খান নানাভাবে সংকট তৈরি করতে থাকেন। অতঃপর আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধে। এ সময় শাসকদের বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন করতে হয়।
বাঙালির অধিকারের প্রতি সম্মান না জানানোয় একপর্যায়ে দাবি তুলতে হয় স্বায়ত্তশাসনের। এ সময় থেকে ইতিহাস ধারণ করা কতগুলো স্লোগান কালোত্তীর্ণ হয়ে আছে। যেমন ‘ঢাকা না পিন্ডি/ঢাকা ঢাকা’। এই স্লোগান বলে দেয় মানসিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পাকিস্তান থেকে। ছয় দফার স্লোগান গগনবিদারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে। আন্দোলনকারী বাঙালি অবদমিত হবে ভেবে শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আটক করা হয়। কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে বাঙালি। স্লোগান তোলে ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো/ শেখ মুজিবকে আনবো।’ যে স্লোগানের তেজ এত দৃঢ় ছিল যে শেষ পর্যন্ত নিঃশর্তে মামলা উঠিয়ে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানিরা। সংঘটিত হয় ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থান। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। একপর্যায়ে বাঙালি স্বায়ত্তশাসন নয় স্বাধীনতার জন্যই যেন প্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে সত্য ধারণ করে আছে স্লোগান । এ সময়ের চেতনা কাঁপানো স্লোগান হচ্ছে, ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ লক্ষ করলে দেখব প্রত্যেকটি স্লোগান ধারাবাহিকভাবে সমকালীন ইতিহাস ধারণ করে আছে।
এরপর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেল বাঙালি আর বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু স্লোগান তোলেন ‘জয় বাংলা।’ ক্রমে জয় বাংলা বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রতীক হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জয় বাংলা স্লোগানটি বাঙালিকে মানসিকভাবে দৃঢ় করেছে শক্তি জুগিয়েছে। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের সময় এতটা প্রতীকী স্লোগান ছিল যে, সে সময় ভারতের মানুষ বিপ্লবী বাঙালিকে ‘জয় বাংলার লোক’ নামেই চিনত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন দুপক্ষের গুলিবিনিময়ের শব্দ শুনতাম; বুঝতে পারতাম পাকিস্তানি হানাদারদের ক্যাম্পে মুক্তিসেনারা আক্রমণ করেছে। কান পেতে থাকতাম। গুলির শব্দ বন্ধ হয়ে গেলে এবং পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হলে দূর থেকে ভেসে আসত জয় বাংলা স্লোগান । সাধারণত যুদ্ধ জয়ের পর মুক্তিবাহিনী জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে চলে যেত।
এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫-এর আগস্ট পর্যন্ত জয় বাংলা প্রধান স্লোগান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। এরপরই ছন্দোচ্ছেদ ঘটে। বিএনপি নামের দল গঠনের আগেই জিয়াউর রহমান নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জয় বাংলা স্লোগান টিকে বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানের অনুকরণে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগানকে রাষ্ট্রীয় স্লোগানে পরিণত করেন। পাকিস্তানি ভাবধারা বজায় থাকায় বিএনপির উত্তরসূরিরা জয় বাংলাকে সতর্কভাবে বর্জন করে। এর পেছনে সম্ভবত বড় কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে প্রজন্মকে দূরে সরিয়ে রাখা। পাকিস্তান-ফেরত সেনা সদস্য এরশাদও একই ধারা বজায় রাখেন। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। তবে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকেও জয় বাংলা জাতীয় স্লোগান হিসেবে ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো চেষ্টা করেনি। শুধু বাংলাদেশ জিন্দাবাদকে এড়িয়ে ‘বাংলাদেশ চিরজীবী হোক’ স্লোগান কেউ কেউ উচ্চারণ করে দায় মেটানোর চেষ্টা করেন।
বদ্ধ অর্গলের কড়া কাউকে না কাউকে নাড়তেই হয়। অ্যাডভোকেট বশির আহমদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তিনি কড়া নেড়েছেন। জয় বাংলা স্লোগান রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে ফিরিয়ে আনার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। মহামান্য আদালতকে ধন্যবাদ আবেদনটি আমলে আনার জন্য। ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার জন্য জয় বাংলা স্লোগান পুনর্বহালের পক্ষে পর্যবেক্ষণ দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু আদালতের রায়ের পর এক বছর অতিবাহিত হলেও প্রজন্মের কাছে ‘জয় বাংলা’ তেমনভাবে পৌঁছানোর উদ্যোগ কোনো পক্ষ থেকেই গ্রহণ করা হয়নি।
ইতিহাসের দায়েই আমরা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কে রাষ্ট্রীয় স্লোগান হিসেবে বাস্তবায়ন দেখতে চাই। ইতিহাসের সত্য ধারণ করা এই অমোঘ স্লোগান এই বিজয়ের মাসে আবার দেশকে মুখরিত করুক আমাদের এটি একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়