রামেন্দু মজুমদার। বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের জন্য অনেক আগেই পেয়েছেন একুশে পদক। কিন্তু তিনি থেমে নেই। ৮২ বছর বয়সেও চালিয়ে যাচ্ছেন অভিনয়, নির্দেশনা, লেখালেখি, সম্পাদনা, সাংগঠনিক কাজ। পাশাপাশি ব্যস্ততা রয়েছে নিজের বিজ্ঞাপনী সংস্থা-এক্সপ্রেশনস নিয়ে। এসেছিলেন দেশ রূপান্তরের শুক্রবারের আড্ডার অতিথি হয়ে। তার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন সহকারী সম্পাদক তাপস রায়হান, মহাব্যবস্থাপক সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মো. হারুনের রশীদ, জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক সালাহ উদ্দিন শুভ্র ও বিনোদন সম্পাদক মাসিদ রণ
শোবিজ অঙ্গনে প্রায়ই একটা বিষয় লক্ষ করা যায়। শিল্পীরা সময়ানুবর্তী হতে পারেন না। এ নিয়ে প্রায়শই সমস্যা তৈরি হয়। তবে যারা থিয়েটার চর্চা করে শোবিজে কাজ করতে আসেন, তাদের মধ্যে সময় মেনে চলার বিষয়টি অভ্যাসে পরিণত হয়। রামেন্দু মজুমদার এই বয়সে এসেও সময় নিয়ে দারুণ নিষ্ঠাবান। তিনি যে সময়ে দেশ রূপান্তর কার্যালয়ে আসার কথা বলেছিলেন, ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক সে সময়েই উপস্থিত হন। প্রতিবারের মতো এবারও ছাদবাগানে ছবি তোলার পর্ব সেরে শুরু হয় আড্ডা। ১৯৭১-এর সেই উত্তাল দিনগুলো দিয়েই শুরু করেন তাপস রায়হান। তিনি রামেন্দু মজুমদারের কাছে জানতে চান, ১৯৭১ সালে আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন। সেই দিনগুলোর স্মৃতি যদি আরও একবার রোমন্থন করেন...
রামেন্দু মজুমদার : আমি আর ফেরদৌসী (কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও অতিথির জীবনসঙ্গী ফেরদৌসী মজুমদার) একাত্তরের মে মাসে কলকাতায় পৌঁছাই। আগেই মনস্থির করি, সেখানে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগদান করব। বেতার কেন্দ্রে আমার পরিচিত ছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি বললেন যে, আপনাকে নিজ নামে খবর পড়তে হবে। তখন আমি উনাকে বললাম, এটা আমার জন্য একটু মুশকিল। কারণ এখনো দেশে আমার চাচা, শ্বশুরবাড়ির লোকজনসহ আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। তাদের আমি বিপদে ফেলতে পারি না। সংবাদ পড়তে রাজি না হলেও পরবর্তী সময়ে বেতার কেন্দ্রের চার পাঁচটি অনুষ্ঠান করতাম। এক পর্যায়ে মনে হলো, আরও অর্থবহ কিছু একটা করা দরকার। মনস্থির করলাম, বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা ও বিবৃতি নিয়ে একটি সুন্দর সংকলন প্রকাশ করব। তার কর্মযজ্ঞের ব্যাপ্তি তো অসম্ভব বড়। তাই একটি টাইম ফ্রেম বেঁধেই কাজটি করব বলে ঠিক করলাম। ১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় পর্যন্ত সেই সংকলনে স্থান পায়।
তখন বাংলাদেশ হাইকমিশনে সংগৃহীত ছিল অনেক পুরনো পত্রিকা। আমার বন্ধু আনোয়ারুল করিম চৌধুরী অ্যাম্বাসির থার্ড সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিল। তার মাধ্যমে সেই পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে কাজটি করি। আমাকে দারুণ সহায়তা করেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। কারণ তখন তো ফটোকপির যুগ ছিল না। সবটাই আমাদের বারবার হাতে লিখে করতে হতো। এভাবেই পা-ুলিপিটি দাঁড় করাই। এক পর্যায়ে আমার একটি চাকরি হয় দিল্লিতে। সেখান যাওয়ার পর পা-ুলিপিটি আমার এক বন্ধু টাইপ করেন। সৌভাগ্যবশত সেখানে আমার আর এক বন্ধুর বাসায় পরিচয় হয় ওরিয়েন্ট লংম্যানের একজন সম্পাদকের সঙ্গে। তিনি আগ্রহ দেখালেন বইটি ছাপানোর জন্য। শেষ পর্যন্ত বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৭২-এর জানুয়ারিতেই। সচেতনভাবেই সংকলনটি ইংরেজিতে প্রকাশ করি, যাতে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে বিদেশিরা ঠিকঠাক ধারণা পায়। সংকলনটির নাম দিয়েছিলাম ‘বাংলাদেশ মাই বাংলাদেশ : সিলেক্টেড স্পিচেস অ্যান্ড স্টেটমেন্টস বাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র : আপনার জন্ম তো লক্ষ্মীপুরে। তখনকার পরিবেশ, সমাজব্যবস্থা কেমন ছিল?
রামেন্দু মজুমদার : এখন তো লক্ষ্মীপুর একটি জেলা শহর। দেখলে স্বপ্নের মতো মনে হয়। কিন্তু তখন এর চেহারা ছিল একেবারেই আলাদা। আমি যখন ক্লাস এইটে উঠি তখন সেখানে বিদ্যুতের লাইন যায়। বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলতে যা বোঝায় তেমনি ছিল। কিন্তু তার মধ্যেও সাংস্কৃতিক আবহ দারুণ ছিল। আমি না দেখলেও আমার বাবা-চাচারা স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ করেছেন। আর আমাদের বাড়িটি ছিল স্কুল লাগোয়া। সেই স্কুলেই আমি ক্লাস টু থেকে ম্যাট্রিক অবধি পড়েছি। এরপর ইন্টারমিডিয়েট শেষ করি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। ১৯৬১-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হই। জগন্নাথ হলেই থাকতাম।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র : আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তো দেশের রাজনীতির উত্তাল সময়। সেই সময়ের কিছু কথা যদি শেয়ার করেন...
রামেন্দু মজুমদার : হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। পুরো ষাটের দশকটাই তো এ দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের খেলায় মত্ত ছিল। তবে আমি কখনোই রাজনীতি নিয়ে খুব একটা উৎসাহী ছিলাম না। বরাবরই সাংস্কৃতিক কর্মকা- নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কারণ আমি অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলাম, একটি দেশ কিংবা সমাজের জন্য সাংস্কৃতিক মুক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক, আমাদের সময়ে বিভিন্ন হলে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ হতো, নাট্য সপ্তাহ হতো। ডাকসুতেও কিছু কার্যক্রম চলত। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই টিএসসি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেটা ১৯৬৩ সালের কথা। কিন্তু তখন ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্রের এই বিল্ডিং তৈরি হয়নি। কার্জন হলের দুটি কক্ষ থেকেই টিএসসির কার্যক্রম পরিচালিত হতো। সেই কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করবার জন্য প্রতি হল থেকে একজন ছাত্রকে মনোনয়ন করা হয়। জগন্নাথ হল থেকে আমাকে মনোনীত করেন তখনকার টিএসসির পরিচালক এ জেড খান। টিএসসিকে কেন্দ্র করে তিন চারটি গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। ছাত্র শিক্ষক নাট্য গোষ্ঠী, লেখক গোষ্ঠী, সংগীত গোষ্ঠী প্রভৃতি। আমি ছিলাম নাট্য গোষ্ঠীর ছাত্র তত্ত্বাবধায়ক। আর শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। তখন সেখান থেকে আমরা চারটি নাটক করেছিলাম। প্রথম কার্জন হলে করি শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’। এরপর মাইকেলের জন্মবার্ষিকীতে করি তার ‘কৃষ্ণকুমারী’। শেক্সপিয়ারের ৪০০তম জন্মবার্ষিকীতে আমরা করি ‘ভ্রান্তিবিলাস’। এটি শেক্সপিয়ারের ‘কমেডি অব এররস’ থেকে উপন্যাসের আদলে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সবগুলো নাটকের নাট্যরূপ দিয়েছিলাম আমি।
মাসিদ রণ : এখন আমরা মঞ্চে যে নাটক দেখি সেগুলো প্রপার ডিজাইন করা এক একটি প্রোডাকশন। তখনকার নাটকগুলো সেদিক দিয়ে কেমন ছিল?
রামেন্দু মজুমদার : টেকনিক্যালি সে সময়ের নাটকগুলো এতটা আধুনিক হবে সেটা তো আশাও করা যায় না। কারণ তখন তো এত সুযোগ-সুবিধা আসেওনি। তবে নির্দেশনা, অভিনয়, সংলাপ এসব খুব উন্নতমানের ছিল।
মাসিদ রণ : দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ারে আপনি বেশ কয়েকটি প্রজন্মের সঙ্গে জড়িত। অভিনয়ের ধারার কী বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
রামেন্দু মজুমদার : না, এটা ওভাবে বলার সুযোগ নেই। তবে সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশের মঞ্চনাটকের অভিনয়ের ধরন শুরু থেকেই স্বকীয়। যাত্রা বা অন্য লোকজ পালার যে অভিনয়ের ঢং, মঞ্চনাটকে আমরা সেগুলো থেকে একেবারেই আলাদাভাবে নিজেদের উপস্থাপন করি। আমাদের সময় আব্দুল্লাহ আল মামুন, ইকবাল বাহার চৌধুরী, ফেরদৌসী মজুমদারসহ অনেকেই খুব ভালো অভিনেতা ছিলেন।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র : ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
রামেন্দু মজুমদার : আমরা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সহপাঠী। তবে দুজন আলাদা সাবজেক্টে পড়তাম। ফেরদৌসী বাংলায় আর আমি ইংরেজি সাহিত্যে। বাংলায় গ্রাজুয়েশন শেষ করে ও আবার আরবি সাহিত্য নিয়েও পড়াশুনা করেছে। তবে আমাদের পরিচয় নাটক করতে গিয়েই। তার ভাই মুনীর চৌধুরীর প্রথম নাটক ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’-এ আমরা দুজনই অভিনয় করি। আমার শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা একদিন আমাকে বললেন, মুনীর চৌধুরী একটি নতুন নাটক করবে, আমি তোমার নাম বলেছি, তুমি দেখা করো। আমি তো খুব খুশি। ওই নাটকের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েই ফেরদৌসীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। নাটক করতে করতেই একে অপরকে জানা-বোঝা ও পরিণয়। ১৯৭০-এ আমরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র : যুদ্ধের আগের ওই দিনগুলো কীভাবে কাটছিল আপনাদের?
রামেন্দু মজুমদার : বিয়ে করার পর পাকিস্তানের একটি স্বনামধন্য বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি পেয়ে করাচি চলে যাই। সেখানে কাজ করতে করতেই সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে নিজেই একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা খুলব। ১৯৭১-এর পয়লা মার্চ আমাদের ঢাকা ফেরার টিকিট করা ছিল। হঠাৎ আমাদের ফ্লাইট বাতিল হয়। পরে শুনেছিলাম ২৫ মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর জন্য ওই সময় একের পর এক ফ্লাইট ভরে পাক সেনারা ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। যাই হোক, অনেক কষ্টে ৯ মার্চ দুটি টিকিট পেয়ে ঢাকায় চলে আসি। তখন দেশের ওই পরিস্থিতিতে আর নিজেদের বিজ্ঞাপনী সংস্থা চালু করার কথা ভাবতে পারলাম না। যোগ দিলাম পুরনো কর্মস্থল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীতে।
হারুনের রশীদ : পাকিস্তানের যে বিজ্ঞাপনী সংস্থাতে কাজ করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
রামেন্দু মজুমদার : ওই বিজ্ঞাপনী সংস্থাটির নাম ছিল ইউনাইটেড অ্যাডভারটাইজিং। সেখানে কপি রাইটার হিসেবে কাজ করতাম। ওটা পাকিস্তানের বেশ বড় সংস্থা। তাদের ক্লায়েন্ট ছিল হামদর্দ, কোহিনূর কেমিকেলস। তবে বাংলাদেশে এসে সে সময় আমরা একটি ভালো কাজ করতে পেরেছিলাম বিটপী থেকে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সাধারণত বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করত সরকারের পক্ষে। আমরা চাইলাম, সেদিন ওটা যাতে আর না বেরুতে পারে। তাই ঠিক তার আগের দিন অর্থাৎ ২২ মার্চ ১৯৭১ আমরা একটি বিজ্ঞাপনের ক্রোড়পত্র বের করেছিলাম, ‘বাংলার স্বাধিকার’ নামে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটি বাণী আমি লিখলাম। সেটি ছাপানোর অনুমতির জন্য রেজা আলী তার কাছে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেটিতে সই করে দিয়েছিলেন। সেই লেখাটিই ব্লক করে ক্রোড়পত্রের ফ্রন্ট পেজে তিন কলামে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ছেপেছিলাম। পরবর্তী সময়ে আমার সেই হাতের লেখাকে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা বলে মনে করেছিল। এটি আমার বিজ্ঞাপনী জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র : ২৫ মার্চ কোথায় ছিলেন?
রামেন্দু মজুমদার : ঢাকাতে শ্বশুরবাড়ি সেন্ট্রাল রোডেই ছিলাম আমরা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আমার পরিবারের লোকজন জোর করতে লাগল ফেরদৌসীকে নিয়ে কলকাতা চলে যাওয়ার জন্য। মে মাসে আমরা সীমান্তবর্তী বসন্তপুর গ্রাম দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে আগরতলা চলে যাই। যে রাতে সীমান্ত পার হই, সেকি গোলাগুলির শব্দ! আমরা খানিকটা ভয়ও পেয়ে যাই। কিন্তু স্থানীয়রা আশ্বস্ত করেন যে, সেগুলো ছিল মুক্তিবাহিনীর গুলির শব্দ। তারা পাক সেনাদের সে রাতে ধরাশায়ী করে ফেলেছিল। যাই হোক, আগরতলা থেকে কলকাতা যাওয়াটাও ছিল আরেক শক্ত কাজ।
মাসিদ রণ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার সরাসরি সাক্ষাতের একটি ঘটনা রয়েছে। সেটি যদি আবার শোনান...
রামেন্দু মজুমদার : সেই ঘটনাটি আমি কোনোদিন ভুলব না। ১৯৬৪ সালের কথা। আমরা থাকতাম বড় ভাইয়ের সঙ্গে তেজগাঁওয়ে, ঢাকা পলিটেকটিক ইনস্টিটিউটের কোয়ার্টারে। ট্রেন লাইনটা ছিল আমাদের বাসার একেবারে কোল ঘেঁষে। সে সময় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল। হঠাৎ এক রাতে শুনতে পাই মানুষের প্রচ- চিৎকার। খবর পেলাম, ট্রেন থামিয়ে মানুষজনকে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। প্রফেসর অজিৎ গুহ বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি ফোন করে আমাদের কথা বললেন যে, আমার এক আত্মীয় পরিবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আটকে পড়েছে। আপনি যদি একটু উদ্ধার করতে পারেন। হঠাৎ সকাল বেলা একটি জিপ নিয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এসে হাজির। বাসায় এসে বললেন, আপনাদের খুব বেশি সময় দিতে পারছি না। যত দ্রুত সম্ভব কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে সবাই জিপে উঠুন। আমরা তার সঙ্গে ৩২ নম্বরের বাড়িতে পৌঁছাই। গিয়ে দেখি আরও কিছু পরিবারকে তিনি একইভাবে উদ্ধার করে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। বেগম মুজিব তাদের খাওয়া-দাওয়ার তদারকি করছেন। পরদিন সকালে মুনীর চৌধুরী এসে আমাদের সেখান থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা সব সময় অনেক নেতাকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলতে শুনি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিপদের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দাঙ্গাবাজদের সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস শুধু বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই দেখেছি।
সালাহ উদ্দিন শুভ্র : আপনার বাবা-মায়ের কথা শুনতে চাই।
রামেন্দু মজুমদার : বাবা ছিলেন লক্ষ্মীপুরের একজন আইনজীবী। আমার দাদাও আইনজীবী ছিলেন। তাই ভেবেছিলাম, আইনজীবী হব। তারা আজীবন নিজেদের কাজটা নিয়েই প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতেন। বাবা একদিন আমাকে নিষেধ করলেন। বললেন, আইন পেশায় এলে তোমার অন্য যে একটা জীবন আছে সেটি আর থাকবে না। ফলে আমারও মত বদলে যায়। আমার মা গৃহিণী ছিলেন। তবে সংগীতের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। এক সময় তিনি গান-বাজনা করতেন। বাবা, বড় ভাইদেরও দেখেছি শখের বশে নাটক করতে। আমরা তিন ভাই, দুই বোন। বড় ভাই ১৯৫৩ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে ফুটবল খেলতে গিয়ে মারা যান। এখন দুই বোন আর ভাইদের মধ্যে আমি একাই আছি।
মাসিদ রণ : দীর্ঘ অভিনয় ক্যারিয়ার আপনার, এখনো মঞ্চে সরব। কিন্তু ক্যামেরার সামনে সমসাময়িক অনেকের মতো দাপট দেখাতে দেখা যায়নি আপনাকে। এটা কি সচেতনভাবেই?
রামেন্দু মজুমদার : অবশ্যই সচেতনভাবে মঞ্চে বেশি সময় দিয়েছি। দেখুন, আমার রক্তেই নাটক জিনিসটা ছিল। বাপ-দাদারা করেছেন, আমি ক্লাস থ্রিতে থাকতে মঞ্চে উঠেছি। বুঝেশুনে নাটক করতে শুরু করি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ক্যামেরার সামনে সুযোগ পাইনি তা একদম নয়। ১৯৬৪ সালে দেশে টেলিভিশন এলো। ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে প্রথম অনুষ্ঠানটাই আমি পরিচালনা করেছিলাম। শুধু তাই নয়, টেলিভিশনের প্রথম নাটক হিসেবে প্রচারিত হয় মুনীর চৌধুরীর ‘একতলা দোতলা’। সেখানেও আমি অভিনয় করেছিলাম। সহশিল্পী ছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার, ডলি আনোয়ারসহ অনেকেই। কিন্তু কখনোই ক্যামেরার সামনে অভিনয় করাটাকে অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করিনি। সারা জীবন থিয়েটারের জন্যই কাজ করেছি। শিক্ষকতা পেশার সূত্রে ঢাকার বাইরে থাকতে হয়েছে অনেকটা সময়। আর ১৯৭২-এর পরে তো আমি টিভিতে সংবাদ পড়া শুরু করলাম। ওরা তখন সংবাদ পাঠকদের নাটকে অভিনয়ের অনুমতি দিত না। সেসব কারণে নাটকের শুটিং করা আমার পক্ষে সব সময় সম্ভব হতো না। ফলে এ নিয়ে কোনো অতৃপ্তি নেই। আমি যা করেছি তাতে আমি তুষ্ট।
তাপস রায়হান : আপনি বা আপনার সমসাময়িক কয়েকজন মানুষ, মঞ্চকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, অন্য মাধ্যমকে ততটা করেনি। মঞ্চের ম্যাজিকটা কোথায়?
রামেন্দু মজুমদার : ম্যাজিকটা হলো দর্শকের সরাসরি প্রতিক্রিয়া শুধুমাত্র মঞ্চেই পাওয়া যায়। এটাই একটা বড় প্রাপ্তি। প্রতিদিনই আমার পরীক্ষা হচ্ছে মঞ্চে। এই এক্সাইটমেন্টটাই আমাকে মঞ্চের সঙ্গে আজও জুড়ে রেখেছে। অন্য মাধ্যমে অভিনয় করলে হয়তো টাকা পাওয়া যায়, কিন্তু মঞ্চে উল্টো টাকা খরচ করতে হয়। তারপরও এই মোহের জন্যই কাজ করি।
মাসিদ রণ : চলচ্চিত্রে আপনাকে সেভাবে পাওয়া যায়নি?
রামেন্দু মজুমদার : হ্যাঁ, চলচ্চিত্র আমাকে সেভাবে টানেনি কখনো। একমাত্র তানভীর মোকাম্মেলকে আমি বলেছিলাম, তোমার ছবিতে এক ধরনের সংস্কার রয়েছে। যদি সেখানে আমার দুই মিনিটের চরিত্রও থাকে, সেটি করতে চাই। তার কয়েকটি ছবিতে করেছিও।
মাসিদ রণ : আপনি নাটকের সংগঠক হিসেবে দেশের অন্যতম পথিকৃৎ। একাধিকবার বিশ্ব থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
রামেন্দু মজুমদার : আমার নাটক জীবনের দুটি বড় অর্জন আছে। একটা হলো থিয়েটার পত্রিকা সম্পাদনা। সেটি ৫২ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আমরা এরইমধ্যে আড়াইশ’র মতো নাটক এই পত্রিকায় ছেপে নাট্যকর্মীদের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি। আরেকটি অর্জন হলো- ইউনেস্কোর উদ্যোগে আইটিআই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। বাংলাদেশ থেকে আমাদের দলই প্রথম ১৯৮১-তে আইটিআই-এর একটি উৎসবে যোগ দিই। পরবর্তীকালে আমরা বাংলাদেশে আইটিআই বাংলাদেশ চ্যাপ্টার প্রতিষ্ঠা করি। সেখান থেকে এ পর্যন্ত ১২-১৩টি আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবসহ নানা আয়োজনে অংশ নিয়েছি। আমরা বেশ কিছু প্রকাশনা বের করেছি যা একেবারে আন্তর্জাতিক মানের। এসব মিলিয়ে অনেক বিদেশির মধ্যে বাংলাদেশের নাটক নিয়ে একটা ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিগত ২৪ বছর ধরে আইটিআই-এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছি, ৩ বার সহসভাপতি ছিলাম এবং দুবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। তবে এটা ব্যক্তিগত অর্জন নয়। এটা সমগ্র বাংলাদেশের নাটকের অর্জন।
মাসিদ রণ : থিয়েটারের বর্তমান অবস্থান নিয়ে আপনি কি সন্তুষ্ট?
রামেন্দু মজুমদার : আমরা যখন শুরু করি অল্প দল ছিল। অল্প নাটক হতো বলে আমরা শো করার সুযোগ পেতাম বেশি। কিন্তু এখন থিয়েটার হলের সংখা না বাড়লেও দল বেড়েছে অনেক। অনেক নাটক হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ নাটক মানহীন। ফলে দর্শকের মধ্যে আমাদের নাটক নিয়ে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। আরেকটি কথা বলতে হয়, আমরা একটা মূল্যবোধ, সমমনা চিন্তা-চেতনা ও সংস্কার নিয়ে কাজ করতাম। আমার সমসাময়িক যদি নাম ধরে বলি আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর আমরা সবাই একে অন্যের মতকে শ্রদ্ধা করতাম। কিন্তু এখন যারা তরুণ তাদের মধ্যে মতের অনেক অমিল। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। তবে আমি আশাবাদী। এখনো ছেলেমেয়েরা এই ব্যস্ত জীবন থেকে সময় বের করে নাটকের প্রেমে সময় ও শ্রম দিচ্ছে। বিনিময়ে কিছুই পাচ্ছে না, এটাই হলো থিয়েটারের শক্তি।
মাসিদ রণ : থিয়েটার স্কুল প্রতিষ্ঠার পেছনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
রামেন্দু মজুমদার : তখন তো ছেলেমেয়েদের শেখার সরাসরি কোনো জায়গা তৈরি হয়নি। দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অল্প কিছু ছেলেমেয়ে নাটক নিয়ে পড়ার সুযোগ পেত। তার বাইরে আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এ কারণেই আমরা ১৮ থেকে ৩৫ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য অভিনয়ের বেসিক শেখার সার্টিফিকেট কোর্স চালু করি। সেখান থেকে অনেকেই শিখতে পেরেছে কিছু না কিছু। এখনো আমরা থিয়েটার স্কুল নিয়ে সমানভাবে সক্রিয়। স্বপ্ন দেখি, থিয়েটার স্কুলের যদি ঢাকায় নিজস্ব একটি ঠিকানা তৈরি হতো।
মাসিদ রণ : বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘এক্সপ্রেশনস’ নিয়ে জানতে চাই।
রামেন্দু মজুমদার : বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন সেক্টরের উত্থান যে সময়ে হয়েছে সেই পুরোটা সময় আমি ছিলাম বিটপীতে। এই উত্থানের কিছুটা অংশীদার হয়তো আমিও। মনে পড়ছে, আমরা কত ধরনের প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করেছি। সরাসরি কোনো বার্তা দিতে পারতাম না, রূপক অর্থে করতে হতো। কিন্তু জায়গাটি পরিণত হয়েছে। আর আমার নিজের প্রতিষ্ঠান এক্সপ্রেশন অনেক পরে তৈরি করেছি, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে। অনেক বড় সংস্থা তা বলব না, মধ্যম মাপের একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান। তবে শুরু থেকেই আমরা যে বিষয়টি খেয়াল রেখেছি, সেটি হলো এমন কিছু করব না যেটিতে সমাজের প্রতি কোনো নেতিবাচক বার্তা পৌঁছায়। এ ক্ষেত্রে আমরা অর্থের লোভ সংবরণ করেছি। এই মূল্যবোধ নিয়েই কাজ করে যাবে ‘এক্সপ্রেশনস’ সেই স্বপ্ন দেখি।
লিখেছেন : মাসিদ রণ
ছবি : আবুল কালাম আজাদ
ভিডিও : লিটু হাসান
লোকেশন : গ্রিন লাউঞ্জ