তানভীন সুইটি। মডেল, অভিনেত্রী ও প্রযোজক। নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শুরু করা শোবিজ ক্যারিয়ারকে ধরে রেখেছেন সমান জনপ্রিয়তায়। এখনো সরব মঞ্চ, নাটক, ওটিটি, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনচিত্রে। রাজনীতিসচেতন এই তারকা এসেছিলেন দেশ রূপান্তরের শুক্রবারের আড্ডায়। তার সঙ্গে গল্প-কথায় মেতে ওঠেন সহকারী সম্পাদক তাপস রায়হান, ডিজিটাল টিমের উপস্থাপিকা ফারজানা নিকিতা ও বিনোদন সম্পাদক মাসিদ রণ
দীর্ঘ তিন দশকের ক্যারিয়ার তানভীন সুইটির। কিন্তু এখনো চিরসবুজ এই তারকা। তার ব্যক্তিত্ব, চলাফেরা, কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ সব কিছুতেই রুচির পরিচয় বহন করে। তিনি যে এক সময় এ দেশের প্রথম তিনজন মডেলের একজন ছিলেন সেই পরিচয় আজও তার উপস্থিতিতে বিদ্যমান হয়। দেশ রূপান্তরের আড্ডায় এই তারকা এসেছিলেন নরম গোলাপি একটি ট্রেন্ডি শাড়ি পরে। একেবারেই ছিমছাম মেকআপ, হালকা গয়না আর মন ভালো করে দেওয়া মিষ্টি হাসি তার। নিয়মমাফিক আড্ডা শুরুর আগেই দেশ রূপান্তরের কার্যালয়ের ছাদ লাগোয়া গ্রীন লাউঞ্জ রেস্টুরেন্টের আউটডোরে নানা পোজে ছবি তুললেন অভিনেত্রী। এরপর স্টুডিওতে বসেছিল আড্ডা। শুরুতেই জানতে চাই, সম্প্রতি আমেরিকায় লম্বা সময় অবকাশ যাপন করে এলেন স্বামীর সঙ্গে। এখন কেমন আছেন?
সুইটি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। আপনাদের সবাইকে দেখেও খুব ভালো লাগছে। তবে আমি কিঞ্চিৎ শঙ্কিত। কারণ এই প্রথম এভাবে কোনো পত্রিকা অফিসে ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। চার পাশে এতগুলো লোক, জানি না আমাকে কোন কোন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেন (হা হা হা)! তার শঙ্কা দূর করার জন্য বললাম, আসলে দেশ রূপান্তরের এই পুরো পাতার আড্ডা আয়োজনের উদ্দেশ্যই হলো, আপনাদের মতো এ দেশের গুণী মানুষদের এক ধরনের ট্রিবিউট করা। যার মাধ্যমে উঠে আসবে আপনার ব্যক্তিগত ও পেশাজীবনের নানা অধ্যায়। এভাবেই শুরু হলো আড্ডা...
মাসিদ রণ : অভিনয়ের বাইরে আর কী নিয়ে ব্যস্ততা যাচ্ছে?
তানভীন সুইটি : বেছে বেছে অভিনয় তো করছিই। সংসারের ব্যস্ততা তো একজন নারীর সব সময় থাকেই। পাশাপাশি একজন শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কিছু কাজ করি। নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করি। যখনই কোথাও থেকে কেউ আমাকে এ ধরনের কাজে ডাকে আমি বিনা বাক্যে সেখানে চলে যাই। কারণ আমি অনুভব করি, আজকে আমি যে জায়গাটায় অবস্থান করছি সেটি তৈরি করে দিয়েছেন আমার দর্শক। ফলে তাদের জন্য আমারও কিছু করণীয় থাকে। সে জন্যই এ ধরনের কাজে নিজেকে যুক্ত রেখেছি (কথার সূত্র ধরেই আমি বললাম, আপনার এ ধরনের কাজের প্রতি যে আগ্রহ সেটির সাক্ষী আমি নিজেও। আজও আড্ডা শেষ করে আপনি ‘মিস এভারগ্রীন বাংলাদেশ’ নামের একটি ট্যালেন্ট হান্ট প্রতিযোগিতায় গ্রুমিং ক্লাস করাতে যাবেন। এবং সেখানে যেতে আপনি রাজি হয়েছেন, যখন শুনেছেন এই প্রথম কোনো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় স্বাভাবিক মেয়েদের সঙ্গে দুজন ট্রান্সজেন্ডার ও একজন ডিজেবল প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছে)।
মাসিদ রণ : সম্প্রতি আপনার ‘মাইক’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ অবলম্বনে ছবিটি নির্মিত। কেমন সাড়া পেলেন দর্শকের?
তানভীন সুইটি : যারা দেখেছেন তারা ছবিটির প্রশংসা করেছেন। তবে এ ধরনের ছবি কতটা জনপ্রিয় হলো তার চেয়ে অন্য কিছু বিষয় বড় হয়ে ওঠে। আগেই বলেছি, শিল্পী হয়ে আমাদের এমন কিছু কাজও করে যেতে হবে, যা আমাদের সমাজের জন্য শিক্ষণীয় কিছু হবে, ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখবে। ‘মাইক’ তেমনি একটি সিনেমা। কারণ এর গল্প ৭ মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। ইতিহাস ভুলে গেলে চলবে না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই কিন্তু আমদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আজকে আমার প্রথম পরিচয়, আমি তানভীন সুইটি, স্বাধীন বাংলাদেশের একজন নাগরিক। সেই জায়গা থেকে আমাকে যখন ‘মাইক’ ছবিতে অভিনয়ে প্রস্তাব করা হয় তখন আমি একবাক্যে রাজি হয়ে যাই। ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকা-ের পরের প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৭ মার্চের ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর অবদানসহ অনেক কিছুই জানত না। কারণ তৎকালীন সরকার এই ইতিহাসকে আড়াল করে রেখেছিল। সেই বিষয়গুলোকেই ‘মাইক’ ছবিটিতে উঠে এসেছে। কাজটি করে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।
তাপস রায়হান : সবাইকে জানানো উচিত, তানভীন সুইটি আমাদের দেশের সম্পদ। তাকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না?
তানভীন সুইটি : নিজের কথা কীভাবে যে বলি! বললেই নানাজন নানাভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারেন। এ কথা আপনারা বললেই ভালো হয়। তবে আমি এটুকু বলতে পারি, আমি যা পেয়েছি তাতেই তুষ্ট। কিন্তু করার ছিল অনেক কিছু। ভবিষ্যতে হয়তো সুযোগগুলো আসবে।
তাপস রায়হান : আপনি তো অভিনয়ের নানা মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, মঞ্চে যেভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন সেটি ক্যামেরার সামনে হয় না। আপনি কি এ কথার সঙ্গে একমত?
তানভীন সুইটি : হ্যাঁ, আসলেই আমি মঞ্চে কাজ করতে বেশি ভালোবাসি, সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। কারণ, আমার অভিনয়ের শুরুটাই তো মঞ্চনাটকের দল ‘থিয়েটার স্কুল’ থেকে। সেটি ১৯৯১-৯২ সালের কথা। যাই হোক, মঞ্চে কাজ করার মজাটাই তো অন্য রকম। মঞ্চে অভিনয়ের প্রতি এক ধরনের মোহ কাজ করে। এটি অভিনয় শেখার প্রকৃত জায়গা। সেখানে কাজের প্রক্রিয়াটাই আলাদা। প্রথমে একটি স্ক্রিপ্ট পাই আমরা, পুরোটা মুখস্থ করে ফেলতে হয়। ৬-৭ মাস রিহার্সেলের পর আমরা যখন ফাইনালি স্টেজে ওঠি, তখন কিন্তু কোনো কাট করার সুযোগ নেই। কোনো ভুল করলে তা শুধরানোর রাস্তা সেই শোতে বন্ধ। এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে যখন কেউ দর্শকভরা হলে পারফর্ম করে তখন যে কী আনন্দ সে কথা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। শো শেষে দর্শকরা সরাসরি যখন তাদের ফিডব্যাক জানায়, ভালোলাগার আবেশ তাদের চোখে মুখে আমরা দেখতে পাই, তখন যে অনুভূতি হয় সেটির কোনো তুলনা হয় না।
তাপস রায়হান : আপনাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম বা আপনারাও যে ধরনের মানসিকতা নিয়ে অভিনয় শুরু করেছিলেন, এখনকার প্রজন্মের মধ্যে তেমনটা দেখা যায় না। এই দায় কী আপনাদের ব্যর্থতা না তাদের দীনতা?
তানভীন সুইটি : অভিনয়ের প্রতি যে মানসিক উৎকর্ষের কথা আপনি বলছেন, থিয়েটার চর্চার মধ্য দিয়েই কিন্তু সেটি আমাদের মধ্যে আস্তে আস্তে এসেছে। তার জন্য প্রচুর সময় দিতে হয়। আপনি কোনো কাজকে ভালো না বাসলে তো সেই কাজে সময় দিতে চাইবেন না। একটি নাটক মঞ্চে আনতে আমরা মাসের পর মাস রিহার্সেল করি। সপ্তাহে ৫ দিন করে রিহার্সেল করতে হয়। অনেকে ভাবতে পারে প্রতিদিন এত কষ্ট করে রিহার্সেলে যাওয়ার দরকার নেই। আমি যখন পুরোদমে টিভি নাটক করতাম, তখনো আমার শর্ত থাকত, আমাকে সন্ধ্যার মধ্যে ছুটি দিতে হবে। কারণ তারপর আমি মঞ্চনাটকের রিহার্সেল করব। এটা অনেকে করতে চায় না। মনে করে, থিয়েটার করে কেন অযথা সময় নষ্ট করব? তারা হয়তো জানে না, থিয়েটার তার অভিনয়কে কতখানি সহজ করে দিতে পারে। এসব কারণেই অভিনয়ের প্রতি তাদের ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।
মাসিদ রণ : ইদানীং আবার থিয়েটারের ছেলেমেয়েদের কদর বাড়ছে। আপনি বিষয়টি খেয়াল করেছেন?
তানভীন সুইটি : অবশ্যই। বিষয়টিতে আমি খুবই খুশি এবং আজকাল বেশ আশাবাদী। করোনার আগেও যখন বিভিন্ন জায়গায় বিচারক হিসেবে যেতাম, খেয়াল করতাম তেমন কেউ থিয়েটার থেকে আসে না। থিয়েটারের প্রতি তাদের উদাসীনতাও খেয়াল করেছি। তারা চাইত, খুব অল্প সময়ে স্টার হয়ে যেতে। শুধু তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাই নয়, আমি বিভিন্ন প্রযোজক পরিচালককে বলতাম, আপনারা কেন থিয়েটারের ছেলেমেয়েদের সুযোগ দেন না। তারা বলত, না, থিয়েটারের ছেলেমেয়েরা তো রিহার্সেলের সময় হলে সব ফেলে চলে যাবে। কিন্তু এখন ওটিটি আসার পর দেখবেন, অনেক থিয়েটারের ছেলেমেয়েরা দারুণ কাজ করছে। কারণ এখন আমরা ফাইট করছি বিশে^র সঙ্গে। তাই এখন গ্ল্যামার বা অন্য কিছুর চেয়ে অভিনয় জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বুঝতে পেরেছেন পরিচালক-প্রযোজকরা। শুধু তারাই নয়, শোবিজে জনপ্রিয় হওয়া অনেক ব্যস্ত তারকা এখন থিয়েটারের গুরুত্ব বুঝে বিভিন্ন কর্মশালা কোর্স ইত্যাদি করছে। আফরান নিশো, মৌটুসী বিশ্বাস, ভাবনা, নওশাবা, নাযিফা তুষির মতো তারকারা এখন থিয়েটার চর্চা করছে। এটা সত্যিই একটি ইতিবাচক বিষয়।
মাসিদ রণ : থিয়েটারে যুক্ত হয়েছিলেন কীভাবে?
তানভীন সুুইটি : থিয়েটার স্কুলের মাধ্যমে থিয়েটার চর্চা শুরু করি। সেখানে গিয়েও তো আমি অবাক! ভেবেছিলাম, অল্প-বিস্তর কোর্স করে অভিনয়টা শিখে ফেলব, নিজের জড়তা কাটিয়ে উঠব। কিন্তু সেখানে তো রীতিমতো বইপত্র কিনে পড়াশোনা করতে হচ্ছে, ক্লাস করতে হচ্ছে, যোগব্যায়াম, নাচ, গান, আবৃত্তি, দেশি-বিদেশি নাটকের ইতিহাস পড়তে হচ্ছে। তখন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার আর আব্দুল্লাহ আল মামুন আমাকে উনাদের নাটকের মূল দলে নিয়ে নিলেন। প্রথম মঞ্চনাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।’ তখন কিন্তু আমি বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছি। ফলে দর্শক মহলে আমার ইমেজ তৈরি হয়েছে একজন গ্ল্যামারাস আধুনিকা মেয়ে হিসেবে। ফলে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকে আমাকে একটি গ্রামের অল্পশিক্ষিত দরিদ্র মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যার একটু শঙ্কিত ছিলেন। কিন্তু আমি যখন নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটি করি তখন তিনি নিজেই বলেছিলেন যে, তোমার সম্মন্ধে আমার ভুল ধারণা ছিল। তুমি থিয়েটারটা চালিয়ে যাও। ভালো করতে পারবে। আমিও সেই থেকে এখনো লেগেই আছি।
ফারজানা নিকিতা : মঞ্চ এবং ক্যামেরার সামনে অভিনয় পাশাপাশি চালিয়ে যেতে নিশ্চয়ই অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। দু-একটি ঘটনা যদি শেয়ার করতেন...
তানভীন সুইটি : অনেক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। দেখা যাচ্ছে খুব ভালো একটি টিভি নাটকের স্ক্রিপ্ট পেয়েছি, কিন্তু যে সময়ে শুটিং হবে তখন আবার থিয়েটারের শো রয়েছে। তাই ওই টিভি নাটকটি করতে পারিনি। আমি থিয়েটারকে বরাবরই প্রাধান্য দিয়েছি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে।
শুটিং ছিল ঢাকার বাইরে। যেদিন কাজ শেষ হবে তার পরের দিন ছিল ঢাকার মঞ্চে আমার নাটকের শো। পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, শুটিং শেষে সেই রাতেই ফিরে আসব ঢাকায়। তাহলে পরদিন শো করতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু হরতালের কারণে আমি কোনোভাবেই ঢাকা ফিরতে পারছিলাম না। তখন আমার যে কি অবস্থা হয়েছিল! ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কান্নাকাটি করে, টেনশনে আমি শেষ। অবশেষে ঢাকায় পৌঁছতে পেরেছিলাম, তবে একেবারে শো শুরুর আধ ঘণ্টা আগে। দ্রুত পোশাক পরে, কোনোমতে মেকআপ নিয়ে সাড়া জাগানো নাটক ‘মেরাজ ফকিরের মা’তে অভিনয় করেছিলাম।
মাসিদ রণ : থিয়েটারের গল্প শোনা হলো অনেকখানি। এবার আসা যাক আপনার শোবিজের ক্যারিয়ারে। মডেলিং দিয়েই প্রথম সারা দেশে পরিচিতি পান। শুরুর দিকের গল্প শুনতে চাই...
তানভীন সুইটি : আমি তো আফজাল হোসেনের হাত ধরে বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হিসেবে এসেছিলাম। আমি আর তানিয়া আহমেদ একই সঙ্গে শোবিজে পা রাখি ডায়মন্ড ব্র্যান্ড নারিকেল তেলের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে। তখন আমি এখনকার মতো এত কথা বলতে পারতাম না। শুরুর দিকে আমি অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিলাম। খুব চুপচাপ, লাজুক স্বভাবের। ফলে প্রথম কাজটি করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কোনোভাবেই ক্যামেরার সামনে নিজেকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেলে ধরতে পারছিলাম না! কিন্তু আফজাল ভাই আমাকে বকা দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে কাজটি আদায় করে নেন। এবং তখনই তিনি আমাকে থিয়েটার স্কুলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। যাই হোক, আমরা কিন্তু অনেক মজা করে কাজ করতাম। তখন সাদিয়া ইসলাম মৌ, তানিয়া আহমেদ, ফয়সাল, পল্লব, নোবেল, আমিসহ একঝাঁক তরুণ মডেল কাজ করতাম। সবাই ছিলাম বন্ধুর মতো। এমনো হয়েছে, আমি তানিয়ার শুটিংয়ে চলে গেছি। গিয়ে তাকে নানাভাবে সাহায্য করছি। আবার আমার শুটিংয়েও চলে আসে তানিয়া কিংবা মৌ। দেখা যাচ্ছে, কারও কাছে একটি সুন্দর কানের দুল আছে, বলল এটা পরে দেখ ভালো লাগবে হয়তো। এই সহযোগিতা, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ এখন খুব একটা দেখি না। আমাদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা ছিল, কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ কাজের জায়গায়। কেউ কারও খারাপ চাইনি কখনো। সেই বন্ধুত্ব এখনো টিকে আছে।
ফারজানা নিকিতা : একাল-সেকালের মডেলিং জগতের কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে?
তানভীন সুইটি : অবশ্যই। অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে কাজের ধরনে, পরিবেশে, পেশাদারত্বে, সুযোগ-সুবিধায়। আমাদের সময় একেবারেই আলাদা পরিবেশ ছিল। তবে যুগের সঙ্গে এখন যে পরিবর্তন হয়েছে। সেটিকে তো মেনে নিতেই হবে। নয়তো আমরা পেছনেই পড়ে থাকব। আমাদের সময় বিজ্ঞাপনগুলো হতো মডেলদের প্রাধান্য দিয়ে। ফলে একজন মডেল অতি দ্রুত সবার মধ্যে আলাদা জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ পেতেন। আর এখন বিজ্ঞাপন হয় পণ্য অথবা কাহিনিকে প্রাধ্যান্য দিয়ে। তবে এখন একটা বিষয় ভালো হয়েছে, একেবারে পরিকল্পনা করে গুছিয়ে কাজটি করা হয়। পারিশ্রমিকও বেড়েছে আগের চেয়ে। এই তো আগামী মাসের শুরুতেই আমি একটি বড় ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপন করব। কিন্তু আমার পোশাক কী হবে, কী মেকআপ হবে, কীভাবে শুটিং স্পটে যাব, কী খাব এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবতে হচ্ছে না। আমি শুধু আমার কাজটায় মনোযোগ দিয়ে করব। আর নেতিবাচক কিছু যদি এসে থাকে, সেটি হলো আন্তরিকার অভাব। আমরা আগে একটি পরিবার হয়ে কাজ করতাম। এখনকার মডেলদের মধ্যে ওই ঋদ্ধতার অভাব রয়েছে।
তাপস রায়হান : ক্যারিয়ারে অনেক কিছু পেয়েছেন। কোনো অপ্রাপ্তি বা আক্ষেপ আছে?
তানভীন সুইটি : আলহামদুলিল্লাহ। কোনো আক্ষেপের জায়গা তো খুঁজে পাচ্ছি না। আমি পরিবার নিয়ে ভালো আছি। পরিবারে যদি আপনি সুখী হন তবে বাকি জায়গাগুলো কিন্তু সুন্দর হয়। সব সময় চেষ্টা করি, আমি যেমন আছি তার থেকে ওপরে না তাকিয়ে নিচের দিকে তাকাতে। তখন মনে হয়, আল্লাহতায়ালা আমাকে অনেক ভালো রেখেছেন। কাজের ক্ষেত্রে বলতে গেলে, সেদিকেও আমি নিজেকে নিয়ে তৃপ্ত। এখনো অভিনয় করে যাচ্ছি। তবে আমি যদি এখন এই ভেবে ভেবে মন খারাপ করি যে, অমুক এত ভালো করছে আমি কেন পারছি না, তমুক ওই ক্যারেক্টার করছে আমি পারছি না, এসব কিন্তু দিনশেষে কোনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। আমি কী পারছি না সেটা আমার সমস্যা, তার জন্য আমি অন্য একজন শিল্পীকে হিংসা করতে পারি না। আমি হয়তো কিছু এথিকস বজায় রেখে কাজ করি, একটি গ-ি থেকে বেরিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, তাই আমি পারি না। যারা করতে পারছে তাদের সাধুবাদ জানাই।
তাপস রায়হান : আপনি রাজনীতির ময়দানেও সরব। গুঞ্জন রয়েছে, সংসদ নির্বাচন করবেন। কথাটি কতটুকু সত্যি?
তানভীন সুইটি : মানুষ আসলে কত কথাই তো বলে! কিন্তু তার সবটা তো জেনে-বুঝে বলে না। আমি এখন রাজনীতি করছি তার মানে এই নয় যে, সংসদ সদস্য হওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। আমি আজ দর্শককে পরিষ্কার করতে চাই, সংসদ সদস্য হওয়ার দরকার আমার নেই। আমি এমপি হতে চাই না। আমি সচেতন নাগরিক হিসেবে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। আমার একটি রাজনৈতিক আদর্শ রয়েছে। ফলে এমপি না হয়েও তো অনেক কাজ করা যায়। আরেকটা কথা, আমি এতদিন শোবিজে কাজ করছি, কেউ বলতে পারবে না কাজের জন্য কখনো মরিয়া হয়ে উঠেছি। ভালো ভালো কাজ না করতে পারার আক্ষেপও আমার নেই।
প্রতিটি মানুষের অধিকার আছে রাজনীতি করার। আমি অভিনেত্রী বলে কেন রাজনীতি করতে পারব না? এখন কথা হচ্ছে, আপনাকে নেতা হিসেবে মানুষ কতটুকু গ্রহণ করছে? সেদিক থেকে যেহেতু আমরা শোবিজ তারকা হিসেবে অনেক মানুষের পরিচিত, তাই রাজনীতির মঞ্চে গেলেও আমরা মানুষের ভালোবাসাটা পাই, এটুকুই বেনিফিট। তবে রাজনীতিতেও কিন্তু সবাইকে সমানভাবে সংগ্রাম করে জায়গা তৈরি করতে হয়।
লিখেছেন : মাসিদ রণ
ছবি : শেখ সাদী
লোকেশন : গ্রিন লাউঞ্জ