
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় এক্সপ্রেসওয়ের রেলিংয়ে ধাক্কার পর অ্যাম্বুলেন্সের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক পরিবারের ৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে তিনজন নারী ও চার শিশু রয়েছে। এছাড়া চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সটির চালকেরও মৃত্যু হয়। গতকাল শনিবার সকাল ১১টার দিকে ভাঙ্গা উপজেলার মালিগ্রাম এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
সামনের বাম দিকের চাকা ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিংয়ে ধাক্কা খেয়ে গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে অ্যাম্বুলেন্সটিতে আগুন ধরে যায় বলে ধারণা করছেন ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কর্মকর্তারা।
নিহতরা হলেন বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের ফেলাননগর গ্রামের প্রবাসী আজিজার রহমানের স্ত্রী তাছলিমা বেগম (৫০), তার মেয়ে কমলা বেগম (৩০), বিউটি বেগম (২৬), নাতি হাসিব (১০), হাফসা (১), আরিফ (১২) ও মেহেদি (১২) এবং অ্যাম্বুলেন্সটির চালক ফরিদপুর শহরের লক্ষ্মীপুর এলাকার মৃদুল মালো (৩৫)। এর মধ্যে কমলা বেগম ঢাকায় বসবাস করতেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পদ্মা সেতুর ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের মালিগ্রাম ফ্লাইওভারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি রেলিংয়ে ধাক্কা খায়। এ সময় গ্যাসচালিত অ্যাম্বুলেন্সটিতে চারদিক থেকে আগুন ধরে যায়। অ্যাম্বুলেন্সের চালক মৃদুল তার আসনের পাশের জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারলেও ভেতরে থাকা তিন নারী ও চার শিশুযাত্রী আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। খবর পেয়ে ভাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ এনে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে সাতজনের কঙ্কাল বের করেন। পরে নেওয়া হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ভাঙ্গা থানা পুলিশ, শিবচর হাইওয়ে পুলিশ এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যৌথভাবে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। এ ঘটনায় পর এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায় দুই ঘণ্টা সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল।
হাইওয়ে পুলিশের ফরিদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার মাহবুব আলম বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে অ্যাম্বুলেন্সটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের ডিভাইডারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আগুন ধরে যায়। চালকের পাশের জানালাটি খোলা ছিল। এ ছাড়া সব জানালা আটকানো ছিল। চালক রক্তাক্ত অবস্থায় বের হয়ে এলে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অন্যরা কেউ বের হতে পারেননি।’
নিহতদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তাছলিমা বেগম হৃদরোগে আক্রান্ত হলে এক মাস আগে ঢাকায় নিয়ে যান স্বজনরা। চিকিৎসা শেষে বড় মেয়ে কমলা বেগমের বাসায় ছিলেন তিনি। ঘটনার দিন শনিবার সকালে তাছলিমা বেগম তার দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে ঢাকা থেকে বোয়ালমারীতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। পথে দুর্ঘটনায় সাতজনই প্রাণ হারান।
এ দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন, জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার ও পুলিশ সুপার মো. শাহজাহানসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল আহসান তালুকদার জানান, দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া মরদেহ দাফনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
এদিকে দুর্ঘটনার খবর নিহত তাছলিমা বেগমের বাড়ি বোয়ালমারীর ফেলাননগর গ্রামে পৌঁছালে শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া এভাবে একই পরিবারের সাতজনের মৃত্যুর খবরে পুরো গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারেফ হোসাইন বলেন, ‘খবর পেয়ে ওই বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে। শোকাহত পরিবারটিকে সর্বাত্মক সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে।’
পদ্মা সেতু চালুর পর গত এক বছরে যোগাযোগ, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রে উন্নয়নের ফলে বদলে গেছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ। তবে নানা কারণে এখনো বহুল প্রত্যাশিত এই সেতুর পুরোপুরি সুবিধা মিলছে না। সে সঙ্গে রয়েছে নানা রকম চ্যালেঞ্জও। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
দুই যুগ আগে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও নানা প্রতিবন্ধকতা শেষে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এই সেতুটি ২০২২ সালের ২৫ জুন এক জমকালো অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। পরদিন শুরু হয় যানবাহন চলাচল।
গত এক বছরে পদ্মা সেতু দিয়ে আয় হয়েছে ৭৭৪ কোটি টাকা। অবশ্য লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এ সময়ের মধ্যে সেতু দিয়ে ৪৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে বলে সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু ঘিরে এক্সপ্রেসওয়ে বা এপ্রোচ রোড নির্মাণ করা হয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় এটা একটা চমৎকার উন্নয়ন। কিন্তু এটি এখনো অপূর্ণ। আছে অনেক চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলকে সাপোর্ট দেওয়া। দেশের অর্থনীতিতে ১ দশমিক ২৫ শতাংশের মতো জিডিপি বাড়ানোর জন্য এই সেতু করা হয়েছে। শুধু একটা ব্রিজ দিয়ে সেটা করা যাবে না। এর সঙ্গে দরকার সামগ্রিক রোড নেটওয়ার্ক। সেটা কিন্তু এখনো তৈরি হয়নি। এটি সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়।
‘সেতুর কারণে গত এক বছরে ওই এলাকায় ছোট গাড়ি চলাচল বেড়েছে। মোটরসাইকেল কিংবা ব্যক্তিগত পরিবহনে ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণের জন্য বিরাট সুন্দর একটা যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক বিবেচনায় এটা কখনই সমর্থনযোগ্য নয়। কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বড় মাপের এই সড়কে ছোট ছোট যান চলাচল করছে। এতে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব কমে যাচ্ছে’।
শামসুল হকের মতে সড়কে ব্যক্তি খুশি আর অর্থনীতি খুশি এক নয়। অর্থনৈতিক খুশির জন্য এখানে গণপরিবহন, ট্রাক এ ধরনের যানবাহনের দ্রুতগতি খুব দরকার। কারণ ছোট ছোট গাড়ি, মোটরসাইকেলের টোল সংগ্রহ করতে যে সময় লাগে একটা বড় গাড়ির ক্ষেত্রেও সময় লাগে একই। অদূরদর্শিতার কারণে এখন খ-িত, বিখ-িত গণপরিবহন, ব্যক্তিগত যানবাহন এবং মোটরসাইকেল যাওয়ার ফলে এটার ‘অপারেটিং কন্ডিশনটা আর তার মানে থাকছে না।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ঢাকায় প্রবেশের মুখে প্রায়ই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি সেই যানজট উড়ালসড়ক হয়ে রাজধানীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক সময় দেখা যায় গোপালগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পৌঁছাতে যে সময় লাগে তার চেয়ে বেশি বা সমান সময় লাগে গুলিস্তান পৌঁছাতে।
এ প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, এই সেতু হয়ে ঢাকায় প্রবেশের জন্য যে চক্রাকার সড়ক বা রিং রোডগুলো করার কথা ছিল সেটা এখনো প্রস্তুত না হওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রিং রোডের মাধ্যমে একমুখী অনেক চাপ দ্রুত চলে এলে তা ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়। যেমন কেউ উত্তরা যাওয়ার পথে যাত্রাবাড়ী দিয়ে ঢুকতে গিয়ে যদি যানজট পান তাহলে বসিলা দিয়ে যেতে পারেন। অথবা আশুলিয়া হয়ে উত্তরা যেতে পারেন। রিং রোড করা হলে ঢাকার মুখে যানজট কমে যাবে। কিন্তু সেটা এখনো না করা বড় ধরনের ভুল।
একই সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের স্থানীয় সড়কগুলোরও উন্নয়ন দরকার বলে মনে করেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে মাদারীপুর যাওয়ার পর সেখানকার লোকাল কানেকশনগুলোও এই সড়কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। পদ্মা সেতুর কারণে পরিবহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় জীর্ণ-শীর্ণ অনুপযোগী স্থানীয় সড়ক নেটওয়ার্কে চাপ বাড়ছে। এসব সড়কের মানও উন্নত করতে হবে।
পদ্মা সেতুকে ঘিরে নির্মিত এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি বহু ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে। এ বিষয়ে শামসুল হক বলেন, এক্সপ্রেসওয়েতে এত বড় বিনিয়োগের যৌক্তিকতা ছিলÑ এখানে গাড়ি দ্রুতগতিতে চলবে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটবে না। অথচ আমরা ৯ মাসের সমীক্ষায় দেখছি প্রতিদিন একজন করে নিহত হচ্ছে। এটা কোনো মানদ-ে যায় না। এক্সপ্রেসওয়েতে মারা যাবে কেন? এটা বানানো হয়েছে কেউ যদি গতি ২শ কিলোমিটারেও চালায় তাতে দুর্ঘটনা ঘটবে না। দুর্ঘটনার রেসিপিগুলো এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের হচ্ছে। তার মানে অপারেটিং কন্ডিশনটাকে ধরে রাখার জন্য যে মানসিকতা অথবা দক্ষতা থাকার সেটা আমাদের নেই। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর ইমপ্যাক্টটা যদি এখন সরাসরি বলা হয় তাহলে বলতে হবে সড়কের উন্নয়নের ফলে চোখের সামনে একটা নৌপথের মৃত্যু হয়েছে। এটা তো কাম্য ছিল না। আমাদের নদীমাতৃক দেশে ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থায় নৌপথে যে অমিত সম্ভাবনা ছিল সেটা নষ্ট হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা সুন্দর ও দ্রুতগতির লঞ্চ নামিয়েছিলেন এবং তাতে সুবিধা ছিল এখানে একটা ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ছিল। জনগণও খুশি হতো। এখানে বহুমাত্রিকতা আছে।
‘উৎসব পার্বণের সময় যানবাহনের চাপ কখনই সড়ক নিতে পারবে না। সড়ক কখনই টেকসই মাধ্যম না। এটা কিছুদিন পর পর রিফ্রেশ করতে হয়। কিন্তু রেল এবং নৌপথ হলো সবচেয়ে টেকসই, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। সেই ইকো সিস্টেমটাকে চোখের সামনে কেজি দরে বিক্রি করে ফেলছে। নৌপথকে বিকল্প হিসেবে রেখে দেওয়ার কৌশলী সিদ্ধান্তও কিন্তু দেখি না। এটা অপ্রত্যাশিত।’
বিশৃঙ্খলার কারণেই এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা ঘটছে উল্লেখ করে শামসুল হক বলেন, ‘ঢাকার মধ্যে গণপরিবহনে যে বিশৃঙ্খলার আয়োজন করা হয়েছে সেই একই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করা হচ্ছে পদ্মা করিডরে। ফলে এক্সপ্রেসওয়েতে যাত্রী ওঠানামা দেখতে পারছি। শিশু ও পরিবার নিয়ে লাগেজ নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে মানুষজন। বাসগুলো যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানামা করাচ্ছে যেটা এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে বেমানান। আবার যারা অপারেট করছেন তারা ন্যূনতম অপারেটিং ম্যানেজমেন্টের সক্ষমতা রাখেন না। এটা দেখলেই মনে হয় এ ধরনের অবকাঠামো ব্যবহারের যোগ্যতা এখনো তৈরি হয়নি।’
শামসুল হক বলেন, এখানে গণপরিবহনে বিজ্ঞাপনভিত্তিক রুট পারমিট দিতে হবে। বাসের সংখ্যা না বাড়িয়ে দোতলা বাস পরিচালনা করতে পারে এরকম সক্ষম একজন অপরেটরকে দায়িত্ব দিতে হবে। ঢাকা টু মাদারীপুর, ঢাকা টু খুলনা, ঢাকা টু বরিশাল এরকম রুট না করে ঢাকায় একটা হাব, মাদারীপুরে একটা হাব। মাঝখানে ব্রডব্যান্ড কানেকশন। একটা কোম্পানি গাড়ি চালাবে। সেই গাড়ি থেকে স্থানীয় পরিবহনের মাধ্যমে যার যার গন্তব্যে যাবে।
পদ্মা সেতুর তৈরির পর এখানে মেধাভিত্তিক পরিচালনার চৌকস মান বা স্মার্টনেসের অভাব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক মেরুদন্ড হিসেবে। এখানে বাস, ট্রাককে অগ্রধিকার দিতে হবে। গণপরিবহন বা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত গাড়ির জন্য টোল কম হবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ঢুকলেই টোল বেশি নেওয়া হবে কৌশলে। যাতে সে নিরুৎসাহিত হয়। এতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার পাশাপাশি নৌপথেও যাত্রী পাওয়া যাবে। এটা না করলে কারখানার মালামাল পরিবহনে সমস্যা তৈরি হবে। বাইরে থেকে বড় বিনিয়োগকারী আসবেন না। সেই সঙ্গে রেলপথ চালু হলেও এর অবস্থা অনেকটা নৌপথের মতো হবে।
ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে ঋণ, তথ্য গোপন, খেলাপি নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে উত্তরা ব্যাংক লিমিটেডের বিরুদ্ধে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়ে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বেসরকারি এই ব্যাংকটি। ঋণ ব্যবস্থাপনায় নানা অনিয়মে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকরা জড়িয়ে পড়েছেন। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়ে ভাইয়ের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকার ঋণ দিয়েছেন। সেই ঋণ খেলাপি হওয়ার পরও বারবার পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ঋণটি নিয়মিতকরণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত কিস্তি পরিশোধের নির্দেশনাও মানেনি উত্তরা ব্যাংক।
বেনামি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অবৈধ সুবিধা নেওয়া, চেয়ারম্যানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে গাড়ি কেনাসহ নানা অনিয়মের কারণে ইতিমধ্যেই আলোচনায় রয়েছে বেসরকারি উত্তরা ব্যাংক। বরাবরের মতোই বিভিন্ন খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে এই ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
ঋণ অনিয়মের এই কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন একসময়ের দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী জহিরুল ইসলামের দুই ভাই আজহারুল ইসলাম ও সফিউল ইসলাম। আজহারুল ইসলাম আফতাব গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান। আর তার ভাই সফিউল ইসলাম নাভানা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা, যে গ্রুপটি রিয়েল এস্টেট, আবাসন, নির্মাণ ও অটোমোবাইল ব্যবসায় জড়িত। উত্তরা ব্যাংকে ইসলাম পরিবারের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সফিউল ইসলাম তার পরিবারের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘বিপনণ’ লিমিটেডের নামে উত্তরা ব্যাংক থেকে দুই দফায় ৩০ কোটি টাকা ঋণ নেন। অবশ্য ঋণ নেওয়ার এক মাস আগেই সফিউল ইসলাম ‘বিপনণ’-এ থাকা তার শেয়ার স্ত্রী খালেদা ইসলামের নামে হস্তান্তর করে চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ঋণ নিলেও তা পরিশোধ না করায় খেলাপি হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শনে গেলে ‘বিপনণ’ নামক প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। এমনকি ‘বিপনণ’র কোনো কার্যক্রমও তাদের চোখে পড়েনি। এমন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে পারছে না নাভানা গ্রুপ। বর্তমানে পুঁজিবাজারে নাভানা গ্রুপের অধীন আফতাব অটোমোবাইল ও নাভানা সিএনজি লিমিটেড নামে দুটি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। আর এই দুই প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ভিত্তি কয়েক বছর ধরেই দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলকে ঋণ হিসাবটির আদায় অগ্রগতি, অনুমোদন প্রক্রিয়া যাচাই করতে ২০২২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৩-এর পরিচালক নির্দেশনা দেয়। ওই বছরের ১০ অক্টোবর পরিদর্শন দল ও শাখা ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ওই প্রতিষ্ঠানটিতে সরেজমিন পরিদর্শন করেন। তারা প্রতিষ্ঠানটির কোনো অফিস এবং প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রমও খুঁজে পাননি। পরিদর্শন দলের কাছে প্রতিষ্ঠানটি একটি কাগজে প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ঋণ অনিয়মের বিষয়ে জানতে উত্তরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রবিউল হোসেন এবং চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তারা সাড়া দেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠালেও কোনো জবাব মেলেনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. জাকির হোসেন চৌধুরী দেশ রূপান্তরকে বলেন, বেনামি বা অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া আইনের লঙ্ঘন। কোনো ব্যাংক যদি এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন তাহলে অভিযোগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ তদন্ত করে দেখবে। যদি অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, সফিউল ইসলাম ১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসে ‘বিপনণ’ লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে ছিলেন তার ছেলে শরিফুল ইসলাম, খাদেজা ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, সাজেদুল ইসলাম ও ফারহানা ইসলাম। কিন্তু হঠাৎ করে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর সফিউল ইসলাম ‘বিপনণে’ থাকা তার মালিকানাধীন ছয় হাজার শেয়ার স্ত্রী খালেদা ইসলামের কাছে হস্তান্তর করে চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান খালেদা ইসলাম। হস্তান্তরের এক মাস পার না হতেই ওই বছরের ১৫ নভেম্বর উত্তরা ব্যাংকে একটি সিডি (ক্রেডিট ডিপোজিট) হিসাব খোলে কোম্পানিটি। আর ২৬ ডিসেম্বর ‘বিপনণ’ লিমিটেডের নামে ১৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করা হয়। পরে কোম্পানিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২ ডিসেম্বর ঋণের পুরো অর্থ একসঙ্গে বিতরণ করে উত্তরা ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই ঋণের বিপরীতে ১৫ কোটি টাকার জমি জামানত নেওয়া হলেও ভ্যালুয়ার কোম্পানি (সম্পদের মূল্য নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান) মেসার্স গ্লোবাল সার্ভে অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মূল্যায়নে ওই জমির দাম অর্ধেকেরও কম। ভ্যালুয়ার কোম্পানির ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের মূল্যায়নে জামানত হিসেবে দেওয়া দুটি জমির বাজারমূল্য ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং তাৎক্ষণিক মূল্য ৫ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির জোনাল হেডের কোনো সুপারিশ গ্রহণ করা হয়নি। আর প্রতিষ্ঠাটির সঙ্গে পরিচালকদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তার তথ্যও উপস্থাপন করা হয়নি।
‘বিপণন’ লিমিটেডের ঋণ হিসাবটিতে সুদ আরোপের সমপরিমাণ আদায় না থাকলেও ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ উত্তরা ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাবদ আরও ১৫ কোটি টাকার ঋণ মঞ্জুর করে। এই ঋণের ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়নি জোনাল হেডের সুপারিশ। প্রতিষ্ঠাটির সঙ্গে পরিচালকদের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তার তথ্যও উপস্থাপন করা হয়নি।
২০২০ সালের আগস্ট মাসে ‘বিপণন’ লিমিটেডের প্রথম নেওয়া ১৫ কোটি টাকার ঋণ গুণগতমানের ভিত্তিতে খেলাপি ঘোষণা করায় প্রথম পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ঋণের হিসাব দুটিতে কোনো আদায় না থাকায় এই ঋণ আদায় অযোগ্য খেলাপি করা হয়। এরপর ২০২১ সালে ১১ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার টাকা ও প্রথম পুনঃতফসিলকৃত মেয়াদি ঋণে ১০ লাখ ২২ হাজার টাকা নিয়ে দ্বিতীয় পুনঃতফসিল মঞ্জুর করা হয়, যা কার্যকর করার জন্য ব্যাংকটি বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। পরে ২০২১ সালের ৮ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধি ও নীতি বিভাগের মাধ্যমে পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়।
পুনঃতফসিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ‘বিপনণ’র সমহারে কিস্তি নির্ধারণ না করে বিশেষ সুবিধা দেয়। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাসিক ১০ লাখ টাকা করে এবং পরে মাসিক ৬৮ লাখ ৭ হাজার ৫৫০ টাকা কিস্তি নির্ধারণ করে উত্তরা ব্যাংক, যা ব্যাংক কোম্পানি আইন এবং বিআরপিডির নির্দেশনার লঙ্ঘন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনা বলছে, ঋণ আবেদনের সময় ‘বিপনণ’ নামে প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় ১৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, বিক্রয় ২১ লাখ ৭২ হাজার টাকা, নিট ক্ষতি ১১ লাখ ২৩ হাজার টাকা দেখানো হয়। এ সময় দায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা ও সম্পদ ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা দেখানো হয়। এমন দুর্বল আর্থিক ভিত্তি উপস্থাপনের পরও কোম্পানিটিকে ৩০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়, যা ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কমিটি। এমন পরিস্থিতিতে অনিয়মসহ ও সরেজমিন পরিদর্শনে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অফিস ও কোনো কার্যক্রম না পাওয়ায় ঋণ হিসাব দুটি মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকরণ করা হয়। পাশাপাশি নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান এবং ঋণ হিসাব যথাযথ মানে শ্রেণীকরণ, সংস্থান সংরক্ষণ ও সিআইবি রিপোর্টসহ অবহিত করতে বলা হয়।
এদিকে, উত্তরা ব্যাংক অন্তত ৪৫টি প্রতিষ্ঠানের ১০৫ কোটি টাকার ঋণ আদায় অগ্রগতি না থাকা এবং দীর্ঘদিন ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ ও সীমাতিরিক্ত অবস্থায় থাকার পরও খেলাপি হিসেবে দেখায়নি। পরে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দলের দৃষ্টিতে এলে মেয়াদোত্তীর্ণ ও গুণগতমানের ভিত্তিতে ঋণগুলো ক্ষতিজনক মানে খেলাপি দেখানের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি এসব ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবিকে অবহিত করারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল আমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যানের প্রতিষ্ঠানে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি কতগুলো নিয়ম রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান হচ্ছে, ব্যাংক চেয়ারম্যান ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নন-ফান্ডেড লোন নিতে পারবেন। এ ছাড়া তিনি যে পরিমাণ শেয়ার ধারণ করেন তার ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। তবে সেটা বোর্ডের অনুমতি সাপেক্ষে। এ ক্ষেত্রে অনুমোদন হওয়া বোর্ডসভায় তিনি উপস্থিত থাকতে পারবেন না।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নীতিমালা রয়েছে, যেখানে উল্লেখ আছে, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আট শ্রেণির বাইরে যদি হয় তাহলে চেয়ারম্যান বা পরিচালক তার দায় নেবেন না। আট শ্রেণির মধ্যে রয়েছে, পরিচালক, তার ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, শ্বশুর এবং শাশুড়ি। এর বাইরে কেউ হলে তার দায় পরিচালকের নয়।
মাত্র এক মাস আগেই ইউক্রেন যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হয়ে ওঠা বাখমুত শহর দখলে নিয়ে রাশিয়ার নিয়মিত সেনাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছিল দেশটির ভাড়াটে আধাসামরিক বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ। যাকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার অন্যতম বড় ধরনের বিজয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন অনেকে। ওই জয়ের পর ওয়াগনার গ্রুপকে শুভেচ্ছায় সিক্ত করেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। বাহিনীটির প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনসহ যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখা সদস্যদের পুরস্কৃত করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। অথচ সেই ওয়াগনার গ্রুপকেই ‘বিশ্বাসঘাতক বিদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে পুতিন বললেন, ওয়াগনার বাহিনী যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা আসলে রাশিয়ার পিঠে ছুরি মারার শামিল। গতকাল শনিবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া টেলিভিশন ভাষণে পুতিন বললেন, প্রিগোজিন ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসঘাতকদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে, রাশিয়া ও ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যকার সম্পর্কের নাটকীয় এ মোড় শুরু হয়েছে গত শুক্রবার ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের এক ঘোষণার পর। সেদিন ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় রোস্তভ-অন-ডন শহর তার নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করেন। বলেন, ওই শহরে অবস্থিত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্সও তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। প্রতিরক্ষা প্রধান সের্গেই শুইগু এবং সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ তার সঙ্গে দেখা না করলে মস্কোর দিকে যাত্রা শুরু করবেন। গতকাল শনিবার বিকেলে বিবিসি অসমর্থিত সূত্রের বরাতে বলেছে, রোস্তভ-অন-ডন থেকে মস্কোর যে দূরত্ব তার মাঝামাঝি পৌঁছে গেছে ওয়াগনার গ্রুপের একটি অংশ। সেখানে রুশ সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে তাদের ওপর গুলিও ছুড়েছে। পাল্টা হামলা হিসেবে সেখানকার একটি তেল শোধনাগার উড়িয়ে দিয়েছে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে রক্তপাত এড়াতে রাশিয়ার রাজধানী মস্কো অভিমুখে যাত্রা স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। গতকাল রাতে নিজের টেলিগ্রাম চ্যানেলে দেওয়া এক অডিওবার্তায় এ ঘোষণা দেন তিনি। ওই বার্তায় প্রিগোজিন বলেছেন, মস্কোর দিকে অগ্রসরমাণ তার দলটি থেমে গেছে। রক্তপাত এড়াতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে দিনভর চলা উদ্বেগ-উত্তেজনার আপাত অবসান হলো।
এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় মস্কো অভিমুখে যাত্রা বন্ধ করতে রাজি হন প্রিগোজিন। লুকাশেঙ্কোকে উদ্ধৃত করে রশিয়া ২৪-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেলারুশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন মস্কো অভিযান বন্ধ করতে রাজি হন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, উত্তেজনা কমাতে সম্ভাব্য একটি গ্রহণযোগ্য উপায় বের করা হবে। পাশাপাশি ওয়াগনার যোদ্ধাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সম্মতি নিয়েই লুকাশেঙ্কো ও প্রিগোজিন এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
ওয়াগনার বাহিনীর কথিত এ বিদ্রোহ তাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনতে না পারলেও এর মধ্য দিয়ে যে ‘উটকো ঝামেলার’ সৃষ্টি হয়েছে তা প্রেসিডেন্ট পুতিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও ইউক্রেনে তার লক্ষ্যকে একটা কঠোর চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
অবশ্য কেউ কেউ বলছেন, ইউক্রেনে এখনো চার লাখের মতো রুশ সেনা অবস্থান করায় দেশটির পক্ষে এখনই এই অস্থিরতার কোনো সুফল পাওয়া সম্ভব না।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধে লিপ্ত ভাড়াটে ওয়াগনার গ্রুপ। গত মাসে ইউক্রেনের বাখমুত শহর দখলের লড়াইয়ে গ্রুপটি নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১০ মাসের মধ্যে ইউক্রেনে সেটি ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় জয়। যুদ্ধক্ষেত্রের এই সাফল্যের সুযোগে প্রিগোজিন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের সমালোচনা শুরু করেন। অবশ্য কয়েকমাস ধরেই তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই এবং জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমোভের বিরুদ্ধে ‘অযোগ্যতার’ অভিযোগ করে আসছিলেন। এর মধ্যে গত শুক্রবার তিনি তার দলের সৈন্যদের ওপর এক মারাত্মক মিসাইল হামলার অভিযোগ করেন রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি তার অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ হাজির করতে না পারলেও কথিত হামলাকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার শপথ নেন। অবশ্য তার পদক্ষেপ সামরিক অভ্যুত্থান না বলেও দাবি করেন তিনি। কিন্তু ধারাবাহিক কয়েকটি অডিও বার্তায় অত্যন্ত উত্তেজিত স্বরে প্রিগোজিন ধারণা দিয়েছেন, তার ২৫ হাজার মিলিশিয়ার শক্তিশালী একটি দল মস্কোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বকে অপসারণ করার পথে রয়েছে। অবশ্য সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানিয়েছে, এসব বার্তায় তার কণ্ঠস্বর বিভিন্ন রকম মনে হয়েছে এবং সেটি তারা স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করতে পারেনি।
অন্যদিকে ক্রেমলিন একে সরাসরি বিদ্রোহ হিসেবে দেখছে। গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন সশস্ত্র বিদ্রোহে লিপ্ত হয়েছেন- এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং তাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে পুতিনের দপ্তর। ক্রেমলিনের নিরাপত্তা বিভাগের এক সূত্রের বরাতে গতকাল সকালে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে মস্কোর সরকারি ভবনগুলো, পরিবহন স্থাপনা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক টেলিভিশন ভাষণে পুতিন বলেন, ওয়াগনার গ্রুপ যা করেছে সেটি ‘বেইমানি’ এবং ‘রাশিয়ার পিঠে ছুরি চালানোর’ মতো। অবশ্য রাশিয়ার সব বাহিনীকে সংহত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। পুতিন বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সব নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাশিয়াকে রক্ষা করার কাজে তারা সব কিছু করবেন। প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, রাশিয়ার সমাজকে যারা বিভক্ত করছে তারা কোনোভাবেই শাস্তি এড়াতে পারবে না। ভাষণে পুতিন প্রিগোজিনের নাম উল্লেখ করেননি। তবে ওয়াগনারের ভাড়াটে সৈন্যদের কথা উল্লেখ করে রাশিয়ার পক্ষে লড়াই করার জন্য তাদের প্রশংসা করেন।
পুতিনের ওই ভাষণের পর এক কথিত অডিওবার্তায় প্রিগোজিন বলেন, মাতৃভূমির বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে, প্রেসিডেন্ট বড় ধরনের ভুল করেছেন। আমরা দেশপ্রেমিক। আমরা যুদ্ধ করছি এবং এখনো করে যাচ্ছি। আমাদের দোষ স্বীকার করতে... প্রেসিডেন্ট যেমনটা চেয়েছেন, এফএসবি (রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা) অথবা অন্য কেউ বা কেউই তেমনটা করতে যাচ্ছে না। কারণ আমরা চাই না আমাদের দেশ আর দুর্নীতি, মিথ্যা ও আমলাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে চলুক।
বিবিসি বলছে, এই পরিস্থিতির বিস্তারিত অনেক কিছু এখনো পরিষ্কার হয়নি। রোস্তভ শহরের পর ভরোনেজ শহরের সব সামরিক স্থাপনা দখল করে নিয়েছে ওয়াগনারের সৈন্যরা। অবশ্য ভরোনেজ অঞ্চলের গভর্নর আলেকজান্ডার গুসেভ সতর্ক করে বলেছেন যে সৈন্যদের গতিবিধি নিয়ে অনেক ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে। সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ভরোনেজ অঞ্চলে সামরিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এই লড়াইটাকে বিশ্লেষকরা দেখছেন রাশিয়ার ক্ষমতার শীর্ষে থাকা দুজনের লড়াই হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য ইনস্টিটিউট অব ওয়ার (আইএসডব্লিউ) বিশ্বাস করে ইয়েভগিনি প্রিগোজিন ক্রেমলিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটা জোরপূর্বক পরিবর্তন আনতে চান। তবে ক্রেমলিন এর বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তার জন্য ‘সাফল্য পাওয়া কঠিন’ হবে। তবে রোস্তভ-অন-ডন দখলের চেষ্টা যুদ্ধে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এখানকার সেনাবাহিনী ‘এই মুহূর্তে ইউক্রেন যে পাল্টা আক্রমণ করছে সেটা প্রতিহত করতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং একই সঙ্গে পুরো ইউক্রেনে রাশিয়ার যৌথ বাহিনীর কমান্ড সেন্টার এখানে। সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ বলছে, শুক্রবারের বিস্ময়কর নাটকীয়তার ফলাফল যা-ই হোক পুতিনকে এ রকম দুর্বল আর কখনই দেখায়নি। এক ঘটনা পুতিনের পেশা জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কা, এমনকি এ ধাক্কা তাকে ক্ষমতার মসনদ থেকেও ছিটকে ফেলতে পারে। গার্ডিয়ানের ভাষ্যমতে, যদি প্রিগোজিনের বিদ্রোহের দ্রুত অবসানও হয় তবু কয়েক মাস এই ধাক্কার রেশ থেকে যাবে, যা রাশিয়াকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং পুতিনের নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে পারে। এই বিদ্রোহ পুতিনের ইউক্রেন অভিযানেও বড় দুর্বলতা তৈরি করেছে। বিপরীতে কিয়েভের পাল্টা আক্রমণ সফল করার পথও করে দিয়েছে। রাশিয়ার দখলে থাকা ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেৎস্ক থেকে ওয়াগনার সেনারা সরে যাওয়ায় রুশ প্রতিরক্ষায় দেখা দিতে পারে বড় ধরনের ফাটল।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা পুতিনের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে সামরিক বিশ্লেষক পাভেল ফেলগেনহাউয়ার বলেন, ‘পুতিন তার শাসনামলে সবচেয়ে বড় হুমকির মুখে পড়েছেন। বর্তমানে তার সামনে যে চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে তা খুবই গুরুতর। এবারই প্রথম সামরিক এবং বেশ কার্যকর কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন তিনি। এমনকি তাকে হয়তো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনের সাংবাদিক নিক প্যাট্রন এক বিশ্লেষণে লিখেছেন, গত ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা পুতিনের রাশিয়ায় এর আগে কখনো এমন চিত্র দেখা যায়নি। তাকে এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়নি। নিক প্যাট্রনের মতে, প্রিগোজিন বিদ্রোহে জয়ী না হলেও দুর্বল হবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এ দুর্বলতা ঢাকতে পুতিন আগামী কয়েক মাসে নিজের শক্তি প্রমাণের জন্য অযৌক্তিক অনেক কিছু করতে পারেন।
খুলনার সুন্দরবন উপকূলীয় কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবন নির্মাণের মেয়াদ শেষ হলেও মাত্র ১১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে মেয়াদ বাড়িয়েছে স্বাস্থ্য প্রকৌশলী দপ্তর। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে নির্মাণকাজ করছেন।
তবে মো. আক্তারুজ্জামান বাবু তার সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বলেন, গুণগতমান ঠিক রেখে যাতে কাজটি দ্রুত শেষ হয়, সেদিকে আমি বিশেষভাবে কেয়ার রাখছি। তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অনেক ঠিকাদার কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ঠিকাদারকে যদি প্রেশার দেওয়া হয় কিংবা আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে কার্যাদেশ বাতিল করা হয় তাহলে আমাদেরই ক্ষতি হবে। কাজে আরও দেরি হবে। এসব দিক বিবেচনা করে কিছু বলতে পারি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, ঠিকাদারকে দ্রুত কাজ করাতে চাপে রাখতে কর্তৃপক্ষ সময় বেঁধে দেয়। এসব বিল্ডিংয়ের সময় কখনো ছয় থেকে আট মাস হয় না। পাইল ও কাস্টিংয়ে সময় লাগে। এসব কারণে সামান্য দেরি হতে পারে।’
এদিকে ৩১ শয্যার পুরনো দোতলা ভবন অপসারণ করায় শয্যা সংকটসহ নানাবিধ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। ১৯ শয্যার অবকাঠামোতে ৫০ শয্যার হাসপাতালের কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। শয্যার অভাবে মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা নিতে হচ্ছে রোগীদের।
স্বাস্থ্য প্রকৌশলী দপ্তর, খুলনা ও কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, খুলনা শহর থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ১৯৬৪ সালে স্থাপিত হয়। সেখানে ২০১১ সালে ১৯ শয্যার একটি ভবন নির্মাণ করা হয় এবং ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ করা হয়। পরে ৩১ শয্যাবিশিষ্ট পুরনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ২০২২ সালে তা অপসারণ করা হয়। পরে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট ৩১ শয্যার তিনতলা ভবন নির্মাণের কার্যাদেশ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স ও মেসার্স শামীম আহসান ট্রেডার্স। তবে ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করে স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. আক্তারুজ্জামান বাবু কাজটি করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
ছয়তলা ফাউন্ডেশনের তিনতলা বিল্ডিং নির্মাণকাজের ব্যয় ধরা হয় ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৭৬ হাজার ৫৮০ টাকা। কাজ সমাপ্তির সময় নির্ধারণ ছিল ২০২৩ সালের ১২ জুন। কাজের মেয়াদ শেষ হলেও মাত্র ১১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজের সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায় গতি বাড়াতে বারবার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে খুলনা স্বাস্থ্য প্রকৌশলী দপ্তর। একপর্যায়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে।
এদিকে, শয্যা সংকটের পাশাপাশি কক্ষ সংকটের ফলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বহিঃ ও জরুরি বিভাগের চিকিৎসাসেবা, প্রসূতি ডেলিভারিসহ নানাবিধ সেবায় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীদের। নারী ও পুরুষের নেই কোনো পৃথক ওয়ার্ড। পুরুষদের সঙ্গে সিজারিয়ান ও শিশুদের দুগ্ধদানকারী নারী রোগীদের একসঙ্গে থাকতে হচ্ছে। এ ছাড়া নারী-পুরুষ সবাইকে ব্যবহার করতে হচ্ছে একই বাথরুম। জায়গার অভাবে বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে এক্স-রে মেশিন। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে অস্ত্রোপচারকক্ষের বেশ কিছু যন্ত্রপাতি। বহিঃবিভাগে রোগীদের চাপ মেটাতেও চিকিৎসকদের বসার মতো উপযুক্ত কক্ষ নেই।
মনিরা আক্তার নামে এক রোগী বলেন, ‘গত রাতে ভর্তি হয়েছি। শয্যা না পেয়ে সিঁড়ির পাশে থাকতে হচ্ছে।’ অন্য এক রোগী জাকির হোসেন বলেন, অ্যাপেন্ডিসের অপারেশন হয়েছি। সিঁড়ির পাশে বারান্দায় থাকতে হচ্ছে। এখানে কোনো বাথরুম নেই। প্রস্রাব-পায়খানার চাপ আসলে মহিলা ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে যেতে সমস্যা হয়।’ সিজারিয়ান এক রোগী বলেন, ‘পুরুষ চলাচলের ফলে নবজাতককে দুধ প্রদানে সমস্যা হয়।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জিয়াউল আহসান টিটো বলেন, ‘আমার লাইসেন্স নিয়ে কয়রা-পাইকগাছার একজন টেন্ডার নিয়েছিল।’ তবে তার নাম বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য কাজটি করছেন। কাজের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এ গতিতে কাজ চললে তা শেষ হতে ৫ বছর লেগে যেতে পারে।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, তীব্র শয্যা সংকটে রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তাদের মেঝে কিংবা বারান্দায় রাখতে হচ্ছে। নারী-পুরুষ পৃথক কোনো ওয়ার্ড নেই। এক্স-রে মেশিন স্থাপনের কক্ষ নেই, বহিঃবিভাগে ডাক্তারদের বসার কক্ষ সংকটে চিকিৎসাসেবায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দূরে অবস্থিত জরুরি বিভাগ থেকে সহজে রোগী আনা সম্ভব হয় না।
স্বাস্থ্য প্রকৌশলী দপ্তর, খুলনার সহকারী প্রকৌশলী মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, এ পর্যন্ত ১১ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কাজের গতি বাড়াতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বার বার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বর্ধিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘একজনের লাইসেন্সে অন্য কেউ কাজ করছে কি না, সেটা আমাদের জানা নেই। আমরা মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করি ও তাগিদ দিই।’
ঘুষ নেওয়ার সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সংস্থার মহাপরিচালকের (মানিলন্ডারিং) একান্ত সহকারী (পিএ) গৌতম ভট্টাচার্যসহ চারজনকে। এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অর্থ পাচারের ভুয়া অভিযোগের নোটিস পাঠিয়ে পরে তাকে রক্ষার কথা বলে ঘুষ নিচ্ছিল তারা।
এ সময় তাদের কাছ থেকে মিষ্টির চারটি প্যাকেট, নগদ দেড় লাখ টাকা, চারটি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রামসহ খাকি রঙের একটি খাম ও প্যাডে লেখা একটি নোটিস উদ্ধার করা হয়।
গত শুক্রবার রাজধানীর মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেল থেকে এই চারজনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল মো. এসকেন আলী খান (৫৭), হাবিবুর রহমান (৪২) ও পরিতোষ মন্ডল (৬৩)।
ডিবি জানিয়েছে, দুদক মহাপরিচালক গৌতম ভট্টাচার্যের বাড়ি মৌলভীবাজার। এসকেন আলীর বাড়ি গোপালগঞ্জ। অন্য দুজনও গোপালগঞ্জের বাসিন্দা এবং পেশাদার দালাল ও প্রতারক। চক্রটি যারা অল্প সময়ে ধনী হয়েছে তাদের টার্গেট করে। সারা দেশেই এদের সদস্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে।
গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির ডিবি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামান আমদানির ব্যবসাও করেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদের কার্পেটের দোকানে কার্পেট ও জায়নামাজ সরবরাহ করেন তিনি। গত ১৯ জুন তার স্ত্রী সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ২০ জুন সকালে আশিকুজ্জামানের উত্তরার বাসায় দুদকের মনোগ্রাম সংবলিত খাকি রঙের খামে একটি নোটিস নিয়ে একজন কথিত কর্মকর্তা হাজির হন। সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণ চোরাচালান এবং মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ তোলেন তার বিরুদ্ধে। স্ত্রীর হাসপাতালে অবস্থান এবং দুদকের এই ভয়ানক অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান তিনি। তখন দুদকের সেই কথিত কর্মকর্তা আশিকুজ্জামানকে সহানুভূতি দেখানোর ভান করে তাকে তখনই মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। এও বলেন যে, ডিবি, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) তাকে খুঁজছে। ইতিমধ্যে দুদক তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একটি অভিযোগ আমলে নিয়েছে।
ডিবি প্রধান বলেন, নোটিস বহনকারী ব্যক্তিটি হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে আশিকুজ্জামানকে কথা বলিয়ে দেন। কথিত ওই কর্মকর্তা মোবাইলে কথা না বলে বিস্তারিত জানার জন্য তাকে দুদক অফিসে আসতে বলেন। কথিত নোটিসে বিভিন্ন অভিযোগের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, ‘শূন্য থেকে আশিকুজ্জামান আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। তাকে দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব প্রমাণ পাওয়া যাবে। এ অবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।’ এতে কারণ দর্শানোসহ ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আগামী ১০ জুলাই তাকে তলবের কথা বলা হয়।
হারুন অর রশীদ বলেন, ঘাবড়ে যাওয়া আশিকুজ্জামানকে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে দফায় দফায় ফোন দিয়ে ভয় দেখানো হয় যে, তার সম্পত্তি ক্রোক হবে, তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, তার মানসম্মান যাবে। এক পর্যায়ে আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সমঝোতার জন্য প্রথমে দুই কোটি টাকা দিতে বলা হয়। পরে তা কমিয়ে এক কোটি টাকা করা হয়। বিনিময়ে সমস্ত অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এই এক কোটি টাকার মধ্যে গত শুক্রবার জুমার আগে ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। বাকি টাকা রবিবার ব্যাংক চলাকালে দিতে বলা হয়।
ডিবি প্রধান বলেন, ভুক্তভোগী ডিবির লালবাগ বিভাগকে জানালে তারা দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ঘটনার দিন সংস্থার উপপরিচালক নজরুল ইসলাম ও ডিবির একটি দল হোটেল হিরাঝিলের আশপাশে অবস্থান নেয়। আগে থেকে বলে রাখা কথামতো আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে তার স্বাক্ষরিত দেড় লাখ টাকা নিয়ে হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে থাকা টাকা গ্রহণ করার সময় ডিবি সদস্যরা দুদকের ডিজির পিএ গৌতমসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেন।
গৌতমের বিষয়ে ডিবি প্রধান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দুদকের বিভিন্ন মহাপরিচালকের পিএ হিসেবে কাজ করে আসছেন গৌতম। তিনি কখনো দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (অ্যাডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজির (মানি লন্ডারিং) পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কর্মরত। সেই সূত্রে দুর্নীতির অভিযোগ বিষয়ে কীভাবে নোটিস পাঠাতে হয়, কীভাবে তাদের কাছ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য নেওয়া হয় এবং অভিযোগ গঠন করা হয় এসব জানতেন। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি সহযোগীদের দিয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং চাকরিজীবীদের টার্গেট করতেন। তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম ও প্যাড ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিস পাঠাতেন। পরে নানা ভয়ভীতি দেখিয়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলে টাকা আদায় করতেন। তাদের সঙ্গে দুদক কার্যালয়ের দায়িত্বশীল আরও কেউ জড়িত আছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য আসামিদের জিজ্ঞাসা করা হবে বলে জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ আগস্ট ৯ বছরের শিশু আরাফাতের মৃত্যু হয়। সপ্তাহ না যেতেই ২৫ আগস্ট মারা যায় আরাফাতের ছোট বোন ৬ বছরের রাইদা। রাজধানীর মধ্যপাইকপাড়ার ছাপাখানা মোড়ের একটি বাসায় দুই সন্তান আরাফাত ও রাইদাকে নিয়ে থাকতেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। সন্তানদের মৃত্যুর পর জীবনটাই বদলে গেছে তাদের। তছনছ হয়ে গেছে সাজানো সংসার। ইব্রাহিম ও রাবেয়া দম্পতির মতো বহু পরিবার এবার সর্বস্বান্ত হয়েছে ডেঙ্গুজ¦রের থাবায়। সন্তান হারানো এমন বাবা-মায়েরা পাগলপ্রায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী ১৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১৮ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ৮৬ এবং নারী ৯১ জন। এবার শুধু শহর নয়, গ্রামেও ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। সেখানেও মারা গেছে অনেক শিশু। এ বছর ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু নিয়মিত ঘটনা হয়ে দেখা দিয়েছে। এই রোগে এত শিশুর মৃত্যু আগে কখনো হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছর শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সীরা আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজার ৯১৯ জন; যা মোট আক্রান্তের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে নারী ২৩ হাজার ৬১৭ এবং পুরুষ ৪০ হাজার ৩০২ জন। ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তথ্য বলছে, ডেঙ্গুতে শিশুদের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের যারা সুস্থ হয়ে উঠছে, তাদের মধ্যে ভবিষ্যতে শারীরিক জটিলতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ডেঙ্গুর বর্তমান সংক্রমণের মধ্য দিয়ে শিশুদের জন্য নতুন ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। তাদের মানসিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতি শিশুদের নতুন বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার বিরূপ প্রভাব শিশুদের মধ্যে ভবিষ্যতে দেখা যেতে পারে। মস্তিষ্ক ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর প্রভাব থাকতে পারে। এতে তাদের মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের যদি কিডনি কিংবা লিভারের মতো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সেই ভার সারা জীবন বহন করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শিশুদের মৃত্যু নিয়ে ভালোভাবে অ্যানালাইসিস করতে পারছি না। এসব মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে অটোপসি করতে পারলে ভালো হতো। বিভিন্ন দেশে মৃত্যু নিয়ে ডেথ রিভিউ বা অটোপসি করা হয়। এটি করতে পারলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যেত।’
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দিতেও হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। কোনো শিশুর শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন হলে পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, ১ মাস থেকে ১২ বছর বয়সী মুমূর্ষু শিশু রোগীদের পৃথক পিআইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। তবে দেশে পিআইসিইউ সংকট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পিআইসিইউর জন্য স্বজনদের হাহাকার করতে দেখা গেছে। হাসপাতালগুলোতে দেখা গেছে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ শিশুকে সেবা দিতে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যেমন বেশি, সেখানে শিশু রোগীও উল্লেখযোগ্য। এই দুটি হাসপাতালে একেকটি শয্যায় একাধিক শিশু রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। ৭০ থেকে ৮০ জনের সেবা পাওয়ার কথা, কিন্তু সেখানে প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে প্রায় ৩০০ শিশু। ঢামেক হাসপাতালের ২৫ শিশুকে একসঙ্গে পিআইসিইউতে সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোনো পিআইসিইউ নেই।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, এখানে শিশুদের ওয়ার্ডেই ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পিআইসিইউ নেই, তবে এনআইসিইউ (নিউনেটাল আইসিইউ বা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) আছে।
এদিকে শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু শনাক্তে পরীক্ষা করা প্রয়োজন। শিশুদের ডেঙ্গুর চিকিৎসা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শামীমা ইয়াসমীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘শিশুদের জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করাতে হবে। এবার অনেকের মধ্যে হঠাৎ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। ফলে তারা দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছে। দেখা গেছে, ডেঙ্গুজ্বরে যেসব শিশু মারা গেছে, তারা বাড়ি থেকেই জটিলতা নিয়ে এসেছে। এখানে একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে, শুধু প্লাটিলেট কমা আশঙ্কার নয়, রক্তচাপ কমে যাওয়া প্লাটিলেট কমার চেয়ে ভয়ের। তাই আমাদের শিশুদের রক্তচাপ নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে।’
স্যাংশন নিয়ে ভয় না পাওয়ার বার্তা দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার মেথডিস্ট সেন্ট্রাল হলে নাগরিক সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি পাল্টা স্যাংশন দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন।
সংবিধান অনুযায়ী সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বলে জানান তিনি। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা ইস্যু সম্পর্কে প্রশ্ন রাখেন, সাজাপ্রাপ্ত কাউকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় কোন দেশ?
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন রেখে বলেন, পৃথিবীর কোন দেশের সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠায় বলতে পারেন? কোনো দেশে পাঠায়? তারা এটা দাবি করে। আমাদের কেউ কেউ আঁতেল আছে। তারা বলে, একটু কী সহানুভূতি দেখাতে পারেন না! সে এভারকেয়ার, বাংলাদেশের সবথেকে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। আর রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো আশির ওপর। মৃত্যুর সময় তো হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এত কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
স্যাংশনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আপনাদেরও বলব, স্যাংশন নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।
বিএনপি চেয়ারপারসন ‘অসুস্থ’ খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে শর্ত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই শর্তের অন্যতম ইস্যু হচ্ছে, বিএনপিকে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। এমন ঘোষণার পরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ বিদেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে। কিন্তু সরকারের সেই শর্তে রাজি নন খালেদা জিয়া। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনো শর্তের বিনিময়ে তিনি মুক্তি চান না। ফলে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার সরকারের যে চেষ্টা, সেটা এ দফায় সফল হচ্ছে না বলে মনে করছেন আন্দোলনে থাকা নেতারা। তাদের মতে, সরকার ফাঁদ পাতলেও এতে পা না দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে বেগম জিয়ার। বরং আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলতে চান তারা। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবেন। এ লক্ষ্যে প্রায় অর্ধশত দল নিয়ে গত প্রায় এক বছর ধরে আন্দোলনে রয়েছেন তারা।
শর্তের বিনিময়ে মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে গত রবিবার রাতে কিশোরগঞ্জে বিএনপির রোডমার্চের সমাপনী সমাবেশে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল তিনি যদি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে চান, তাহলে বিএনপিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আসতে হবে। বিএনপি থেকে উত্তর দেওয়ার আগেই অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে খালেদা জিয়া বিদ্রোহ করে বলেছেন, তার জীবনে গণতন্ত্রের জন্য কোনো শর্ত নেই। ভোটের অধিকারের জন্য, এই দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কোনো শর্ত নেই। কোনো শর্ত খালেদা জিয়ার নামের সঙ্গে যায় না এবং আমরাও তা মানি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়া ৫৪ দিন ধরে টানা হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিতই খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ অবস্থা খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ সময় বেশ কয়েকবার শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের দেওয়ার বক্তব্যের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি দলের মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কয়েকজন সম্পাদক ও সদস্য খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলেন। সূত্রগুলো বলছে, একজন ভাইস চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য কথা প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রসঙ্গেও ইঙ্গিত দিলে খালেদা জিয়ার শর্ত দিয়ে মুক্ত হতে চান না বলে পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও এর আগে শর্ত দিয়ে দেশের বাইরে চিকিৎসার বিষয়ে দল যাতে সম্মত না হয়, সে কথা নেতাদের আগেই বলে রেখেছিলেন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া এ নেত্রী। কোনো অবস্থায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না এবং এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সমঝোতাও নয়Ñ এ ব্যাপারেও খালেদা জিয়ার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করেন। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে মঞ্চের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের এ আন্দোলনে উনার সমর্থন আছে। আমাদের একজন নেতা (ওই বৈঠকে) বলেছেন, সরকার একটা নির্বাচনের জাল বিছানোর চেষ্টা করছে। উনি (খালেদা জিয়া) বলেছেন, কোনো অবস্থায় এ সরকারের অধীনে নির্বাচনী ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না।’
এর আগে ৮ মে রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় সাক্ষাৎ শেষে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছিলেন, কেউ কেউ বলছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এমন প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া তাদের বলেছেন, প্রশ্নই আসে না। এ বিষয়ে আমি কোনো অনুমতি দেব না।
এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি মনে করছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এ সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমে এ ইস্যুর সমাধান করবে তারা। এজন্য চলমান এক দফার আন্দোলনের সঙ্গে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসা ইস্যুটি জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করতে চান তারা। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন বড় ধরনের মোড় নিতে পারে বলে তাদের বিশ্বাস।
গতকাল সোমবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ৫ অক্টোবর বিএনপি ঘোষিত রোডমার্চ কর্মসূচি শেষ হবে। এর আগেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু বলেন, ‘দাবার ঘুঁটি হিসেবে খালেদা জিয়াকে ব্যবহারের চিন্তা তারা কীভাবে করে সেটাই বোধগম্য নয়। সরকারের এ ধরনের চিন্তা বা পরিকল্পনা কোনো কাজে আসবে না।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে বিএনপিপ্রধানের পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের ওপর গত রবিবার আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়ে বলেছে, সাজা স্থগিত থাকাবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর সুযোগ নেই। যদি যেতে হয়, তাহলে সাজা স্থগিতের আদেশ বাতিল করতে হবে। কিন্তু সেটা করে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হবে না বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে বিদেশে পাঠানোর অনুমতির জন্য আদালতে যেতে রাজি নয় খালেদা জিয়ার পরিবার ও বিএনপি।
আবার গতকাল নিজ কার্যালয়ে সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়া রাষ্ট্রপতি কিংবা আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। তবে তার আগে তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জেলে যেতে হবে। রাষ্ট্রপতি বা আপিল বিভাগের খালেদা জিয়ার পরিবার আবেদন করবে না বলে দলীয় আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দেশে আইনের শাসন নেই বলেই বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া এখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সেখানে বলা হয়েছে, তাকে “দেশে চিকিৎসা নিতে হবে”, তার বদলে “দেশে বা বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন” বলাই যথেষ্ট। এর বাইরে দলের পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এদিকে চিকিৎসক সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল তার আলট্রাসনোগ্রাম ও ইকো করা হয়েছে।
তিনি জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রণীত আইনের অধীনে ধানমন্ডিতে যে বাড়ি পেয়েছিলেন শেখ রেহানা, বিএনপি ক্ষমতায় এসে সে বাড়ি উচ্ছেদ করে। সেখানে পুলিশ ফাঁড়ি করছে আর ‘লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে’ সেই পুলিশ ফাঁড়ি উদ্বোধন করেছে খালেদা জিয়া। ছেলে কোকোর মৃত্যুর পর তাকে (শেখ হাসিনা) খালেদা জিয়ার বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা কীভাবে খালেদা জিয়ার জন্য আমার কাছ থেকে আরও সহানুভূতি আশা করে।’
লন্ডনের মেথোডিস্ট সেন্ট্রাল হল ওয়েস্টমিনস্টারে তার সম্মানে আয়োজিত একটি কমিউনিটি সংবর্ধনায় তিনি এসব কথা বলেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা বিএনপির পক্ষে শোভা পায় না কারণ তারা জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে ধোকাবাজি খেলেছে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি প্রহসনমূলক নির্বাচন করে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার দেড় মাসের মধ্যেই দেশের জনগণ তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। তিনি বলেন, দেশের জনগণ কখনই ভোট কারচুপিকারীদের ক্ষমতায় বসতে দেয় না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার প্রধান হিসেবে তার ওপর ন্যস্ত নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে এতিমদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ড স্থগিত করার পর খালেদা জিয়াকে তিনি বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন। খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি আইন অনুযায়ী যা করতে পারেন তাই করেছেন। অনেকেই এখন যুক্তি দিচ্ছেন, ‘আইন নিজের গতিতে চললেও খালেদা জিয়ার প্রতি আমি বেশি সহানুভূতি দেখাতে পারি’।
অনুষ্ঠানের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এবং আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাজেদুর রহমান ফারুক।
উত্তর-পূর্ব পাকিস্তানে একটি অঙ্গ পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, পুলিশ বলছে। চক্রটির নেতা ফাওয়াদ মুখতারের বিরুদ্ধে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কিডনি চুরি করে বের করে ধনী গ্রাহকদের মধ্যে প্রতিস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে।
মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা বিবিসি নিউজ।
বিবিসি জানায়, অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর দেহ থেকে কিডনি সরিয়ে ফেলা এবং ধনী গ্রাহকদের কাছে বিক্রির অভিযোগে ফাওয়াদ মুখতার নামের এক চিকিৎসক ও তার দলের আট সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তান পুলিশ। ফাওয়াদ এ পর্যন্ত তিন শতাধিক রোগীর কিডনি চুরি করেছেন।
এমনকি অস্ত্রোপচারকালে কিডনি চুরির সময় তার হাতে অন্তত তিনজন রোগী মারা গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ফাওয়াদ এর আগে পাঁচবার অসদাচরণের জন্য গ্রেপ্তার হলেও প্রতিবারই জামিন নিয়ে মুক্তি পেয়ে যান। রোববার (১ অক্টোবর) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানায় পাকিস্তান পুলিশ। চক্রটি পূর্ব পাঞ্জাব প্রদেশের পাশাপাশি পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে কাজ করছে বলে ধারণা করছে পুলিশ।
পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মহসিন নকভি রবিবার একটি সংবাদ সম্মেলনে জানান, “কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলি বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন ভবনকে ক্লিনিক আকারে সাজিয়ে সেখানে রোগীদের অস্ত্রোপচার করার সময় রোগীদের অজান্তেই কিডনি সরিয়ে নেয়া হত।“
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফাওয়াদ মুখতার জানিয়েছেন, তার নেতৃত্বাধীন চক্র এখন পর্যন্ত মোট ৩২৮ রোগীর দেহ থেকে কিডনি চুরি করেছে। প্রতিটি কিডনি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি রুপি করে।
২০১০ সালে মানবদেহের প্রত্যঙ্গ ব্যবসা নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান। এ অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও মোটা অঙ্কের জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর বিএনপি নেতারা।
তারা বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে জার্মানিতে নেওয়ার কথা ছিল উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সে সময় শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়। এবার চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছি। জার্মানিতে খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে আমরা তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাব। জার্মানিতে তার ভালো চিকিৎসা হবে।’
এর অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত দেড় মাসের বেশি সময় ধরে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় খালেদা জিয়া ঢাকায় এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে তার লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে আসছে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, লিভার সিরোসিসের কারণে খালেদা জিয়ার হৃদ্যন্ত্র ও কিডনির জটিলতা বেড়েছে। তিনি হাসপাতালে কখনো কিছুটা ভালো থাকছেন, পরক্ষণেই তার স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। ফলে তাকে সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লিভার সমস্যার কারণে ম্যাডামের শ্বাস কষ্ট হয়। ইতোমধ্যে তাকে দুইবার করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) রাখা হয়েছিল। লিভার প্রতিস্থাপন করতে পারলে শ্বাসকষ্টটা হতো না।’
এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতির লক্ষণ না থাকায় তার পরিবার ও বিএনপির পক্ষ থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি এখন সামনে এসেছে।
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়া হতে পারে এমন খবরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খোঁজখবর নিচ্ছেন জার্মান বিএনপি নেতারা।
জার্মান বিএনপির সভাপতি আকুল মিয়া বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘জার্মানিতে ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হতে পারে বলে জানতে পেরেছি। আমরা খুবই খুশি। কারণ জার্মানিতে আসলে আমরা তার চিকিৎসার বিষয়ে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে পারব। চেয়ারপারসনের যে চিকিৎসা দরকার তা সকল ব্যবস্থা জার্মানিতে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তি, তার উন্নত চিকিৎসা ও গণতন্ত্র ফেরাতে দেশে চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে জার্মানিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। আগামী ৯ অক্টোবর আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। জার্মান বিএনপির উদ্যোগে রোডমার্চ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করব জার্মান পার্লামেন্টের সামনে। ’
আকুল মিয়া বলেন, ‘দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যখন বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছিল তখনও জার্মানিতে নেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়েছিল। সে সময় তারেক রহমানের সেবা করতে না পারলেও চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সেবা করতে পারব বলে আশা করছি। তার চিকিৎসা জার্মানিতে করতে পারলে আমরা ধন্য হবো।’
গত ২৫ সেপ্টেম্বর সোমবার খালেদা জিয়ার ছোট ভাই সাঈদ ইস্কান্দার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইনি মতামত জানতে চেয়ে আবেদনের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। খালেদা জিয়ার ভাইয়ের আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃতিক বিস্ময় হাওরের ওপর অত্যাচারের যেন শেষ নেই। ধান-মাছের এই বিপুল ভান্ডার রক্ষার নামে একদিকে চলে স্থায়ী-অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণে সীমাহীন দুর্নীতি; যার কারণে যখন-তখন হাওরডুবিতে ঘটে ফসলহানি। পাশাপাশি আরেক দিকে চলে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নের নামে অবৈজ্ঞানিকভাবে যত্রতত্র বাঁধ-রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের ধুম; ফলে পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মরতে বসেছে হাওর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শেষমেশ সরকারপ্রধান হুকুম দিয়েছেনে ‘হাওরে আর কোনো সড়ক নয়।’
এই পরিস্থিতিতে দেশ রূপান্তরের চোখে ধরা পড়েছে আরেক অশনিসংকেত। এবার শিল্পপতিদের চোখ পড়েছে হাওরে। কোথাও কোথাও থাবাও পড়তে শুরু করেছে। তেমনি সব ক্ষতচিহ্ন দেখা গেছে ভাটি অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হবিগঞ্জ জেলার সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে। এখানে গড়ে উঠেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদনের কারখানা। তৈরি হচ্ছে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প। হাওরের ‘লিলুয়া’ বাতাসে এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে কারখানার দুর্গন্ধ। ‘চান্নি পসর রাইতে’ এখন আর শোনা যায় না বাউলকণ্ঠের দরদি সুর। প্রায় দিনই শিল্পপতিদের আনাগোনার অশুভ পদধ্বনি শুনতে পান হাওরবাসী।
অথচ যেকোনো ধরনের স্থাপনা তৈরি বা উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য হওরের স্বাভাবিক পরিবেশ ও জীবনাচরণ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। গত ১৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে হাওর অঞ্চলের সড়কগুলো এলিভেটেড করার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরপর থেকে হাওরাঞ্চলে কোনো সড়ক করতে হলে এলিভেটেড পদ্ধতিতে করতে হবে, যাতে সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায়। সরকারপ্রধানের এমন নির্দেশের পরও থামেনি হাওর ধ্বংসের তৎপরতা।
হাওরে জমি কেনাবেচার হিড়িক
বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট বাজারের অদূরে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের নিচু জমি ভরাট করে বিশাল আকৃতির ছয়টি শেডসহ অনেক স্থাপনা নিয়ে ‘কাজী ফার্ম’ গড়ে তুলেছে মুরগির ডিম ও কম্পোস্ট সার উৎপাদন কেন্দ্র। উপজেলার বাগদাইরসহ আরও কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা ও জেলা সদরে যাতায়াতের একমাত্র পথের ধারেই কাজী ফার্মের এই প্রতিষ্ঠান। এখনই নাকে কাপড় দিয়ে দ্রুত পার হতে হয় রাস্তা; আর প্রতিদিন প্রায় ১২ লাখ ডিম উৎপাদনের এই বিশাল কারখানাটি পুরোপুরি চালু হলে দুর্গন্ধে বসবাস করা যাবে কি না, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন এলাকাবাসী। স্নানঘাট ভূমি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯ একর ৮০ শতক জমি নামজারি হয়েছে। আরও কয়েক একর জমি কিনেছে তারা, যা নামজারির অপেক্ষায়।
গত ১৮ জুন হাওর লাগোয়া বাগদাইর গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা হয় স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের সদস্য আলেকজান বিবির সঙ্গে। তিনিসহ আরও কয়েকজন নারী-পুরুষ দেশ রূপান্তরকে বললেন, হাওরের ফসলি জমি ভরাট করে এ ফার্মটি গড়া হয়েছে। এভাবে শিল্প গড়ে উঠলে হাওরের অস্তিত্ব বিলীন হতে আর সময় লাগবে না।
স্থানীয় লিটন মিয়া বললেন, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের ইলাম এলাকায় আকিজ গ্রুপেরও ১৮ বিঘা জমি রয়েছে। উঁচু পাড় বেঁধে আপাতত মাছ চাষ করছে তারা। আগে জমিটির মালিক ছিলেন সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির চৌধুরী। আব্দুল কাদির চৌধুরী জানান, পাঁচ-ছয় বছর আগে তার নিজের জমি ছাড়াও আশপাশের আরও ৫০ বিঘা জমি কিনেছে আকিজ গ্রুপ। আপাতত পুকুর করেছে। ভবিষ্যতে কী করবে, কোম্পানিই জানে।
দীর্ঘদিন ধরে জমি কেনাবেচায় মধ্যস্থতা (দালালি) করেন হারুন মিয়া। তিনি জানান, শুকনো মৌসুমে মাসের ১০ দিনই তাকে হাওরে জমি দেখাতে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন শিল্পপতির সঙ্গে তার মাধ্যমে জমির মালিকদের কথাবার্তা চলছে।
একই পেশার আলী আমজদ বলেন, ইদানীং গুঙ্গিয়াজুরী হাওর এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার লোকজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সালাউদ্দিন নামে ঢাকার এক বাসিন্দা গত মার্চে বন্ধুদের নিয়ে হাওর ঘুরে গেছেন। রাস্তার পাশে তিনি কমপক্ষে ১৫-২০ একর জমি কিনতে চান। তার সঙ্গে আলাপ করে আমজাদ যা বুঝতে পেরেছেন, জমিতে তারা সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আগ্রহী।
লন্ডনপ্রবাসী নাঈম চৌধুরী জানান, তার ১২ বিঘা জমি কেনার জন্য দামদর ঠিক করেন ঢাকার ব্যবসায়ী জুয়েল খান। সবকিছু ঠিকঠাক করার পর অজ্ঞাত কারণে তিনি সরে যান। নাঈম চৌধুরী পরে জানতে পারেন, কমিশন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় আইনি পরামর্শক জুয়েল খানকে নিরুৎসাহিত করেন।
হাওর গ্রাসের যত কৌশল
নিচু এলাকা হওয়ায় হাওরে জমির দাম তুলনামূলক কম। এখনো এক বিঘা (৩৩ শতক) জমি ৮০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে বেচাকেনা হয়। পুটিজুরী গ্রামের বাসিন্দা টেনু মিয়া বলেন, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলা অংশে গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই-চার কিলোমিটার দূরেই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বিবিয়ানা গ্যাস কূপ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। আবার হাওর এলাকা স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারিও তেমন থাকে না। ফলে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে জমি থেকে বালু তুলে অন্য অংশ ভরাট করে ফেলা সহজ হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ভরাট করা হয়। এভাবে সহজেই হাওরের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলা হয়।
স্থানীয় নবীর হোসেন বলেন, জমির শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমোদন নেওয়া সময়সাপেক্ষ ও বেশ ঝামেলার কাজ। নবীগঞ্জ ও বাহুবল ভূমি অফিসের কয়েকজন তহশিলদারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে তাদের না জানিয়েই শিল্পপতিরা সব কাজ সেরে ফেলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী কৃষিজমিতে শিল্প বা আবাসিক এলাকা তৈরির জন্য জমি কেনার আগেই জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিতে হয়। আবেদনটি প্রথমে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে পাঠাবেন। ইউএনও তখন উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে প্রতিবেদন চাইবেন। সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার) সরেজমিন পরিদর্শন এবং কৃষি, মৎস্য ও বন বিভাগের মতামত পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন পাঠাবেন। এর পর জেলা প্রশাসক সেই অনুমোদন দিতে পারেন।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, কোনো অনুমোদনেরই তোয়াক্কা করেন না শিল্পপতিরা। আবার কেউ জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন করলে তখন চাপের মুখে স্থানীয় প্রশাসনকে শিল্পপতিদের পক্ষেই প্রতিবেদন দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরেজমিন পরিদর্শনে ভূমির যে শ্রেণি পাওয়া যায়, সেই মোতাবেক ভূমি কর আদায় করে নতুন শ্রেণির বৈধতা দিয়ে দেওয়া হয়।
শিল্পপতিরা রাস্তার পাশে প্রথমে এক-দুই একর জমি একটু বেশি দাম দিয়ে কিনে পরে পেছনের জমি প্রায় পানির দরে কেনেন বলে জানান স্নানঘাট ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহশিলদার আবুল কালাম। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, সাধারণত শিল্প মালিকরা দালাল দিয়ে জমি কিনতে চান। কারণ, তারা সরাসরি কিনতে এলে দাম বেশি চাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আরেক মধ্যস্থতাকারী শামসু মিয়া বলেন, ‘বেশি জমি কেনার ইচ্ছা থাকলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। আমরা কম দামে কিনে দিয়ে বেশি কমিশন নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ, আমাদের আয়ের একটা অংশ ভূমি শাখার কর্মকর্তাদেরও দিতে হয়। নইলে জমির কাগজপত্র যত স্বচ্ছই হোক, তারা “ঘিয়ের মধ্যে কাঁটা” বের করার চেষ্টা করেন।’
এ ছাড়া স্থানীয় বা বহিরাগতদের উদ্যোগে পুকুরের নাম করে হাওর এলাকার যেখানে-সেখানে মাটি খনন করা হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, আইন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ড্রেজার বসিয়ে কৃষিজমি থেকে দেদার বালু তোলা হচ্ছে।
জমি নিয়ে লুকোচুরি
হবিগঞ্জের ১৩টি হাওরের মোট আয়তন ৭৩ লাখ ৫৭৯ একর। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের অবস্থান জেলার বাহুবল, নবীগঞ্জ, বানিয়াচঙ্গ ও সদর উপজেলা ঘেঁষে। এই হাওরে কী পরিমাণ জমি ছিল বা এখন কতটুকু আছে, তার প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায়নি সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করেও।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সর্বশেষ হিসাবে, এই হাওরের জমির পরিমাণ ১৭ হাজার ৮৩৩ একর। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ৬৪ হাজার ২২০ একর। ৮ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রকাশিত হিসাবে হাওরের আয়তন দেখানো হয়েছে ১৬ হাজার ৪২৯ একর। জেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৩৯৯ একর ৪ শতক। চারটি অফিসের কর্মকর্তারাই তাদের হিসাব সঠিক বলে দাবি করছেন। আরেকটি রহস্যময় বিষয় হলো, চারটি উপজেলা ঘেঁষে এই হাওরের অবস্থান হলেও ওই চার সরকারি প্রতিষ্ঠানই বানিয়াচঙ্গ ছাড়া বাকি তিন উপজেলার হিসাব দেখাচ্ছে।
১০ বছর আগে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরে জমির পরিমাণ কত ছিল জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এক মাস সময় নিয়েও কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
ওদিকে ২০১৬ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন হাওর ও জলাভূমি অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘ক্লাসিফিকেশন অব ওয়েটল্যান্ড অব বাংলাদেশ ভলিউম-৩’-এ দেখা যায়, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের মোট আয়তন ৬৯ হাজার ৮২৯ একর ৩৭ শতক। এর মধ্যে বাহুবল উপজেলায় ৩০ হাজার ১৫৬ একর ২০ শতক, বানিয়াচঙ্গ উপজেলায় ১৭ একর ২০ শতক, হবিগঞ্জ সদর ১৫ হাজার ৯০১ একর ৮৬ শতক ও নবীগঞ্জে ২৩ হাজার ৭৫৩ একর ৯৯ শতক।
হাওর এলাকায় দিনে দিনে জনবসতি বৃদ্ধি, হাজার হাজার পুকুর তৈরি, জমি ভরাট করে শিল্প-কারখানা স্থাপনের কারণে আগের চেয়ে এখন কৃষিজমির পরিমাণ অনেকটাই কমে আসছে বলে জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. নূরে আলম সিদ্দিকী।
গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের আওতাধীন বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ও স্নানঘাট ইউনিয়নের ছয়টি মৌজার নাম উল্লেখ করে গত ১০ বছরে কী পরিমাণ জমি বিক্রি করা হয়েছে, উল্লিখিত সময়ে জমির মূল্য কত ছিল জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করলে উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার সুশান্ত ঘোষ এবং জেলা রেজিস্ট্রার মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মৌজা হিসাব করে জমি কেনাবেচার তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। এসব উত্তর দিতে হলে প্রতিটি দলিল তল্লাশি করে বের করতে হবে, যা ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ।’
আবেদন-অনুমোদন খেলা
স্থানীয় কয়েকজন কৃষক জানান, কাজী ফার্মের বিক্রি হওয়া জমির মধ্যে ৭৮ বিঘায় আগে তারা বর্গাচাষ করেছেন দীর্ঘদিন। ২০১৮ সালের দিকে জমির মালিকরা কাজী ফার্ম লিমিটেডের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে কাজী ফার্ম প্রায় দুই বছর ধরে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তুলে পুরো জমি উঁচু করে নেয়। তবে নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, এই জমির আগের মালিকের দলিল এবং বর্তমানে কাজী ফার্মের দলিল- দুই জায়গাতেই এটি এখনো ‘কৃষি’ শ্রেণি হিসেবেই আছে।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি বছরের শুষ্ক মৌসুমে গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের তলদেশ থেকে বালু তুলে বাহুবলে নির্মাণাধীন কয়েকটি স্থাপনা ও ছয় লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করতে স্নানঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের নেতা তাজুল ইসলাম একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। হাওরে থাকা তার জমিতে ‘দেশীয় মাছের অভয়ারণ্য’ বানানোর কথা বলে মাটি কেটে পাড় তৈরির অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন তিনি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান এ বিষয়ে ইউএনও ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন দিতে বলেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই সিন্ডিকেট বাহুবল উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে তাদের পক্ষে প্রতিবেদন করায়। প্রতিবেদন পেয়ে কয়েকটি শর্ত দিয়ে জেলা প্রশাসক মাটি কাটার অনুমোদন দেন। বাণিজ্যিক কাজে তাজুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের দীর্ঘদিন ধরে বালু তোলার বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানান স্থানীয় কৃষকরা। এ নিয়ে দেশ রূপান্তরসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে জেলা প্রশাসন তদন্ত করে এর সত্যতা পায় এবং অনুমোদন বাতিল করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, বালু তোলা বন্ধ হলেও এখনো ড্রেজার মেশিন ও পাইপলাইন সরানো হয়নি।
গত ১৪ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর, হবিগঞ্জ কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, কাজী ফার্ম বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ডিজাইন না দেওয়ায় তাদের পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। একই দিন জেলা প্রশাসন অফিসের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, কাজী ফার্ম বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদনই করেনি। অফিস সহকারী আব্দুল ওয়াদুদ বিভিন্ন ফাইলপত্র ঘেঁটে ওই কোম্পানির মাধবপুর উপজেলায় কয়েকটি প্রজেক্টের জমির শ্রেণি পরিবর্তনের আবেদন পেয়েছেন।
আব্দুল ওয়াদুদ জানান, গুঙ্গিয়াজুরী হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় ৫ একর ৭৪ শতক জমি শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ নামে একটি কোম্পানির আবেদন গত ২৩ জানুয়ারি মঞ্জুর হয়েছে। এ ছাড়া ওই কোম্পানি হাওর থেকে দুই-তিন কিলোমিটর দূরে পশ্চিম ম-লকাপন, হায়দরচক মৌজার ৬টি প্রজেক্টের জন্য প্রায় ৬৩ একর জমি কিনেছে। এগুলোর মধ্যে দুই-একটি বাদে বাকিগুলোর শ্রেণি পরিবর্তন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গড়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য হাওরের দিকেই ধাবিত হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
শিল্পপতি পক্ষের ভাষ্য
জানতে চাইলে কাজী ফার্মের ম্যানেজার (অ্যাডমিন) জিয়াউল হক দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের জমির শ্রেণি পরিবর্তন করা আছে। গত ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জিয়াউল হক জানান, বাহুবল স্নানঘাটে তাদের প্রতিষ্ঠানে ডিম উৎপাদন পরীক্ষামূলকভাবে চলছে। এখানে লেয়ার মুরগির ডিম ছাড়াও কম্পোস্ট সার উৎপাদন হবে। এসব মুরগি খুবই স্পর্শকাতর। পরিবেশ একটি বড় বিষয়। যদি এখানকার পরিবেশ অনুকূলে থাকে, তাহলে আরও কী কী উৎপাদন করা যাবে তা পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বায়ুদূষণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিশে^র নামকরা প্রতিষ্ঠান জার্মানির ‘বিগ ডাচম্যান’-এর সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এখানে। ফলে প্রকট দুর্গন্ধ বেরোনোর শঙ্কা খুবই কম। তবে তিনি এও বলেন, সব প্রাণীর শরীরেই গন্ধ থাকে। লাখ লাখ মুরগি যেখানে থাকবে, সেখানে কিছু গন্ধ তো হবেই।
মুরগির বিষ্ঠা সংরক্ষণের ব্যাপারে জিয়াউল হক বলেন, এর গন্ধ বের হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ রাসায়নিক ব্যবহারের মাধ্যমে গন্ধ দূর করা হয়। হাওরের জমি ভরাট করে শিল্প গড়ার আইনি দিক সম্পর্কে প্রশ্ন তুললে তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছাড়া এ-সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়।’
গত ২৪ আগস্ট বাহুবল উপজেলার আব্দাকামাল এলাকায় আকিজ ভেঞ্চার গ্রুপের নির্মাণাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের স্থানীয় ম্যানেজার (অ্যাডমিন) হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, উপজেলার পুটিজুরী, সাতকাপন, স্নানঘাট ইউনিয়নের বিভিন্ন মৌজায় আকিজ গ্রুপের জমি রয়েছে। বর্তমানে আব্দাকামাল এলাকায় প্রায় ৬৫ একর জমিতে বিভিন্ন ধরনের শিল্প স্থাপনের কাজ চলছে। গুঙ্গিয়াজুরী হাওর থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরে এই ‘শিল্পপার্ক’ নির্মাণের পর হাওরের সমুদ্রফেনা মৌজায় তাদের আরও যে ৫৭৪ শতক জমি রয়েছে, তাতে ফ্লাওয়ার মিল, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ শিল্প গড়ে তোলা হবে। তিনি দাবি করেন, ইতিমধ্যে প্রশাসনের কাছ থেকে তারা জমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন।
‘খুবই অন্যায় হবে’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওরে নিচু জমি ভরাট করে যদি শিল্প গড়া হয়, তাহলে পরিবেশের ওপর খুবই অন্যায় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে হাওরের পানি প্রবাহ ও পানি ধরে রাখার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে এমন অবকাঠামো করা যাবে না। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণের সময় হাওরের পানি প্রবাহ যাতে সঠিক থাকে, এ জন্য তিনি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক ও জনপথ বিভাগ, এলজিইডিকে।
তিনি আরও বলেন, ‘উজান থেকে নেমে আসা পানির সঙ্গে বালু আসার ফলে অধিকাংশ হাওরের বুক বালুমাটি এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। হাওর ও বিলগুলোকে পুনঃখনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি। এখন সেখানে যদি মাটি ভরাট করে শিল্প গড়া হয়, সেটা কখনোই কাম্য নয়।’
লাক্সারিয়াস জীবন পাওয়ার জন্য এখন মানুষ দিনরাত শুধুই কাজ করে চলেছেন। যার মধ্যে অফিস ডেস্কে বসে কাজ করেন এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেয়ারে বসে ল্যাপটপের সামনে তাকিয়ে থাকা রীতিমতো যন্ত্রণাদায়ক।
শুধু তাই নয়, এটা স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যারা অফিসে ডেস্কে কাজ করেন তাদের মোটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
সারাদিন যারা ডেস্কে বসে কাজ করেন তাদের অন্যতম অভিযোগও এটি। তারা বলে থাকেন, চেয়ারে বসে কাজ করে মোটা হয়ে যাচ্ছি! তবে এই অজুহাতকে একেবারে সত্য বলার সুযোগ নেই। কারণ ডেস্কে বসে কাজ করেও স্লিম ও ফিট থাকা সম্ভব। এজন্য মেনে চলুন পাঁচটি টিপস।
হাঁটুনফিট ও কর্মক্ষম থাকতে নিয়মিত হাঁটুন। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় বসে থাকলে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। সুস্থ থাকতে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করুন। এমনকি কাজের ফাঁকেও ১০ মিনিটের ব্রেক নিয়ে হেঁটে আসতে পারেন।
সোজা হয়ে বসুনচেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসুন। মেরুদণ্ডের ডিস্কগুলোতে অনেক চাপ পড়ে, সেই সঙ্গে চাপ পড়ে মেরুদণ্ডের পাশের মাংসপেশি ও লিগামেন্টের ওপর। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় মনিটরটি চোখের সমান স্তরে রাখুন। মাউস ব্যবহার করার সময় শুধু আপনার কব্জি নয় পুরো হাত ব্যবহার করুন।
চাপ এড়িয়ে চলুনএটা খুব কঠিন কাজ, চাপমুক্ত থাকা। বিশেষ করে যখন চারপাশ থেকে নানা ধরনের চাপ আসতে থাকে। তবে মানসিক স্থিরতা ধরে রাখুন, নিজেকে মোটিভেট করুন। কোনও চাপই বেশি দিন থাকে না, এগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজে মনোযোগ বাড়ান। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে আনতে অনলাইনে কিছু যোগা শিখে অভ্যাস করুন।
চোখের যত্নকম্পিউটারে কাজ করার সময় স্ক্রিনে একটানা ১০-১৫ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকবেন না। নিয়মিত চোখের পাতা ফেলুন। স্ক্রিনে পর্যাপ্ত আলো রাখুন, যেন চোখের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে।
হাড়ের যত্ন বসে থাকার ফলে হাড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ক্যালসিয়ামের ঘাটতিও হতে পারে। এজন্য নজর দিতে হবে প্রতিদিনের খাবারে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে নিয়মিত ডিম, দুধ, দই ও বাদাম রাখুন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কোন দেশে ভালো চিকিৎসা হতে পারে তার খোঁজ নিচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঢাকায় জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসা জার্মানিতে হতে পারে কিনা জানতে চেয়েছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সম্ভব জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। মঙ্গলবার জানতে চাইলে ঢাকায় জার্মানির সিডিএ জান রল্ফ জানোস্কি বলেছেন, ‘মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মিসেস জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ধরন সম্পর্কে জেনেছি। তার ভালো চিকিৎসা বিশ্বের খুব কম দেশে সম্ভব। জার্মানিতে এসব সমস্যার খুব ভালো চিকিৎসা আছে। সরকারের অনুমোদন পেলে তিনি জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে পারেন।’ এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলেননি তিনি।
৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কিডনির কর্মক্ষমতা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। ফলে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। এ কারণে কয়েকবার তাকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) লিভার, কিডনি, হার্ট, ফুসফুসসহ সার্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে সম্প্রতি দুবার সিসিইউতে নিতে হয়। এখন মেডিকেল বোর্ডের অধীনে নিবিড় পর্যবেক্ষণে আছেন। ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ।
তিনি আরও জানান, মেডিকেল বোর্ড মনে করে সর্বসম্মতভাবে তাদের পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অতি দ্রুত বিদেশে লিভার প্রতিস্থাপনে সম্মিলিত আধুনিক মাল্টি ডিসিপ্ল্যানারি মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া জরুরি। তাহলেই তিনি শঙ্কা মুক্ত হতে পারেন বলে বোর্ড রিকমেন্ডেশনে বলেছেন।
এর আগে ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রারাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।
এদিকে খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, চিকিৎসা, বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে আজ বুধবার জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, খালেদা জিয়ার অবস্থা শঙ্কাজনক। এ অবস্থায় তাকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই সরকার সেসব আমলে না নিয়ে খালেদা জিয়াকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এখন দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। আগের মতোই লিভারের জটিলতার পাশাপাশি ফুসফুসের জটিলতা নিয়ে শঙ্কিত তার চিকিৎসকরা। মেডিকেল বোর্ডের একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার ফুসফুস থেকে পানি বের করা হয়েছে। শরীরে ক্যাথেডর লাগানো হয়েছে। আগে যেখানে দুই-তিন দিন পরপর পানি বের করা হয়েছে, এখন প্রতিদিনই পানি বের করতে হচ্ছে। তার কেবিনে মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, খালেদা জিয়ার অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি নেই। লিভার সিরোসিসের সঙ্গে কিডনির জটিলতাও বাড়ছে। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া সামনে বিকল্প নেই। এর জন্য খুব দ্রুত উন্নত চিকিৎসায় বিদেশ পাঠানো দরকার।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই গুরুতর। গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। আবেদনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি বলে খালেদা জিয়ার একান্ত সহকারী জানিয়েছেন।
পাশাপাশি সরকারের অনুমতি পেলে দ্রুততম সময়ে তাকে বিদেশে নিতে ভিসা-প্রক্রিয়া শুরু থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ভিসা করানো যাচ্ছে না।
গতকাল শুক্রবার দেশ রূপান্তরকে এসব কথা জানিয়েছেন খালেদা জিয়ার মেজো বোন সেলিমা ইসলাম।
তিনি বলেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের খোঁজখবর নিচ্ছেন যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান। শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ থাকলে প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হতে পারে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নত হলে অন্য দেশে নেওয়া হবে।
সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘আমার বোন হেঁটে জেলে গেলেন। জেলে থাকাবস্থায় অসুস্থ হলে তাকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এরপর করোনার কারণে সরকার তাকে দুটি শর্তে মুক্তি দেয়। তখন থেকেই আমরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে আবেদন করে আসছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকার তাকে মুক্তি দেয়নি। বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারায় দিনের পর দিন তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আমার বোন।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবিএম আব্দুস সাত্তার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি নেতারা সার্বক্ষণিক চেয়ারপারসনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আমরা সরকারের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে আমরা দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠাতে পারব।’
জিয়া পরিবারের সদস্যরা গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুমতি পাওয়া মাত্র সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন। ইতিমধ্যে ভিসা প্রস্তুতিসহ অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। বিদেশে নেওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাবেন তার পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান, ব্যক্তিগত সহকারী ফাতেমা ও ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথি। তখন থেকেই তিনি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সেবায় সার্বক্ষণিক থাকছেন।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আজ (গতকাল শুক্রবার) ম্যাডাম শ্বাসকষ্ট অনুভব করলে বিকেলে তাকে তৃতীয়বারের মতো কেবিন থেকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) নেওয়া হয়। রাতে আবার তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হওয়ায় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। পরে অবস্থার উন্নতি হলে তাকে ফের কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় বিএনপি গঠিত চিকিৎসক দলের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একই বছরের নভেম্বরে তার চিকিৎসকরা জানান, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত দলীয় মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন, তাদের সাধ্য অনুযায়ী যতটুকু করার ছিল, তারা তা করেছেন। পরবর্তী চিকিৎসা যুক্তরাজ্য, জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবারকে বলেছেন। পরের বছর জুন মাসে খালেদা জিয়ার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর মধ্যে একটিতে রিং পরানো হয়। এখনো তার হার্টে দুটি ব্লক রয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ম্যাডামকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের পাশাপাশি আমরা বিএনপি নেতারা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি। স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চেয়ারপারসনের পরিবারকে সার্বিক সহযোগিতা দিতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি। সরকার অনুমতি দিলে দ্রুতই চেয়ারপারসনকে বিদেশে পাঠানো হবে।’
গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহিলা দলের উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যে মানুষটি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তাকে আজ সরকার গৃহবন্দি করে রেখেছে। তিনি গুরুতর অসুস্থ হলেও তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। আমরা আশা করি, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে তার পরিবার যে আবেদন করেছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করবে।’
সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে আটক রাখা হয়েছে। কারণ উনি মুক্ত থাকলে ওনাদের ক্ষমতায় থাকা কঠিন হয়ে যাবে। উনি মুক্ত থাকলে দেশের গণতন্ত্র মুক্ত থাকবে। উনি মুক্ত থাকলে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না।’
খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী, সরকার নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছে। ফলে এখন জেলে যাওয়া বা আদালতের আশ্রয় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ওই ৪০১ ধারাতেই বলা আছে, নির্বাহী আদেশে শর্ত ছাড়াই মুক্তি দেওয়া যায়। এমনকি সরকার সাজা মওকুফও করতে পারে। ফলে সরকারই শর্তহীন মুক্তি দিয়ে খালেদা জিয়াকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’
গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর বিষয়ে দুই-তিন দিন আগে তার ভাই শামীম এস্কান্দার এসেছিলেন। তিনি আবেদন জমা দিলে তা আইনমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে ব্যাখ্যার জন্য।
আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদনটি অল্প সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নিতে চায় তার পরিবার। ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এদিকে খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়টি জানতে পেরেছেন জার্মান বিএনপি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে থাকা বিএনপি নেতারা।
তারা গত বৃহস্পতিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে আনার কথা শুনছেন। খালেদা জিয়ার যে চিকিৎসা দরকার তার আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা জার্মানিতে রয়েছে। তারাও অপেক্ষা করছেন যদি চেয়ারপারসনকে জার্মানিতে আনা হয় তাহলে তার জন্য কিছু করার সুযোগ পাবেন ওই নেতারা।
খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে নেওয়ার বিষয়ে গত মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) জান রল্ফ জানোস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন। জবাবে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত জানোস্কি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যে ধরনের সমস্যায় ভুগছেন তার সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা বিশে^র যে কয়েকটি দেশে সম্ভব, জার্মানি তার অন্যতম। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দিলে জার্মানিতে তার সুচিকিৎসা হতে পারে।’
গত ৯ আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর আগেও অবশ্য খালেদা জিয়াকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, আর্থ্রাইটিস, রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি, হৃদযন্ত্রে জটিলতা, ফুসফুস, চোখ ও দাঁতের নানা সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া তার মেরুদ-, হাত ও হাঁটুতে বাতের সমস্যাসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতা রয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার সাজা হয়। সেদিন থেকে প্রায় দুই বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আরও সাত বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনা মহামারির শুরুতে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছিল সরকার। এরপর থেকে তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাস করে বাড়ানো হচ্ছে।