সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৪ ফাল্গুন ১৪৩১
দেশ রূপান্তর

ভাষা আন্দোলনের চেতনা অধরা রয়ে গেছে

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১০:৫৮ এএম

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আহমদ রফিকের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহবাজপুরে, ১৯২৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। একাধারে প্রাবন্ধিক, কবি ও কলাম লেখক আহমদ রফিক রবীন্দ্র গবেষক হিসেবেও খ্যাতিমান। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে শিক্ষাজীবন বিপর্যস্ত হয়। কর্মজীবনে তিনি একসময় ওষুধশিল্পের উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনায় যুক্ত ছিলেন। তিনি রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলা একাডেমির ফেলো ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্য। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘একুশে পদক’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, কলকাতার টেগোর রিসার্স ইনস্টিটিউট থেকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি, স্বদেশের ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ দেশ বিভাগ : ফিরে দেখা, শিল্প সংস্কৃতি জীবন, আরেক কালান্তর, বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলন : ইতিহাস ও তাৎপর্য, রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প, রবীন্দ্রচর্চা বাংলাদেশ, রবীন্দ্রভুবনে পাতিসর, জাতিসত্তার আত্মঅণে¦ষা, জীবনানন্দ : সময় সমাজ ও প্রেম, একাত্তরে পাক বর্বরতার সংবাদভাষ্য, ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো, একুশ থেকে একাত্তর ইত্যাদি। কবিতাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : নির্বাসিত নায়ক, বাউল মাটিতে মন, রক্তের নিসর্গে স্বদেশ ইত্যাদি। ভাষা আন্দোলনের ৬৭তম বার্ষিকীর প্রাক্কালে দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনিন্দ্য আরিফ

দেশ রূপান্তর : ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপটটি আলোচনা করবেন।

আহমদ রফিক : ১৯৪৮-এ ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন শুরু করেছিল তমুদ্দন মজলিস আর প্রগতিশীল ছাত্র-যুবারা। কিন্তু আন্দোলন তুঙ্গে না উঠতেই জিন্নাহ এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন শান্তি প্রস্তাব পাঠালে তা গ্রহণ করে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। এটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তোয়াহা সাহেব, তাজউদ্দিন সাহেব তখন বলেছিল একবার আন্দোলন স্থগিত করলে আবার তা চাঙ্গা করা কঠিন হবে। তাদের কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছিল। আন্দোলন চাঙ্গা করতে ১৯৪৮-এর মার্চ থেকে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ প্রায় চার বছর লেগে গিয়েছিল। ১৯৫০-এ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হলেও তা তখন আন্দোলনকে খুব বেশি বেগবান করতে পারেনি।

এই আন্দোলনে মূলত চারটি বিষয় কাজ করেছে। প্রথমত, আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ছাত্রদের কেউ আন্দোলন করতে শেখায়নি। সরকারের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্ররা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ ছাত্ররা এই আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা পালন করেছিল। তৃতীয়ত, ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত। ছাত্ররাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রাজনীতিবিদরা এর বিরোধিতা করেছিল। আমার লেখা বইতে এই ইতিহাস আছে। চতুর্থত, পুলিশের গুলি চালানো। পুলিশের গুলি চালানোর খবর প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল। আমি গ্রামাঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের বিষয় নিয়ে একটি বই লিখছি। প্রথমা প্রকাশন ‘ভাষা আন্দোলন : টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ এই শিরোনামে বইটি প্রকাশ করবে। সেখানে আমি গবেষণা করে দেখিয়েছি যে, পুলিশের গুলি চালানোর খবর সারা দেশে কোথাও ২২ তারিখ, কোথাও ২৩ এমনকি ২৪ তারিখও পৌঁছায়। তারপর তা তুঙ্গে ওঠে এবং দেশব্যাপী পরিসর পায়। মূলত এই চারটি বিষয় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে কাজ করেছিল।

দেশ রূপান্তর : ২০২২ সালে ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পূর্তি হবে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের ফলাফলকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?

আহমদ রফিক : ভাষা আন্দোলনের পর দীর্ঘ সময় ধরে দৃশ্যপটটা একই রকম থেকে গেছে। ভাষা আন্দোলনের যেসব উদ্দেশ্য ছিল তার মধ্যে মূল দাবি ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। অর্থাৎ তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু এটাই একমাত্র দাবি ছিল না। আরও কিছু দাবি ছিল, যেমন : ‘সকল রাজবন্দীর মুক্তি চাই’, ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর’। এর মধ্যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করার দাবিটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই দাবিগুলোর ভিত্তিতে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে এবং ষাটের দশকে এর বিকাশ ঘটে।এরই পথ বেয়ে ৬ দফা, ১১ দফা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এসব সংগ্রামে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল ছাত্র-যুব সমাজ। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর একুশের চেতনা অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনের দাবিগুলো বাস্তবায়িত হওয়ার যে প্রত্যাশা ছিল তা পূরণ হয়নি। ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ কিছুটা বাস্তবায়িত হয়েছে। অর্থাৎ আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বাধীন হওয়ার পর যে সংবিধান প্রণীত হলো তা একটি ভালো সংবিধান। একটি ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। সেখানে উল্লেখ আছে, প্রজাতন্ত্রের ভাষা হিসেবে সর্বস্তরে বাংলা চালু করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবনে তথা জাতীয় জীবনে সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

গোটা ইংরেজ আমলে রাজভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রচলন ছিল। এই ভাষার মাধ্যমে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান শিক্ষিত হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পরও আমরা দেখলাম ইংরেজি ভাষার দাপট। অর্থাৎ গোটা পাকিস্তান আমলে যে স্লোগানগুলোর ভিত্তিতে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, তা মিথ্যে হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো উচ্চ আদালত, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষায় ইংরেজি ভাষার আধিপত্য। শুধু ভাষাগত আধিপত্য নয়, সাংস্কৃতিক আধিপত্যও বজায় থেকেছে। সর্বক্ষেত্রেই বিদেশি সংস্কৃতির প্রাধান্য বিদ্যমান। লক্ষ করুন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এখনো বিচারকদের ‘মাই লর্ড’ বলে সম্বোধন করা হয়। যা ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির আধিপত্যকেই ইঙ্গিত করে। এটা তো স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

এই দিকটাতে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি, শিক্ষিত শ্রেণি কখনোই মনোযোগ দেয়নি। তাই ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়িত হয়নি। নামকাওয়াস্তে রাষ্ট্রভাষা, নামকাওয়াস্তে ভাষা আন্দোলন। একটি জাতিরাষ্ট্রের জাতীয় ভাষা হয় তার মাতৃভাষা। সেটা শুধু জাতীয় ভাষাই নয়, জীবিকার ভাষাও হয় মাতৃভাষা। যারা শিখছে তাদের দোষ নেই। কেননা তাদের পরিবারের অভিভাবকরা সবাই মিলে প্রতিবাদ করছে না যে, ভাষা আন্দোলনের মূল যে চেতনা তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাই ভাষা আন্দোলনের মূল যে চেতনা তার বাস্তবায়ন অধরাই রয়ে গেছে।

দেশ রূপান্তর : বাংলাদেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর শিশুদের এখনো মাতৃভাষায় ‘প্রাথমিক শিক্ষা’র সুযোগ নিশ্চিত করা যায়নি। এই বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আহমদ রফিক : প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তাদেরও অধিকার রয়েছে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের। কিন্তু এটা একটা সমস্যাও বটে। কেননা এতগুলো ছোট ছোট ভাষাকে তো আর রাষ্ট্রভাষা করা যায় না। তবে একটা স্তর পর্যন্ত তারা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ করতে পারে। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষাটা তারা মাতৃভাষায় সম্পন্ন করতে পারে। তাদের সেই অধিকারের সুযোগ দেওয়া উচিত। তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকা রাখা উচিত।

দেশ রূপান্তর : জাতীয় শিক্ষানীতিতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, মাদ্রাসাসহ নানা মাধ্যমে বিভক্তি আছে এবং বাংলা ভাষা এখনো উচ্চশিক্ষায় গুরূত্ব পাচ্ছে না। আপনার মূল্যায়ন কী?

আহমদ রফিক : আমাদের দেশের শিক্ষায় চরম দুরবস্থা চলছে। ত্রিধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে। একদিকে সবচেয়ে উঁচুতে ইংরেজি ভাষার ইংরেজি মাধ্যম, এরপরে আরবি ভাষার কওমি মাদ্রাসা আর বাংলায় সাধারণ শিক্ষা। আমরা ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। এর মাধ্যমে কিছু মানুষের শ্রেণিগত স্বার্থ পূরণ হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সময় যে আদর্শিক ভিত্তি ছিল তা আজ আর নেই। ইংরেজি মাধ্যম, কিন্ডারগার্টেন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই বাংলা ভাষা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এই ব্যাপারে সরকার চরম উদাসীন। তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা শুধু নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ পূরণে তৎপর। সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থাতেও এত বিভক্তি। আর ইংরেজি মাধ্যমের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের এই অবহেলা স্পষ্ট।

দেশ রূপান্তর : প্রাচীন বাংলা সম্পর্কিত ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চায় এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের মতো এত বড় অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও বঙ্গবিদ্যা চর্চার মতো বিষয়টি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে না। এর কী কারণ মনে করেন?

আহমদ রফিক : আমি খুব সংক্ষেপে এটা আলোচনা করতে চাই। এর দুটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি। প্রথমত. মেধাবী, বিশেষ করে শিক্ষকদের গবেষণায় মনোযোগ নেই। তাদের গবেষণায় আগ্রহ কম। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত চাহিদা পূরণে তৎপর। আর রাষ্ট্রও এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। দ্বিতীয়ত. আমাদের ঐতিহ্য সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত নই। আমরা এই বিষয়টিকে খুবই অবহেলার চোখে দেখি। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগও তেমন শক্তিশালী নয়।

সর্বশেষ সর্বাধিক পঠিত আলোচিত