
দেশ ও অর্থনীতির অর্ধশতবর্ষ পূর্তির এই প্রান্তিক পর্যায়ে এসেও রাজস্ব আয় অর্জনে আমরা যে এখনো একটা পুশ ফ্যাক্টরের ভেতরে আছি তা বুঝতে কষ্ট হয় না। অর্থাৎ রাজস্ব আহরণকে কাক্সিক্ষত পরিমাণে উন্নীত করার জোর চেষ্টা চলছে তো চলছেই। বিপুল সংখ্যক করদাতা এখনো করজালের আওতায় আসতে পারেননি, আনা যায়নি। অন্যদিকে সঠিক পরিমাণে কর ও শুল‹ায়নযোগ্য যে খাতগুলো বাদ পড়ে গেছে বা বাইরে আছে সেগুলোকে শুল্ক ও করের আওতায় আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই পরিশীলিত, সংস্কারকৃত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়ে একটা করদাতাবান্ধব ও স্বয়ংক্রিয় প্রণোদনামূলক পদ্ধতি গড়ে তোলা বা প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। অর্থাৎ কর যারা দেয় না তাদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি কর প্রদানে যারা ফাঁকি দিচ্ছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে তাদের প্রতি কঠোর ও কঠিন মনোভাব পোষণ এবং সর্বোপরি কর প্রদান ও আহরণের সংস্কৃতিকে জাতীয় দায়িত্ব বোধের চেতনায় উত্তরণ ঘটানোর কাজে ক্লান্তিকর প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না।
কর দান ও আহরণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা বা জটিলতাসহ স্পর্শকাতরতা রয়েছে তা দূর করে কার্যকর অবস্থায় নিয়ে আসতে সেই ৯০-এর দশক থেকেই চেষ্টা চলছে। ৯০ দশক পর্যন্ত আমদানি বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতির সময়ে নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা তেমন ছিল না বলে তখন আমদানি শুল্ক ব্যতিরেকে কর ও ভ্যাট রাজস্ব আহরণের আবশ্যকতা দেখা দেয়নি। ৯০-এর দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের দিকে অগ্রসরসমান হয় তখন থেকেই শুল্কের চেয়ে করের কলেবর বৃদ্ধি পেতে থাকে। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি পোশাক শিল্পের হাত ধরে আমাদের রপ্তানি আয় ও উন্নয়ন বেড়ে গেলে এবং আমদানি ব্যয় হ্রাস পেতে থাকলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ সংক্রান্ত বিষয়াদি নতুন করে জাতীয় ভাব-ভাবনার চৌহদ্দিতে চলে আসে। অন্যদিকে ৯০ দশকের শুরুতেই রুশ ফেডারেশনের পতনে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়। তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর আগের মতো বিদেশি ঋণ অনুদানপ্রাপ্তির সুযোগ এবং সম্ভাবনা হ্রাস পায়। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বাংলাদেশের মতো অনুন্নত অথচ উন্নয়নআগ্রহী দেশে নিজস্ব রাজস্ব আহরণের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
এতদসত্ত্বেও, রাজস্ব আহরণের প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেও কর-জিডিপির অনুপাত কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছাতে এখনো মনে হচ্ছে অনেক পথ বাকি। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি র্যাশিও বরাবরই নিম্ন পর্যায়ের আশপাশেই ঘুরছে, যদিও সব সময় কর-রাজস্ব আহরণের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ছিল বা আছে অনেক বেশি। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা বেশি ধরা হলেও তা পূরণে সফলতার গতি গজেন্দ্রগামী। এক্ষেত্রে পদ্ধতিগত, অবকাঠামোগত এবং বিবিধ সব ধরনের ত্র“টি দূর করে উপযুক্ত করদাতাদের মধ্যে থেকে যত বেশি জনকে করের আওতায় আনা যায় সে চেষ্টাই যেন শুধু চলছে। পাশাপাশি যেসব নিত্যনতুন আর্থিক খাত তৈরি হচ্ছে সেগুলোকেও চটজলদি করের আওতায় আনার প্রয়াস চলছে। কিন্তু কর্মক্ষমতায় ও কর্মদক্ষতায় সে প্রয়াস কাক্সিক্ষত ফলাফল আনতে যথেষ্ট সময় নিচ্ছে। রাজস্ব আহরণ দপ্তরে দক্ষ জনবলের অভাব এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির প্রসার প্রতিপত্তির প্রেক্ষাপটে রাজস্ব আহরণ পদ্ধতি প্রক্রিয়ার অনলাইন রূপান্তরের কাজ, সংস্কারের কাজ কেমন যেন শেষ হয়েও হচ্ছে না, সময়ের অবসরে প্রযুক্তির প্রভূত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ঢিমেতালে চলা উদ্যোগে বাধা আসছে ঘরে-বাইরে থেকেও। বাধার বিন্ধ্যাচল পেরুনো কঠিন মনে হচ্ছে।
প্রযোজ্য সবার করদানে সচেতন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য যখন এবং যেখানে উদ্বুুদ্ধকরণ ও প্রণোদনামূলক পন্থা-পদ্ধতি প্রয়োগের কথা, সেখানে কর আহরণ পরিবেশ পরিস্থিতিকে স্বয়ম্ভর ও অভিজ্ঞ মনে করে কঠিন কঠিন পদ্ধতি প্রয়োগের পরাকাষ্ঠা যদি দেখানো হয় বা অহেতুক চাপ সৃষ্টি করা হয় তাহলে করদাতারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। দেখতে হবে আইনকানুন সংস্কারের পাশাপাশি রীতি-পদ্ধতিকে করদাতা বান্ধবকরণের নামে পরিবেশ পরিস্থিতিকে আরো কঠিন ও কর্কশ করা হচ্ছে কি না। কর আহরণ পদ্ধতি-প্রক্রিয়া এমনতর জটিল, কমপার্টমেন্টালাইজড ও কঠিন হলে যারা এখনো করের আওতায় আসেনি তারা করদাতা হতে ভয় পেতে পারেন। পাশাপাশি যারা কর দিচ্ছেন তারাও সঠিকভাবে কর দিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে পারেন।
করদাতারা তাদের অভিযোগ ও সমস্যার সমাধান পেতে পারতেন কর ন্যায়পালের কাছে। শতাধিক দেশে কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান কার্যকর থাকলেও বাংলাদেশে প্রবর্তিত কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানকে বাল্যবয়সেই বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। কর ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠানের কার্যকরকরণে যে সব সমস্যা সীমাবদ্ধতার যুক্তিতে তাকে অপাঙ্ক্তেয় ভাবা হয়েছিল আইনে সেগুলো সংশোধন সংযোজন করে প্রতিষ্ঠানটির পুনর্জন্ম কর-সংস্কৃতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। যে স্টেজে যে অ্যাটিচুড বা মনোভঙ্গি (মাইন্ডসেট) বা উপলব্ধি থাকার কথা সেটায় না থেকে আমরা যদি ভাবি বা ধরে নিই যে, উন্নত অর্থনীতির মতো আমাদের সব করদাতা শিক্ষিত, করদানে দায়িত্বসচেতন এবং তারা আইনকানুন সব বোঝেন-জানেন, তাহলে কর-দৃষ্টিভঙ্গি (মাইন্ডসেট) ভিন্ন আঙ্গিকে নির্মিত হতে বাধ্য। এমনতর অবস্থায় রাজস্ব আহরণ পরিবেশ পরিস্থিতি ‘প্রোগ্রেসিভ’ না হয়ে ‘রিগ্রেসিভ’ হতে পারে। নতুন করদাতা আসতে যেহেতু চাচ্ছে না, বা তাদের আনা যাচ্ছে না, সেহেতু তাদের স্থলে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ বেড়ে গেলে তারাও পথ খুঁজতে পারেন কীভাবে কর দেওয়া থেকে ফাঁকি দিয়ে পরিত্রাণ মিলতে পারে।
প্রতি বছর যে অর্থবিধি জারি করা হয় সেখানে বিদ্যমান তিনটা রাজস্ব আহরণ আইনেরই সংশোধন ও সংযোজন পরিমার্জনে গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা জানি ইতিমধ্যে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের স্থলাভিষিক্ত একটা নতুন কর আইন ২০১২ সালে জারি হলেও ২০১৯ সালের আগে তার পূর্ণ প্রবর্তন করা যায়নি। এদিকে ১৯৬৯ সালের কাস্টমস আইনের সংস্কার ও আধুনিকীকরণের চেষ্টাও চলছে। পাশাপাশি ইনকাম ট্যাক্সের ১৯৮৪ সালের অধ্যাদেশটির নবায়ন বহুদিন বা সবসময় ফাইনাল স্টেইজে আছে। এসবের পাশাপাশি এবং এসব সত্ত্বেও ইদানীং দেখা যাচ্ছে অর্থবিধিতে বিস্তর রিভিশনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। বছর বছর ট্যাক্স রেট, কর রেয়াতের মাত্রা, অবকাশের হার ও ক্ষেত্রে নিত্যনতুন সংশোধন, সংস্কার প্রস্তাবনা প্রতি বছর যেন বেড়েই চলেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, শুধু আয়করের ক্ষেত্রেই গড়ে ৭০টির মতো সংস্কার প্রস্তাব আসে অর্থবিধিতে। এক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে প্রতি বছরের অর্থবিলে যদি এক একটা আইনের ধারা-উপধারা অতি পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও সংশোধনের হিড়িক পড়ে তখন সংশ্লিষ্ট সবার পক্ষে ঐ সমস্ত পরিবর্তন ফলো করা কঠিন তো হয়ই, এসব প্রয়োগে জটিলতা আরও বাড়ে বৈ কমে না। ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগে সিদ্ধান্ত নিতে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় করদাতাদের।
আইনের সংশোধন সংক্রান্ত এসআরও’র প্রয়োগ ন্যূনতম ৩ বছর বা তার বেশি হলে ঐ এসআরও’র কার্যকারিতা অনুসরণ অনুধাবন যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এদিকে আয়কর পরিপত্র-১ জারিতে বিলম্ব করেও তাতে কিছু কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা নিরসনে ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায়। এসবই সঠিক পরিমাণে ন্যায্য কর আদায়ের ক্ষেত্রে বিলম্ব সৃষ্টি বা অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিপত্রে স্পষ্টকরণ করতে গিয়ে যে দীর্ঘসূত্রতা তা থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিবেশগত নানা প্রভাব পুরো বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত কর আদায়ের জন্য অপারগ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের অর্থবছরে শুরু থেকেই ঝড়বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি আরও নানান উপলক্ষের সমস্যা থাকে, এর সুযোগ নিয়ে আয়কর দেওয়ার সময় বাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করে সবাই। এই অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসতেই এবার আইনের মধ্যেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে অর্থবছর শেষ হওয়ার ৩ মাসের স্থলে ৫ মাস পর্যন্ত অর্থাৎ নভেম্বর মাস পর্যন্ত ব্যক্তি আয়কর দেওয়া যাবে। যেহেতু সবাই অপেক্ষা করে পরিপত্র জারির, তাই সেই কাক্সিক্ষত ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষায় কিংবা পরিপত্র জারির দেরি হওয়াকে হয়তো নভেম্বর নির্ধারণে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সবাইকে করের আওতায় আনতে চাই তাহলে অর্থবছর শেষ হওয়ার পর পাঁচ মাস পর্যন্ত অপেক্ষার অবকাশ অর্থাৎ সময়ক্ষেপণের এ ধরনের অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে সবার জন্য যথাসময়ে কর দেওয়ার সহজ সুযোগ সৃষ্টি শ্রেয়তর বিবেচিত হতে পারে।
বাজেটে নতুন হারে করারোপের পর অর্থবছরের শুরু থেকেই কর কীভাবে দিতে হবে, কোন কোন পরিস্থিতিতে কী করণীয় সেটা নিশ্চিত না করা গেলে সমস্যা সৃষ্টি হবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে আয়করে নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নেওয়াতে মূল সমস্যা যেটা হয়েছে সেটা হলো কর প্রদান ও প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রতা বেড়েছে। এক্ষেত্রে আগের তুলনায় দুই মাস পর কর আদায় হওয়ায় সামষ্টিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিড়ম্বনা ও ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা অর্থবছরের শুরু থেকে সরকারি অর্থব্যয় অব্যাহত থাকে, কিন্তু রাজস্ব আয় কত আসবে সেটার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বেশ কিছুটা সময়। ফলে ব্যাংক বরোয়িং বাড়তে থাকে। অনেক সময় কাক্সিক্ষত কর নাও আসতে পারে। একবারে ৩ থেকে ৫ মাস সময় বেড়ে যাওয়াতে সবাই যাতে যার যার মতো গা-ছাড়া ভাব বা বিলম্ব করার প্রবণতায় অর্জিতব্য রাজস্বের উপযোগিতা যাতে হ্রাস না পায় সেদিকে সচেতন দৃষ্টিক্ষেপ প্রয়োজন হবে।
রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে ও পদ্ধতি-প্রক্রিয়ায় আইনসংগত স্বচ্ছতার আলোকে গতিশীলকরণের স্বার্থে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আইন ও প্রক্রিয়ার যৌক্তিকতা যথা বিশ্লেষণ হওয়া উচিত। বিশেষ করে কর আহরণ প্রক্রিয়ার যেসব আইনি জটিলতা সেটা ঠিক মতো সংস্কারের মাধ্যমে স্পষ্ট করা না গেলে সমস্যা থেকেই যাবে। অন্তত এই অবস্থায় রেখে ব্যাপক কর আদায়ের যে কথা চিন্তা করা হচ্ছে তা অর্জন স্বতস্ফূর্তভাবে সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে আইনের আর্থ-প্রশাসনিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যদি আরও কিছু অসম্পূর্ণতা ও ফাঁকফোকর থেকে থাকে তা সংশোধন করা না গেলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর কর্তৃপক্ষের নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
লেখক: রাজস্ব নীতি বিশ্লেষক
ইসলামি শরিয়তে সত্য নির্ণয়ের মাপকাঠি হলো পবিত্র কোরআন ও হাদিস। সেই সঙ্গে কোরআন-হাদিস যেসব বিষয়কে শরিয়তের দলিল ও হক নির্ণয়ের মাপকাঠি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে সেগুলো। সুতরাং যেখানে হক-বাতিল (সত্য-মিথ্যা) নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে, সেখানে হক নিরূপণের জন্য শরিয়তের এই মানদ- ব্যবহার করতে হবে। এর বাইরে ভিন্ন কিছু ভাবার কিংবা করার সুযোগ নেই। অনেকেই বলেন, আমি বড়দের অনুসরণ করি, অমুক দলের সমর্থক। তারা যা বলেন এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমি যেতে পারি না, যাব না। এমন চিন্তা ও মনোভাব ইসলাম সমর্থন করে না। এটাকে শরিয়তের পরিভাষায় আসাবিয়্যাত বলে।
ইসলাম আসাবিয়্যাত অপছন্দ করে। আসাবিয়্যাত অর্থ গোত্রপ্রীতি, সাম্প্রদায়িকতা, স্বজনপ্রীতি ও স্বদলপ্রীতি প্রভৃতি। এক সাহাবি হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আসাবিয়্যাত’ কী? জবাবে তিনি ইরশাদ করলেন, অন্যায় কাজে স্বগোত্র-স্বজাতির পক্ষে দাঁড়ানো (সুনানে আবু দাউদ : ৫০৭৮)। অর্থাৎ অন্যায়, জুলুম ও ভুল কাজ-কর্মে কাউকে শুধু এ জন্য সমর্থন করা যে, সে তার নিজ দল, গোত্র, জাতি, দল ও ধর্মের লোক এটাই আসাবিয়্যাত; এটাই সাম্প্রদায়িকতা। আপনি কোরআন মাজিদের সুরা আন নিসা’র শুরু থেকে পড়ুন, দেখবেন ইসলাম মানবতার বন্ধনকে কীভাবে দৃঢ় করেছে। আল্লাহতায়ালা কীভাবে সব মানুষকে একই পিতা-মাতার সন্তান ঘোষণা দিয়ে তাদের পরস্পরের আপন বানিয়েছেন। হজরত হুজাইফা (রা.) বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘সব জাতি যেন তাদের বাপ-দাদা তথা বংশ নিয়ে গর্ববোধ থেকে ফিরে আসে অন্যথায় তারা আল্লাহর কাছে নাপাকির পোকামাকড় থেকেও নিকৃষ্ট গণ্য হবে’ (মুসনাদে বাযযার : ২৯৩৮)।
সুনানে আবু দাউদের অন্য বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে আসাবিয়্যাত (সাম্প্রদায়িকতা)-এর দিকে আহ্বান করবে (অন্যায় কাজে নিজ দল, গোত্র, জাতিকে সাহায্য করতে বলবে) সে আমাদের (মুসলমানদের) দলভুক্ত নয়। যে এমন সাম্প্রদায়িকতার কারণে মৃত্যুবরণ করবে সেও আমাদের দলভুক্ত নয়’ (সুনানে আবু দাউদ : ৫০৮০)। এ বিষয়ে বর্ণিত আরও একাধিক সহিহ হাদিসের মর্ম হলোযে ব্যক্তি জাতীয়তা কিংবা ভাষার ভিত্তিতে অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর সহযোগিতা করে এবং দল, গোত্র, বংশের ভিত্তিতে অন্যকে সাহায্য করতে গিয়ে মারা যায় সে জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল। যে উম্মতের বিরুদ্ধে অস্ত্র উঠিয়ে ভালোমন্দ সবাইকে হত্যা করতে থাকে সে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত নয়।
বিদায় হজের বিখ্যাত ভাষণের কথা সবারই জানা। যেখানে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের ভিত্তিতে কারও ওপর কারও প্রাধান্য নেই।’ তিনি বলেছেন, ‘কোনো আরব অনারবের ওপর (শুধু ভাষার কারণে) প্রাধান্য পাবে না। কোনো সাদা (তার বর্ণের কারণে) কালোর ওপর প্রাধান্য দাবি করতে পারবে না। প্রাধান্যের একমাত্র ভিত্তি হবে তাকওয়া (আল্লাহভীতি)’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৪৮৭)।
মুফতি সাইদ আহমদ পালনপুরি (রহ.) বলেন, ‘বড়দের কাজ তখনই দলিল হবে, যখন তা কোরআন-হাদিস এবং স্বর্ণালি তিন যুগের আমল দ্বারা সমর্থিত হবে। সর্বাবস্থায় বড়দের কাজ গ্রহণ করাটা তাদের অনুসরণ নয়; বরং এটাকে আকাবিরপূজা (বড়দের) বলে।’ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায় শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) দ্বীন বিকৃতির সাতটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তার একটি ‘ইসতিহসানে মাশায়েখ অর্থাৎ বড়রা যে কাজ পছন্দ করেন, পরবর্তী প্রজন্ম সেটাকেই দ্বীন মনে করে বসে। এর মাধ্যমে দ্বীন-ধর্মের বিকৃতি হয়।’ হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন দ্বীনের ক্ষেত্রে কারও অন্ধ অনুসরণ না করে। যদি সে ইমান আনে তাহলে এ ব্যক্তিও ইমান আনে। আবার সে যদি কাফের হয়ে যায়; তাহলে এ ব্যক্তিও কাফের হয়ে যায়। কেননা মন্দের ভেতরে কোনোরূপ আদর্শ নেই’ (ইলামুল মুআকিয়িন: ২/১৭৬)।
শাইখুল ইসলাম ইবনুল কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাহ (রহ.) বলেন, ‘দুই ধরনের কাপড় পরিধান করা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নাও। যে এই দুই কাপড় পরিধান করে, সে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেই বস্ত্রদ্বয়ের একটি হলো চরম মূর্খতা ও অজ্ঞতা, দ্বিতীয়টি অন্ধভাবে স্বীয় পক্ষে কঠোর হওয়া, কতই না নিকৃষ্ট এ বস্ত্রদ্বয়!’
বিষয়টি শঙ্কার কারণ হলেও অনেকে এটাকে এখনো অবহেলার দৃষ্টিতে দেখছেন। অনেকেই আবার হেকমতের দোহাই দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, সমস্যা যখন ছোট থাকে; তখন বিষয়টিতে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু যখন তা বিশালাকার ধারণ করে, প্রবল বন্যার মতো সব কিছু ভাসিয়ে নিতে থাকে, তখন হুঁশ ফেরে। ততদিনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরপর অপরিকল্পিতভাবে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা ওই স্রোতকে থামাতে তো পারেই না; উল্টো আরও বেগবান করে।
ইসলামি বিধানে এটা স্পষ্ট, আসাবিয়্যাত তথা স্বদল, স্বজাতি ও স্বগোত্রপ্রীতি এক ভয়ংকর ফিতনা। জাহেলি যুগে আরবদের দশা ছিল এমন। সর্বত্র বিরাজ করত গোত্রীয় পক্ষপাতিত্ব ও দম্ভ অহংকার। তাদের নীতি ছিল, আমি আমার ভাইকে সাহায্য করব, সে অত্যাচারিত হোক বা অত্যাচারী। বর্তমান সমাজেও এই মনোভাব বিস্তৃতি লাভ করেছে। ফলে আপন লোকদের দোষত্রুটি দেখেও অনেকেই অন্ধ। অন্যদিকে কোনো দুর্বল ব্যক্তির সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলেই দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়। অত্যাচারিতের প্রতি আরও বেশি করে অত্যাচার আজ যেন ‘স্মার্টনেস’ হয়ে উঠেছে। অথচ ইসলাম শিক্ষা দেয়, অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে আর অত্যাচারীকে প্রতিহত করতে, সে আমাদের আত্মীয়ই হোক বা অনাত্মীয়।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি লোকদের গোত্রবাদের দিকে আহ্বান করে অথবা গোত্রবাদে উন্মত্ত হয়ে ভ্রষ্টতার পতাকাতলে যুদ্ধ করে নিহত হয়, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল’ (ইবনে মাজাহ : ৩৯৪৮)।
নিবন্ধে যে কয়টি উদাহরণ পেশ করা হলো তার সবই ইসলামের দৃষ্টিতে সাম্প্রদায়িকতা এবং কঠোর নিন্দনীয় এবং ইহ ও পরকালীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ বর্তমান সময়ের প্রচারমাধ্যমগুলো এগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা হিসেবে দেখতে চায় না। সমাজের লোকজনও তা মনে করে না। এমন মনোভাবের পরিবর্তন কাম্য।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামবিষয়ক লেখক
পারস্য সাগর উপকূলের ছোট দেশ কাতার। বৃহৎ প্রতিবেশী সৌদি আরব ও ইরানের মাঝখানে বিশ্বমানচিত্রে খুঁজে পাওয়া দায়। মরুর বুকে বিস্ময় সে কাতার আয়োজন করেছে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ক্রীড়া আসর ফুটবল বিশ্বকাপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশকে বিটে হারিয়ে আয়োজক দেশের মর্যাদা আদায় করেছিল দেশটি। অভিযোগ ওঠে রাজপরিবার টাকার বিনিময়ে বিশ্বকাপ আয়োজন বাগিয়ে নিয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করে ফিফা। শেষ পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদনে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। মধ্যপ্রাচ্যের বুকে প্রথম বিশ্বকাপ, আরব বিশ্বেও প্রথম, কিন্তু কাতারের এই অর্জনে খুশি ছিল না মোড়ল প্রতিবেশী সৌদি আরব। ২০১৭ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন ‘কাতার অবরোধে’ কাতারকে কাবু করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আয়োজক দেশের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আবহাওয়া, মানবাধিকারসহ নানা ইস্যুতে সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জে পড়তে হয় কাতারকে। কিন্তু সব ছাড়িয়ে কাতার একটি শুভ সূচনা করেছে।
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য : নিঃসন্দেহে এশিয়া, ইউরোপ বা আফ্রিকায় তাদের নিজ নিজ সংস্কৃতি রয়েছে, নিজ নিজ মূল্যবোধ রয়েছে, তেমনি আরব বিশ্বেরও। ভারতের বড় বড় শহরগুলোতে গরু হেঁটে বেড়াচ্ছে, ইউরোপের পার্কে পোষা কুকুর থাকছে, আরবে উট’কে প্রিয় পশু হিসেবে সমাদর করা হচ্ছে এই প্রত্যেকটা অনুভূতিকে তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ দিয়ে ভাবতে হবে। নৃবিজ্ঞানী আর বি টেইলর বলেছেন, ‘প্রতিটি সংস্কৃতির প্রথা ও রীতিনীতিসমূহকে সংস্কৃতির বাস্তবতার নিরিখেই মূল্যায়ন করতে হবে।’ ভিন্ন সংস্কৃতিকে গ্রহণ না করা ও শ্রদ্ধা না করা থেকে মূলত জেনোফোবিয়া তৈরি হয়। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, প্রথা ও মূল্যবোধের সঙ্গে একে অপরের পরিচয় ঘটানোর জন্য বিশ্ব ক্রীড়া আসরগুলোর আয়োজন হয়ে থাকে। ফলে কাতারে টুর্নামেন্ট উদ্বোধন যুক্তরাষ্ট্র বা অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির মতো হবে না এটাই স্বাভাবিক। কাতার বিশ্বকাপ ২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কাতারের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের আলোকে গ্রহণ করতে হবে, ইউরোপীয় মানদন্ডে নয়।
ঐক্যের বার্তা : উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চমৎকার উদার আহ্বান রেখেছে কাতার। অনুষ্ঠানের একটি মুহূর্তে মার্কিন অভিনেতা মরগান ফ্রিম্যান হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশেষভাবে সক্ষম কাতারের কিশোর তারকা ঘানিম আল মুফতাহ’র দিকে। ঘানিম কাতার বিশ্বকাপ ২০২২-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। একজন বিশেষভাবে সক্ষম কিশোরকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর করে কাতার বিশ্বের বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার বার্তা দিয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মরগান ঘানিমকে জিজ্ঞেস করেন ‘আমাদের কাছে যতবেশি একত্র হওয়ার উপাদান তার চেয়ে বেশি আলাদা হওয়ার উপাদান, আমরা কীভাবে সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারি?’ কাতারি কিশোর জবাব দেয়, ‘একমাত্র সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা আমাদের এক ছাদের নিচে রাখতে পারে।’ তাদের এই আলোচনা পূর্ব-পশ্চিমের একটি সেতুবন্ধ আলোচনারূপে উপস্থাপিত হয়েছে। পশ্চিমের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা পূর্বের একজন বিশেষভাবে সক্ষম কিশোরের সঙ্গে বিশ্বশান্তি নিয়ে আলোচনা করছে, এরচেয়ে দৃঢ় বার্তা আর কী হতে পারে? এটাই কাতার বিশ্বকাপ ২০২২-এর থিম ডায়লগ হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
কাতারি কিশোর পবিত্র আল কোরআনের সুরা আল হুজরাতের ১৩ নম্বর আয়াতও পড়ে শোনায়। এই আয়াতটির অর্থ, ‘হে মানুষ আমি তোমাদের সবাইকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।’ এই আয়াত মূলত ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ বা ‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’ দর্শনের কথাই বলছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যখন এই বার্তা প্রচারিত হচ্ছিল তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ ও তার পিতা ও কাতারের জাতির জনক শেখ হামাদ বিন থানি। মঞ্চের প্রথম সারিতে উপস্থিত ছিলেন সৌদি যুবরাজ সালমান, জাতিসংঘের মহাসচিব, মিসর, তুরস্ক, ও আলজেরিয়া ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট। যে সৌদি আরব কাতারকে বিশ্বমঞ্চ থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল সে সৌদি আরবের যুবরাজকে পাশে বসিয়ে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলায় সহনশীলতার বার্তা দিয়েছে কাতার।
অনন্য কাতার : শুধু ফুটবল আয়োজন নয়, এর আগে থেকেই ধীরে ধীরে বিশ্বের বুকে একটি কূটনৈতিক মধ্যস্থতাকারী ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে মাত্র ৩ লাখ জনসংখ্যার কাতার। লেবানন, ইথিওপিয়া-ইরিত্রিয়া, লিবিয়া, সুদানসহ বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও দ্বিপক্ষীয় বিরোধ নিষ্পত্তির মধ্যস্থতা করেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র- তালেবান শান্তি প্রক্রিয়ার মূল সঞ্চালক ছিল কাতার। মূলত কাতারের মধ্যস্থতায় যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের আয়োজক ছিল কাতার। বর্তমানে তুরস্ক-সৌদি আরব, ইরান-সৌদি আরব বিরোধ নিষ্পত্তির প্রস্তাবও দিয়ে রেখেছে দেশটি। কাতারের এসব মধ্যস্থতার ভূমিকায় সফট পাওয়ার হিসেবে কাজ করছে কাতারের মালিকানাধীন নিউজ মিডিয়া ‘আলজাজিরা’। তেল ও গ্যাসে কাতারের অর্থনীতি ফুলে-ফেঁপে উঠলেও এয়ারলাইনস ও ইউরোপীয় ফুটবল ক্লাবে রয়েছে তাদের বিশাল বিনিয়োগ। রূপকল্প ২০৩০-এর অংশ হিসেবে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় বিশেষ অবস্থান করে নেওয়ার পরিকল্পনা কাতারের। বিশ্বের টপ র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শাখা রয়েছে কাতারে। এখন সেসব বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটদের ৪২ শতাংশই নারী। এছাড়া ‘কাতার ফাউন্ডেশন’-এর মাধ্যমে বিশ্বের নানা জায়গায় চ্যারিটি করা হচ্ছে। এসবের মূল ভাবনায় আছেন সাবেক আমির শেখ হামাদের স্ত্রী ও বর্তমান আমিরের মা শায়খা মোজাহ।
তবু ষড়যন্ত্রের যেন শেষ নেই : সৌদি আরবের ব্রিটিশ সেন্টারে স্ট্র্যাটেজিক রাজনীতি বিশ্লেষক আমজাদ তাহা দাবি করেছেন কাতার ও ইকুয়েডর ম্যাচটি ফিক্সড। ম্যাচে যেন ইকুয়েডর হেরে যায় তার জন্য ইকুয়েডরের চারজন ফুটবলারকে ঘুষ দেওয়া হয়। ৯২ বছরের বিশ্বকাপ আয়োজনের ইতিহাসে প্রথম স্বাগতিক দেশ হিসেবে হেরে গিয়ে কাতার সে গুজবের জবাব দিয়েছে। এই বিশ্বকাপে কাতার খরচ করেছে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলার। প্রথম ম্যাচে যে ইকুয়েডর কাতারকে হারিয়েছে তাদের জিডিপি মাত্র ১০০ বিলিয়নের কিছু বেশি আর ২৫ শতাংশ মানুষই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এই দারিদ্র্যপীড়িত ইকুয়েডর অনায়াসে হারিয়ে দিল এক বিশ^কাপেই ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলা একটি ধনী দেশকে। এটাই ফুটবলের সৌন্দর্য। প্রতিবেশী থেকে যখন গুজব রটানো হচ্ছিল তখন কাতারের আমির স্বাগত বক্তব্যে বলছিলেন, ‘বিশ্ববাসী আপনাদের কাতারে স্বাগত, আরব বিশ্বে স্বাগত।’
মানবাধিকার বিতর্ক : কাতারের বিরুদ্ধে স্টেডিয়াম নির্মাণের সময় শ্রমিকদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের। এই অভিযোগে বিবিসি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেনি। কাতার নয় শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়। নিউ ইয়র্ক থেকে সিডনি, দোহা থেকে দুবাই বড় বড় ইমারত নির্মাণ হয়েছে শ্রমিকদের ঘামে-রক্তে। শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে পুঁজিপতিদের পুঁজি জ্যামিতিক হারে বেড়েছে এসব দেশে। প্রত্যেক সিভিলাইজেশনের রয়েছে শ্রমিক শোষণ করার নিষ্ঠুর ইতিহাস। মুঘল সাম্রাজ্যের কালজয়ী নিদর্শন তাজমহল নির্মাণেও শ্রমিকদের অধিকারকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছিল। আবার মুঘল সাম্রাজ্যের মূল্যবান রতœ লুট করেছিল ব্রিটিশরা। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার বহু দেশকে শোষণ-শাসন করেই আজ ইউরোপ-আমেরিকা এত সমৃদ্ধ হয়েছে। ইউক্রেনীয় রিফিউজিদের প্রতি ইউরোপের যে ব্যবহার ছিল সিরিয়ান রিফিউজিদের প্রতি তা ছিল না। আবার ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ইউক্রেনীয় শিক্ষার্থীদের ইউরোপের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিলেও তাদের অ-ইউরোপীয় সহপাঠীদের পাঠানো হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। এখানে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ইউরোপের চিত্রই স্পষ্ট হয়। কিন্তু ইউরোপীয়দের সেকালের কলোনিয়ালিজমের অপরাধের কারণে এখনকার ইউরোপ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে যে অবস্থান নিয়েছে তা খারিজ করা যায় না। কাতার একটি সুন্দর ও নির্র্মোহ আয়োজন করেছে বলে তার বিরুদ্ধে শ্রমিকদের মজুরি ও নির্মাণকাজে নিহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না তা নয়।
আসলে এসব ক্ষেত্রে তুলনামূলক আলোচনা বরং ঘটনার ভয়াবহতাকে হালকা করে দেয়। কাতার ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে পেরেছে কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকদের ইন্স্যুরেন্স কেন দিতে পারবে না, কেন নিহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেবে না! বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্য বিমোচনে বড় ভূমিকা রয়েছে কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। এখনো দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ পরিবারে মধ্যপ্রাচ্য থেকে রেমিট্যান্স না এলে ঈদ, পূজা, দিওয়ালিতে নতুন জামা জোটে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব শ্রমিক অদক্ষ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন হওয়ার কারণে তারা ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা, ইন্স্যুরেন্স সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম আইন ও অভিবাসন আইন নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। কাতার একটি স্ট্যান্ডার্ড ও জবাবদিহিমূলক শ্রমিক ও অভিবাসী আইন প্রণয়ন করলে বিশ্বের বুকে কাতারের অবস্থান আরও অনন্য হয়ে উঠবে।
লেখক: কলামিস্ট
শিশু মাত্রই যত্ন, মনোযোগ ও বিশেষ সুবিধার দাবি রাখে, কেননা এই সুযোগ তার অধিকার। আর এসব সুযোগ তার বিকাশের জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে, প্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন শিশুদের ক্ষেত্রে তাদের বিকাশ ও সমাজে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে দরকার বিশেষ সুযোগ। দেখা গেছে সামান্য মানবিক আচরণ ও সুবিধা পেলে এসব শিশুও সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের অধিকারী হয়ে সমাজে তার অবদান রাখতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবারের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায় রয়েছে। এ ধরনের শিশুদের সমাজে অন্তর্ভুক্তি যেমন জরুরি, তেমনি তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করা দরকার। এজন্য এখন তাদের প্রথাগতভাবে প্রতিবন্ধী না বলে ‘স্পেশাল চাইল্ড’ বা ‘বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু’ বলা হচ্ছে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি অনেকের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাও দেখা যায়। আমাদেরও এ ব্যাপারে সচেতন থাকা দরকার। কারণ, আমাদের সমাজে মানসিক রোগীকে ‘পাগল’ আখ্যায়িত করে অপাঙ্ক্তেয় করে রাখার চল রয়েছে, যা ভুল ও অমানবিক। দেখা যায়, যে বয়সে লেখাপড়া, খেলাধুলা ও দুরন্তপনায় মেতে সময় পার করার কথা সে সময়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অবহেলা ও অমানবিক আচরণ এ ধরনের শিশুদের জীবনকে আরও কঠিন এবং নিরাময়হীনতার দিকে ঠেলে দেয়।
বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরে ‘শেকলে বাঁধা শিশু জিহাদের জীবন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চিকিৎসার অভাবে সাত বছর ধরে শেকলে বাঁধা জীবন পার করছে বাকপ্রতিবন্ধী ও মানসিক ভারসাম্যহীন শিশু জিহাদ (১২)। খিঁচুনি ওঠা, ভাঙচুর করা, বা কোথাও চলে যাওয়াসহ বিভিন্ন আতঙ্কে শিশু জিহাদকে সাত বছর ধরে শেকলে বেঁধে রেখেছে তার অসহায় মা-বাবা। প্রসঙ্গত, সচেতনতার ঘাটতির কারণে আমাদের দেশে বেশিরভাগ সময় শিশুর জন্মের বেশ পরে, বেড়ে ওঠার একপর্যায়ে পরিবারের কাছে তারা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু হিসেবে চিহ্নিত হয়। শিশু জিহাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। চিকিৎসকরা জানান, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা হলে জিহাদ সুস্থ হবে। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে তার চিকিৎসা থেমে গেছে। জিহাদের মা জিয়াসমিন বেগম বলেন, ‘একটা ছেলে যখন পাগল হয়, তখন আর মায়ের জীবনে কিছু থাকে না। ছেলেটা যখন একদিকে চলে যায়, তখন মনে হয় পোলারে পাগল ভেবে মানুষে মাইরা ফালাইবো।’ জিয়াসমিন বেগমের কথায় আমাদের সমাজ যে এ ধরনের শিশুদের প্রতি মানবিক নয়, তা স্পষ্ট। সচেতনতা তৈরিতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। জিহাদের যথাযথ চিকিৎসা ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ তৈরির জন্য সরকারের পাশাপাশি বিত্তশালীদের সহায়তা কামনা করেছেন পরিবারের সদস্যরা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সর্বশেষ (২০১৮ সাল) জরিপে বলা হয়েছে, দেশে ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মানসিক রোগের প্রকোপ বেড়েছে। বর্তমানে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা দেশের মানসিক হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের নেই। ওই জরিপ অনুযায়ী, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় দেশে মাত্র দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। দেশে ৮১৩ শয্যার মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্তর্বিভাগ রয়েছে মাত্র ৪০টি। সে হিসাবে প্রতি এক কোটি জনসংখ্যার জন্য ৫৮টি শয্যা ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া শিশু-কিশোরদের জন্য ২০ শয্যার একটি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্তর্বিভাগ রয়েছে। এমনকি মানসিক রোগীদের চিকিৎসায় বাজেটের ঘাটতি রয়েছে বলেও জরিপে উঠে এসেছে। তবে, আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে শুধু প্রতিবন্ধীদের ভাতা ১০০ টাকা বাড়িয়ে ৮৫০ টাকা করা হবে। যা অপ্রতুল। বিবিএসের হিসাবে দেশের ২.৪ শতাংশ মানুষ শারীরিক, মানসিক বা যে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এ হিসাবে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ৪৭.৪২ লাখ। জরিপের তথ্যে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে প্রতিবন্ধীরা আশঙ্কাজনক হারে পিছিয়ে আছে। জাতীয় পর্যায়ে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় শতভাগ এনরোলমেন্ট হলেও প্রতিবন্ধী শিশুদের মাত্র ৪০.৫৫ শতাংশ স্কুলে যেতে পারছে। বিশেষভাবে চাহিদাসম্পন্ন এসব শিশুর সীমাবদ্ধতাকে প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমে জয় করতে তাদের প্রস্তুত করতে হবে। তাদের স্কুলে পড়ার হার কম হলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের অনেক কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যারা কাজ করতে একেবারে অক্ষম তাদের সরকারের ভাতার আওতায় আনতে হবে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নজর দিতে সমাজকল্যাণ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহি এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সমাজের অবস্থাপন্ন ও বিত্তবানদের এগিয়ে আসা। সার্বিকভাবে জনগণকে সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা দরকার।
শিক্ষাবিদ ও নাট্যকার নুরুল মোমেনের জন্ম ফরিদপুরে ১৯০৬ সালের ২৫ নভেম্বর। ১৯২৪ সালে তিনি ঢাকা মুসলিম হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯২৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ১৯২৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করে ১৯৩৬ সালে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন। তার প্রথম নাটক ‘রূপান্তর’ ১৯৪২ সালে ঢাকা বেতারে প্রচারিত হয়। ১৯৪৭ সালে নাটকটি গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়। তার ‘নেমেসিস’ নাটক শনিবারের চিঠি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৫ সালে এবং গ্রন্থরূপ পায় ১৯৪৮ সালে। নাটকটি পঞ্চাশের দশকের মন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত। এর রচনাশৈলী ও পরিকল্পনা অভিনব। ১৯৪৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে আইনে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তিনি ইংল্যান্ড গমন করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি বিবিসির বাংলা বিভাগে ‘কাকলী’ নামে শিশুদের আসর পরিচালনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালনসহ আইন বিভাগের ডিন, প্রক্টর ও ট্রেজারার ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সমকালীন সমাজের অসংগতি ও দ্বন্দ্ব তিনি ব্যঙ্গরসের মাধ্যমে নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৮৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।
বুধবার (২৯ মার্চ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।
হেফাজতে সুলতানার মৃত্য নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে মোমেন বলেন, ‘হঠাৎ করে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আপনি প্রায় প্রতিদিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের দুর্ঘটনা দেখতে পাবেন।’
‘এই সপ্তাহে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি গণগুলিতে শিশু নিহত হয়েছে। কারও সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে? আমি মনে করি না এই ধরনের দুর্ঘটনা আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করবে।’
এর আগে, নওগাঁ পৌরসভা-চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের অফিস সহকারী সুলতানাকে (৩৮) র্যাব-৫ এর একটি টহল দল ২২ মার্চ সকালে কাজে যাওয়ার সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ধরে নিয়ে যায়। হেফাজতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং তারপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
মোমেন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে অন্যদের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকার নেই।
‘বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে। অন্য দেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের কোনো পাঠের প্রয়োজন নেই।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন খুবই শক্তিশালী।
যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সমস্যা উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের গণতন্ত্র খুবই দুর্বল। তাই তারা দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পক্ষে ওকালতি করার চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দেশে ও বিদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। আমরা এটি সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আছি। আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গত এক দশকে ব্যাপক সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা ভুয়া ভোটারদের মোকাবিলা করার জন্য ছবিসহ ভোটার আইডি তৈরি করেছি। বিগত ১৪ বছরে নির্বাচন কমিশন হাজার হাজার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তাদের প্রায় সবগুলোই ছিল স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। এবং ভবিষ্যতেও আমাদের নির্বাচন হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।’
মোমেন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ‘জাদুকরী’ হিসেবে সমাদৃত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্বব্যাপী আমাদের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এবং ক্রমাগত উন্নয়নের কারণে, বিশ্বের অনেক দেশ এখন আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।’
তিনি আরও বলেন,‘এই স্বাধীনতা দিবসে এবং রমজানের শুরুতে, আমরা অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাছ থেকে অভিনন্দনমূলক চিঠি পেয়েছি।’
মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল নিয়ে বাফুফে যতটা তৎপর, সিনিয়র জাতীয় দল নিয়ে ততটাই উদাসীন। আরো একবার দেশের ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থার সিদ্ধান্ত সেটাই প্রমাণ করল। অর্থাভাবের অজুহাত দিয়ে সাবিনা খাতুন, কৃষ্ণা রানী সরকারদের অলিম্পিক বাছাইয়ে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা।
বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাফুফে বলেছে, ‘মায়ানমার যাতায়াতের বিমান ভাড়া, ইনস্যুরেন্স ফি, সেখানে থাকা-খাওয়া ও ট্রান্সপোর্টশনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচের সংকুলান না হওয়ায় উক্ত প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ মেয়েদের জাতীয় ফুটবল দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
অলিম্পিক বাছাইয়ে বাংলাদেশের মেয়েরা আছে ‘বি’ গ্রুপে। স্বাগতিক মায়ানমারের সঙ্গে গ্রুপে আরও আছে ইরান ও মালদ্বীপ। গ্রুপের খেলাগুলো হবে আগামী ৫ থেকে ১১ এপ্রিল।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে চেয়েছিলাম এই বাছাই পর্বের স্বাগতিক হতে। কিন্তু স্বাগতিক মর্যাদা মায়ানমারকে দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী এখানে অংশ নিতে হলে সব খরচ নিজেদের বহন করতে হবে, যা বহন করার মতো অবস্থায় নেই বাফুফের।’
আবু নাঈম সোহাগ আরও বলেন, ‘আমরা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। সেই সাহায্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরই আমরা দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
গত সেপ্টেম্বরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর আর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি সাবিনারা। এই সফর বাতিল হওয়ায় মাঠে নামার অপেক্ষাটা তাদের আরো বাড়ল।
মেয়েদের জাতীয় দল নিয়ে বাফুফের উদাসীনতার নজির এটাই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৯ সালের এসএ গেমসে মেয়েদের দল পাঠায়নি বাফুফে।
সেবার যুক্তিটা ছিল অদ্ভুত। যেহেতু তখন মেয়েদের জাতীয় দলটি মূলত বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া ছিল, তাই শক্তিশালী দলগুলোর বিপক্ষে খারাপ করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারে। এই কারণের কথা বলে সেবার এসএ গেমসে দল পাঠায়নি বাফুফে।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও 'সময়োচিত সংস্কার পদক্ষেপ' গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশংসা করে বিশ্বখ্যাত সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন সরকার চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক অর্থবিষয়ক সংবাদ সংস্থাটি এক নিবন্ধে লিখেছে, 'তিনি (শেখ হাসিনা) টানা চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।' একই সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পুরো তহবিল পেতে আরও সংস্কার করতে হবে বলেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থ মেয়াদে সম্ভাব্য জয়ী হওয়ার কারণ এটা নয় যে তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছেন বা আইনি ফাঁদে পড়েছেন।
নিবন্ধে বলা হয়, শেখ হাসিনার বিজয়ের কারণ 'কেবলমাত্র তার অনেক প্রতিপক্ষ কারাগারে আছে বা আইনি ফাঁদে পড়েছেন- এটা নয় বরং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সাফল্যের কারণেই এটা ব্যাপকভাবে প্রত্যাশিত।'
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির সময়োপযোগী সংস্কারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণপ্রাপ্তির পটভূমিতে ব্লুমবার্গ দুটি উপশিরোনামসহ 'বাংলাদেশ লিডার বেটস আইএমএফ-ম্যান্ডেটেড রিগর উইল পে অফ ইন পোলস' শিরোনামের এই নিবন্ধটি প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, 'পুরো তহবিল পেতে শেখ হাসিনাকে আরও সংস্কার করতে হবে' এবং 'নির্বাচনে তিনি টানা চতুর্থবারের মতো জয়ী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে'।
ব্যালট বাক্সে পরাজিত হওয়ার ভয়ে বিশ্বজুড়ে সরকারি দলের নেতারা প্রায়শই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে সম্মত সংস্কার বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মতো নন।
তার দ্রুত আইএমএফ ম্যান্ডেটের বাস্তবায়ন দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে যেখানে পাকিস্তান এখনও জ্বালানি ভর্তুকি নিয়ে দুরাবস্থার মধ্যে রয়েছে। শ্রীলঙ্কা স্থানীয় পৌরসভা নির্বাচন বিলম্বিত করেছে, কারণ, তারা গত সপ্তাহে আইএমএফ তহবিল পেতে কর এবং সুদের হার বাড়িয়েছে।
গত জুলাই মাসে আইএমএফের সহায়তা চাওয়া দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মধ্যে সর্বশেষ ছিল বাংলাদেশ। দেশটি দ্রুত জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির পর প্রথম ঋণ অনুমোদন পেয়েছে। ৭৫ বছর বয়সী শেখ হাসিনা এই পদক্ষেপ নিতে কোনো কুণ্ঠা বোধ করেননি।
যদি কোনো নারী কমপক্ষে দুটি মুরগি পালন করেন অথবা কোনো ব্যক্তি যদি সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করেন তাকে শ্রমশক্তির আওতায় এনেছে সরকার। অথচ সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করে কর্মের আওতায় এসেছেন এমন পরিসংখ্যানের হিসাবই দেওয়া হয়নি। গতকাল বুধবার শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে প্রকাশের কথা থাকলে শ্রমশক্তি জরিপটি ছয় বছর পর প্রকাশ করল বিবিএস। এতে বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার বলে উল্লেখ করা হযেছে। যা ২০১৭ সালের জরিপে ছিল ২৭ লাখ। অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার কমেছে ৭০ হাজার। শ্রমশক্তি জরিপ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
সরকারের বেকারত্বের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ৩০ দিনে বেতন বা নিজস্ব পণ্য উৎপাদনের নিমিত্তে কোনো না কোনো কাজ খুঁজে থাকেন এবং গত সাত দিনে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন তবে তাকে বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিবিএস বলছে, করোনার সময় দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়েনি বরং কমেছে। কারণ ওই সময় সরকার বিশেষ অনেক পদক্ষেপ নেওয়ায় এসব বেকারের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তাছাড়া কৃষি খাতে অংশগ্রহণ বাড়ায় বেকারের সংখ্যা কমেছে।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশে এখন ২৬ লাখ ৩০ হাজার বেকার আছে। এর আগে ২০১৭ সালের জরিপে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। ছয় বছরের ব্যবধানে বেকার কমেছে ৭০ হাজার।
জরিপে দেখা গেছে, ছয় বছর আগের তুলনায় বেকারত্বের হারও কমেছে। ২০১৭ সালে বেকারত্ব ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সর্বশেষ জরিপ বলছে, এখন বেকারত্ব কমে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টা মজুরির বিনিময়ে কাজ করার সুযোগ না পেলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, এখন দেশে শ্রমশক্তিতে ৭ কোটি ৩৪ লাখ মানুষ আছে। এর মধ্যে কাজে নিয়োজিত ৭ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার মানুষ। এ শ্রমশক্তির মধ্যে থাকা ৪ কোটি ৭৪ লাখ পুরুষ আর ২ কোটি ৫৯ লাখ নারী। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৯৯ লাখ ১০ হাজার মানুষ শ্রমশক্তির আওতায় এসেছে অর্থাৎ এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
জরিপে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের বিবেচনা করা হয়েছে। গত বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের প্রায় সোয়া লাখ পরিবার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তথ্য সংগ্রহ করা হয় দ্বৈবচয়ন অর্থাৎ লটারি পদ্ধতিতে বাছাইয়ের মাধ্যমে। এর আগে ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপ করেছে বিবিএস। প্রতি চার থেকে পাঁচ বছরের ব্যবধান এ জরিপ করা হয়ে থাকে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেকারদের মধ্যে পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার। আর নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার। পাঁচ বছর আগের চেয়ে নারীর বেকারত্ব কমেছে। বেড়েছে পুরুষের বেকারত্ব। ২০১৭ সালের জরিপে ১৪ লাখ পুরুষ বেকার ছিল। ওই সময় ১৩ লাখ নারী বেকার ছিল।
জরিপ বলছে, মোট সাত কোটি কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তির মধ্যে কৃষি খাতে নিয়োজিত রয়েছে ৩ কোটি ২২ লাখ, শিল্প খাতে ১ কোটি ২০ লাখ এবং সেবা খাতে ২ কোটি ৬৬ লাখ।
জরিপের হিসাবে আরও দেখা যায়, দেশে শ্রমশক্তির বাইরে আছেন ৪ কোটি ৬৯ লাখ মানুষ। এর মধ্যে নারী ৩ কোটি ৪৮ লাখ, পুরুষের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। বেকারত্ব কমে আসার পাশাপাশি কর্মে নিয়োজিত জনবলও বেড়েছে দেশে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী যুবকদের কর্মসংস্থান হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, এ জরিপের মাধ্যমে অর্থনীতির মূল গতিবিধি আমরা বুঝতে পারব। আমরা কোনো তথ্যই লুকিয়ে রাখব না। তিনি বলেন, আমাদের দেশের গৃহিণীরা প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কাজ করেন। তাদের শ্রম হিসাব করা হয় না। তাদের শ্রম হিসাবে এলে জিডিপির আকার ৬০০ থেকে ৭০০ বিলিয়ন হতো। নারীদের শ্রমের প্রকৃত বিচার হয় না। আমরা আশা করছি এখন থেকে এ তথ্য প্রতি তিন মাসেই পাব।
আইএলওর আইন মানা হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আইএলওর মানদ- অনুযায়ী এ জরিপ করা হয়েছে। কডিডের সময় আমাদের দেশে বেকারত্ব কমেছে কারণ সে সময় আমরা শিল্প খোলা রেখেছিলাম। লকডাউনে সড়কে বাস চলাচল করতে দিয়েছি। ১ মিলিয়ন ডলারের বেশি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে সে সময়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, এটি প্রভিশনাল রিপোর্ট। এ তথ্য মূল প্রতিবেদনে পরিবর্তিত হতে পারে। অর্থনীতির হাল বোঝার জন্য এ তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশে বেকার বাড়ছে নাকি কমছে সে তথ্য সরকারের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসব তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেসব প্রশ্ন আসছে, এগুলো সবসময়ই এসে থাকে। এসব প্রশ্ন আসবেই। শহরের মহিলা শ্রমিক কমে গেছে, তার মানে হলো তারা গ্রামে গিয়ে কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে।
বিবিএস বলছে, সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা ও নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ঘরে ঘরে চাকরি প্রদানের বিষয়ে বিশেষ সুযোগ তৈরির প্রচেষ্টায় বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে।
এ সময় শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এহসান-ই-এলাহী বলেন, আমি তো ভেবেছিলাম দেশে শ্রমিক ছয় কোটি, এখন দেখি সাত কোটির বেশি। এটি বড় সুসংবাদ। আমরা আগামী বছরের মধ্যে তিন লাখ শ্রমিকের ডেটাবেজ করব। কারণ আমাদের কাছে সঠিক কোনো ডেটাবেজ নেই।
মেট্রোরেলের উত্তরা দক্ষিণ ও শেওড়াপাড়া স্টেশন আগামীকাল ৩১ মার্চ যাত্রীদের জন্য খুলে দেওয়া হবে। ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) ইতিমধ্যে এ দুটি স্টেশন খোলার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। মেট্রোরেল সেবা পরিচালনাকারী ডিএমটিসিএল সূত্র এ তথ্য জানায়।
উত্তরা দক্ষিণ ও শেওড়াপাড়া স্টেশন চালু হলে যাত্রীরা উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ৯টি স্টেশন ব্যবহার করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন।
ডিএমটিসিএল-এর একজন কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা দুটি দল গঠন করেছি যারা অপারেশনের জন্য উত্তরা দক্ষিণ এবং শেওড়াপাড়া স্টেশনের অপারেশন টিমের সাথে সমন্বয় করবে।'
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম এলিভেটেড মেট্রোরেল উদ্বোধন করেন। রাজধানীর দিয়াবাড়িতে দিয়াবাড়ি-আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ এর ১১.৭৩ কিলোমিটার অংশের ফলক উন্মোচন করেন তিনি। বর্তমানে মেট্রোরেল সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত যাত্রীসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতাকে রড দিয়ে পিটিয়ে মাথা ফাটানোর অভিযোগে পাঁচ নেতাকর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়।
বহিষ্কৃতরা হলেন আইন ও বিচার বিভাগের ইমরুল হাসান অমি, বাংলা বিভাগের আহমেদ গালিব, দর্শন বিভাগের কাইয়ূম হাসান ও আরিফুল ইসলাম এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভিরুল ইসলাম। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকেন।
এদের মধ্যে অমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, গালিব ও কাইয়ূম সহসম্পাদক, আরিফুল ইসলাম কার্যকরী সদস্য এবং তানভিরুল কর্মী বলে পরিচিত। বহিষ্কৃতরা হলে অবস্থান করতে পারবে না বলেও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলামকে রড দিয়ে পেটানো হয়। আহত সাইফুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
সাইফুলের মাথায় তিনটি সেলাই দেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার পলাশ চন্দ্র দাশ।
ভুক্তভোগী সাইফুল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি এবং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, এ মারধরের ঘটনার পাশাপাশি গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ কমিটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ছাত্রলীগের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দুটি মারধরের ঘটনারও তদন্ত করবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন ১৯ নম্বর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন আলবেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার মোহাম্মদ জুলকারনাইন, শহীদ রফিক-জব্বার হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহেদ রানা, জাহানারা ইমাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোরশেদা বেগম এবং সদস্যসচিব ডেপুটি রেজিস্ট্রার মাহতাব উজ জাহিদ।
শৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মারধর এবং সাম্প্রতিক ঘটনা বিবেচনায় চিহ্নিত পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি একটি জেলার ডিসিকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ‘স্যার’ সম্বোধন না করা নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই বিতর্ক আজও চলছে। যদিও দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা নতুন কিছু নয়। প্রশাসনের কর্তা-ব্যক্তিদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময় জনসাধারণের কাছ থেকে স্যার ডাক শুনতে চেয়েছেন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনা-বিতর্কের জন্মও হয়েছে।
তবে এবারের ঘটনাকে কিছুটা ব্যতিক্রম বলতে হয়। খোদ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ডিসি প্রশ্ন করেন তাকে কেন ‘স্যার’ ডাকা হলো না। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা হলো শিক্ষককে সবাই স্যার ডাকবেন; তিনি আরেকজন শিক্ষক ব্যতীত কাউকে স্যার ডাকবেন না।
প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জনসাধারণ স্যার ডাকতে বাধ্য নন। সেখানে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককেই কি না জিজ্ঞেস করা হলো ডিসিকে কেন স্যার ডাকা হলো না!
ঘটনাটা রংপুরের হলেও সুদূর ঢাকা থেকে যতটা বোঝা যায়, এখানে একটা জেন্ডার ইস্যু আছে। এ ঘটনায় দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত সংবাদে ওই নারী ডিসির মন্তব্য হলো, তিনি জানতে চেয়েছেন একজন পুরুষ হলে কি স্যার না ডেকে ভাই ডাকতেন?
এ প্রশ্ন গুরুতর। আমাদের সমাজের জন্য স্বাভাবিক। তারপরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের জাজমেন্টাল না হয়ে স্বাভাবিক কাজ করে যাওয়াটাই প্রাথমিক দায়িত্ব।
একই সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নে আলোচনা হচ্ছে এবারের বিতর্ক নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় বা যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যে শিক্ষার্থীরা ‘স্যার’ ডাকে-তা কতটা যৌক্তিক কিংবা গ্রহণযোগ্য।
বেশ কয়েকজন পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মত দিয়েছেন স্যার ডাকা জরুরি না। তারা স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করেন।
এ বিষয়ে শুক্রবার (২৪ মার্চ) দেশ রূপান্তরে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনটি কয়েকজন শিক্ষকের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে তৈরি করা। তাদের মন্তব্যের সূত্র ধরে দেশ রূপান্তরের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরো কয়েকজন শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, আমাদের সাহিত্যে বা সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে যারা শিক্ষাদান করেন বা পাঠদান করেন, তাদের পণ্ডিত, মাস্টার মশাই, ওস্তাদ, হুজুর এসব নামে সম্বোধন করা হতো, সেটা হঠাৎ স্যার হয়ে গেল কেন?
এ ছাড়া বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে ‘স্যার’ শব্দটি কোন কোন ক্ষমতা বা অর্থকে তার নিজের সঙ্গে ধারণ করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘স্যার’ সম্বোধন কোন তাৎপর্য বহন করে?
এসব বিষয়ে শিক্ষকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তবে তাদের কথায় মিলও আছে।
যেমন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক স্বাধীন সেন বলেছেন, ‘স্যার সম্বোধন ঐতিহাসিকভাবেই আমরা ঔপনিবেশিক ক্ষমতা সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পেয়েছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে স্যার সম্বোধন শোনা বা স্যার সম্বোধনে কাউকে ডাকা ততক্ষণ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সম্বোধন প্রভুত্ব, উচ্চমন্যতা ও ক্ষমতার স্তরবিন্যাসকে প্রকাশ না করে। ভাষা, বিশেষ করে সম্বোধন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণি, লিঙ্গ, ক্ষমতার সম্পর্ক সম্বোধনের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হতে পারে, হয়। স্যার ডাকা কিংবা স্যার ডাক শোনার বাসনা আমাদের দেশে নিতান্তেই নৈমিত্তিক ও স্বাভাবিক হিসেবে পরিগণিত হয়।
কারণ প্রভুত্ব ও দাসত্বের যে অদৃশ্য সম্পর্ক তার মধ্য থেকে ‘স্যার’ সম্বোধন দাপট আর আনুগত্যের প্রচ্ছন্ন সম্পর্ককে জারি রাখে, প্রকাশ করে আর প্রতিষ্ঠিত করে। স্যার ডাক শুনতে চাওয়ার বাসনাকে তাই ক্ষমতা সম্পর্কের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না।
আবার ভাষা ব্যবস্থায় জুতসই শব্দ ব্যবহারের রীতি ও অভ্যাস না থাকায় আধিপত্যবাদী ভাষা দিয়ে আধিপত্য প্রতিরোধের চেষ্টা করি। পদমর্যাদায় ওপরে থাকা নারীদের পুরুষেরা আপা বা ম্যাডাম ডেকে তথাকথিত নৈকট্যের নামে অনেকে হেনস্তা করতে পারে, নির্দেশনা অমান্য করতে পারে, সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা ভেঙে ফেলতে পারে। তখন লিঙ্গ নিরপেক্ষভাবে স্যার সম্বোধনটি তাৎক্ষণিকভাবে আপৎকালীন মোকাবিলার জন্য ব্যবহার হয় অনেক ক্ষেত্রে।
কিন্তু পরিশেষে, স্যার সম্বোধনটি আধিপত্য ও অধীনস্থতার সম্পর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপনিবেশ পূর্বকালেও আধিপত্য বা উচ্চ মর্যাদা বা দরবারি কেতা হিসেবে নানা ধরনের সম্ভাষণ, রীতি ও এমনকি শরীরী অভিব্যক্তি প্রচলিত ছিল। কিন্তু সেই প্রচলন সর্বজনীন যেমন ছিল না, তেমনই সুনির্দিষ্টভাবে মেনে চলাও হতো না। রাজা বা সম্রাট বা অভিজাতবর্গকে লিখিত দলিলে বা দরবারি রীতিনীতির লিখিত রূপে যেভাবে সম্ভাষণ করা হতো, বাস্তব জনপরিসরে সেই সম্ভাষণ অনেক পরিবর্তনশীল ও নমনীয় ছিল।
তার বক্তব্য, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইডিয়া সেখানে বৈষম্য ও পদমর্যাদার প্রসঙ্গটি গৌণ হওয়ার কথা ছিল। অন্ততপক্ষে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। একটি সাংগঠনিক কাঠামো বা ব্যবস্থাতে উচ্চ ও নিচ পদ থাকে। সেই পদাধিকারীগণ নানাভাবে নানা কাজে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু এখনকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগে আমলাতান্ত্রিক করণ কেবল স্বাভাবিক বিবেচিত হয় না, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ তেমন স্তরবিন্যাস ও পদানুক্রম প্রত্যাশা করেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আরাধ্য চাকরি হলো সিভিল সার্ভিস। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন সরকারি চাকরিজীবী হতে চান তার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা যে কেরানি তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল বা যে প্রজা উৎপাদনের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যে প্রজাগণ মনেপ্রাণে ব্রিটিশ হবে, সেই শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ও বৈশিষ্ট্যাবলি আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করছি। তাহলে স্যার সম্বোধনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা স্তরে প্রভুত্ব বা উচ্চ মর্যাদা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হওয়াটা বিস্ময়কর কিছু না।
স্বাধীন সেন দেশ রূপান্তরকে আরও বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত পরিবর্তন না করে, অনুগত অনুসারী শিক্ষক তৈরির কারখানা হিসেবে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বা ‘ভাই’ - যেকোনো সম্বোধনই দাপট, দম্ভ, প্রভুত্বর অভিব্যক্তি হয়ে উঠতে পারে। আমি মনে করি, মার্কিন দেশীয় কিংবা ইউরোপীয় তরিকায় অধ্যাপক অমুক বা তমুক সম্বোধন, বা কেবল নাম ধরে শিক্ষককে সম্বোধন করাটা তখনই ক্ষমতা সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত নমনীয় রাখতে পারে যখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গণতান্ত্রিক, জবাবদিহিতামূলক এবং অব্যাহতভাবে আত্মসমালোচনামূলক ব্যবস্থা জারি থাকে।
তার কথায়, পরীক্ষা পদ্ধতি, শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পদ্ধতি, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে যোগাযোগের ধরন ও প্রকৃতি যদি প্রতিনিয়ত আত্মসমালোচনা করে স্বাধীনভাবে চিন্তার উপযুক্ত করার পরিসর নির্মাণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয় তাহলে যেকোনো সম্বোধনই নিপীড়নমূলক ও প্রভুত্বকামী হয়ে উঠতে পারে। মার্কিন দুনিয়াতেও এমন বৈষম্য ও অসমতার উদাহরণ কম নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেমন পরিবারের ধারণাটি বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষকগণ নিজেদের শিক্ষার্থীদের বাবা, মা বা অভিবাবক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। একটি সংহতি মূলত পরিচয়বাদী বয়ানে আমরা অমুক বিভাগ পরিবার, তমুক হল পরিবার, অমুক ব্যাচের পরিবার ইত্যাদি অভিধা অহরহ শুনতে পাই।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষার্থীরা রিকশাচালক, দোকানদার, বা অন্যান্য পেশাজীবীদের মামা বা খালা সম্বোধনে ডাকেন। এসব ডাকের মধ্যে অবশ্যই একটা পর্যায় পর্যন্ত মানবিক একটা করুণা ও ভালোবাসার অনুভূতি থাকে। কিন্তু যেকোনো সময় এই জ্ঞাতি সম্পর্কসূচক পদাবলি নিপীড়ন, আনুগত্য নিশ্চিতকরণ, অন্যায় আড়ালকরণ বা মর্যাদা জোরজবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। মনে রাখা জরুরি যে, অনেক সময় প্রভু ও দাসের সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে, রাজা ও প্রজার সম্পর্কও মানবিক হয়ে উঠতে পারে। দাস বা প্রজা সামান্য দয়া, বা মানবিকতায় তার আনুগত্য নিশ্চিত করতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘শিক্ষককে’ স্যার সম্বোধন বাধ্যবাধকতামূলক হওয়ার কোনো কারণ নাই। একটা সময় গুরুমুখী শিক্ষাও কিন্তু যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণমূলক আর অধিপতিশীল ছিল, তা যতই আমরা ঐতিহ্যের বড়াই করি না কেন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে আর সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে না-পারেন সেই বিদ্যায়তন তো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত না। শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থী বাহাজ করবেন, মতান্তর হবে। নিরন্তর একে অপরের চিন্তা করার সামর্থ্যকে সমতার ভিত্তিতে প্রসারিত করতে থাকবেন। পরীক্ষার নম্বরের ভয় থাকবে না। কারণ পরীক্ষার পদ্ধতি বা মূল্যায়নের পদ্ধতির সংস্কার করা হবে। শিক্ষককে শিক্ষার্থী চোখে চোখ রেখে বলতে পারবেন যে, স্যার বা অধ্যাপক অমুক, আপনি ভুল বলছেন। আপনার মতামতের বা তথ্যের সঙ্গে আমি একমত না। এই অনুশীলন যেকোনো সম্বোধন বজায় রেখেই চলতে পারে। সম্বোধন ছাড়া কেবল নাম ধরে ডেকেও চলতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমার অনুভব এমনই। আমি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও পড়ানোর স্বপ্ন দেখি।
তিনি বলেন, স্যার সম্বোধনটির ঐতিহাসিক ও জন্মগত আধিপত্য ও প্রভুত্বের সঙ্গে সম্পর্ক বিবেচনা করে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার সম্বোধনটি বিলুপ্ত করা হোক।
স্বাধীন সেন বলেন, স্যারের সঙ্গে একই পাটাতনে দাঁড়িয়ে তর্ক করা, দ্বিমত করা আর পরীক্ষার খাতায় স্যারের মতামতের সমালোচনা লিখে ভালো নম্বর পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্যের মধ্যেই তৈরি হয়। অবশ্য, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আদৌ জ্ঞানচর্চা হয় কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
এ বিষয়ে দেশ রূপান্তর যোগাযোগ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসেন তার সঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক। তিনি শিক্ষকদের স্যার ডাকার প্রসঙ্গকে ভিন্ন খাতে ঘটনাটিকে প্রবাহিত করার চেষ্টা বলে মনে করেন।
তার বক্তব্য, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য থেকে ক্লাসরুমে শিক্ষকদের স্যার বলে ডাকে। আমার জানামতে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুল পর্যায়ে স্যার ডাকতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয় না। এখন যে বিষয়ে কোনো বাধ্য করার বিষয় নেই, বিতর্ক নেই সেই বিষয়ে কথা বলে আমরা মূল বিষয়টা হালকা করে ফেলছি কি না সেটাও ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, আমাকে যদি ক্লাসে কোনো শিক্ষার্থীর স্যার ডাকতে ইচ্ছে হয় ডাকবে, ডাকতে ইচ্ছে না হলে ডাকবে না। শিক্ষার্থীরা কী বলে শিক্ষকদের ডাকবে সেটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। তারা যা বলে সম্বোধন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে আমাকে তাই বলে ডাকবে।
ওমর ফারুকের বক্তব্য, শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে যদি কোন দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাহলে সমাজের মানুষ, রাষ্ট্র, আইন ঠিক করবে কি করা উচিৎ। কিন্তু এ বিষয়ে তো কোন দ্বন্দ্ব নেই। যেটা নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই সেটা নিয়ে আমরা কেন দ্বন্দ্ব তৈরি করছি। আর এটা করতে গিয়ে আমরা কি মূল বিষয় থেকে সরে যাচ্ছি না।
ওমর ফারুক এখানে মূল বিষয় বলতে বুঝিয়েছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্যার ডাকতে সেবাগ্রহিতাদের বাধ্য করেন তা। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল শিক্ষকদের স্যার ডাকা নিয়ে বিতর্ক অনুসন্ধান করা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ দেশ রূপান্তরকে জানান, শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরে চলে গেলেও তাকে স্যার ডাকেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও অনেকে তাকে স্যার ডাকেন।
তিনি বলেন, স্যার ডাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাইতে বাইরের মানুষদের সংখ্যাই বেশি হবে। তবে ভাই ডাকও আমি অনেক শুনি। এগুলোতে আমার কোনো সমস্যা নাই। ‘আনু স্যার’ যেভাবে ডাকে অনেকে সেটা নাম ধরে ডাকাই মনে হয়। তবে আমি আমার শিক্ষকদের স্যারই বলি, শুধু শিক্ষকদেরই, স্যার বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। এই স্যার বস নয়, শিক্ষক।
তার মন্তব্য, সবাই নাম ধরে ডাকলে ভালোই লাগবে। অনেক বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখনও ডাকে।
নৃবিজ্ঞানী ও লেখক সায়েমা খাতুন অবশ্য ইতিহাসের গোড়া ধরেই টান দিয়েছেন। তিনি স্যার অথবা পণ্ডিত যা-ই ডাকা হোক না কেন তাকে পুরুষতান্ত্রিক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, যেহেতু ভাষা বাস্তবতা তৈরি করে, আমাদের কলোনিয়াল লিগেসির বাস্তবতায় স্যার বা ম্যাডাম শ্রেণি ক্ষমতা ও পদমর্যাদার প্রকাশক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতা সম্পর্কের সঙ্গেই এটা চলবে বা বদলাবে। নারী শিক্ষক পণ্ডিত মশাই, ওস্তাদ, হুজুর, মাস্টার বলে সম্বোধিত হয় নাই। কেননা নারীকে শিক্ষক বা পণ্ডিত বলে গ্রহণে সমাজ প্রস্তুত ছিল না। সেই প্রস্তুতির সঙ্গে ভাষাও প্রস্তুত করতে হবে আমাদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী আ-আল মামুনের কাছেও এ প্রতিবেদক বিষয়টি জানতে চেয়েছেন।
তিনি বলেছেন, এটা পরিষ্কার শিক্ষকদের ওস্তাদজি, গুরুজি, গুরু এগুলো বলার একটা অভ্যাস ছিল। খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, উপনিবেশ শাসনের আগে উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এমন ছিল যে এখানে যারা শিক্ষাদানের কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা এর বিনিময়ে কোনো টাকা নিতেন না। সমাজ তাকে যেভাবে আশ্রয় দিত, তিনি বা তারা সেভাবে থাকতেন। লেনদেন বা টাকা দিয়ে পড়ানোর বিষয়টা তখন একদম ছিল না। ফলে সে সমাজ ব্যবস্থায় গুরুজি, ওস্তাদজিদের একটা আলাদা সম্মান ছিল। উপনিবেশ যুগে এসে স্যার শব্দটা আসলো বটে, কিন্ত স্যার শব্দটা এমনভাবে আসলো যে এটা ক্ষমতা কাঠামোর একটা অংশে পরিণত হলো।
তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে দেখেছি, সেখানে জুনিয়ররা অনেকে হয়তো স্যার বলে কিন্ত সেখানে সেখানে শিক্ষকদের দাদা বা দিদি বলাটা বহুল প্রচলিত। কলকাতায় শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক যতটা সহজ বাংলাদেশে কিন্ত সম্পর্ক টা ততটা সহজ না।
শিক্ষকদের স্যার বলা না বলায় কিছু যায় আসে না। তবে না বলাই ভালো বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যদি ওই রকম একতা সম্পর্কের ভেতর যেতে পারে, যেখানে উপনিবেশ আমলের স্যার শব্দটা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, তাহলে তো খুব ভালো হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ক্ষমতার পরিমাপ হিসেবে যেখানে স্যার ব্যবহার হয়, শিক্ষকদের সেখান থেকে বের হয়ে আসা উচিত। শিক্ষকরা যদি বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়।
আ-আল মামুন বলেন, আপনি দেখবেন শিক্ষকদের সঙ্গে এখন শিক্ষার্থীদের সহজ সম্পর্ক নেই। এখন অনেকটা প্রভু বা আনুগত্যের একটা সম্পর্কে এসে এটা দাঁড়িয়েছে। যেটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমি যেমন অনেক সহজে মিশি স্টুডেন্টদের সাথে। ওরা কি বলল না বলল সেটা নিয়ে আমি চিন্তা করি না। বরং তাদের সাথে বন্ধুর মতো মিশি। এর ফলে আমাদের সম্পর্কটা অনেক সহজ থাকে।
কেবল স্যার বাদ দিয়ে অন্য কোন কিছু দিয়ে সম্বোধন করলেই কি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে আ-আল মামুন বলেন, মূল বিষয়টা বুঝতে হবে। বিষয়টা এমন নয় যে স্যার বললেই কেবল দূরত্ব থাকে আর দাদা ভাই বা মিস্টার বললেই সব সংকট দূর হয়ে যাবে। কেবল স্যার না বললেই যে ছাত্র-শিক্ষকের প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক সেটা শেষ হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়। এখন ইস্যুটি ভাইরাল হওয়ার ফলে শিক্ষকরা উৎসাহের সাথে ফেসবুকে 'শিক্ষার্থীদের স্যার ডাকতে নিরুৎসাহিত করছি' বললেই ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করা হয়ে যাবে না। এই পপুলারিজম থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। যারা ফেসবুকে লিখছেন তাদের কেউ কিন্তু এটা বলছেন না যে তারা ক্ষমতাকাঠামো পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। তারা কিন্তু ক্ষমতার চর্চা ঠিকই করেন।
তিনি বলেন, ইউরোপে বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে, যারা পরবর্তীতে শিক্ষা নিয়ে কাজ করবে, বা অন্য কোন বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণা করতে চান কেবল তারা ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসেন। আর যারা এমনিতে পড়াশোনা করবে তারা বিভিন্ন ধরনের প্রফেশনাল ট্রেনিং নেন, কোর্স করেন তারা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন না বা যেতে হচ্ছে না। এর ঠিক বিপরীত সিস্টেম বাংলাদেশে। এখানে যেটা ঘটে তা পুরো গোলমেলে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় , আমাদের দেশের সাংবাদিকতা বিভাগের বিষয়ে সবার ধারণা আমাদের প্রধান কাজ মনে হয় সাংবাদিক তৈরি করা। এমনকি সরকার ও তাই মনে করছে। কিন্তু আমাদের তো মূল কাজ হওয়া উচিত মিডিয়াকে স্টাডি করা, তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, মিডিয়া নিয়ে গবেষণা করা। সরকার মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেশকে কর্মী সরবরাহ করা হবে।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষক ক্ষমতার চর্চা, বিশেষ করে শিক্ষক রাজনীতি বা অন্য কোন ক্ষমতার চর্চা করেন, তারা প্রত্যাশা করেন যে জুনিয়র শিক্ষকেরা তাদের স্যার ডাকবে। শিক্ষকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। অনেক জুনিয়র শিক্ষক হয়তো জানেন ই না যে একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি কি অধিকার আছে। তিনি অন্য যে কোন শিক্ষকের সমান এটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় একজন শিক্ষক বুঝতেও দেওয়া হয় না। জুনিয়র যদি সম্মান না করে সিনিয়র শিক্ষকেরা তাদের বিভিন্ন সমস্যায় ফেলে দেন। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া, দুর্নাম রটনা করা ও মিটিংয়ে হয়রানি করা হয়। আমাদের দেশে আলোকিত শিক্ষক কম। সবাই তথাকথিত শিক্ষক অনেকটা সরকারি আমলাদের মতো। আমলাদের যেমন ক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ করার মানসিকতা তেমনি শিক্ষকরাও একই চিন্তা বহন করছেন। ফলে এই স্যার ডাক শোনার বাসনা তাদের মনে কাজ করে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অধীনতার দাবি করে। আমাকে স্যার বা ভাই বলুক এতে শিক্ষার্থীদের সাথে বা অন্য কোন শিক্ষকের সাথে সম্পর্কের কোন তফাত হয় না।
তিনি বলেন, আমি ক্ষমতা কাঠামোকে অস্বীকার করে তাদের সাথে বন্ধুর মত মিশি। আমার বাসায় নিয়ে আসি এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে চাই। বর্তমান এই ভাইরাল ইস্যুর জন্য অনেকেই হয়তো স্যারের পরিবর্তে ভাই ডাকতে বলবে, আবার ক্ষমতার চর্চা করবে। যা বিপরীতমুখী এবং এর ফলে ক্ষমতা কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন আসবে না। ফলে এখন এটা ভাবতে হবে, ক্ষমতার চর্চার মানসিকতা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়।
তিনি কথা শেষ করেন এই বলে, এখন আমাদের সমাজে তথাকথিত ভিআইপির সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এটা এমন মহামারি আকার ধারণ করছে যে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও এই তথাকথিত ভিআইপিদের ছড়াছড়ি। তাদেরকে প্রোটোকল দেওয়া হয়। এই যে একটা মোহ এখান থেকে কেউ বের হতে চান না। অথচ একটা দেশে ভিআইপি বলে কেউ থাকতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো ও আমলাতন্ত্র এ প্রবণতাকে টিকিয়ে রাখছে। গত ১০/১২ বছরে আমাদের সমাজে স্যার শুনতে চাওয়ার মানসিকতার লোকের সংখ্যা কিন্তু কয়েকগুণ বেড়েছে। এই প্রাদুর্ভাব আগে এত ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, স্যার বলার মধ্যে দিয়ে আমরা নিজেদের এক্সক্লুসিভ কোনো প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। সেই প্রবণতা থেকে স্যার ডাক শুনে একটা দাপট বোঝাতে চাই। এটা পুরোপুরি ঔপনিবেশিক চর্চা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেলেও, আমাদের মাথার মধ্যে সেই শাসনের বৈশিষ্ট্যগুলো পুরো মাত্রায় বিদ্যমান।
তার মতে, এটাকে আমরা আধিপত্যের প্রতীকে পরিণত করেছি। ব্রিটিশরা নিজেরা স্যার না বললেও তারা যেখানে শাসন করেছে, আধিপত্য দেখিয়েছে, সেখানে তারা স্যার বলাটা অভ্যাস হিসেবে তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি ব্রিটেনে পড়াশোনাকালীন শিক্ষার্থীদের কখনো কোনো শিক্ষককে স্যার বলতে শুনিনি বা দেখিনি। তারা মি. প্রফেসর বা নাম ধরেই ডাকতো।
তানজিম উদ্দিন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমলাতন্ত্র। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু পুরোপুরি ঔপনিবেশিক কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। শাসক এবং শোষিতের যে কাঠামো এখনো তাই রয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের যে মানসিকতা থাকা উচিত আমাদের কিন্তু তা গড়ে ওঠেনি। আমাদের মধ্যে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানি আমলের আমলাতন্ত্র একইভাবে, একই পদ্ধতিতে এখনো রয়ে গেছে। কেবল আমলাতন্ত্র নয় সামাজিক অবস্থানেও স্যার বলা দিয়ে একটা আধিপত্য দেখানো হয়। স্যার দিয়ে আমি যে অধিপতি সেটা বোঝাতে চাই।
তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা থেকে কোনোভাবে মুক্ত নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় তো সমাজ ব্যবস্থার অংশ। আর এই সংকটটা বর্তমানে পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না স্যার বলাটা একান্ত জরুরি। বরং আমার শিক্ষার্থীরা যদি আমাকে প্রফেসর তানজিম বলে ডাকেন এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং আমি উৎসাহ দেব।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন দেশ রূপান্তরের সহসম্পাদক আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।)
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তাকে প্রায়ই বিভিন্ন ভাইরাল ইস্যু নিয়ে ফেসবুক লাইভে কথা বলতে দেখা যায়। যুবলীগে পদ পেয়েও পরে অব্যাহতি পেয়েছেন। সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেশ রূপান্তরের সাথে মুখোমুখী হয়েছিলেন ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল তোফায়েল।
সামাজিক যোগাযাগ মাধ্যমে আপনি যে ভিডিও আপলোড করেন এর প্রধান উদ্দেশ্য কি টাকা ইনকাম করা?
বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে টাকা ইনকামের সুযোগ আসার কয়েক বছর আগে থেকেই আমি ভিডিও আপলোড করি। আমার প্রথম যে কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল তখন মনিটাইজেশন নামে কোন শব্দের সাথে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আমার ফেসবুক থেকে যে ইনকাম হয়, ব্যারিস্টারি থেকে যে আয় হয় এবং বিদেশে থাকা আমার পরিবারের মানুষেরা যে টাকা পাঠান তার সব আমি মানুষের জন্য খরচ করি। এর প্রমাণ হিসাবে দেশে বিদেশে আমার নামে কিংবা আমার পরিবারের কারও নামে কোন ফ্ল্যাট নেই।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া স্যার ইস্যু নিয়ে আপনার অবস্থান কি?
স্যার ম্যাডাম মহোদয় এইগুলো নাম নাম মাত্র। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাজে কতটুকু এগোলাম আমরা। একজন মানুষ যে কাজে সরকারী অফিসে যান সেই কাজ টা যদি ঠিক মত হয় তাহলে কি নামে ডাকলেন সেটা কোন সমস্যা বলে আমার কাছে মনে হয়না। এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা কেবল সময়ের অপচয় মাত্র।
আপনি নমিনেশন চাইবেন আওয়ামী লীগ থেকে?
আমি আওয়ামী লীগ থেকে নমিনেশন চাইব। দল যদি আমাকে নমিনেশন দেয় আমি নির্বাচন করব। না হলে দল যাকে নমিনেশন দেবে আমি তার হয়ে কাজ করব।
যুবলীগ থেকে আপনাকে বহিষ্কারের পর আপনার কেমন লেগেছিল, আপনার অবস্থানে কি আপনি অনড়?
আমার কাছে একদম খারাপ লাগেনি। নেতা যাকে ইচ্ছে নিতে পারেন, আবার প্রয়োজন না হলে ফেলে দিতে পারেন। আমাকে যখন যুবলীগে নেওয়া হয়েছিল, তখন হয়তো আমাকে প্রয়োজন ছিল, এখন মনে হয় হয়তোবা আমি যেভাবে কাজ করি তা উনাদের পছন্দ না। তবে যে বক্তব্য দিয়েছিলাম সে বিষয়ে আমি অনড়। একজন ওসি কখনো নির্দিষ্ট এমপি কে খুশি করার জন্য স্লোগান দিতে পারেন না।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আপনাকে কথা বলতে কম দেখা যাচ্ছে কেন ?
দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা বিশ্ব পরিস্থিতির অংশ। শ্রীলংকা, পাকিস্তানের মত দেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আমরা টিকে আছি। আমাদের অধিকাংশ জিনিস আমদানি করতে হয়। তাই এ সমাধান আমাদের হাতে নেই। তবে আমি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি নিয়ে কথা না বললেও দুর্নীতি নিয়ে কিন্তু প্রতিদিন কথা বলতেছি। দুর্নীতি আর টাকা পাচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে জিনিস পত্রের দাম এত বাড়ত না। তাই বলতে পারেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলা আমার অন্য সবকিছুকে কাভার করে।
শোনা যায় অনেকেই রাজনীতি করে কানাডায় বাড়ি কিনছেন, এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
রাজনীতিকে এখন ওনারা ধারণ করেন না। এমপি পদ টাকে তারা আরও সম্পদ উপার্জনের সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। ওনারা মনে করেন পরেরবার এমপি মন্ত্রী হতে পারেন বা না পারেন টাকা বানিয়ে ফেলি যাতে আর অসুবিধা না হয়।
আব্দুস সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে বানানো ভিডিও সরিয়ে ফেলতে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন।এটা কি আপনার পরাজয়?
সালাম মুর্শেদিকে নিয়ে আমি অনেকগুলো ভিডিও বানিয়েছি। এর মধ্যে মাত্র ২টা ভিডিও সড়াতে হয়েছে। মামলা চলাকালীন সময়ে মামলার মেরিট যেন নষ্ট না হয় এর জন্য ভিডিও সড়াতে বলা হয়েছে। এটাকে আমি পরাজয় মনে করি না।
বর্তমান সরকারকে অনেকে অনির্বাচিত বলেন, এ বিষয়ে আপনার অবস্থান কি?
সংবিধান মেনে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। প্রক্রিয়া নিয়ে অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে। রাজনৈতিক বিষয়ে যা ঘটেছে বা ঘটছে তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। এ নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে আপনার অবস্থান কি?
পারস্পরিক আস্থার অভাব হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর বিশ্বাস কতটুকু সেটাও ভেবে দেখতে হবে। একটা সময় আওয়ামী লীগ এই দাবিতে আন্দোলন করেছিল তখন কিন্ত বিএনপি এই দাবি মেনে নেয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বিষয়টা এমন নয়।
রাজনীতির চেয়ে সামাজিক ইস্যুতে আপনাকে বেশি কথা বলতে দেখা যায়। এটা কি সুবিধাজনক অবস্থান?
একজন সাধারণ মানুষ হিসাবেই আমার রাজনীতিতে আসা। আমার বাবা বা অন্য কেউ এমপি মন্ত্রী নয়। যে আমি এমনি এমনি রাজনীতিতে আসছি। আমি সামাজিক কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসছি। আমি যদি রাজনীতিতে পুরোদমে প্রবেশ করি তখনও দেখবেন আমি সামাজিক বিষয় নিয়ে কথা বলব কাজ করব।
সাকিব আল হাসানকে নিয়ে আপনার অবস্থান?
একটা ভিডিওতে তিন লাখ টাকা সাকিবকে দেওয়া নিয়ে আমার মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সোনারগাঁ হোটেলের লবিতে সাকিব আমাকে মারতে আসেন। আমি মনে করি, সাকিবকে কোটি মানুষ অনুসরণ এখন তিনি যদি জুয়ার এম্বাসেডর হন টাকার লোভে মার্ডারের আসামীর দাওয়াতে যান তাহলে আমাদের দুর্ভাগ্য।
ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
আমি সরাসরি বলব বাংলাদেশের ফুটবল ধ্বংস করার কারিগর কাজী সালাউদ্দীন ও আব্দুস সালাম মোর্শেদি। তারা ফুটবল কে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেরা এগিয়ে গিয়েছেন। ফুটবলকে সিঁড়ি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করছেন।
ফুটবল নিয়ে অনেক আগ্রহ আপনার , অগ্রগতি কতদূর?
আমার ক্লাবের অগ্রগতি অনেক। গত দেড় বছরে ১২ জন খেলোয়াড় ঢাকার বিভিন্ন লীগে খেলছেন। ৩ জন খেলোয়ার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি সি টিমে থাকা ২/৩ জন ( যাদের বয়স ১২-১৩) আগামীতে জাতীয় দলে খেলবেন এটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলে দিতে পারি।
বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করায় বিদ্যুৎ বিভাগের ১২টি প্রতিষ্ঠান নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে কর্মীদের ‘ইনসেনটিভ বোনাস’ প্রদান করলেও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ক্ষেত্রে এ সুবিধা দিতে অপারগতা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ বিরাজ করছে।
প্রতি অর্থবছরে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কী কী কাজ করবে তা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে অন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা দলিল হলো বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা জোরদার করার পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতেই এ চুক্তি করা হয়।
সূত্রমতে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তির (এপিএ) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য গত ২৯ ডিসেম্বর এক সভায় ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী তা অনুমোদন দেয়। গত ২ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের সহকারী সচিব মোহাম্মদ লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এপিএ অর্জনের সামগ্রিক মূল্যায়নে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শতকরা ৯৯ দশমিক ৩২ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটিকে তার কর্মীদের ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ডিপিডিসি এবং ওজোপাডিকোকে ১ দশমিক ৫টি ইনসেনটিভের সুপারিশ করা হয় যাদের প্রাপ্ত নম্বর যথাক্রমে ৯৬ দশমিক ৬৯ এবং ৯৫ দশমিক ২৩। নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড এবং পিজিসিবি এ চারটি প্রতিষ্ঠানকে ১ দশমিক ২৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের সুপারিশ করা হয়েছে। ১টি ইনসেনটিভ বোনাসপ্রাপ্তরা হলো বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ড (৯২.০৮), নেসকো (৯২.২৫) এবং আরপিসিএল (৯৩)। এ ছাড়া ডেসকো, ইজিসিবি এবং বি-আর পাওয়ারজেন শূন্য দশমিক ৫টি ইনসেনটিভ বোনাসের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে সুপারিশ অনুযায়ী কর্মীদের বোনাস প্রদান করে। তবে পিডিবির কর্মীরা এখনো ইনসেনটিভ বোনাস পাননি। আদৌ তা পাবেন কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
ইনসেনটিভ বোনাস পরিশোধের অনুমোদনের প্রস্তাব অর্থ বিভাগে পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে গত ২ জানুয়ারি পিডিবির সচিব মোহাম্মদ সেলিম রেজা বিদ্যুৎ বিভাগে চিঠি পাঠান। এতে বলা হয়, ১টি ইনসেনটিভ বোনাস হিসেবে পিডিবির প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পিডিবির রাজস্ব বাজেটে সংস্থান আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে অর্থ বিভাগের এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানোর পর গত ২১ মার্চ তা নাকচ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ বিভাগ তাদের চিঠিতে বলেছে, এপিএ অর্জনের জন্য কর্মসম্পাদন সূচক রয়েছে, যা সরকারের প্রতিটি সংস্থার ‘রুটিন’ কাজ। রুটিন কাজের জন্য ইনসেনটিভ বোনাস দাবি করা যৌক্তিক নয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, দেশে অনেক সংস্থা আছে, যাদের বেতনভাতাসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় সরকারের অনুদানে পরিচালিত হয়। এসব সংস্থা বা দপ্তরগুলো এপিএ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে থাকে। এখন যদি পিডিবিকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বোনাস দেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটি সংস্থা থেকে একই দাবি আসবে। এতে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা বিঘিœত হতে পারে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিপরীতে ইনসেনটিভ বোনাস প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করা হলো।
বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব ফাওজুল কবির খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের অগ্রগতি সন্তোষজনক না। তারপরও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন কোম্পানি বা সংস্থাকে ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া যেতে পারে তাদের কাজের পারফরম্যান্স বিবেচনায়। শুধু পুরস্কার দিলেই হবে না। পাশাপাশি কেউ যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয় তাহলে শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কাজের গতি বাড়বে। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিতে যদি ইনসেনটিভ বোনাসের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তারা যদি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে তবে এটা তাদের প্রাপ্য।
এ বিষয়ে পিডিবির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেশ রূপান্তরকে বলেন, এর আগেও তারা এপিএর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বোনাস পেয়েছেন। এবারও বোনাসের আশায় বাড়তি কাজ করেছেন। হঠাৎ বোনাস না পাওয়ার খবর শুনে সবার ভেতর চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
প্রতিষ্ঠানের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সব কোম্পানি এমনকি পিডিবির সমমনা প্রতিষ্ঠান আরইবি তাদের পরিচালনা পর্যদের সিদ্ধান্তে অন্তত এক মাস আগে এ বোনাস প্রদান করেছে। তাদের কর্মীদের ওই টাকা খরচও হয়ে গেছে। আর আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাওয়ার নিয়ম রক্ষা করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছি। অন্যরা পেলেও পিডিবির কর্মীরা কেন বঞ্চিত হবে? সবার জন্য একই নিয়ম থাকা দরকার।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন নির্বাহী প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অনেক সময় অফিসের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করতে হয়। এ জন্য অনেক সময় পরিবারকে সময় দিতে পারি না। এরপরও যদি বোনাস থেকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে কর্মীরা বাড়তি কাজ করতে উৎসাহ হারাবে।’
ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভাড়া ৫৩ হাজার টাকা। এ রুটের অন্যসব এয়ারলাইনস আরও কম দামে যাত্রী বহন করলেও বিমান করে না। খালি যাবে, তাও কম ভাড়ায় যাত্রী নেয় না বিমান।
ঢাকা থেকে বিমান কত বেশি ভাড়া নেয় তা স্পষ্ট বোঝা যায় নিকটতম প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকে চোখ বোলালে। কলকাতার নেতাজি সুভাষ বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানের তিন ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে কুয়ালালামপুর যাওয়া যায়।
ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে উড়ে যাওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে বিমানের ভাড়া বেশি। বিমানের ভাড়া শুধু বেশিই নয়, এই এয়ারলাইনস ভাড়া বাড়ানোর নেতৃত্ব দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রথমে বিমান ভাড়া বাড়ায় পরে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এয়ারলাইনসগুলো সেই সুযোগ নেয়।
অন্য এয়ারলাইনসের তুলনায় বিমানের ভাড়া বেশি এ অভিযোগ ছিল মূলত জনশক্তি রপ্তানিকারক ও ট্রাভেল এজেন্টদের। তাদের সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন সাধারণ যাত্রীরাও। কুয়ালালামপুর, রিয়াদ বা জেদ্দার মতো বাংলাদেশি শ্রমিকপ্রবণ শহরগুলোতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ব্যবহারকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, দেশের বেসরকারি টেলিভিশন এমনকি খবরের কাগজগুলোতে যেচে এসে বলে যাচ্ছেন বিমান অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছে।
কীভাবে বিমান ভাড়া বাড়ায় জানতে চাইলে একজন জনশক্তি রপ্তানিকারক জানান, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে কী ভূমিকা রাখে তা নতুন করে বলার দরকার নেই। তাদের কর্মস্থলে পাঠাতে বা ফিরিয়ে আনতে বিমানের বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেই। বিমান কোনো দিন কোনো ঘোষণায় বলেনি ‘এ উদ্যোগটি শুধু রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য’। এই শ্রমজীবীদের জন্য বিমানের কোনো ছাড় নেই। বরং যখন যে ‘আদম বাজার’ চাঙ্গা হয় তখন সেখানে ভাড়া বাড়িয়ে দেয় বিমান। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রচুর শ্রমিক যাচ্ছে। সেখানে ভাড়া বাড়িয়েছে সংস্থাটি। শ্রমিক এবং ওমরাহর কারণে জেদ্দার টিকিটই পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও তা অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়।
এ অবস্থা থেকে বিমান কীভাবে বের হয়ে আসতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিমান নানা পলিসি নিতে পারে। বিকল্প রুট চালু করতে পারে। ট্রানজিট দিয়ে যাত্রীদের গন্তব্যে নিতে পারে। এতে যাত্রীরা কম দামে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ যাত্রী যেহেতু শ্রমজীবী তাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। কত সময় ট্রানজিট নিয়ে গেল তা মুখ্য নয়। ঠিক এ জায়গাটিতেই এগিয়ে আছে আমাদের নিকটবর্তী শহর কলকাতা। ঢাকার তুলনায় অনেক কম দামে কলকাতার যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছতে পারেন। সেখান থেকে পরিচালিত এয়ারলাইনসগুলো সরাসরি বা এক-দুটি ট্রানজিট দিয়ে অনেক কমে যাত্রী বহন করে। বিমান কেন পারে না সেই প্রশ্নটি কেউ তুলছে না।
এক সপ্তাহ পর আগামী ৪ এপ্রিল ফ্লাই (যাত্রা) করার জন্য গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা কুয়ালালামপুর রুটের বিমান টিকিটের দাম ছিল ৫৩ হাজার ২৭ টাকা। থাই এয়ারওয়েজ ৪১ হাজার ৭৬ টাকায়, ইন্ডিগো এয়ার ৪৩ হাজার ৬৪৪, ইউএস-বাংলা ৪৭ হাজার ১৯, এয়ার এশিয়া ৪৯ হাজার ৪৪৫, মালিন্দো এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৯০ এবং মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের ভাড়া ছিল ৬১ হাজার ৪৭২ টাকা।
অথচ কলকাতা থেকে এয়ার এশিয়া একই দিনে একই গন্তব্যে নন-স্টপ ফ্লাইটে মাত্র ১৭ হাজার ৩৭৯ টাকায় পৌঁছে দেওয়ার অফার ছিল অনলাইনে। এয়ারক্রাফটের মানভেদে একই দিনে বিভিন্ন সময়ে টিকিটটির দাম ২৬ হাজার টাকা পর্যন্ত ছিল। ইন্ডিগো এয়ার চেন্নাইয়ে একটি স্টপেজ দিয়ে ২০ হাজার ৩৩৭ টাকায় অফার দেয়। কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে যাওয়ার জন্য এয়ার ইন্ডিয়ার টিকিটের দাম ছিল ২৯ হাজার ৬৩৯ টাকা। মুম্বাই এবং সিঙ্গাপুরে দুই স্টপেজ দিয়ে এয়ারলাইনসটি এ ভাড়া নির্ধারণ করে। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনস মুম্বাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে কলকাতা থেকে ৫৪ হাজার ৩২৬ টাকায় যাত্রীদের নিয়ে যায় কুয়ালালামপুর।
ঢাকা রিয়াদ রুটে আগামী ৩ এপ্রিলের এয়ার অ্যারাবিয়ার ভাড়া ৫৪ হাজার ৯৫১ টাকা। শারজায় একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কলম্বোতে একটি স্টপেজ দিয়ে শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস রিয়াদ নিয়ে যাবে ৫৬ হাজার ৫৪৫ টাকায়। জাজিরা কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৫ হাজার টাকায়, গালফ এয়ার বাহরাইনে এক স্টপেজ দিয়ে ৬৭ হাজার ৬৭৭ টাকায়, সৌদিয়া এয়ারলাইনস ৭১ হাজার ৭১১ টাকায় সরাসরি, কুয়েত এয়ারওয়েজ কুয়েত সিটিতে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৩ হাজার ২৪৭ টাকায়, ওমান এয়ার মাস্কটে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৩২ টাকায়, ফ্লাই দুবাই দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৭৪ হাজার ২৬৩ টাকায়, কাতার এয়ারওয়েজ দোহায় এক স্টপেজ দিয়ে ৮২ হাজার ৫৫৭ টাকায়, এমিরেটস দুবাইয়ে এক স্টপেজ দিয়ে ৮৪ হাজার ২৩১ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে। আর ঢাকা-রিয়াদ রুটে বিমানের ভাড়া ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৪৭ টাকা। ৩ এপ্রিল কলকাতা থেকে রিয়াদ যাওয়ার ভাড়াও ঢাকা রিয়াদের তুলনায় অনেক কম।
কলকাতা থেকে মাত্র ৩৫ হাজার ৩২৪ টাকায় রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। মুম্বাইতে মাত্র একটি স্টপেজ দিয়ে তারা যাত্রীদের সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। ওইদিন সময়ভেদে তাদের ভাড়া ৪১ হাজার টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করছে। এক স্টপেজ দিয়ে ফ্লাই দুবাই নিয়ে যাচ্ছে ৪১ হাজার ৫৬০ টাকায়। ইতিহাদ এয়ারওয়েজের ভাড়া ৪১ হাজার থেকে ৪২ হাজার টাকা। এয়ার ইন্ডিয়া দিল্লিতে একটি স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪১ হাজার ৪১৯ টাকা। গালফ এয়ার মুম্বাই এবং বাহরাইনে দুই দফা স্টপেজ দিয়ে নিচ্ছে ৪৫ হাজার ৫৮৭ টাকা। ইন্ডিগো এয়ার দিল্লিতে এক স্টপেজ দিয়ে ভাড়া নিচ্ছে ৪৮ হাজার ১৮৭ টাকা। দুবাইতে এক দফা বিরতি দিয়ে এমিরেটস কলকাতা থেকে রিয়াদের ভাড়া নিচ্ছে ৫৪ হাজার ৬৪৬ টাকা। কাতার এয়ারওয়েজ ৫৯ হাজার ১৩৮ টাকায় এবং এমিরেটস ৬০ হাজার ১০৮ টাকায় একটি বিরতি দিয়ে কলকাতা থেকে রিয়াদ নিয়ে যাচ্ছে।
এসব রুটে বিমানের উচ্চমূল্য নির্ধারণই ভাড়া বৃদ্ধির মূল কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এর সঙ্গে আছে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলোর ফ্লাইট কমানো এবং উচ্চ দামের সুযোগ নিতে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কারসাজি এবং ২০২৩ সালে ডলারের বর্ধিত বিনিময় দর। জেট ফুয়েলের দাম বৃদ্ধিও টিকিটের দাম বৃদ্ধির কারণ।
বিমানের এমডি শফিউল আজিম বিমান ভাড়া বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি না মানলেও রিক্রুটিং এজেন্ট, ট্রাভেল এজেন্ট বা হজ এজেন্সির তরফ থেকে বরাবরই এ অভিযোগ করা হচ্ছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, যখন বিমান ভাড়া বাড়ায় তখন অন্য এয়ারলাইনসগুলোও ভাড়া বাড়ায়। বিমান যখন বাড়ায় তখন কোনো সীমা মানে না। তারা ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ায়।
৩৫ বছরের পেশাজীবনের কথা উল্লেখ করে মাজহারুল ইসলাম বলেন, বিমানের ভাড়ার সঙ্গে কুলাতে পারছি না। একজনকে বাইরে পাঠানোর সব খরচ অনুমান করা যায়, বিমান ভাড়া ছাড়া। কারণ ৫ ডলারের ভিত্তিভাড়া তারা ৩০ ডলার থেকে শুরু করে। বিমান ধারাবাহিকভাবে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির কথা বলে। কিন্তু জ্বালানি খরচ কমছে। যখন কমে তখন বিমান ভাড়া কমায় না। বিমান যেভাবে ভাড়া বাড়ায় তাতে ব্যবহারকারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপ দরকার বলে তিনি মনে করেন।
বিমানের ভাড়া প্রায় মহামারীর সময়ের মতো অবস্থায় চলে গেছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টরা । বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে শ্রম আমদানিকারক দেশের গন্তব্যগুলোতে ভাড়া বেড়েছে। ঢাকা-জেদ্দা রুটে টিকিট পাওয়াই সৌভাগ্য। এ মাসের শুরুতে যে ভাড়া ছিল ৫০ হাজার তা এখন ৮০ হাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না।
বিমান ভাড়া বৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি)-ওয়েবসাইট তথ্য দিচ্ছে, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ২ লাখ ১৩ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছে। যাদের বেশিরভাগই গেছেন মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।
গত বছরের শেষদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলা হয়। বাজার নতুন করে শুরু হওয়ার পর ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটে টিকিটের দাম আকস্মিকভাবে বেড়েছে। ব্যাংকক, কলম্বো বা অন্যান্য শহরে ট্রানজিট ফ্লাইট দিয়েও অনেক এয়ারলাইন কুয়ালালামপুরে যাত্রী বহন করছে। এতে টিকিটের দাম কমেছে ৩০-৪০ হাজার টাকা।
এবার হজ প্যাকেজে বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এ টাকা বাড়িয়ে হজ প্যাকেজ ঘোষণার পর সংশ্লিষ্টরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হজযাত্রী এবং হাবের ধারাবাহিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে বিমান ভাড়া বাড়িয়ে যচ্ছে। এবারও বাড়িয়েছে। গত ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হজবিষয়ক এক সভায় হাবের সিনিয়র সহসভাপতি ইয়াকুব শরাফতি হজে বিমান ভাড়া কমানোর অনুরোধ করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত বিমানের এমডি ভাড়া কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান। বৈঠকে হজে কেন বিমান ভাড়া বাড়নো হলো তার যৌক্তিকতা জনসমক্ষে তুলে ধরার নির্দেশনা দেওয়া হয় এমডিকে।
ইয়াকুব শরাফতি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেছি হজের বিমান ভাড়া কমানোর জন্য। বিমান কোনোভাবেই কমাতে রাজি হয়নি।’
বিমানের বর্ধিত ভাড়ার সুযোগে সৌদিয়া দেশ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে যাচ্ছে। কারণ বিমান যে ভাড়া নির্ধারণ করে সৌদিয়াও একই ভাড়ায় হজযাত্রী বহন করে। হজের চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশি হজযাত্রীদের অর্ধেক বহন করবে সৌদি আরবের এয়ারলাইনস।
আটাবের সাবেক মহাসচিব মাজহার ইসলাম ভূঁইয়া জানান, প্রধান এয়ারলাইনসগুলোর পাশাপাশি এয়ার অ্যারাবিয়ান, ফ্লাই দুবাই, সালাম এয়ারের মতো বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলো তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের তুলনায় কম ভাড়া নেওয়ার কথা। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের চেয়ে বেশি নিচ্ছে। বাজেট ক্যারিয়ার বলে পরিচিত সংস্থাগুলোও তাদের প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে মাত্র ৫০০ বা ১০০০ টাকা কম নিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম প্রতিযোগীদের চেয়ে বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অথচ সরকারের কাছে তাদের প্রজেকশন ছিল তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে অর্ধেক মূল্যে যাত্রী নেবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার মনিটরিং কম থাকায় তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।